মানুষের জীবদ্দশায় তার নানান রকমের নাম থাকে - বাবা-মায়ের দেওয়া ফরম্যাল নাম, ডাক নাম, নিক-নেম, মামা-দাদু-পিসী-মাসীদের দেওয়া আদরের নাম, বন্ধুদের দেওয়া হ্যান্ডফুল নাম, প্রেমিকার দেওয়া সোহাগের নাম, বৌয়ের দেওয়া গলু-মলু নাম, পাবলিকের দেওয়া বদনাম, আরও কতো নাম!! কিন্তু মানুষ মরে যাবার পর তার "একটাই" নাম হয়ে যায়, সেটা হলো 'body' বা সোজা বাংলায় 'লাশ' বলে যাকে। তো সেই লাশ নিয়ে রাত কাটানো মুখের কথা নয়, অনেক সাহসের দরকার পড়ে। ভাগ্যের একান্ত ফেরে না পড়লে সেরকম রাত কেউ কাটাতে চায় বলে আমার বিশ্বাস হয় না। কিন্তু মাথা ঘুরে কেউ যদি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়, তখনও কি তাকে 'লাশ' বলা চলে? তা যদি হয় তো, লাশের সাথে আমি কাটিয়েছি বেশ কিছুটা সময় - 'রাত' হয়তো ঠিক নয়, তবে 'ক্লাস' বলা চলে।
ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ড থেকে গ্রাজুয়েশনের জন্যে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে প্রথম যে সমস্যার সম্মুক্ষীণ হয়েছিলাম, সেটা হলো সেমিস্টার সিস্টেমে পরীক্ষার ব্যবস্থা। অর্থাৎ প্রতি ছয় মাস অন্তর পরীক্ষা, এবং প্রতিটি পরীক্ষাই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মানে হাফ-ইয়ার্লি বলে রিলাক্সড থাকার কিছু নেই - প্রতিটি পরীক্ষাই ফাইন্যাল। অবশ্য এ সমস্যা আমার মতো আরও অনেকেরই হয়েছিলো। আমরা কয়েকজন গ্রুপ করে, নিজেদের মধ্যে নোটস আদান-প্রদান করে সব পরীক্ষার প্রিপারেশন নিতাম। এ ঘটনার সূত্রপাত সেকেন্ড ইয়ার চলাকালীন - তখন পরীক্ষা প্রায় আসন্ন। আমরা সব সিরিয়াস হয়ে উঠেছি, সিনিয়রদের কাছ থেকে নোটস যোগাড় করে রীতিমত আলোচনা শুরু করে দিয়েছি। এসময়ই আমাদের এক ক্লাসমেট, তার আসল নাম এখন ভুলে গেছি, যাকে আমরা 'মামা' বলে ডাকতাম, সে এসে আমাদের গ্রুপে ঢুকতে চাইলো। মামা ছিলো বয়সে একটু বড়ো, নাদুস-নুদুস চেহারা, আর 'গুল' দিতো বেশ ভালোই। সে কাঁচুমাচু মুখে তার সমস্যা নিয়ে এসে হাজির হলো। সমস্যাটি হলো সে নাকি কিছুতেই রাত-জেগে পড়াশোনা করতে পারছে না। রাত দশটার পর তার চোখে অবশ্যম্ভাবী ভাবে ঘুম নেমে আসছে - আর সে ঘুম যেন মরণের ঘুম। অবশ্য এ সমস্যা নতুন কিছু নয়, আমাদের সবারই কম-বেশি হতো, বা হয় এখনো। পরীক্ষা যত কাছে চলে আসে, ঘুমও ততো চোখের পাতায় ভর করে বসে - এটা অনেকটাই মেন্টাল সমস্যা। আমার মনে আছে "Mr. Bean"-এ রন অ্যাটকিনসন ঘুম তাড়ানোর জন্যে প্রথমে তার চোখের পাতায় scotch tape আটকে ট্রাই করেছিলো, কিন্তু সেটাতেও কাজ না-হওয়ায় শেষ অবধি আলপিন দিয়ে চোখের পাতাদুটোকে তার কপালে ভ্রুয়ের সাথে আটকে রাখে !! কিন্তু সে 'ব্রিটিশ সমাধান' মামা কাজে লাগাতে পারবে না বলে, আশ্বাস দিয়ে বললাম, যে অনেক করে চা-কফি খা, না-হলে কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর বিড়ি-সিগারেট ফোঁক - নিশ্চয়ই কাজ হবে। কিন্তু মামা জানালো যে এই সবকিছু সে অলরেডি ট্রাই করে দেখেছে - কিস্যু হয়নি, বরং আরও বেশি বেশি করে তার চোখে ঘুম চলে এসেছে। আমার আরেক ক্লাসমেট, সে আবার "হাততালি-নেশা", অর্থাৎ 'খৈনি'তে ঘোর বিশ্বাসী ছিলো। যতদুর মনে পড়ে 'রাজা খৈনি'ই সে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতো সে সময়। তো সেই অত্যাধিক খৈনি সেবনের কারণে তার নিচের ঠোঁটটা সবসময় ফুলে থাকতো। প্রথম প্রথম দেখতে একটু অস্বস্তি লাগলেও, পরে সেটা আমাদের চোখ-সয়ে গিয়েছিলো। সে-ই মামাকে সাজেশন দিলো যে 'খৈনি' ট্রাই করে দেখতে - হাতেনাতে অব্যর্থ ফল সে পাবেই পাবে। মামাও উৎসাহিত হয়ে তার কাছ থেকে কার্যকরী খৈনির ব্র্যান্ড, তার অনুপানের মাত্রা, প্রস্তুত প্রণালী, সেবনের পদ্ধতি, সময়কাল ইত্যাদি সব ডিটেলসে জেনে নিয়ে, একটুখানি স্যাম্পেল তার কাছ থেকে নিয়ে তখনি ট্রাই করবে কিনা ভেবে দোনামনা করতে লাগলো। সেটা ছিলো একটা অফ-পিরিয়ড, পরের ক্লাসের জন্যে আমরা সবাই ওয়েট করছি। তো আমরা সবাই তাকে অভয় দিলাম যে খুবই ভালো বুদ্ধি এটা - আর সামান্য একটু ট্রাই করে দেখলে কোনো ক্ষতি নেই, বরং সে অনেক বেশি energized ফিল করবে। মামা এতোদিনে আমাদের অনেক 'হ্যান-করেঙ্গা, ত্যান-করেঙ্গা' বলে গুল দিয়ে এসেছে। কার্য্যকালে এসে দেখা গেলো বেসিক্যালি সে বেশ ভীতু আর নার্ভাস টাইপের ছেলে, যাকে বলে নিখাদ বাঙালি। যাই হোক আমাদের সবাইয়ের মিলিত অভয়্দানে কিছুটা ভরসা পেয়ে সে সামান্য একটু খৈনি আর চুন ভালো করে ডলে ডলে, 'জয় মা' বলে হাততালি মেরে, তার তলার ঠোঁটটার নিচে ঢুকিয়ে দিলো। তাকে নির্দেশ দেওয়া ছিলো কিছুক্ষণ ওয়েট করে, সামান্য একটু ঢোঁক গেলার। কিন্তু তারপর আল্টিমেটলি যা ঘটলো সেটা ঠিক লিখে প্রকাশ করা যাবে না, বরং হ্যান্ডিক্যামে রেকর্ড করা থাকলে ভালো হতো। মামার চোখ দুটো ফুলে গোল-গোল আর লাল হয়ে উঠলো। ঘড়ির পেন্ডুলামের দুলুনির ভঙ্গিতে সে তার মাথাটা সামান্য করে দোলাতেই থাকলো - ধীরে ধীরে দুলুনির স্পিড বাড়তে থাকলো। তারপর আমাদের সকলকে হতবাক করে দিয়ে, 'অ্যা-আ-ওঁ-ওঁ-ক' করে বেঞ্চে লুটিয়ে পড়লো। ঘটনাটা শুনতে যতোটা মজার, বাস্তবে কিন্তু ততোটা মজার হয়ে ওঠেনি আমাদের কাছে। শক খেয়ে উঠে আমাদের মাথায় সর্বপ্রথম চিন্তা এলো যে ব্যাটা মরে যায় নি তো? কিন্তু তার কানের তলায় আর নাকের নিচে হাত দিয়ে আমাদের ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এলো - নাহ: বেঁচে আছে ঠিকই - শুধু একটু ভিরমি খেয়েছে মাত্র !!! তখন আমাদের হাসি দেখে কে !!
এদিকে আমাদের স্যারের আসার সময় তখন হয়ে এসেছে। আমাদের ক্লাস হতো দোতলায়, স্যার আসতেন অন্য এক বিল্ডিং থেকে। কে একজন দৌড়ে হলের বারান্দায় গিয়ে দেখে এসে জানালো যে স্যার প্রায় আমাদের বিল্ডিংয়ের সামনে চলে এসেছেন। এদিকে আমরা মামার সেই অচেতন বডি নিয়ে কি করবো ভেবে পেলাম না। তখন আমদের ক্লাসরুম ছিলো গ্যালারি প্যাটার্নের। একজন বুদ্ধি দিলো যে মামাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে একদম উপরের সারির বেঞ্চের নিচে শুইয়ে রেখে আসা যাক - কারোর নজরে চট করে পড়বে না। আর হোপফুলি ক্লাস চলাকালীন মামারও জ্ঞান ফিরে আসবেনা - at least let's pray for that - যেই বলা সেই কাজ। চারজনে মিলে মামার দুই হাত-পা ধরে, চ্যাংদোলা করে তুলে, কোনমতে একদম উপরের সারির বেঞ্চের নিচে শুইয়ে রেখে এসে, ভালো ছেলের মতো আমরা দ্রুত যে-যার জায়গায় বসে পড়লাম। যথারীতি স্যার এসে ক্লাস নেওয়া শুরু করলেন। তাঁর নজর অতো দূর অবধি গেলো না, যাবার কোন কারণও ছিলো না - কারণ সেই গ্যালারিতে প্রায় আশি জনের বসার সিট ছিলো, কিন্তু আমাদের ক্লাসে টোটাল স্টুডেন্ট ছিলো পঁয়ত্রিশজনের মতো। সুতরাং স্যারের সন্দেহ করার কোনো কিছু ছিলো না। কিন্তু একটা কিছু যে ঘটে চলেছে সেটা তিনি আঁচ করতে পেরে মাঝে মাঝেই লেকচার বন্ধ করে, আমাদের দিকে কিছুক্ষন ধরে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। সেই প্রথম, আমরা ছেলেরা, একের পর এক প্রশ্ন করে করে তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললাম। আমাদের এতো উৎসাহ দেখে, আর অগুন্তি প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে স্যার পর্যন্ত অবাক হয়ে গেলেন - কিছুটা খুশীও হলেন। এইভাবে কোনমতে হাসি চেপে, আর তীব্র মনোযোগ দেখিয়ে আমরা সে পিরিয়ডটা কাটিয়ে দিলাম।
ক্লাস শেষ হয়ে গেলে জলের ছিটে দিয়ে দিয়ে মামার জ্ঞান ফেরানো হলো।পুনর্জীবন পেয়ে মামার সে হম্বি-তম্বি দেখে কে তখন! আমাদেরকে ধরে এই মারে তো সেই মারে! কিন্তু দোষটা পুরোপুরি আমাদের নয়। সামান্য খৈনির ঝাঁজ যে সে সহ্য করতে পারবেনা তা কে জানতো ! নিজের হাতে করে সে ডলে ডলে, নিজের বুদ্ধিতেই খৈনিটা খেয়েছে - তো আমরা যদি দোষী হই, তো সেও কম দোষী কিছু নয়। এই সব আবোল-তাবোল যুক্তি দেখিয়ে তাকে সেদিনের মতো কোনরকমে থামানো হলো। বলাবাহুল্য সেবারের পরীক্ষায় মামা সবকটা পেপার ক্লিয়ার করতে পারেনি - দুটো না তিনটেতে 'রিপিট' পেয়ে গেছিলো। হাততালি-নেশা তাকে সে যাত্রায় বাঁচাতে পারেনি। কিন্তু ক্লাসে থাকা মেয়েদের দল সেদিন 'giggling' কাকে বলে তা হাড়ে হাড়ে আমাদের বুঝিয়ে ছেড়েছিলো।
ক্লাস শেষ হয়ে গেলে জলের ছিটে দিয়ে দিয়ে মামার জ্ঞান ফেরানো হলো।পুনর্জীবন পেয়ে মামার সে হম্বি-তম্বি দেখে কে তখন! আমাদেরকে ধরে এই মারে তো সেই মারে! কিন্তু দোষটা পুরোপুরি আমাদের নয়। সামান্য খৈনির ঝাঁজ যে সে সহ্য করতে পারবেনা তা কে জানতো ! নিজের হাতে করে সে ডলে ডলে, নিজের বুদ্ধিতেই খৈনিটা খেয়েছে - তো আমরা যদি দোষী হই, তো সেও কম দোষী কিছু নয়। এই সব আবোল-তাবোল যুক্তি দেখিয়ে তাকে সেদিনের মতো কোনরকমে থামানো হলো। বলাবাহুল্য সেবারের পরীক্ষায় মামা সবকটা পেপার ক্লিয়ার করতে পারেনি - দুটো না তিনটেতে 'রিপিট' পেয়ে গেছিলো। হাততালি-নেশা তাকে সে যাত্রায় বাঁচাতে পারেনি। কিন্তু ক্লাসে থাকা মেয়েদের দল সেদিন 'giggling' কাকে বলে তা হাড়ে হাড়ে আমাদের বুঝিয়ে ছেড়েছিলো।
Waao !!! Great story !!
ReplyDelete