হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় ঘটে বাংলাদেশী BTV চ্যানেলে প্রচারিত হওয়া ধারাবাহিক নাটক 'এইসব দিনরাত্রি' চলাকালীন। বাড়িতে মেজদা তখনো চাকরি পায় নি, তাই শিয়ালদহের কোনো একটা সংস্থায় রেডিও-টিভি রিপেয়ারিং শেখার ট্রেনিং কোর্স শুরু করে দিয়েছিলো। বেশ কয়েকটা ভালো রেডিও খারাপ করে করে হাত পাকানোর পর মেজদা চলে এলো টিভি সারানোতে। শুরু করলো একদম হাতে করে টিভি বানানো, যাকে বলে 'Starting from scratch' - চাঁদনী চক থেকে কিনে আনা হলো একগাদা যন্ত্রপাতি - মাদার বোর্ড, ধ্যাবা পিকচার টিউব, অজস্র ট্রানজিস্টার, ক্যাপাসিটার, ভাল্ব, গালা, কয়েল, সোল্ডারিং ইনস্ট্রুমেন্ট, আরও কত্তো কি ! মাস খানেক লেগে গেলো সেই টিভিতে প্রথম ছবি আসতে। প্রথমে হিজিবিজি, ঝিলঝিলে ছবি, তারপর শব্দহীন ছবি, শব্দ-আছে-কিন্তু-ছবি-নেই ছবি, তারপরে কনস্টান্ট কাঁপুনি-ধরা ছবি, ১৮০ ডিগ্রী উল্টোনো ছবি, এরপর মাথা-সরু-দেহ-মোটা কিম্ভুৎকার ছবি, হতে হতে একসময় ছবির কোয়ালিটি কিছুটা স্টেবিলাইজ হোলো। ততোদিনে চোখ কুঁচকে দেখা অভ্যেস করতে করতে নরমাল চোখে টিভি দেখা প্রায় ভুলে যেতে বসেছি। তার উপর বড়ো একটা আয়না হাতে ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে থেকে হাতের মাসলগুলো সব ব্যায়াম ছাড়াই ফুলে উঠতে শুরু করেছে ! অন্যদিকে সোল্ডারিং করতে গিয়ে ছ্যাঁকা খেয়ে খেয়ে মেজদার বাঁ-হাতের আঙুলগুলোতে বসন্ত রোগের মতো অনেক দাগ দেখা দিয়েছে। কিন্তু সে সব দেখে মনে দু:খের বদলে 'যেমন কর্ম তেমন ফল' টাইপের ভাবই আসতো। যাই হোক নিজের হাতে করা যেকোন জিনিষের মূল্যই আলাদা - হোক না সে সাদা-কালো গোদা টাইপের এক টিভি। বাড়ির ছাদে লাগানো হলো একটা বুস্টার অ্যান্টেনা - শুরু হলো আমাদের বাংলাদেশী প্রোগ্রাম দেখা। অবশ্য সেসময় কলকাতা টিভিতে লোকাল চ্যানেল ছিলো একটাই - তাই বহু বাড়িতেই বুস্টার অ্যান্টেনা লাগিয়ে বাংলাদেশী প্রোগ্রাম দেখার চল ছিলো। 'নাইট রাইডার', 'স্ট্রিট হক', 'A TEAM', 'ম্যাক গাইভার'-এর মতো পপুলার মার্কিনি সিরিয়ালগুলো BTV তখন নিয়মিত দেখাতো।
যাই হোক 'এইসব দিনরাত্রি' যখন দেখতাম তখনও আলাদা করে নাট্যকার বা ডিরেক্টরের নাম জানার তেমন প্রয়োজন বোধ করিনি, যদিও ওই নাটকের প্রতি অদ্ভুত একটা টান ঠিকই অনুভব করতাম। কিন্তু তারপরে যখন 'কোথাও কেউ নেই' শুরু হলো তখন একপ্রকার বাধ্য হয়েই নাট্যকারের নাম জেনে নিলাম। এরপর 'বহুব্রীহি' আর 'নক্ষত্রের রাত' চলাকালীন তো আমাদের কলকাতা টিভি দেখার পার্ট তুলে দিতে হলো। নাটকের প্রতিটি চরিত্র: আবুল হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, আলী যাকের, জাহিদ হাসান, আফজাল হোসেন, আবুল খায়ের - সবাইকেই ভয়ানক ভাবে রক্ত-মাংসের জীবন্ত বলে মনে হতে লাগলো। মা-বাবা থেকে শুরু করে বাড়ির সকলে, এমন কি বাড়ির কাজের মেয়েটি পর্যন্ত উন্মুখ হয়ে বসে থাকতো কখন সেই নাটকগুলোর নেক্সট এপিসোড দেখবে বলে। খুব সম্ভবত প্রতি বৃহস্পতিবার রাত আটটা থেকে ধারাবাহিক নাটকগুলো শুরু হতো - চলতো বোধহয় ৪৫ মিনিট, কি এক ঘন্টা। মাঝে মাঝে বেশ কিছু বিজ্ঞাপণ হতো, তখন আমাদের বিরক্তির আর শেষ থাকতো না। মেজদার ঘরটা ছিলো এমনিতেই বেশ ছোটো - তো ওই নাটক চলাকালীন সেই ঘরটার অবস্থা হতো দেখার মতো। বিয়ে বাড়িতে রাতে শোবার মতোই 'যে-যেখানে পারি' আমরা বসে পড়তাম কোনো রকমে। কম করে ন'জন মিলে একসাথে বসে (এবং কখনো কখনো দাঁড়িয়ে) আমরা ওই নাটক দেখতাম। এর বছরকয়েক পরে কলকাতা বইমেলা থেকে বেশ কিছু হুমায়ুন আহমেদের বই কিনেছিলাম - তার মধ্যে অবশ্যই 'বহুব্রীহি' ছিলো। তার পরে আস্তে আস্তে পরিচয় ঘটলো 'হিমু' আর 'মিসির আলী' ক্যারেক্টার দুটোর সাথে। 'হিমু'র সাথে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'নীললোহিত' ক্যারেক্টারের কিছুটা মিল আছে - তবে 'হিমু' আরো কেয়ার-ফ্রি টাইপের নির্লোভ উদাস, আরও অনেক বেশি রোমান্টিক, একই সাথে দার্শনিক ও ফানি, এবং আন-প্রেডিক্টেবল। আবার 'মিসির আলী' ক্যারেক্টারটা ঠিক তার উল্টো! যুক্তিবাদী কঠোর, কঠিন একজন মানুষ - সায়েন্স ও ফিলোসফিকাল লজিকে ভরপুর। এই দুই ক্যারেক্টারের টানাপোড়েনে আমার টিন-এজড চিন্তা-ভাবনা আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। নিজেকে 'হিমু' বলে মনে করার সাথে সাথে, আশেপাশের সমবয়সী মেয়েদের মধ্যে হিমু-র প্রেমিকার ('রূপা') মিল খোঁজার চেষ্টা শুরু হলো !!
একবার মনে আছে ইউনিভার্সিটিতে গ্রাজুয়েশান পড়াকালীন কোনো একটা সেমিস্টারের প্রিপারেশান নিচ্ছি - পরীক্ষার আর মাত্র কয়েকদিন বাকি, অথচ অনেক কিছুই কভার করা হয়নি। এদিকে হিমুর একটা নতুন প্রেমের উপন্যাসও (খুব সম্ভবত 'ময়ূরাক্ষী' বা 'দরজার ওপাশে') একই সময়ে পড়া শুরু করেছি - ভেরি ভেরি ব্যাড টাইমিং। তখন বর্ষাকাল চলছে - ভরদুপুর বেলাতেই আকাশ কালো করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে - দেখে মনে হয় যেন ঘোর সন্ধ্যা নেমে এসেছে। যথারীতি লোডশেডিংও শুরু হয়ে গিয়েছে। দোতলার কোনের ঘরেৱ সমস্ত জানালা-দরজা বন্ধ করে আমি হ্যারিকেন জ্বেলে বিছানায় বসে পরীক্ষার পড়া শুরু করেছি। কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারছি না - কেবল মনে হচ্ছে উপন্যাসটার আর একটা চ্যাপ্টার পড়ে নিই, তারপর পরীক্ষার পড়া শুরু করবো। সুতরাং আবার পড়ার বই ছেড়ে গল্পের বই ধরি। তিন-চার বার এই একই পড়ার-বই-থেকে-গল্পের-বই-পড়ার খেলা চললো। নিজের উপরে নিজেরই বিরক্ত লাগা শুরু হলো - কিন্তু কিছুতেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। অবশেষে ঠিক করলাম যা হবার হবে, আগে উপন্যাসটার শেষ দেখে নিই, তারপর তেড়েফুঁড়ে পড়া শুরু করবো। অত:পর টানা দু-ঘন্টা ধরে সেই গল্পের বইটা পড়ে শেষ করলাম, তার পর পরীক্ষার পড়া শুরু হলো। সেই পরীক্ষার রেজাল্ট কি হয়েছিলো তা এখন আর মনে নেই, কিন্তু মনের সেই দোদুল্যমান অবস্থার কথা আজও ভুলিনি। মনে হয় আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই বিভিন্ন সত্তার একাধিক ক্যারেক্টার লুকিয়ে থাকে - সময় বুঝে সাব-ডিউইব্ড ক্যারেক্টারগুলো মাঝে মাঝে আত্মপ্রকাশ করে।
এরপর নিয়মিত ভাবে হুমায়ুন আহমেদের লেখা ফলো করতে লাগলাম - তাঁর লেখা প্রায় সবকটা গল্প-উপন্যাস কিনে ঘর ভরিয়ে ফেললাম। বইমেলা ছাড়াও কলেজ স্ট্রীটের একটা বাংলাদেশী প্রকাশনার দোকানে নিয়মিত যাতায়াত শুরু হোলো। কলকাতার 'প্রতিভাস' পাবলিকেশন থেকেও তাঁর কিছু উপন্যাস ছাপানো হয়েছিলো। পরের দিকে অবশ্য তাঁর লেখাগুলো কিছুটা একঘেয়ে লাগতো। হিমু ক্যারেক্টারও কিছুটা প্রেডিক্টেবল হয়ে উঠেছিলো, প্লাস ঘটনাগুলোর বিষয়বস্তু বা ভেরিয়েশানেরও অভাব দেখা দিয়েছিলো। কিন্তু তা স্বত্তেও হুমায়ুন আহমেদ চলে যাবার পর থেকে বাংলা রোমান্টিক গল্প পড়ার আকর্ষণ অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছি। একজন লেখক যে কত রকম দৃষ্টিকোণ থেকে জীবন ও জগৎ দেখেছেন, প্রকৃতির অপার রহস্য, ভূত ও বিজ্ঞান যে কত রকমভাবে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন, তা তাঁর বিভিন্ন লেখার মধ্যে ফুটে উঠেছে। এ রকম জাদুকরী কলম বাংলা সাহিত্যে খুব বেশী আসেনি। নি:সন্দেহে তিনি এই সময়কার অন্যতম শক্তিশালী লেখক ও ঔপন্যাসিক। ওপার বাংলার তো বটেই, এমন কি দুই বাংলা মিলিয়েও তিনি সেরা দশ জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে স্বচ্ছন্দে চলে আসবেন।
~~~ শুভ জন্মদিন Humayun Ahmed ~~~
No comments:
Post a Comment