Wednesday, December 11, 2013

জয়নগরের মোয়া

হেমন্তকাল এলেই বাঙালীর মনটা সব থেকে বেশি ছোঁকছোঁক করে ওঠে নলেন গুড়ের জন্যে, আর তার হাত ধরে ধরেই চলে আসে 'মোয়া' - আরও specifically বলতে গেলে 'জয়নগরের মোয়া' - কে জানে কত বছর আগে থেকে আপামর বাঙালী নলেন গুড় দিয়ে খাবার বানিয়ে আসছে। পিঠে, পায়েস, নরমপাকের সন্দেশ, কড়াপাকের সন্দেশ, তালশাঁস, রসগোল্লা, কাঁচাগোল্লা থেকে হালের আইসক্রীম ব্যাটা ভাগ বসিয়েছে এই নলেন গুড়ের স্বাদে। ইংরাজিতে একটা কথা আছে, 'Flavour' - হতচ্ছাড়া অ্যামেরিকানরা আবার আরো ছোট করে একে বলে 'Flavor' - এর বাংলা প্রতিশব্দ আমি খুঁজে চলেছি, কিন্তু এখনো পাইনি। ফ্লেভার মানে শুধু গন্ধ নয়, সেটা একাধিক ইন্দ্রিয়কে একসাথে আহ্বান করে। আমার ছোটবেলার শীতকালের সঙ্গে এই নলেন গুড়ের Flavor ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলো। ভেজাল আর এসেন্সের চক্করে পড়ে নলেন গুড়ের সেই ফ্লেভার হয়তো গত শতাব্দী থেকে অনেকটাই কমে গেছে, কিন্তু তাহলেও বাঙালীর কাছে এখনও শীতকাল মানেই নলেন গুড়। রসগোল্লা না-হলেও চলে যাবে, কিন্তু নলেন গুড়ের নরমপাকের সন্দেশ না-থাকলে শীতের বেলায় আমি কারোর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রাখতে যাচ্ছি  না,  না,  না:হ!!


জয়নগর মজিলপুর হলো দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ছোট্ট একটা গ্রাম। প্রায় পাঁচশো বছর আগে আদি-গঙ্গা এইখান দিয়ে বয়ে বয়ে মিশে গিয়েছিলো বঙ্গোপসাগরে। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর শিষ্যদেরকে নিয়ে নীলাচলে যাবার সময় এখানে থেমে ছিলেন। সাংস্কৃতিক আবহাওয়ায় পরিপুষ্ট এই অঞ্চলটিকে অনেকেই পশ্চিম বাংলার 'দ্বিতীয় নবদ্বীপ' বলেও অভিহিত করে থাকেন। গুগল সার্চ জানাচ্ছে ১৯২৯ সাল নাগাদ এই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ দুই ব্যক্তি নৃত্যগোপাল সরকার (বুচকি বাবু) এবং পূর্ণচন্দ্র ঘোষ, দু'জনে মিলে সর্বপ্রথম 'মোয়া' নামক লোভনীয় মিষ্টান্নটির জন্ম দেন। তারপর সেই মোয়ার সুস্বাদ, সুঘ্রাণ আর গুণ ক্রমে ক্রমে সারা পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই, এমন কি ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। অরিজিনাল 'জয়নগরের মোয়া' তৈরীতে 'কনকচুড়' নামে এক বিশেষ ধরণের চালের খই ব্যবহার করা হয়। এছাড়া উৎকৃষ্ট মানের ঘি আর খাঁটি নলেন গুড় তো লাগেই। কিন্তু আজকাল অনেক জায়গাতেই সাধারণ খই, নিম্নমানের গুড়, ঘি আর রাইস পাউডার ব্যবহার করে মোয়া তৈরী করা হয় - যেটা খেতে তেমন ভালো হয় না - কিন্তু সেটাই চড়া দামে 'জয়নগরের মোয়া' বলে বিক্রি করা হয়ে থাকে। 

শীতের শুরুতে গ্রামে-শহরে যত্রতত্র, ব্যাঙের ছাতার মতো হই-হই করে গজিয়ে ওঠে মোয়া তৈরীর অসংখ্য দোকানশুনে মজা লাগলেও এদের প্রায় প্রতিটির নাম হয়ে থাকে 'জয়নগরের মোয়া' - বড়জোর দোকানদারের নাম তার আগে জোড়া হয়, কিন্তু নামের মধ্যে 'জয়নগরের মোয়া' কথাটি থাকবেই। ছোটবেলায় আমাদের লোকাল বাজারের এদিক-ওদিক, সর্বত্র এরকম মোয়ার দোকান দেখে ভাবতাম যে জয়নগর থেকে যদি সব মোয়া আমাদের বাজারে চলে আসে, তো ওখানকার লোকেরা খাবে কোথাকার মোয়া !! স্কুলে পড়াকালীন এক শীতের শুরুতে দেখলাম আমাদের বাড়ির খুব কাছেই, কালীতলার পাশে ঝটপট গজিয়ে উঠলো এক 'জয়নগরের মোয়া'-র দোকান। বাঁশের গোটা চারেক খুঁটি পুঁতে, দরমার বেড়া দিয়ে, একটা মেক-শিফট ছাউনি মতো করে আমাদের পাড়ার নারাণদা হয়ে গেলেন খাঁটি মোয়া-প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতা। এমনিতে তিনি রাজমিস্ত্রিদের যোগাড়ের কাজ, আর লোকেদের ফাই-ফরমাশ খেটে বেড়াতেন। হঠাৎ কি করে যে তাঁর মধ্যে ময়রার এক্সপেরিয়েন্স এসে গেলো, তা বোঝা গেলো না। গিয়ে ঢুঁ মারলাম একদিন তাঁর দোকানে - দেখি গোটা দু-তিন জন লোককে কোথা থেকে ধরে এনে তিনি হেঁকে-বকে, খুব করে নির্দেশ দিয়ে চলেছেন। বিশাল একটা লোহার কড়াইতে অনেকটা গুড় ঢেলে, তার মধ্যে গুচ্ছের চিনি ঢেলে, কাঠের বড়ো একটা হাতা দিয়ে খুব কষে ঘাঁটা হচ্ছে, যদিও গুড় থেকে খুব বেশি একটা সুবাস বার হচ্ছেনা। আমি এদিক-ওদিক দেখে বিজ্ঞের মতো বললাম, "এটা কি ভালো হলো নারাণদা? গুড়টা তো পাতি সোনারপুর বাজার থেকেই কেনা বলে মনে হচ্ছে - আর খইগুলো দেখে মোটেই 'কনকচুড়' চালের খই বলে মনে হচ্ছে না। তা, তুমি কোন আক্কেলে এই দোকানের নাম রাখলে 'জয়নগরের মোয়া'?" - নারাণদা ফিক করে একটু হেসে বললেন: "অ্যাতো সব জানো, অ্যাতো বুদ্ধি ধরো - আর এইটুকু জানো না যে শীত এলে আমি আমার নাম চেন্জ করে 'নগর' করে নিই?" -  আমি কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম: 'তার মানে?' - তিনি আমার থুতনিটা তাঁর গুড়-মাখা হাতে একটু নেড়ে দিয়ে বললেন: "ওরে বোকা, আমারই তো এখনকার নাম হলো গিয়ে 'নগর' - আর এসব তো আমারই মোয়া, অর্থাৎ হলো কিনা 'নগরের মোয়া' - তার আগে ছোট্ট করে শুধু একটা 'জয়' জুড়ে দিয়েছি, এতে দোষটা দেখলে কোথায়?" - তার পর আমার হাতে, শালপাতায় মুড়ে একটা ক্যাম্বিস বলের সাইজের বিশাল মোয়া ধরিয়ে দিয়ে বললেন, "এই নাও, এটা নিয়ে এখন কাটোতো বাপু!  ম্যালা কাজ পড়ে আছে আমার !!"
শীতের রোদ্দুরে সেই ফ্রী-তে পাওয়া মোয়াতে কামড় বসিয়ে আমি হাঁটতে লাগলাম। খেতে দিব্যিই লাগলো - সুস্বাদু মোয়ার আবেশে চোখ বুজে আমি মনে মনে বলে উঠলাম, 'জয়!  নগরেরই হোক তবে জয় !!'

No comments:

Post a Comment