Sunday, December 1, 2013

Alma Mater, লাইব্রেরী ও কিছু ছেঁড়া কথা...

স্কুল-কলেজকে যে আলমা ম্যাটার বলে তা প্রথম জেনেছিলাম নির্মলদার কাছ থেকে। নির্মলদা, অর্থাৎ নির্মল মিরাণী ছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র, গোড়খাড়া হাই স্কুলের ইংলিশের টিচার। তাঁর দাদা আর আমার দাদা  একই UBI ব্রাঞ্চে এক সময়ে কাজ করতেন। তারই সুত্র ধরে নির্মলদার সাথে আমাদের পরিচয়। এমনিতে তিনি কোনো প্রাইভেট ট্যুইশান করাতেন না। কিন্তু আমার দাদার অনুরোধ তিনি ফেলতে পারেনি। অত:পর সপ্তাহে একদিন করে তিনি আমাকে ইংরাজী পড়াতে রাজি হয়ে যান। গোড়খাড়া স্কুল শেষে  ফেরার পথে, বিকালের দিকে  তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন, থাকতেন ঘন্টা দেড়েক। ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভ  অবধি আমি তাঁর কাছে পড়েছিলাম। খটমট ইংরাজী সাহিত্যও যে কি ভীষণ ভাবে রসময়ী ও আকর্ষনীয় হয়ে উঠতে পারে তা আমি তাঁর কাছে কিছুদিন পড়ার পরই  'ফীল' করা শুরু করলাম। 'লমা ম্যাটার' হলো গিয়ে একটি ল্যাটিন শব্দ, যার মানে "bountiful mother" -শিক্ষাস্থানকে যে 'লমা ম্যাটার' বলা হয়, সেটা জেনে প্রথমে একটু অবাকই  হয়ে গিয়েছিলাম। তারপরে মনে হলো, নাহ: সেটাই তো হওয়া উচিত। মায়ের মতো না'হলেও স্কুলকে আমি চির'টা কালই যথেষ্ঠ ভালোবেসে এসেছি - যেটা হয়তো এর আগে আলাদা করে কখনো ভেবে দেখেনি, কিন্তু তার মানেই যে কথাটা সত্যি নয়, তা ঠিক নয়। 

আমাদের স্কুলের এক লম্বা-চওড়া নাম ছিলো, হরিনাভী ডি.  ভি. এ. এস. হাই স্কুল - বাংলায় এই নামটা ছিলো আবার আরো বড়ো। সংক্ষেপে সবাই একে 'হরিনাভী স্কুল' বলতো। আমাদের অঞ্চলের সেরা স্কুল ছিল এটা। সে সময়ে পাক্ষিক 'আনন্দমেলা' পত্রিকার প্রতি সংখ্যায় পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীরা মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্যে কিভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে, আর সে স্কুলের প্রধান শিক্ষক কি অ্যাডভাইস দিচ্ছেন, সে নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত অর্টিকেল প্রকাশিত হতো। তাতে প্রধান শিক্ষক এবং ক্লাসের প্রথম ছাত্র (বা ছাত্রী), দুজনার আলাদা আলাদা সাদা-কালো ছবি ছাপা হতো, দু'পাতা জুড়ে। আমি যখন সেভেন কি এইটে পড়ি তখন আমাদের স্কুলের টার্ন এলো। পত্রিকার পাতায় আমাদের হেডস্যার, 'আনন্দমোহন চট্টোপাধ্যায়ের' ছবি দেখে আমাদের সে কি ভালো-লাগা! সবাইকে ডেকে ডেকে দেখানো শুরু হয়ে গেলো যে এটাই আমাদের স্কুলের হেড স্যার। আমাদের স্কুল শুরু হতো সকাল ১১টায়। যতো দিন সাইকেল চড়া শিখিনি, আমি পাবলিক বাসে করেই স্কুলে যাওয়া-আসা করতাম। সোনারপুর মোড় থেকে সাধারনত বাসে উঠতাম - বাসের নাম্বার ছিল ৮০বি-ফাইভ - কখনো কখনো দেরী হয়ে গেলে আমি সোনারপুর মোড়ের পরের স্টপ, দেশবন্ধু পার্ক বা ক্ষিরিশতলার মোড় থেকেও বাসে উঠতাম। সকালের দিকটাতে প্রতি  ২০মিনিট অন্তর করে বাস চলতো - ১০টা, ১০:২০, ১০:৪০, ১১টা  - তারপর আবার একটু গ্যাপে গ্যাপে চলতো। আমি চেষ্টা করতাম রোজ ১০টার বাস ধরতে। বাসে করে স্কুলে যেতে লাগতো প্রায় কুড়ি মিনিট । বাড়িতে সবাই আমাকে ক্ষ্যাপাতো যে 'এতো আগে গিয়ে করবিটা কি, স্কুলে ঝাঁট দিবি ?' - আমি রেগে গিয়ে বলতাম, 'হ্যাঁ, তাইই করবো - স্কুলব্যাগ করে ঝাঁটাই বয়ে নিয়ে যাচ্ছি !!' - কিন্তু স্কুলের যে কি অদম্য আকর্ষণ ছিলো সেটা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। স্কুল মানে তো শুধু পড়াশুনা নয় - আরো একগাদা মজার অ্যাক্টিভিটি। ক্লাস শুরু হবার আগে পর্যন্ত এবং সব ক্লাসের শেষে নানান ধরণের খেলা, লাঞ্চ টাইমে মোড়ের  বৈশাখীদার দোকানে বসে পরোটা-আলুর তরকারী, কি মুড়ি-চানাচুরের ঠোঙা  নিয়ে ভাঙ্গা মন্দিরটার দোতলায় উঠে পা-ঝুলিয়ে খাওয়া, এ সবই যেন চুম্বকের মতো করে আমাদের স্কুলের দিকে টানতো। বৈশাখীদার দোকানের সিঙারা ছিল সেসময় দারুণ পপুলার - তবে  সিঙারা বা পরোটা-আলুর তরকারী খাওয়ার পয়সা প্রতিদিন জুটতো না। অগত্যা পাশের মনোহারী দোকানটার মুড়ি-চানাচুর কি মুড়ি-বাদামই আমাদের আশা-ভরসা ছিলো। সে দোকানদারের নাম আজ ভুলে গেছি - কিন্তু মনে আছে টিফিন পিরিয়ডের কিছু আগে থেকেই তিনি গোটা তিরিশেক ছোট ছোট ঠোঙাতে মুড়ি ভ'রে, থরে থরে সাজিয়ে রাখতেন। আমরা ছুটে যাওয়া মাত্রই সেগুলোতে ফরমায়েশ অনুযায়ী এক চামচ চানাচুর কি বাদাম ঢেলে, পয়সা নিয়ে এক এক করে আমাদের দিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে কঞ্জুষামির চূড়ায় উঠে এতো কম বাদাম-চানাচুর দিতেন যে আমরা রাগারাগি করে বলতাম, 'নোব না এই ঠোঙা, তোমার মুড়ি তুমি খাও!' - কিন্তু খুব একটা ভ্রুক্ষেপ তিনি করতেন না, কিম্বা এতো কাস্টমার হতো যে সে-সব কথা পাত্তা দেবার সময়ই তখন তাঁর থাকতো না। 

হরিনাভী মোড়ই ছিলো আমাদের বাসের লাস্ট স্টপ। এখান থেকেই বাসটা ঘুরে আবার উল্টো পথ ধরে ফিরে যেতো। মোড়ের কাছের পিচের রাস্তাটাতে একটু  উঁচু করে করে তিনটে  বাম্পার করা ছিলো, যাতে ওই জায়গা দিয়ে গাড়িগুলো আস্তে আস্তে যায়। বাম্প থাকার দরুণ যে-কোন গাড়িই  ওই জায়গা দিয়ে যাবার সময় একটু নেচে-দুলে যেতো। এসময় বাসের একদম পিছনের দিকের সীটে যারা বসতো, তাদের ঝাঁকুনি লাগতো সব থেকে বেশী - আর এটাই ছিলো আমাদের কাছে বেশ মজার ব্যাপার। তাই ওই সীটগুলোতে বসার জন্যে আমরা মুখিয়ে থাকতাম। বাস মোড়ে এসে থামা মাত্রই কে-কার আগে উঠবে সে নিয়ে প্রায় মারামারি শুরু হয়ে যেতো। বাসের লোকেদের নামার সুযোগ না দিয়েই আমরা বাসে উঠে পড়তে চাইতাম। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার কমপ্লেনও গেছিলো স্কুলে। আবার মাঝে মাঝে আমরা হেঁটে হেঁটে  হরিনাভী মোড়ের  আগের বাস-স্টপ, 'চৌহাটি'তে গিয়ে, সেখান থেকে বাসে উঠে পড়তাম। কারণ ওই একই বাসই মোড়ে গিয়ে ঘুরে আসবে। আলাদা করে টিকিট কাটার কোনো প্রশ্নই উঠতো না, কারণ একটা মাত্র স্টপের জন্যে কেউ টিকিট কাটেনা, আর তাছাড়া আমরা তো এমনি এমনিই আগে এসে উঠেছি।  এই কারণে অনেক সময়েই কিছু ফাজিল বাস-কন্ডাক্টাররা ওই স্টপে বাস থেকে নামার কেউ না থাকলে, ইচ্ছা করেই আমাদেরকে দেখে ওখানে বাস দাঁড় করাতো না। অগত্যা আমরা বাসের পিছন ছুটতে ছুটতে আবার হরিনাভী মোড়ে ফেরত  চলে আসতাম, তারপর সেই বাসে উঠতাম। বলাবাহুল্যই কোন ভালো সীটই আর সেদিন আমাদের কপালে জুটতো না। আর আমাদের সে হয়রানি দেখে কন্ডাক্টাররা তখন খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হাসতো। 

হরিনাভী স্কুলের দক্ষিণ দিকে একটা বড় মাঠ ছিলো - কিন্তু সেটাতে তেমন কোন খেলাধুলা হতো না। যতদুর মনে হয় সেটা কোন প্রাইভেট প্রপার্টি ছিলো। স্কুলের বাথরুমের একদম শেষে, পাঁচিলের পাশ দিয়ে একটা সরু গলি-মতো রাস্তা হয়ে গিয়েছিলো - সেটা দিয়ে নেমে ওই মাঠে ঢুকে পড়া যেতো।  তারপর সেই মাঠ ক্রশ করে রাস্তার ওধারে গেলেই পৌঁছে যেতাম 'প্রগতি সংঘ লাইব্রেরী'তে। এই লাইব্রেরীও ছিলো আমার স্কুলে আসবার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। লাইব্রেরীর পাশে ছিলো ছোট্ট পার্ক মতো একটুখানি খালি জায়গা।  সেখানে ছোটদের খেলার জন্যে সিমেন্টের তৈরী উঁচু একটা  'স্লাইড', আর একটা কাঠের seesaw ছিলো। সেগুলোতে আমরা যখনই যেতাম তখনই চড়তাম। এই  লাইব্রেরীতে বড়োদের বই ছাড়াও বাচ্চাদের প্রচুর  গল্পের বই ছিলো, বিভিন্ন বয়সের উপযোগী - আর ছিলো বাঁধাই করা গোটা পনেরো ইন্দ্রজাল কমিকসের মোটা মোটা কালেকশন। এই বাঁধানো কমিকসের বইগুলো ছিলো আমাদের কাছে স্বপ্নে পাওয়া জাদুকাঠির মতো। এগুলো বাড়িতে নিয়ে এসে পড়বার অনুমতি ছিলো না - শুধুমাত্র ওখানে বসেই পড়া যেতো, তাও আবার ফার্স্ট-কাম-ফার্স্ট-সার্ভ বেসিসে। বহুবারই টিফিনের ঘন্টা বাজা মাত্রই আমরা ছুটতে ছুটতে লাইব্রেরীতে গিয়ে হাজির হতাম সেইসব কমিকসের বই পড়ার জন্যে - আর ফিরতাম সেই  টিফিনের শেষ  ঘন্টা বাজারও পর। মাঝে মাঝে পড়ুয়ার সংখ্যা এতো বেড়ে যেতো যে দুজন বন্ধুতে মিলে একটাই বই শেয়ার করে পড়তে হতো। আমাদের এই গোপন অভিযানের খবর  কিছুদিনের মধ্যেই জানাজানি হয়ে গেলো - এমন কি স্যারেরাও সবাই জেনে গেলেন। একদিন দেখলাম আমাদের সিড়িঙ্গে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডস্যার দাঁড়িয়ে আছেন বাথরুমের সেই গলিপথের সামনে - হাতে তাঁর ছোট্ট একটি বেত। টিফিনের শেষ ঘন্টা বেজে যাবার পরে যারা লুকিয়ে চুরিয়ে ওই গলিপথ দিয়ে স্কুলে ঢুকছে, তাদের পিঠে সপাসপ  পড়ছে সেই বেতের বাড়ি। আর 'বাবাগো-মাগো' বলে সে কি চিৎকার তাদের! সৌভাগ্যবশত: তাঁর মুখোমুখি আমায় হতে হয় নি কোনদিন। অচিরেই স্কুল থেকে লাইব্রেরীয়ান 'নিমাইদা'-র কাছে কড়া নির্দেশ গেলো - তার পর থেকে টিফিন পিরিয়ডে কমিকসের বই দেওয়া বন্ধ করে দিলেন তিনি। অগত্যা আমরা স্কুল শেষ হয়ে যাবার পরে লাইব্রেরীতে গিয়ে ঘন্টাখানেকের মতো সময় কমিকস পড়ে,আর কিছুটা খেলে তারপর সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরতে লাগলাম। এবার নির্যাতন শুরু হলো বাড়িতে, দেরী করে ফেরার জন্যে! কিন্তু মার খেয়ে খেয়ে তখন পিঠ গেছে তক্তা হয়ে - তাই কে শোনে কার কথা!  

আমাদের বাড়ি থেকে এই প্রগতি সংঘ লাইব্রেরীতে দুটো কার্ড করা হয়েছিলো - প্রতি কার্ডে দুটো করে বই নেওয়া যেতো। লাইব্রেরীয়ান 'নিমাইদা' আমার ছোটদাকে বেশ ভালো করেই চিনতেন।  স্কুলে পড়াকালীন আমাকে না চিনলেও, পরের দিকে তিনি আমাকে চিনে যান। আমি লাইব্রেরীতে এলেই তিনি ছোটদার কথা জানতে চাইতেন। চাকরিসুত্রে  ছোটদাকে মাঝে মাঝেই বাইরে চলে যেতে হওয়ায় আমিই নিয়মিত ভাবে লাইব্রেরীতে যাওয়া-আসা শুরু করে দিলাম। তার পর আমিও চাকরিতে জয়েন করে ফেললে, বাড়ি থেকে লাইব্রেরী যাওয়া-আসা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলো। তখন অবশ্য বই কিনে পড়ার সামর্থ্য চলে এসেছে, তাই লাইব্রেরীর প্রতি টানও গেলো ধীরে ধীরে কমে। বেশ কয়েক বছর পরে একদিন  ঠিক করলাম বাড়িতে পড়ে থাকা লাইব্রেরীর বইগুলো ফেরত দিয়ে, আমাদের দুটো অ্যাকাউন্টই বন্ধ করে দিয়ে আসবো। সেই মতো এক শনিবারের বিকেলে  গিয়ে হাজির হলাম আমার কৈশোরের অন্যতম আকর্ষণ, প্রগতি সংঘ লাইব্রেরীতে। সেখানে পৌঁছে মনে হলো 'সময়' যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে কোন ভাবে। বইয়ের সেই চেনা সোঁদা-সোঁদা গন্ধ - লোডশেডিং হয়ে যাওয়ায় যথারীতি গুটিকতক লম্বা মোমবাতি জ্বলছে এখানে সেখানে। কিছু বয়স্ক লোক বসে চুপচাপ খবরের কাগজ পড়ে যাচ্ছেন, কিছু ইয়ং ছেলে মেয়ে ইত:স্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছে এদিক সেদিক। আর কাউন্টারের সামনে বসে আছেন আমাদের অতি পরিচিত, সেই আদি, অকৃত্রিম, সদা হাস্যময় নিমাইদা। মোমবাতির স্বল্প আলোতেও বোঝা গেলো তাঁর আরও বয়স হয়ে গিয়েছে। মুখের খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ির আধিক্যে তাঁকে যেন আরও বেশী করে বয়স্ক দেখাচ্ছে। আমাকে দেখে তিনি ঠিকই চিনে উঠলেন, বললেন, "আরেব্বাস! কতো বড়ো হয়ে গেছিস !" - আমার বৃত্তান্ত সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনলেন, ছোটদারও  অনেক খোঁজ-খবর নিলেন। তার পর আমার আসার মূল কারণটা জেনে মুখখানা তাঁর ব্যথায় ভরে উঠলো। প্রায় বছর পাঁচেকের ফাইন জমা দিয়ে আমি তাঁর কাছ থেকে আমাদের জরাজীর্ণ-প্রায় কার্ড দুটো ফেরত নিয়ে নিলাম। দুটো কার্ডের মধ্যে একটির অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের নাম দেখে চমকে উঠলাম -  সেটি আমার শ্রদ্ধেয় পিতৃদেবের নাম। অর্থাৎ তিনিও একসময় কখনো এখানে আসতেন। কোন সুদুর অতীতে আমার বাবার হাত দিয়ে একদিন যে প্রথার শুরু হয়েছিলো, আজ আমার হাত ধরে তার চির-সমাপ্তি ঘটলো। নিমাইদার থমথমে মুখ যেন সে কথাগুলোই নিঃশব্দে বলে চলেছে। সাইড ব্যাগে কার্ড দুটো রেখে আমি নিমাইদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সেই ইন্দ্রজাল কমিকসের বইগুলো এখনো আছে? নিমাইদা নির্লিপ্তভাবে বললো বহুদিন আগেই সেগুলোর ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে। দোতলার ঘরে কোথাও সেগুলো বাতিল হয়ে যাওয়া বইয়ের বস্তার মধ্যে ডাম্প করা আছে। কারণ জানতে চাইলে বললেন কিছু বদ ছেলে নাকি ব্লেড দিয়ে কেটে কেটে অনেক বই চুরি করে নিয়েছিলো - আল্টিমেটলি বইগুলো সব ড্যামেজড হয়ে যায়। আমি বললাম, আমাকে দিয়ে দিন না সেই ছেঁড়া বইগুলোই, যা দাম লাগে আমি তাই দিয়ে কিনে নেবো - এমনকি নিজের পয়সায় ওগুলো বাঁধিয়ে দিতেও আমি রাজি আছি, at least যেগুলো এখনো টিকে আছে...” - কিন্তু নিমাইদা কিছুতেই রাজি হলেন না - বললেন ওগুলো সব সরকারী সম্পত্তি, তাই ওগুলো নিয়ে কিছু করা তাঁর ক্ষমতার বাইরে। আমি যেন আবারো নতুন ভাবে নিমাইদাকে চিনলাম। দায়িত্ববোধ, বিশ্বস্ততা তাহলে এখনো টিকে আছে।  ফিরে আসার সময় হয়ে এলো - নিমাইদার ম্লান মুখের দিকে চেয়ে মনে মনে বলে উঠলাম, থ্যাঙ্ক ইউ নিমাইদা, স্কুল জীবনে আমাদের ওগুলো পড়তে দেবার জন্যে - It's a privilege to grow old with you...

বাইরে বেরিয়ে আমি চুপচাপ সাইকেলে উঠে পড়লাম। লাইব্রেরীর পাশে, সেই ছোট্ট পার্কের seesaw-টা তে তখনো দুজন ছেলে অবিশ্রান্ত ভাবে খেলেই যাচ্ছে, ক্যাঁচ-ক্যোঁচ আওয়াজ করে করে। ক্লান্ত বিকেলের ম্লান আলোয় তাদেরকে দেখে মনে হলো যেন সেই  'কিশোর বয়সের আমি-ই' এখনও খেলে চলেছে সেখানে... 

No comments:

Post a Comment