Tuesday, June 27, 2017

অমলেন্দুর রাগ

জোনাকির দল কি আজও এসে  'হাজির' বলে যায়  ? 
ভেসে ভেসে দেহ জ্বেলে আলো দিয়ে যায়  ?  
বন্ধু, শীতল ছায়ায় এলাম পুরান নদী পার        
বন্ধু, শিউলি হাওয়ায় পেলাম স্মৃতি উপহার . . . 




[ ছবি: ইন্টারনেট ]
অমলেন্দু প্রচন্ড রাগী, জন্ম থেকেই - তার মা, পিসিমা থেকে দেশের বাড়ির ভিখারী-বিড়াল-কুকুর-পাখীরা পর্যন্ত জানে সে'কথা। কিন্তু ঝামেলাটা শুরু হয়েছে মাস আটেক আগে থেকে - এক কথায় বলতে গেলে শিঞ্জিনীর সাথে আলাপ হবার পর থেকে। এখন সে আর ভালো করে রাগতেই পারে না। এই তো, গত সপ্তাহেই তো তাদের একটি ম্যুভি দেখার কথা ছিলো দুপুর তিনটের শো-তে। অমলেন্দু যথারীতি ঘন্টা দেড়েক দেরী করে ফেলেছে - কি করে শিঞ্জিনীর মান ভাঙাবে সেই নিয়ে খান দশেক প্রেমে ভরা, বাছাই করা ঝাড়া-কবিতার লাইন এদিক-ওদিক করে ঠোঁঠস্থ করেও ফেলেছে - কিন্তু কোথায় কি !! শিঞ্জিনী কি আর পাঁচটা মেয়ের মতো ! দেখা হতেই সে একগাল হেসে বললো, "ফোনে কল যাচ্ছে না দেখেই বুঝতে পারলাম যে কাল রাতে তুমি ফোন চার্জে দিতেই ভুলে গেছো, তাই ফোন করে জানাতেও পারছো না। টিকিট দুটো আমি একটা মিষ্টি দেখতে 'Couple'-কে বিক্রি করে দিয়েছি। ছেলেটা আবার জোর করে আমার হাতে পঞ্চাশ টাকা বেশি করে গুঁজে দিলো। চলো, দু'জনে মিলে টিকিট আর এই ফাউয়ে পাওয়া টাকা দিয়ে পেট পুরে ফুচকা খেয়ে ফেলি - তারপর ঝালের চোটে হু-হা-হু-হা করতে করতে, ময়দানে গুনে গুনে তিনবার চক্কর কেটে, নব্বুই ক্যালোরি ঘাম ঝরিয়ে তবে বাড়ি ফিরবো।"  শুনে অমলেন্দুর মাথা থেকে যাবতীয় ভয়-আশঙ্কা কর্পূরের মতো উবে গিয়ে গালটা কেমন যেন হাঁ-হয়ে গেলো ! এ কি মেয়ে রে বাবা !! অ্যাতোদিন সে জানতো মেয়েরা অপেক্ষা করতে ভালোবাসে না - দেরী করে আসলে ক্ষেপে যায়, কথা বন্ধ করে দেয় কিন্তু  শিঞ্জিনী  যেন অন্য কোনো গ্রহের মেয়ে।  সে এসব কখনোই করে না,  বরং অপেক্ষা করতে পছন্দ করে। বলে, "অপেক্ষা করার মতো আনন্দ আর কিছুতে আছে না কি ! 'দেখা হবে' এই ভাবনার মধ্যেই তো আসল আনন্দ আর উত্তেজনা লুকিয়ে আছে - দেখা হয়ে গেলে তো হয়েই গেলো" -  বোঝো !! এরকম কোনো মেয়ের সঙ্গে থাকলে কি কোনোও ভাবে রাগতে পারা যায় !!  


শিঞ্জিনীর সাথে তার প্রথম আলাপও হয়েছিল এই রাগের হাত ধরেই। হাজরার 'এম. এন. কর্পোরেশনে' ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে টানা আড়াইঘন্টা অপেক্ষা করার পর বসের সুন্দরী পি. এ. এসে জানালো যে বাকিদের ইন্টারভিউ সেদিন আর হবে না, পরে ফোন করে সময়মতো জানিয়ে দেওয়া হবে। শুনে অমলেন্দুর পা থেকে মাথার চুলগুলো পর্যন্ত রাগে হিসহিসিয়ে উঠেছিলো। ফেরার সময় ভীড় বাসে এক বয়স্কা মহিলা তার চটির পিছনে এমন ভাবে পা ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো যে নামতে গিয়ে হ্যাঁচকা টানে তার চটির স্ট্র্যাপটাই গেলো ছিঁড়ে ! সেই ছেঁড়া স্ট্র্যাপওয়ালা চটি হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে নিয়ে যাওয়া দেখে কলেজ ফিরতি তরুণী মেয়েগুলো হেসে যেন আর বাঁচে না !! ঝামেলা আর বিপদ কখনো একা একা আসে না। সেটা প্রমান করতেই যেন এসে গেলো আকাশ কাঁপিয়ে টোপা কুলের ঝরে পড়ার মতো বৃষ্টির ঝাঁক। সঙ্গে থাকা ছাতাটার হ্যান্ডেলটাও এই সময় জ্যাম হয়ে গেলো - কিছুতেই সে ব্যাটা খুলতে চাইলো না !! অমলেন্দুর মাথায় তখন রাগের চোটে দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে শুরু করে দিয়েছে। ছাতা খুলবে না, চটি সামলে দৌড় দিয়ে সামনের কোনও একটা দোকানের শেল্টারে গিয়ে দাঁড়াবে, এই দো'টানায় যখন সে পড়েছে, তখনই তার চোখ টানলো রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা, লম্বাটে, ছিপছিপে চেহারার একটা মেয়ে --- দু'হাত দু'দিকে সামান্য মেলে দিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে ইচ্ছা করে ভিজে চলেছে, ঠিক যেন বিরহী যক্ষপ্রিয়া দীর্ঘ অপেক্ষার পর প্রথম বর্ষার জলের স্বাদ নিচ্ছে। আকাশী-নীল কুর্তিতে ভিজে চুপসে যাওয়া শিঞ্জিনী তার চোখে যেন আবেশের ঘোর টেনে দিলো। অমলেন্দু ভুলে গেলো স্থান-কাল-পাত্র - ভুলে গেলো তার ব্যর্থ ইন্টারভিউ আর ছেঁড়া চটির দুর্গতির কথা। সারাদিনের ক্লান্তি উবে গিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো - অমলেন্দু বুঝতে পারলো তার জীবনের বারোটা বেজে গেলো সেই ক্ষণ থেকেই। আমহার্স্ট স্ট্রিটে অমলেন্দু স্থবির হয়ে দাঁড়িয়েই থাকলো, যতক্ষণ না জল জমে উঠে এসে তার গোড়ালি ছাপিয়ে গেলো !! 
[ চলবে... ]


Thursday, June 22, 2017

অচিনপুরের গল্প

[ছবি: ইন্টারনেট]
একা একাই হাঁটছিলাম - ধীরে সুস্থে, এদিক ওদিক দেখে -  অচেনা কিন্তু পুরো অচেনা যেন ঠিক নয় -  রাস্তার ধারে ধারে ঘন জঙ্গল, জ্যোৎস্না আছে বটে, কিন্তু সেই আলোতে খুব বেশি কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাঁদিকে একটু এগিয়ে লাহিড়ীদের বিশাল গোল-বাড়ি, দেওয়াল থেকে পলেস্তরা খসে পড়ে পড়ে ইঁটগুলো যেন বিশ্রীভাবে হাসছে - আরেকটু এগিয়ে গেলেই স্কুলের সেই বড়ো মাঠ -  এক ধারের একটা ল্যাম্প পোস্টে টিমটিম করে আলো জ্বলছে।  মাঠের শেষ প্রান্তে কারা কি বসে আছে? একসময় ওখানে বসেই সন্ধ্যার অর্ধেকটা সময় কেটে যেতো - খেলা, পড়াশুনা, কবিতা, প্রেমিকা, পলিটিক্স, সিনেমা থেকে যাবতীয় সরস ও ভাব-আলোচনার ঢেউ বয়ে যেতো। 

নিস্তব্ধতারও এক অচেনা শব্দ আছে - ঝিঁঝির একটানা অসহ্য ডাকে কান যেন ঝিমিয়ে যাচ্ছে - একটু এগোলেই নাট্যভবন, ওখানে নাটকের রিহার্সাল হতো একসময় - সময় মেপে, প্রচুর হাঁক-ডাক করে - এখনও হয়তো হয়, কি হয় না, কে জানে !  বৃষ্টি-ভেজা মাটি থেকে সোঁদা গন্ধ আসছে, কিছুটা যেন অপার্থিব লাগছে, অস্বস্তিকর হলেও ভালো লাগছে। ডাঁয়ে পথটা ঘুরে যেতেই সান্যালদের বাগান, ওখানে কেয়ারী করে ফুলের গাছ ছিলো একসময়।  পরী লাল গোলাপ খুব ভালোবাসতো - পরী কি এখনও আসে আর ? মাঝে-সাঝে, শীতের ছুটিতে ?  মাথার উপরে দুদিকে হেলে থাকা গাছ থেকে টুসটুসে কামরাঙা নিচে পড়ে ফেটে রয়েছে -  দু-চারটে বুনো ফলও, বোধহয় বিষাক্ত --- আরো একটু যেতেই গিরীনদার চায়ের দোকান -  ছিলো, কিন্তু এখন আর নেই।  শনি আর রবিবার করে ওখানে সিঙাড়া-ফুলুরি-বেগুনি-পিয়াঁজি ভাজা হতো -- চারটে একসাথে কিনলে ছোটো এক ঠোঙা মুড়ি ফ্রী-তে মিলতো।  ওখানে দাঁড়িয়েই সময় যেন হূ-হূ করে কেটে যেতো - মিলি স্কার্ট পরে তার বন্ধুদের সাথে দল বেঁধে কিচিরমিচির করতে করতে একসাথে অঙ্ক-স্যারের বাড়িতে পড়তে যেতো - প্রতি মঙ্গল আর শনিবার করে - ফিরতে ফিরতে হয়ে যেতো সেই রাত দশ'টা, কি তারও পর. . .

হঠাৎ করেই শিরশিরে বাতাস বইতে শুরু করে দিয়েছে - ঠান্ডার পরশে থেকে থেকে শিউরে উঠছি - ছায়াগুলোও কিরকম যেন শীতল শীতল লাগছে। গাছের ডালেরা মাঝে মাঝে ঝাপ্টা মেরে যাচ্ছে - গালে পাতার চকিত স্পর্শ - কেমন যেন ভয়-ভয় ভাব চারিদিকে। আরও একটু সামনে এগোলেই রেল-জংশন...  রথীনদার গলা-কাটা লাশের খবর ভোর-সকালে পেতেই ঘুমচোখে পড়িমরি করে একসাথে ছুটে গিয়েছিলাম। পিয়ালীদির সেদিন কালরাত্রি চলছিলো - কেউ জানাতে যেতে রাজি হয়নি - চারদিনের মাথায় আমি গেছিলাম, পিনটুকে সঙ্গে নিয়ে।  এক নিঃশ্বাসে কথাটা বলেই দৌড়ে পালিয়ে এসেছিলাম দু'জনেই. . .  পিয়ালীদির সামনে থাকতে কেমন যেন ঘেন্না করছিলো। সেদিনের সেই স্মৃতিগুলো যেন এখনো চাপ হয়ে ঘুরে-ফিরে মরছে ওখানে। 


* * * * *

ঘন জঙ্গলে ভ'রে থাকা পথ দিয়ে আমি একা একাই হেঁটে চলি  - বন-জ্যোৎস্নায়, নিস্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে, সোঁদা মাটি আর ফেটে থাকা বুনো ফলেদের বিষণ্ণ গন্ধের মধ্যে দিয়ে --- নুইয়ে পড়া গাছের চন্দ্রাতপ শামিয়ানা কেমন যেন ঘোর টেনে আনে চোখে - একদম অন্যরকম, অচেনা। ওখানেই একসময় শব্দ ছিলো, জীবন ছিলো, আর ছিলে তুমি -
   একটু এগোলেই -
         একটু ফিরলেই...




Sunday, April 23, 2017

ফিরে ফিরে আসি, কতো ভালোবাসি...


"আমার চতুর্পাশে, সব কিছু যায় আসে,
আমি শুধু তুষারিত, গতিহীন ধারা..."


প্রায় দীর্ঘ এক বছর বাদে আবার কিছু একটা নিয়ে লিখতে বসলাম - মাঝে শরীর ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো - যে জায়গায় যেতে আমি সবচেয়ে অপছন্দ করি সে জায়াগাতেই, অর্থাৎ হাসপাতালের এমার্জেন্সি রুমে আমায় কাটাতে হলো অসহনীয় তিন রাত, চার দিন। ভাগ্যের অদৃষ্ট পরিহাস বোধ করি একেই বলে !   

স্মৃতিরা হলো যেন অনেকটা জলে ধোয়া ছবির দল। অনেক দৃশ্য আবছা হয়ে গেছে - রং হারিয়ে সাদা-কালো, বা একেবারেই বিবর্ণ হয়ে গেছে - চেষ্টা করলেও আজ আসল রং মনে আসে না। ছোটবেলায় ডায়েরী লেখার অভ্যেসটা মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো আমার সেজদি। শিয়ালদায় স্টেশনে যাবার পথে ফুটপাথের দু'পাশ জুড়ে গজিয়ে থাকা স্টেশনারি দোকান গুলোতে ফুল-পাতার মতো ডাঁই করে থাকা ডায়েরীর স্তুপ থেকে তিনি একটি স্বস্তা ধরণের, ছোট্ট ব্রাউন ডায়েরী কিনে এনে আমাকে বলেছিলেন যে সেটা লিখে শেষ করতে পারলেই আরেকটা 'নতুন' কিনে দেবেন! সেই "আরেকটা নতুন"-এর লোভে পড়ে আমি প্রতি রাতে ঘুমাতে যাবার আগে পালা করে রাত জেগে সারাদিনের কেচ্ছা-কাহিনীর কিছু কিছু কথা, সাল-তারিখ-ক্ষণ দিয়ে তিন-চার পাতা ভ'রে লিখে চলতাম। পরবর্তী কালে দেখা গেলো সেইসব ডায়েরীর লেখা পড়েই দাদা-দিদিরা জেনে ফেলছে সেই কিশোর বয়সে আমার যাবতীয়  'ইনফ্যাচুয়েশেনার'-এর কথা !! অগত্যা নিত্য-নতুন লুকানোর জায়গা খুঁজে বার করতো হতো আমায় ! তবে গ্র্যাজুয়েশনের সময় থেকে লেখার অভ্যেস কমতে কমতে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলো। লেখার জন্যে সময় বার করা মুশকিল হয়ে উঠেছিলো ঠিকই, কিন্তু তার থেকেও খালি মনে হতো যে এইসব ছাইপাঁশ লিখে আর কি হবে!! সেই সব দুঃখ-হতাশার বাতুলতা কেউ কি  না-হেসে কোনোদিনও শুনবে? এখন মাঝে মাঝে মনে বড়ো আফশোষ হয় যে কেন লিখে চললাম না? চললে, আজ স্মৃতিকে অ্যাতো করে তৈলমর্দন করতে হতো না - আর স্মৃতিরাও আমাকে এরকম ভাবে ল্যাজে-গোবরে খেলানোর সুযোগ পেতো না।  

ছোটবেলার দিনগুলো ভরা থাকতো ভালো আর মন্দ, দুইয়েতেই।  স্কুলের দিনগুলোতে যেমন সকালের দিকে বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চাইতো না, আবার তেমনিই রোববারের সকালে কিছুতেই সাতটার পর বিছানায় পড়ে থাকতে পারতাম না। সারা সপ্তাহ জুড়ে আমাকে নিয়ম করে পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়া আর ঘুমাতে যেতে হলেও, রবিবারের সারাটা দিন-রাত জুড়ে আমার দৌরাত্ম্যতে কেউ কোনো বাধা দিতো না। কোনোরকমে মুখ-হাত ধুয়ে, সকালের জলখাবারের পরেই আমাকে বাবার সাথে যেতে হতো বাজারের দিকে, মূলত: বাজারের থলি বইবার জন্যে। পাড়ার বন্ধুদেরকে দেখাবার জন্যে আমি বাজারের থলিগুলোকে দু'হাতে বেশ গম্ভীরভাবে বয়ে নিয়ে চলতাম যাতে আমাকে কিছুটা বড়ো আর বয়স্ক দেখায়। ঝটপট বেড়ে ওঠার সেই ভয়ানক কুবুদ্ধি যে কেন আমার মাথায় সেদিন ভর করে ছিলো, তা আমি আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না !     
ছেলেবেলা সব দেশেতেই সমান আকর্ষণীয়...
কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাঁদের সান্নিধ্যে এলে মনটা আলোয় ভরে যায় - এক মহৎ উপলব্ধি হয়। যে উপলব্ধি সারা জীবন মনের গভীরে এক আশ্চর্য আলো জ্বালিয়ে রাখে। কালের পাকচক্রে পড়ে সেই মানুষটি হয়তো একসময় আর জীবিত থাকেন না, কিন্তু তাঁর ছড়িয়ে দেওয়া আলোটা থেকেই যায়। সেই কনে-দেখা আলোর আভা স্মৃতিকে আচ্ছন্ন করে রাখে আমাদের বাকি জীবনটা জুড়ে। সেই রকমই একজন মানুষ ছিলেন লাইব্রেরীয়ান নিমাইদা। আমার স্কুল থেকে সামান্য দূরেই ছিলো এক সমৃদ্ধ পাঠাগার। আমার বাবা ছিলেন তার সক্রিয় সভ্য - তবে অফিস শেষে তিনি নিয়ম করে লাইব্রেরি যেতে পারতেন না।  তাঁর জায়গায় বরং আমার ছোটদাই নিয়ম করে সপ্তাহান্তে গিয়ে, দুটি কার্ডে মোট চারটি গল্প-উপন্যাসের বই ইস্যু করে আনতো। ছোটদার হাত ধরেই প্রথম যেদিন নিমাইদার সাথে আলাপ হয়েছিলো তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। তবে তার অনেক আগে থেকেই আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে, স্কুল ফাঁকি দিয়ে বা স্কুল শেষ করে, প্রায় প্রতিদিনই নিয়ম করে 'ইন্দ্রজাল কমিকস', 'শুকতারা', 'আনন্দমেলা' ইত্যাদি পড়ার জন্যে সেখানে গিয়ে ঢুঁ মারতাম। বইপত্র ইস্যু করার টেবিলে সদা-গম্ভীর মুখ করে বসে থাকা সৌম্য চেহারার নিমাইদাকে আমরা সব সময়ই এড়িয়ে চলতাম, কারণ তাঁর মুখোমুখি হলেই তিনি জিজ্ঞাসা করতেন পরীক্ষা কেমন হয়েছে - শেষ পরীক্ষায় অঙ্কে আর ইংরেজিতে কতো নাম্বার পেয়েছি, সায়েন্স পড়াচ্ছেন কোন টীচার, আনন্দবাবু আমাদের কোনো ক্লাস নেন কি না, ইত্যাদি সব কঠিন, বিরক্তিকর প্রশ্ন। সে যাই হোক, ছোটদার হাত ধরে নিমাইদার সাথে সৌজন্যমূলক পরিচয় হতেই তিনি একগাল হেসে ছোটদার কানে তুলে দিলেন যে আমরা দলবেঁধে প্রায় প্রতিদিনই সেখানে স্কুল কেটে ঘন্টাদুয়েক হাজিরা দিয়ে যাই!! ছোটদার মুখে পাহাড়ি সান্যালের মতো "আই সী, আই সী" শুনে বুঝতে পারলাম যে আজ বাড়ি গিয়ে কপালে আমার বিস্তর ঝামেলা অপেক্ষা করে আছে ! 

এরপর থেকে লাইব্রেরী গেলেই নিমাইদা নিয়ম করে আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন বাবা কেমন আছেন, বাড়িতে আমি কি করে সময় কাটাই, কি বই পড়ছি এইসব। এক দিন দুরু দুরু বুকে তাঁর কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম যে শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র আর বিভূতিভূষণের বই কোথায় রাখা আছে। তিনি কিছুটা আপ্লুত স্বরেই বললেন, "এই বয়সে, বিভূতিভূষণ তাও ঠিক আছে, কিন্তু শরৎচন্দ্র পড়ার দুর্বৃদ্ধি কে মাথায় ঢোকালো ?" - আমি আমতা আমতা করে জানালাম যে বাবা বলেছেন, কোনো কিছু শুরু করতে হলে ভালো করেই শুরু করা উচিত - তাই আমি যেন রবীন্দ্র-বঙ্কিম-শরৎচন্দ্র দিয়েই... - শুনে তিনি উচ্চস্বরে হেসে উঠে বললেন, "ঠিকই বলেছেন উনি - এসো আমার সাথে..." ---  তিনি চেয়ার থেকে উঠে আমায় সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন লাইব্রেরীর একটি বিশেষ আলমারীর দিকে - বললেন সেই আলমারীতেই আছে পুরানো দিনের বিখ্যাত সব বই - আমি আমার পছন্দমতো বেছে নিয়ে পড়তে পারি। কি করে ক্যাটালগ দেখে, বা বইয়ের কভারে লাগানো লেবেল পড়ে বই খুঁজতে হয় তাও তিনি সযত্নে বুঝিয়ে দিলেন।   

নিজের হাতে বই খোঁজার বিরল অধিকার পেয়ে আমি উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলাম - অজস্র বইয়ে সাজিয়ে রাখা সারি সারি সব বুকশেল্ফ  - বই আর বই, যেন বইয়ের সমুদ্র। পুরানো বইয়ের অদ্ভুত গন্ধে মাথা যেন ধাঁধিয়ে যেতে লাগলো। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম বিবর্ণ, অবহেলিত সেই বুকশেল্ফগুলিতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা আমাদের বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী সব দিকপাল সাহিত্যিকদের অসামান্য সব রত্নমালা। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে এঁদের অনেকের সাথেই অল্পবিস্তর আলাপ হয়েছে - কিন্তু সে আলাপ তো নগন্য মাত্র - তাতে কি মন ভ'রে? কিন্তু, আজ থেকে তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্যের সাথে আমার পরিচয়ের আর কোনো বাধাই রইলো না। এরপর থেকে মাঝে মাঝেই নিমাইদার সাথে আমার সাহিত্য নিয়ে ছোটোখাটো প্রশ-উত্তরের সেশন চলতে থাকলো। সেই সব সেশনের শেষে তিনি কিছুটা অভ্যেসবশতই নিয়ম করে বলতেন, "বই পড়ার অভ্যাসটা কখনো ছেড়ো না, আর কখনও ভুলেও বইকে অসম্মান করো না..."  

ক্লাস টেন-তে ওঠার অনেক আগেই আমার শেষ হয়ে গেলো শরৎচন্দ্রের যাবতীয় নভেল। এরপর সেই লাইব্রেরী থেকে লাগাতার, অজস্র বই নিয়ে পড়ে চলেছিলাম, এমন কি মাস্টার্স কমপ্লিট হয়ে যাবার পরেও। বিভূতিভূষণের 'আরণ্যক', শীর্ষেন্দুর 'দিন যায়', সঞ্জীবের 'লোটাকম্বল', তারাশঙ্করের 'হাঁসুলিবাঁকের উপকথা', নারায়ণ সান্যালের 'নাগচম্পা', রমাপদ চৌধুরীর 'বন পলাশীর পদাবলী', বিমল করে 'আত্মজা' নিয়ে তুল্য মূলক বিচার চলতে থাকতো নিমাইদার সাথে। বাংলা ভাষার মহীরুহ থেকে নবীন প্রজন্মের সাহিত্যিকদের সাথে আমরা যাবতীয় যোগসাজশের সূত্রপাত, বা ভিত্তিস্থাপন ওই লাইব্রেরী আর নিমাইদার হাত ধরেই। 

~ ~ ~ ~ ~ 

কর্মসূত্রে দেশ ছেড়ে চলে আসার আগে, ইচ্ছা থাকলেও নিমাইদার সাথে দেখা করে আসা হয়ে ওঠেনি। বুঝি সম্পর্কের টানে মায়ার বাঁধন অনেক কমে গিয়েছিলো। আজ যদি টাইম মেশিনে করে কোনও ভাবে সেই অকালপক্ক কৈশোর জীবনে ফিরে যেতে পারি, তো নিমাইদার কাছে প্রথমদিনই গিয়ে হাজির হবো।  কোনও কথা বলবো না - স্রেফ বুকে জড়িয়ে তাঁকে ধরে বেশ কিছুক্ষন চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকবো - আর ছাড়বো না 
কিছুতেই...