Wednesday, December 18, 2013

চল ঝ্যাঁটা চালাই, ভুলে মানের বালাই...

ডেস্কে বসে কাজ করতে করতে হঠাৎই কাঁচের জানলায় চোখ আটকে গেলো। ব্লোয়ার দিয়ে রাস্তায় জমে থাকা শুকনো পাতার ঝাঁক পরিষ্কার করে চলেছে একজন রোড ওয়ার্কার। আমাদের দেশে লোকে ঝ্যাঁটা দিয়ে করে, তাও যদি দরকার পড়ে তো তবেই - সাধারনত: ভোটের আগে বা কোন মিনিস্টার, ফিল্মস্টার আসার আগে। কিন্তু এখানে এটা একটা নিয়মিত কাজ। পাশ দিয়ে হু-হু করে ছুটে চলেছে গাড়ির দল - মুহুর্তের অসাবধানতায় মৃত্যু না হলেও, গুরুতর যখম হবার ভালো চান্স আছে। ঈশ্বরের কৃপায় at least এ জন্মে আমাকে এতো কষ্টকর কাজ করতে হয় নি, এখনো পর্যন্ত। তাই মনে মনে তাকে আমি বাহবা না-জানিয়ে পারলাম না। আমার থেকে অনেক কষ্টকর কাজ করে চলেছে সে - প্রায় একই জায়গায় থেকে। তবে এই দেশে “শ্রমের মূল্য” আছে - কোন কাজই এখানে ছোটো-কাজ নয়।

অনেকের মতোই ছোট বেলায় আমার জীবনের মূল স্বপ্ন ছিলো যে বড়সড় কোনো একটা গাড়ীর ড্রাইভার হওয়া - যেমন ট্রাক বা লরি, বা নিদেন পক্ষে ট্রেন বা বাস-গাড়ি। ১৯৮৩-র প্রুডেনশিয়াল কাপ জয় আমাদের সব লক্ষ্যকে বদলে দিলো - তখন থেকে সবার লক্ষ্য হয়ে গেলো বড়ো হয়ে “কপিলদেব” হবার। ফুটবল খেলা কমে যেতে লাগলো, তার জায়গা নিয়ে নিলো ক্যাম্বিস বলের ক্রিকেট। কোন কোন জায়গায় মাঠের অভাবে, পাড়াতে পাড়াতে গলি-ক্রিকেটও শুরু হয়ে গেলো। এই সুযোগ দু'হাতে লুফে নিলেন আমার মা। তখন আমি দুধ খেতে একদম ভালোবাসতাম না - কিন্তু কপিলদেব প্রতিদিন লিটার খানেক করে দুধ খান, সুতরাং আমাকেও at least দিনে-রাতে মিলিয়ে দু' গ্লাস করে গরুর দুধ গিলতে হতে লাগলো। ফল যা হবার তাই হলো - টনসিল, ঘুংরু কাশির সাথে পাল্লা দিয়ে শুরু হলো ক্রনিক-আমাশা - কপিলদেব হতে গিয়ে শেষমেষ হতে হলো পেট-ছাড়া রোগী। খাঁটি দুধ কি সবার পেটে সহ্য হয় !! পিতৃদেব গোমড়া মুখে বললেন “এ ছেলে তো দেখছি আমাকে দেউলিয়া করে পথে বসাবে বলে জন্ম নিয়েছে !!” - মুখ করুন করে চুপচাপ ওষুধ খেয়েই চললাম - নানান বদ্যি-পথ্যি-র হাত ঘুরে ঘুরে আবার আমার লক্ষ্য দিশা বদল করে ফিরে গেলো সেই “ড্রাইভারীতে”, অর্থাৎ ব্যাক টু স্কোয়ার-ওয়ান। কলকাতায় কেনাকাটা করতে গিয়ে, এক খেলনার দোকানে পছন্দ মতো এক দোতলা বাসও দেখে আসা হলো। কিনে দেবার প্রস্তাব করতেই পিতৃদেব মন্ত্রীদের মতো হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে আশ্বাস দিলেন, “হবে, হবে - সব হবে - ওয়েট করতে শেখো !” - বছরের পর বছর গেলো ঘুরে, কিন্তু সেই “হবে”-র দিন আর এলো না। অপেক্ষা করতে করতে জীবনের প্রায় অর্ধেকটুকুই পার করে দিলাম। অতি কাছের মানুষ থাকতে থাকতে, কবে তিনি একদিন আমার মানিব্যাগের ফটোতেও ঢুকে গেলেন - তবুও সেই 'দোতলা বাস' আমি আজও পেলাম না। এখন হয়তো তিনি ওপর থেকে আমার গাড়ি চালানো দেখে মুখ টিপে টিপে হাসছেন আর বলছেন: “কি? বলেছিলাম না - গাড়ী আমি তোমাকে পাইয়ে দেবোই !!”

সিওল ওলিম্পিক গেমসের বেশ কিছুটা আগেই এসে গেলো আমাদের বাড়িতে তখনকার দিনের বিখ্যাত Sonodyne কোম্পানির “কালার টিভি” - আমাদের পাড়ার সর্বপ্রথম কালার টিভি। গোটা এলাকায় তখন আমার জানা মতো একমাত্র “খাদি কুটির”-এর পার্থ-প্রতিম-দের বাড়িতেই কালার টিভি ছিলো। সেজন্যে তাদের বাড়ির ঘ্যামই ছিলো আলাদা। এবার আমাদের বাড়ীও সেই এলিট গ্রুপে পদার্পণ করলো। শাঁক বাজিয়ে, সারা পাড়াকে জানান দিয়ে টাক্সি থেকে নামানো হলো কাকে? না - কোনো বউ নয়, এক কালার টিভিকে !! পাড়া-পড়শীরা সব জানালা খুলে জানতে চাইলো, “শুধুই টিভি? না কি বউও এলো সঙ্গে?” - যে যার চিন্তা করে !!! তো, কালার টিভির দৌলতে আমাদের বাড়িতে অতিথি সমাগম বেড়েই চললো - বিশেষ করে উইকএন্ডের সন্ধ্যাগুলোয় আর ইন্ডিয়ার ওয়ানডে ক্রিকেট ম্যাচের দিনগুলোতে। মা প্রথম প্রথম চা পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন - কিন্তু খদ্দেরের সংখ্যা GP হারে বাড়তে থাকায়, শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে জানালেন, “রঙিন টিভিতে ছবি দেখাটাই হলো গিয়ে স্ন্যাকস - বাড়তি কোনো চা-ফা আর হবে না !” - তাতেও কারুর কিছু এসে গেলো না - দর্শক সংখ্যা আরো বাড়লো বই কমলো না। কালার টিভির মোহ অনেকটা নতুন বৌয়ের মতোই - তার সবই ভালো, এমন কি ফিঁচ করে ছাড়া হাঁচি-কাশিও যেন কত্তো রোমান্টিক !! কপিলদেব তখন অলরাউন্ডার++ - দুমদাম ব্যাট করে ভালোই রান করে চলেছেন। তবে সত্যি কথা বলতে কি তাঁর ব্যাটিংয়ের সাথে তখনকার দিনের মারকাটারি ওপেনার “কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্ত”-এর তেমন কোনো তফাৎ খুঁজে পাইনি - দুজনেই ছিলো কম-বেশি তাড়ু আর আনপ্রেডিকটেবল। বুকে হাত চাপা দিয়ে খেলা দেখতে হতো ! তবে
কপিলদেবের মারে, বল হয় ব্যাটে লেগে মাঠের বাইরে যেতো, নয়তো সোজা উইকেটে - মাঝামাঝি কোথাও গিয়ে তাঁকে কখনো ক্যাচ, এল-বি, বা রান-আউট হতে খুব একটা দেখিনি। এমনই একটা দিনে ঘর-বোঝাই হয়ে আমরা সাগ্রহে ইন্ডিয়ার এক ওয়ানডে ক্রিকেট ম্যাচ দেখে চলেছি - শারজা না কোথায় যেন হচ্ছে - উত্তেজনায় সবাই টান-টান। ইন্ডিয়া রান চেস করছে - করতে হবে সব মিলিয়ে দুশোর সামান্য বেশি, যা এখনকার দিনে ধোনি-কোহলীরা হয়তো হাসতে-হাসতে একাই করে দেবে! কিন্তু সেটা করতেই ইন্ডিয়ার ছেড়ে-দে-মা-কেঁদে-বাঁচি অবস্থা। অত:পর সেভেন ডাউনে এক মুখ দেঁতো হাসি নিয়ে নামলেন কপিলদেব - গদার মতো বনবন করে ব্যাট ঘোরাতে ঘোরাতে। আমরা সবাই নড়েচড়ে বসলাম - এবার কিছু না কিছু একটা হবেই ! পাশ থেকে কে একজন টিপ্পনী কেটে উঠলেন: “চল ঝ্যাঁটা চালাই, ভুলে মানের বালাই...” - আমি মুখ ঘুরিয়েও বক্তা যে কে, তা বুঝতে পারলাম না। সবার মুখই এখন চাইনীজদের মুখের মতো একই রকমের দেখাচ্ছে - থমথমে, চাপা টেনশন আর উত্তেজনায় ভরপুর। চোখের দৃষ্টি সোজা সামনের টিভির স্ক্রিনে নিবদ্ধ - কারোর চোখেই যেন কোন পলক পড়ছেনা। তো চালালেন কপিলদেব তাঁর বলিষ্ঠ ঝ্যাঁটাখানা - এক বিশাল সুইং করে - কিন্তু বল ধুলো হয়ে, গলে গিয়ে লাগলো তাঁর উইকেটে। আমরা সবাই “য-যা:হ-হ” করে ঘাড় এলিয়ে, চোখ বুজে ফেললাম। প্যালপিটিশানের কবলে পড়ে ইন্ডিয়ার ইনিংস যথারীতি খাবি খেয়ে থেমে গেলো, কুড়ি রানের মতো বাকি থাকতেই - হাতে তখনও গোটা পাঁচেক ওভার বাকি। বাবা বলে উঠলেন, “ঝ্যাঁটা না চালিয়ে স্রেফ টুকটুক করে রান করে গেলেই ম্যাচটা দিব্যি বার করে নেওয়া যেতো - অতো ক'টা ওভার বাকি ছিলো !!” - কিন্তু কে বোঝে সেটা !! 'মান'-এর জ্ঞান থাকলে তবেই না সেই বুদ্ধিটা ঘটে আসবে !! এখনকার দিনের ছেলেরা অনেক, অনেক lucky - তারা at least ধোনির মতো এক “ক্যাপ্টেন Cool”কে রোল মডেল করার সুযোগ পাচ্ছে...
 
 
 

No comments:

Post a Comment