Wednesday, December 4, 2013

নিরামিষ আমিষ

শিরোনামে বিভ্রান্তি আসতেই পারে - কিন্তু কথাটা সত্যিই। এরকম জিনিষ বাঙালি জীবনে আছে বৈকি। যেমন, এঁচোড়ের তরকারী - গরমমশলা দিয়ে ঠিকঠাক বানাতে পারলে মাংসের ঝোলকেও হার মানিয়ে দেবে। তারপর যেমন ধরা যাক সোয়াবিনের তরকারী। ভালো করে, মশলা দিয়ে রাঁধলে মাংসের মতোই খেতে লাগে - নো কোলেস্টেরল, কিন্তু প্রচুর পরিমানে প্রোটিনে ভরপুর। আমার এক জ্যাঠতুতো দাদা যৌবন বয়সে বিবেকানন্দ হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে মাছ-মাংস সব ছেড়ে ছুড়ে কঠিন ব্যারামে পড়ে গিয়েছিলো। উপায়ন্তর না দেখে তার মা, অর্থাৎ আমার বড়ো জ্যেঠিমা এই সোয়াবিনের তরকারী মশলা দিয়ে রান্না করা শুরু করে দেন। সে প্রোটিন-পথ্যের এমনই জোর ছিলো যে দাদাটি বিবেকানন্দ হতে গিয়েও, পথ ভুল করে হয়ে গেলো ঘোরতর সংসারী। 'বই'য়ের বদলে 'বউ'-ই হয়ে উঠলো তার একমাত্র মোক্ষ !  শুধু তার মা আর সয়াবিন রয়ে গেলো হেঁশেলেই - যেমন ছিলো আগের মতো!!  শাস্তির ক্ষেত্রেও এই একই কনসেপ্ট প্রযোজ্য। যেমন, জেলের সেলেতে বন্দী থাকা কয়েদীদের মোটা কম্বলে জড়িয়ে, লোহার রড দিয়ে রাম-ঠ্যাঙ্গানো। হাড় ভেঙ্গে চুরচুর হয়ে যাবে, কিন্তু বাইরে থেকে কিচ্ছুটি বোঝার উপায় থাকবে না - এমনকি একটু আঁচড় পর্যন্ত দেখা দেবে না। যাই হোক, এমনই একটি গৃহে-প্রযোজ্য, নিরামিষ-আমিষ ট্রিটমেন্ট আমার সম্প্রতি খুব দরকার হয়ে পড়েছিলো। “ঘরওয়ালিকে থোড়া-সা কড়কে দেনা চাহিয়ে...” - এই সব ভুল-ভাল হিন্দী বলে বলে আমার মনটাকে টম-অ্যান্ড-জেরির টমের মতো শক্ত করে তুললাম। কিন্তু যা করার করতে হবে খুব ভেবে-চিন্তে, রয়ে-সয়ে। স্বামী হলেও বোকা পাঁঠা তো নই। কি থেকে কি হয়, সব আমার জানা আছে। এই বয়সে ভালো চাকরি খুঁজলেও হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু........  তার উপরে আমার পুত্ররত্নকে সামলানো মুখের কথা নয় ! হাড়ে যাকে বলে দূর্ব্যো গজিয়ে ছাড়বে। কি করি, কি করি, ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেলো ছোটবেলায় যেভাবে কড়কানি খেয়েছিলাম, সেই একই পদ্ধতি প্রয়োগ করলে মন্দ হয় না। অর্থাৎ “সাঁড়াশী আক্রমন, ফলে জয় সুনিশ্চিত” পন্থা গ্রহণ করাই হবে যুক্তিযুক্ত। 

প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় আমার সামনে দুটো পথে খোলা ছিলো - হয় নিজে 'Bully' হও, নয়তো অন্য কোনো Bully-র পদতলে নিজেকে সঁপে দাও। পরেরটা অনেক সোজা, সুতরাং আমি সেদিকেই ঝুঁকে ছিলাম। ক্লাসের জম্পেশ ছেলেদেরকে হাতে রাখার জন্যে আমি বাড়ির দেবসাহিত্য কুটিরের মোটা মোটা পূজাবার্ষিকীগুলো থেকে রঙিন, সুন্দর সব ছবির পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে গোপনে তাদেরকে 'ভেট' হিসাবে সরবরাহ করে চলতাম। ফলে আমার অঙ্গুলি-হেলনে তারা যে-কোন কাউকেই, আমার হয়ে, 'আচ্ছা-সে কড়কে' দিতো। আলটিমেটলি আমিই হয়ে উঠলাম “আসলি শাহেনশাহ” - নিজের ক্লাসের তো বটেই, এমনকি উপরের ক্লাসের ছেলেরাও কেউ আমাকে পারতপক্ষে ঘাঁটাতে চাইতো না। কিন্তু ঐ যে বলে না, 'ধর্মের কল বাতাসে নড়ে' - তাইই হলো আমার ক্ষেত্রে। একদিন সন্ধ্যায় যখন হ্যারিকেন জ্বেলে, দাওয়াতে বসে পড়াশুনা শুরু করে দিয়েছি - বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ করেই আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হলো আমার ক্লাসের দুই মূর্তিমান বুলী, 'কম্বল' আর তার দাদা 'রবিন', ওরফে ভোম্বল। কম্বল-এরও একটা পোশাকি নাম ছিলো, কিন্তু সেটা এখন বেমালুম ভুলে গেছি। মোদ্দা কথা দুই পিঠোপিঠি ভাই-ই  ছিলো মারাত্মক টাইপের বিচ্ছু। পড়তো আমার সাথে একই ক্লাসে, আর কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলতো না। এদিকে আমার পিসিমা তো চোর এসেছে ভেবে এক হাতে হ্যারিকেন, আর অন্য হাতে বাড়ির উঠান-ঝাঁট দেওয়া মুড়ো ঝ্যাঁটাটা নিয়ে পুকুরঘাটের দিকের দরজা খুললেন। খুলতেই তারা দু'জনে প্রায় একসাথে চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “কোথায় সে  'আমি'? এক্ষুনিই একটা ফয়সালা হওয়া  খুব দরকার...” - কি ব্যাপার? না, 'ঠাকুরের ছবিটা' আমি কাকে দিয়েছি সেটা আমায় তক্ষুণি পরিষ্কার করে বলে দিতে হবে। বোঝা গেলো এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিস্তর জল-ঘোলা হয়েছে - কিন্তু উজবুক দুটো ফয়সালার জন্যে কাল সকাল অবধি অপেক্ষা না করতে পেরে এখনই আমাদের বাড়িতে চলে এসেছে! গাড়োল কোথাকার!! মনে মনে তাদের বাপ-বাপান্ত করার সাথে সাথে আমি ধরা পড়ার ভয়ে প্রমাদ গুনে চললাম। পিসিমা কিছুক্ষণ মাত্র সময় নিলেন তাদের বক্তব্যটা হজম করতে, তারপর চিলের মতো ছোঁ-মেরে কেড়ে নিলেন ছবিটা তাদের হাত থেকে। তাঁর মুখের সে ভয়াল ভাব-ভঙ্গী আর হাতের ঝাঁটার সাইজ দেখে মুহুর্তের মধ্যে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারলো - ফয়সালার অপেক্ষা না-করেই নিমেষের মধ্যে দু'জনে বেমালুম হাওয়া হয়ে গেলো। তারপর শুরু হলো “আসল ফয়সালা”, আমার ওপর - বেসিক্যালি আমার মুখে, মাথায় আর পিঠের ওপর। বেদম মারের চোটে চোখে সর্ষেফুল দেখার উপক্রম হোলো। ছোটদা হুমকি দিলো যে আজ শুধু 'বুলিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো', ফের যদি এরকম ঘটনা ঘটে, তো সে বোঝাবে “মার” কাকে বলে। ওই রাতেই আমাকে বসে বসে ডজন-খানেক ছবি, যা তখনো আমার কাছে লুকানো ছিলো, সেগুলোর সব কটা'কে, ঠিক বইয়ের ঠিক জায়গায় আঠা দিয়ে জুড়তে হলো - পড়াশুনা সব উঠলো মাথায়!


বেশ কিছুদিন আর এসব কূ-কর্মের ধারে-কাছে গেলাম না। কিন্তু আবার সেই একই কথা: “স্বভাব যায় না মলে, আর কয়লার রং যায় না ধুলে” - 'ক্ষমতা' অর্থাৎ 'Power' যে কি লোভনীয় বস্তু, তার স্বাদ একবার যারা পেয়েছে, তারাই শুধু জানে!! সাধে কি আমাদের শ্রীনিবাসন মহাশয় নিজের জামাইকে জেলে পাঠিয়ে নিজে দিব্যি BCCI-র প্রেসিডেন্ট হয়ে যান! সুতরাং আবার শুরু হলো আমার 'অপারেশান-পূজাবার্ষিকী' - এবার আরো সতর্ক ভাবে। এইভাবে এক রবিবারের নির্জন দুপুরে, দোতলার ছোটঘরে, দরজা ভালো করে বন্ধ করে, আলমারির সামনে বাবু হয়ে বসে ঝুঁকে ঝুঁকে আমি পূজাবার্ষিকী থেকে একের পর এক  ছবি ছিঁড়ে চলেছি। হঠাৎ চোখ আটকে গেলো আলমারির গ্লাসের দরজায়। রিফ্লেকশানে দেখলাম দরজাটা কেমন যেন ফাঁক হয়ে গেছে - অথচ আমার পরিষ্কার মনে আছে যে আমি দুটো 
দরজাই  ভালো করে ভেজিয়ে, তবে বসেছিলাম। হাওয়া নেই, বাতাস নেই যে ঝট করে আপনা-আপনি সেটা খুলে যাবে, সুতরাং ঘরের মধ্যে নিশ্চয় কেউ ঢুকে পড়েছে, আর যাস্ট আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। পিঠে মনে হলো যেন দশ-মনি আলুর বস্তা কেউ বসিয়ে দিয়েছে, শিরদাঁড়া দিয়ে যেন বরফের চাঁই গলে গলে নামতে শুরু করলো। ভয়ে আর কান্নায় আমার গলা গেলো বুজে - “আর করবো না, এবারের মতো ছেড়ে দাও” ফিসফিস করে বলতে বলতে কোনমতে ঘাড়টা ঘোরালাম।  কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, ও মা ! কোথায় কে !! আমাদের বাড়ির সেই মুটকো  হুলো বিড়ালটা কখন চুপিচুপি এসে, ঠিক আমার পিছনেই বসে একদৃষ্টে আমার দিকে গম্ভীরভাবে চেয়ে আছে। তার ঘাড়টা সামান্য বেঁকানো, আর মুখের ভাবখানা যেন: “আর কতোদিন চলবে এইসব ছেলে-মানুষীপনা?” - ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এলো আবার। সেই মূহুর্তেই প্রতিজ্ঞা করলাম অনেক হয়েছে, আর নয়। যে শিক্ষা আমি বেদম প্রহারের মধ্যে দিয়েও শেখার আগ্রহ খুঁজে পাই নি, আজ এই বিড়ালটা যেন ভয় দেখিয়ে, সেটা ঘাড় ধরে শিখিয়ে দিয়ে গেলো। এরপর জীবনে আর আমি সেই কূ-কীর্তি করার কথা ভাবিনি। 

আজও সেই বিড়ালের কথা মনে পড়ে গেলো, আর আমি তাকে নকল করেই বাথরুমের দরজার সামনে রইলাম দাঁড়িয়ে - নি:শব্দে, নিথর হয়ে। বন্ধ দরজার ওপার থেকে শোনা যাচ্ছে নানান রকমের বাংলা-হিন্দী সুরের টুকরো টুকরো কিছু গান - হয়েই চলেছে, থামছে আর না!!  দাঁড়াতে দাঁড়াতে পা-দুটো গেলো ধরে। কিন্তু ঠাকুর বলে গেছেন, 'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু...' - সুতরাং ওয়েট করেই চললাম। ঘোড়াদের যে কি কষ্ট, তা এবার 
যেন আমি হাড়ে হাড়ে রিয়ালাইজ করলাম। অত:পর এলো সেই চরম মুহূর্ত, যাকে বলে 'দ্যা ক্লাইম্যাক্স' !! গিন্নী স্নান-টান করে, সুগন্ধে ভেসে, মুখ ভর্তি প্রশান্তি নিয়ে এলো বেরিয়ে। দরজা খুলেই আমার ভোঁতা মুখ দেখে তিনি অ্যা-তো ভয় পেলেন যে মুখ দিয়ে গোঙানির মতো একটা বিকট “অ্যা-য়াঁ-ক” শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা গেলো না। হাতে থাকা ভিজে জামা-কাপড় সব অসাড়ে পড়ে গেলো নীচে - আর তিনি হাঁটু ভেঙে ধপ করে, মেঝেতে থেবড়ে বসে পড়লেন। আচ্ছা জব্বর শিক্ষা হয়েছে! ভিরমি খেয়েছে কিনা সেটা ভালো করে দেখে শিওর হয়ে, আমি “সাঁড়াশী আক্রমন, এবং জয় সুনিশ্চিত” বলতে বলতে নিচের দিকে লাফ লাগালাম। এখন বেশ কিছুক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকা বড়োই আবশ্যক !!

2 comments:

  1. অসাধারন দাদা,
    জমে ক্ষীর, ফাটাফাটি চৌচির।
    আপনার লেখার হাত দারুন। আপনি কি এখনো মেরিকায়ই থাকেন ?
    আর আপনার বাড়ি মানে ভারতে আসেন না ? আপনার লেখা যতটুকুই পড়েছি, তা থেকে বুঝলাম আপনি পশ্চিমবঙ্গের কিন্তু কোন জেলার তা বুঝলুম না।
    একটু বলবেন কি ?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ব্লগ-এ আসার জন্যে অনেক ধন্যবাদ - হ্যা, এখনো কর্মসূত্রে বাইরেই আছি - তবে দেশে যাই, on average দু'বছরে একবার। বাড়ি আমার পশ্চিবঙ্গের দ: কলকাতায় - দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত সোনারপুর নামে এক শহরে - বড়ো হওয়া, পড়াশুনা সবই সেখানে। কিন্তু এখন গেলে আর চিনতে পারি না - সব বদলে গেছে অতি দ্রুত, বেশিরভাগ-ই খারাপের দিকে !!

      Delete