Tuesday, November 19, 2013

ছেঁড়া ঘুড়ি, রঙিন বল, এইটুকুই সম্বল...

অবশেষে শীত এলো এদেশে, সাথে নিয়ে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। প্রথম প্রেমের মতোই, প্রথম শীতের ধাক্কায় যথারীতি হাবুডুবু খাচ্ছি আমি। ঠান্ডা লেগে জ্বর-জ্বর ভাব, মাথা ভোঁ-ভোঁ শুরু হয়েছে, স্মার্ট মনিটরে ফুটে ওঠা source code গুলোকে দেখে মনে হচ্ছে সব কালো কালো স্মার্ট পিঁপড়ের দল  - দিব্যি হেসে-খেলে, নেচে-গেয়ে বেড়াচ্ছে। 'লোহা লোহে কো কাটতা হ্যায়' - সুতরাং গব্বরের মতো এই শীতকে কাবু করতে আমার চাই আরেকটা শীতল কোন কিছু। তবে এই মুহুর্তে হাতের কাছে 'শীতের গান' ছাড়া অন্য কিছুতে ভরসা রাখতে পারছিনা। 

শীতের গানের কথা ভাবলেই মাথায় প্রথমে আসে আশা ভোঁসলের গাওয়া সেই গানটা: "একটা দেশলাই কাঠি জ্বালাও, তাতে আগুন পাবে..." - এরকম witty অথচ meaningful গানের কথা খুব একটা দেখা যায় না। এই গান শীতকালের না-হয়ে যেতেই পারে না। নির্ঘাৎ কোনো এক শীতের সকালে গানের গীতিকার প্রাত:কালীন প্রেশার আনতে গিয়ে হাতের কাছে কোনো দেশলাই না-খুঁজে পেয়ে, চরম আক্ষেপে এটি লিখে ফেলেছিলেন। পরে একটু সেন্টিমেন্টাল রং-টং চড়িয়ে প্রেমের গান হিসাবে দিব্যি চালিয়ে দিয়েছেন। গানের মধ্যে দেশলাই কাঠি জ্বালানোর সেই 'ফসসজজসস....' আওয়াজ দেওয়ার বুদ্ধিটা যার মাথা থেকে বেরিয়েছে তিনিও এক 'নমস্য ব্যক্তি' - তবে আমি শিওর সেই ব্যক্তি কোনমতেই R. D. Burman নন - most probably স্বপন চক্রবর্তী, যিনি  R. D. সাহেবের গানের 'Interlude Music' গুলো কম্পোজ করতেন। গানের মুখড়ার কয়েক লাইন পরে যখন আশা-দি সুরের চড়ায় উঠে গিয়ে বলেন: "তবুও, আমায় তুমি পাবে না, আমায় তুমি পাবে ন-ন্যা..." শুনে মনে হয় এরকম একটা আগুনে-প্রেমিকা থাকলে ভালোই হতো। প্রেমাগুন দিয়ে at least শীতকালের হীটারের খরচ কিছুটা কমানো যেতো ! 
এই দেশলাই কাঠির কথাতেই মনে পড়ে গেলো ছোটবেলায়, যখন ফোর কি ফাইভে পড়ি তখন একটা হুজুক উঠেছিলো, যেটা ক্রমশই সংক্রামক ব্যাধির চেহারা নিয়েছিলো, সেটা হলো দেশলাই বাক্সের কভারগুলো জমানো। পুরানো পিচবোর্ডের মলাট লাগানো খাতার পাতাতে গঁদের আঠা দিয়ে লাগানো হতো এই সব কভারগুলো। কখনো কখনো আমরা ডুপ্লিকেট কভারগুলোকে অন্যের সাথে ট্রেড করে নিতাম। বাড়িতে যখন বাবা দিনের পর দিন সেই একই, বোরিং লাল 'জাহাজ মার্কা' দেশলাই নিয়ে আসতেন, তখন কি রাগ আর বিরক্তি হতো। বলতাম: 'অন্যের বাবারা তো কত নানান ধরনের দেশলাই কেনেন - তুমি কেনো না কেন?' - বাবা মুচকি মুচকি হাসতেন আর বলতেন 'আচ্ছা, আচ্ছা হবে - নেক্সট টাইমে ঠিক হবে' - তো সেই নেক্সট টাইম আর সহজে আসতো না। আমাদের পুকুরের অন্যদিকের বাড়ির অধিকারীদের ছেলেটা আবার এইসব কভার লুকিয়ে লুকিয়ে বিক্রি করতো। কভার যত রেয়ার হবে, দাম তত বেশী। আমি কিছু না হলেও at least গোটা ত্রিশেক কভার তার কাছ থেকে কিনেছিলাম। যখের ধনের মত আগলে রাখতাম এই কভার গুলোকে। ইস্কুলে নিয়ে গেলেও টেনশান, কেউ যদি নিয়ে নেয়, বিশেষ করে স্যারেদের চোখে পড়লে তো আর রক্ষা নেই। আবার না নিয়ে গেলেও প্রেস্টিজ পুরো পাংচার,  দেখাতে হবে না, যে কতোগুলো জমলো আমার। পরীক্ষায় কিছু নম্বর কম পেলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু দেশলাই কালেকশনে যদি নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে টপকাতে না পারি, তো ফ্রাষ্টু খাওয়ার চোটে কেস দফারফা। ছাতা, মোটর গাড়ি, মশাল, জাহাজ, পিস্তল, বরফি, লাট্টু, নৌকা, তাসের হরতন, রাজা, ঘন্টা... আরো কত্তো নানান ব্র্যান্ডের দেশলাই কভার হতো সেই সময়। একসময় কোত্থেকে ধুয়ো উঠলো যে চারশ'টা ইউনিক কভার জমা দিলে একটা রেডিও, না টিভি ফ্রী-তে পাওয়া যাবে। শুনে আমাদের সে কি উত্তেজনা - বাড়ির বড়োদেরকে দিয়ে দেশলাই কেনানোর হিড়িক পড়ে গেলো। কারোর মাথাতে একবারও এলোনা যে কোথা থেকে সেই প্রাইজ দেওয়া হবে, কারা প্রাইজ দেবে, কেনই বা দেবে, সে'সব ডিটেলস ভেরিফাই করানোর কথা!! দেশলাই বাক্স দ্রুত শেষ করানোর জন্যে আমি মাঝে মাঝে মায়ের চোখের আড়ালে দেশলাই বাক্স থেকে এক গোছা কাঠি তুলে নিয়ে উনুনের মধ্যে ফেলে দিতাম। মুহুর্তের মধ্যে আগুনের এক ঝলকে, দপ করে জ্বলে উঠে শেষ হয়ে যেতো তারা। তারপর নিজেই বলতাম যে একটা দেশলাই কিনে আনবো? মা শুনে অবাক হয়ে বলতেন 'এই তো সেদিন স'বে মাত্র একটা বার করলাম !!'


আবার কখনো কখনো কয়েকটা আস্ত দেশলাই বাক্স একসাথে নিয়ে, তাদেরকে পাশাপাশি রেখে, ইলাস্টিক-ব্যান্ড (গাডার) দিয়ে আটকে পিস্তল বানিয়ে খেলাও বেশ পপুলার ছিলো - বিশেষ করে কালীপূজার সময়ে। টিনের বা মেটালের তৈরী ক্যাপ-পিস্তল তখন এতোটা সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি, অন্তত সাধারণ মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে তো নয়ই। যতদূর মনে পড়ে অর্ডিন্যারি দেশলাইগুলোর দাম ছিলো পনেরো পয়সা, আর যদি মোমের-কাঠি হয় তো দাম কুড়ি, কি বড়জোর পঁচিশ পয়সা ! মোমের দেশলাই বাক্সগুলো ছিলো আকারে একটু ছোট, কাঠিগুলো বেশ মসৃণ ধরণের, আর জ্বলতো অনেকক্ষণ ধরে। একবার রবিবারের সকালে বাবার সাথে বাজার করতে গিয়েছি - বাবা তার এক পুরানো বন্ধুর সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। হঠাৎ সেই বন্ধুটি পকেট থেকে দেশলাই বের করে ফস করে জ্বেলে একখানা সিগারেট ধরালেন। আমি তো তাঁর হাতের সেই অনামী ব্র্যান্ডের দেশলাইখানা দেখে ঈর্ষায় বেশ জ্বলছি। একসময় আর থাকতে না পেরে, শেষমেষ বলেই ফেললাম: 'কাকু, দেশলাইটা আমায় দেবেন ?' - আমার একথা শুনে তিনি তো বটেই, এমনকি বাবা পর্যন্ত হা-হয়ে গেলেন। আমি বেগতিক দেখে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম : 'না মানে, আসলে দেশলাইয়ের কভার জমাই তো, খাতায় আঠা দিয়ে সব আটকে রাখি। আপনার দেশলাইটা আমার কাছে নেই, তাই পেলে ভালো হয়  - তাহলে বোধ হয় আমার দু'শোটা কমপ্লিট হয়ে যাবে' - সেদিন বাড়িতে ফিরে এসে যা বকা খেয়েছিলাম !!!

অবশ্যম্ভাবী পরিণতি রাস্তায় মুখ গুঁজে, শকুনের নজরে চলা। বিশেষত বাজার কিংবা বাসষ্ট্যান্ড এলাকাগুলোতে। পাঁক-কাদা, কফ-থুথু, পান-গুটকার পিক, হিসি, গোবর – কোন আনহাইজেনিক বর্জ্য পদার্থের সাধ্যি ছিলোনা আমাদের দেশলাই অন্বেষণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর। একহাতে নাক ঢেকে অন্য হাতে কাঠি দিয়ে নেড়ে-চেড়ে  দেশলাইবাক্স খোঁজার কাজে আমাদের জুড়ি ছিলো না। পরীক্ষার শেষে বা পুজোর ছুটিতে কখনো বাইরে বেড়াতে গেলে, বন্ধুরা আগে থেকে সব অগ্রিম বুকিং দিয়ে রাখতো - আমিও তাই করতাম। একবার পুরীতে বেড়াতে গিয়ে আনন্দে দশখানা হয়ে বড়দের চোখ এড়িয়ে, রাস্তাঘাট থেকে জমিয়ে কতো যে দেশলাই কুড়িয়েছি, কিনেওছিলাম অনেককটা। এমনও হয়েছে, একই দোকান থেকে তিন-চার রকমের দেশলাই কিনে দোকানদারের চোখ ছানাবড়া করে দিয়েছি। 

গতবছরে দেশে ফিরে মায়ের ঘরের পুরানো কাঠের বাক্সটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎই পেয়ে গেলাম, বা বলা ভালো আবিষ্কার করলাম পুরানো দিনের সেই প্রিয়, অতি-প্রিয় দেশলাই-জমানোর খাতাটা। ক্লাসে এইটে ওঠার পর থেকে ওটার প্রয়োজন ধীরে ধীরে কমে গিয়েছিলো। দীর্ঘ পঁচিশবছরের সময়ের ভারে, বয়সের চাপে, অনাদরে অবহেলায় মায়ের মতোই সে এখন হয়ে উঠেছে মলিন বিবর্ণ, ধুলোর আস্তরণে হয়ে উঠেছে আরও পুরু। হঠাৎ করে খাতাটার জন্যে বড়ো মায়া হলো - সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়া আবেগগুলো এক ঝটকায় উদ্গারিত হলো যেন। কতো-কি স্মৃতি মনে পড়ে গেলো ! ছেলেবেলার বকুনি খাবার কথা, স্কুলের নানান দৌরাত্ম্যির কথা, বন্ধুদের সাথে মিলে করা হাজার কান্ড-কারখানার কথা - মা-বাবা, দাদা-দিদিদের কথা, যারা দিনের পর দিন আমাকে নি:স্বার্থে ভালোবেসে, হাজার ঝক্কি সামলিয়ে মানুষ করে তুলেছিলেন। হঠাৎ কি জানি হলো, জলভরা চোখে আমি দেখলাম সেটাতে আর এক ফোঁটাও ধূলো জমে নেই - প্রথম যৌবনের প্রেমিকার মতোই তরঙ্গিত, অসাধারণ মায়াকাড়া রূপ হয়ে উঠেছে তার। শৈশব আর কৈশোরের স্মৃতিতে আচ্ছন্ন সেই খাতার ধুলোর আবরণ ঝেড়ে-পুঁছে, পাতায় আটকানো দেশলাইয়ের কভারগুলোর গায়ে খুব ধীরে ধীরে, পরম স্নেহে হাত বোলাতে লাগলাম। আর কি অদ্ভুত! তাদের গায়ে লেগে থাকা ছোটবেলার মন-কেমন করা সেই অতুলনীয় 'ম-ম' গন্ধটা যেন আবার অনুভব করলাম... অনেক, অনেক দিনের পর। 

রেডিওতে চাপা স্বরে তখন বেজেই চলেছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মোহময় গলায় হারানো দিনের সেই রোমান্টিক গান: 'তুমি এলে, অনেকদিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো...'




2014 সালে ক্যালিফোর্নিয়া বে-এরিয়ার "পশ্চিমী" পুজা সংগঠন থেকে দূর্গাপুজা উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হওয়া  'অঞ্জলি' পুজা-ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিলো আমার এই আর্টিকেলটি। 
                                          এইখানে দেওয়া হলো সেই গল্পের লিঙ্কটি   


No comments:

Post a Comment