Showing posts with label জীবনের প্রথম প্যারাবোলা.... Show all posts
Showing posts with label জীবনের প্রথম প্যারাবোলা.... Show all posts

Sunday, November 17, 2013

জীবনের প্রথম প্যারাবোলা...

কিছুদিন আগে এক টিম লাঞ্চে কথা হচ্ছিলো কার কি ফেভারিট জিওমেট্রিক শেপ তাই নিয়ে। ফেভারিট শেপ দিয়ে নাকি মানুষের পার্সোনালিটি গেস করা যায়। বেশিরভাগই বলছিলো 'স্কোয়ার', 'সার্কেল', 'রেক্টাঙ্গল' বা 'ট্রায়াঙ্গল' - কে একজন বললো 'স্কুইগেল' - আমাকে জিজ্ঞাসা করতেই আমি ইনস্ট্যান্টলি জবাব দিলাম 'প্যারাবোলা' - সবাই কিছুটা হকচকিয়ে গেলো। কারনটা কি জানতে চাইলে যুতসই কোনো জবাব খুঁজে পেলাম না। বেসিক্যালি আমার অবচেতন মনই এই উত্তরটা সাজেস্ট করেছে। কিন্তু সেটাকে সাপোর্ট করার মতো সাফিসিয়েন্ট যুক্তি তার কাছে সঙ্গে সঙ্গে আশা করা যায় না। তাই কায়দা করে বললাম নেক্সট কোনো একদিন কারনটা বলবো। সবাই ভাবলো না-জানি কি গূড় কারণ সেটা ! সারাটা দিন নানান ব্যস্ততায় কেটে গেলো - মিটিংয়ের পর মিটিং। কিন্তু মাথার ভিতর ঘুনপোকার ঘ্যানঘ্যানানির মতো রয়েই গেল প্রশ্নটা। সত্যি তো, এতো কিছু শেপ থাকতে হঠাৎ 'প্যারাবোলা' বলতে গেলাম কেন? রাতে ঘুম আসতে ইদানিং আমার এমনিই সময় বেশি লাগে, সেই রাতে ঘুম এলো অনেক পরে। ভোরের দিকে ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্নের একগাদা অসংলগ্ন, খন্ড খন্ড ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে বোধহয় জানতে পারলাম সেই আসল কারণটা ছিলো কি। 

আমার ছোটবেলাতে ইন্টারনেট, বা ভিডিও গেমসের প্রাদুর্ভাব ছিলো না। কিন্তু অজস্র মজার মজার খেলা ছিলো - এর মধ্যে আমার অন্যতম, বা হয়তো সব থেকে ফেভারিট ছিলো শীতকালে, অ্যানুয়াল পরীক্ষার শেষে 'ঘুড়ি ওড়ানো ' - একটা কেটে যাওয়া ঘুড়ি পাওয়ার থেকে বেশি আনন্দ যে কোনো কিছুতে থাকতে পারে, তা আমার জানা ছিলো না। সে সময়ে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই আমি বাড়ির উঠানে এসে আকাশটাকে দেখে নিতাম। হাওয়াহীন, নিস্তব্ধ সকালবেলা দেখলেই আমার গা-পিত্তির জ্বলে উঠতো। ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে একটানা আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সান-বার্নের কারণে চোখ-মুখের চেহারাই যেতো বদলে। বিশেষ করে ঠোঁট ফেটে রক্ত বার হওয়াটা খুব কমন একটা ব্যাপার ছিলো। মা-পিসিমা সহ বাড়ির বড়োরা অনেকেই এই সময়ে আমাকে ল্যাজওয়ালা সেই পপুলার প্রাণীটার সাথে অহেতুক তুলনা করতো। 

ঘুড়ি ওড়ানো, প্লাস ঘুড়ির প্যাঁচ লড়াইয়ের যাবতীয় কৌশল আমার মেজদার কাছ থেকে শেখা। বিকেল গড়িয়ে গিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত পশ্চিম আকাশে সূর্যের লাল আলোর সামান্য প্রভাটুকু লেগে থাকতো, ততক্ষণ অবধি আমরা ঘুড়ি উড়িয়ে চলতাম। কখনো কখনো এমনও হয়েছে যে আকাশে চাঁদ উঠে গিয়েছে, সেই চাঁদের আলোতেও আমরা চাদর গায়ে দিয়ে, মাফলার পরে ঘুড়ি উড়িয়ে চলেছি। তবে অধিকাংশ সময়েই পিসিমা দায়িত্ব নিয়ে বিকেলবেলার শেষে অম্ল-মধুর হাঁক-ডাক করে করে আমাদের ঘুড়ি ওড়ানোর বারোটা বাজিয়ে দিতেন। যাই হোক, এমনই এক শীতের বিকেল শেষে আমি ঘুড়ি-লাটাই সব গুছিয়ে রেখে ছাদে পায়চারী করে বেড়াচ্ছি। এদিক ওদিক দেখে চলেছি যে এখনও কেউ ঘুড়ি ওড়াচ্ছে কিনা। হঠাৎই চোখে পড়লো ছাদে ঠাকুরঘরের মাথার বেশ কিছুটা ওপর দিয়ে সুতোর মতো কি যেন একটা চলে গেছে - শেপটা অনেকটা যেন বিশাল একটা ফ্ল্যাট চন্দ্রবিন্দু। যার একটা দিক ঈশান কোনের জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেছে, আর অন্যদিকটাতে আকাশের প্রায় তারাদের কাছাকাছি, ছোট্ট একটা কালো বিন্দুর মতো কি একটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘুড়ি বলে সেটাকে আদৌ কিছু মনে হচ্ছে না, বরং মনে হচ্ছে যেন আকাশের গায়ে হয়ে থাকা কালো একটা স্পট মাত্র! গায়ের লোম সব খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। পাগলের মতো সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নীচে নেমে এসে মেজদাকে ডেকে নিয়ে এলাম। মেজদাও ভীষণ উত্তেজিত - বললো নিশ্চয় কারোর লাটাইয়ের একদম গোড়া থেকে সুতোটা কেটে গেছে, যাকে ঘুড়ি ওড়ানোর ভাষায় বলে 'উবড়ে যাওয়া' - সেই ঘুড়ি উড়তে উড়তে আকশের একদম উপরের লেয়ারে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। যার একটা কারণ ওটার পিছনে এতো বড়ো লম্বা সুতো আছে যে সেটা বয়ে নিয়ে ঘুড়িটা আর উপরে উঠতে পারছেনা, আর আরেকটা কারণ আকশের ওই উপরের লেয়ারে এখন আর কোনো হাওয়া নেই, তাই ঘুড়িটার নড়বড়ৈ-চ একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। তো যাই হোক, এটা অবশ্যই বিশাল কিছু একটা পাওয়া - বিশেষ করে ঘুড়ির সাথে সাথে অতোটা সুতো পাওয়া মুখের কথা নয় - ভীষণ লাকের ব্যাপার। মেজদা মূহুর্তের মধ্যে ঠাকুরঘরের মাথায় উঠে পড়লো। তার পর ছাদে থাকা বিশাল বাঁশের লগাটা উঁচু করে কোনোমতে সেই সুতোটাকে জড়িয়ে ফেলে, ধীরে ধীরে নিচে নামিয়ে আনলো। এই সব কান্ড দেখে উল্টোদিকের বাড়ির ছাদে মোহনদাও উঠে এসেছে। সে বলে চলেছে: 'খুব আস্তে আস্তে টান - সুতোতে প্রচন্ড টান থাকবে...' - বাস্তবিকই তাই, ঘুড়িটা এতদূরে উঠে গেছে যে তার সুতোটার বিশাল একটা পেট হয়ে আছে। মেজদা খুব সাবধানে সুতোটা টেনে টেনে ঘুড়িটাকে নামিয়ে নিয়ে আসলো। পুরো ব্যাপারটা কমপ্লিট হতে প্রায় আধঘন্টা লেগে গেলো। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেই চলেছি। বিশাল একটা বাতিয়াল ঘুড়ি ধীরে ধীরে আমাদের বাড়ির ছাদে অবতরন করলো - যেন ভিনগ্রহের কোন একটা জীব। কালোর উপরে ঘন নীল রঙের দো-তিল ঘুড়ি ছিলো সেটা -  দেখলেই কেমন যেন একটা ভয় আর সম্ভ্রম জাগে। পড়ে পাওয়া অতোটা সুতো গুটিয়ে গুটিয়ে আমার লাটাই ফুলে ফেঁপে বিশাল একটা পটলের আকার ধারণ করে বসলো। 

সব কিছু নির্বিঘ্নে শেষ হয়ে গেলে আমি বললাম: 'মেজদা, সুতোটা কেমন দেখাচ্ছিলো বল, এই সন্ধ্যার আকাশে !' - মেজদা বললো: 'বলতো কিসের মতো ?' - আমি বললাম: 'জানি না তো, কিসের মতো ?' - মেজদা বলে উঠলো: 'দূর বোকা !! জিওমেট্রিতে 'প্যারাবোলা'ও পড়িস নি !! কি পড়ায় কি তোদের স্কুলে !!' 

মেজদার অবজ্ঞাকে থোড়াই কেয়ার করে আমি আনন্দে ডগমগ হয়ে, নাচতে নাচতে ঘুড়ি-লাটাই নিয়ে নীচে নামতে থাকলাম...

~ ~ ~   ~ ~ ~

Also published on: ও-কলকাতা-ডট-কম (April 9th, 2014)
LINKজীবনের প্রথম প্যারাবোলা @ oKolkata.in