Friday, November 29, 2013

টিনটিন আর অ্যাসটেরিক্সের সাথে

On January 10th (Le 10 Janvier)
"আনন্দমেলা" প্রকাশিত হতে শুরু করে বাংলায় ১৩৮২-র বৈশাখ মাস থেকে অর্থাৎ ইংরেজিতে ১৯৭৫ সাল থেকে। সুখপাঠ্য কিশোর সাহিত্যের একটা স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দিয়ে গিয়েছিলো আনন্দমেলা। শুধু তাই নয় রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত ঘরের হাজার হাজার বাবা-মার ঘোর আপত্তিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে টিনটিনকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলো। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মহাশয়ের অসাধারণ সাবলীল বাংলা কথোপকথনে টিনটিনের 'স্নোয়ি' নিমেষেই হয়ে উঠেছিলো আমাদের অতি প্রিয় 'কুট্টুস' - গল্পের বাঁধুনি, চরিত্রের বৈচিত্র্য, দুরন্ত সব পটভূমিকা, তার সাথে টিনটিনের স্রষ্টা আরজে বা হার্জে-র প্রবর্তিত Ligne Claire (‘লিনেউ ক্লেয়ার’) স্টাইলটাও টিনটিনের সাফল্যের একটা অন্যতম বড় ফ্যাক্টর। পরবর্তীকালে অন্যান্য ফ্রেঞ্চ এবং বেলজিয়ান আর্টিস্টরাই মূলত হার্জের দেখাদেখি এই স্টাইলটা ফলো করতে থাকেন। 
টিনটিন - কাঁকড়া রহস্য
তবে সেই সুদুর কৈশোরে প্রথমবার টিনটিন পড়তে গিয়ে Ligne Claire ব্যাপারটা সেরকম ভাবে কোনো ছাপই ফেলেনি মনে, কারণ টিনটিনের গল্পগুলো ছিল এতোই টানটান, আর চরিত্রগুলো এতোই বর্ণময়, যে কমিকস পড়ছি বলে মনেই হতো না - বরং মনে হতো যেন ফেলুদার মতনই ঝরঝরে কোনো গোয়েন্দা কাহিনী বা অ্যাডভেঞ্চার পড়ছি কমিকস হিসাবে। আশির দশকের মাঝামাঝি ইন্দ্রজাল কমিকস নিয়ে এসেছিলো আর একটি নতুন ক্যারেক্টার, ‘টিম্পা’ - যার স্রষ্টা ছিলেন, জাহাঙ্গীর কেরাওয়ালা। অরণ্যদেব, ম্যানড্রেক, বাহাদুর, ফ্ল্যাশ গর্ডন জাতীয় মূল কমিকসের শেষে চার-পাঁচ পাতা বরাদ্দ থাকত টিম্পার জন্য - ঠিক যেমন একটি বা দুটি পাতা বরাদ্দ থাকত হেনরি (গুণধর/গাবলু), চকি ইত্যাদি চরিত্রগুলির জন্য। সোজা বাংলায় টিম্পা হল টিনটিনের স্পিন-অফ ক্যারাক্টার, সারা পৃথিবী জুড়ে এরকম চরিত্রের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু তারপরেও টিম্পার জন্য অনেক কলকাত্তাইয়া কমিকস-প্রেমীর মনে আলাদা একটা জায়গা আছে, কারণ ইন্দ্রজাল কমিকস সর্বভারতীয় হলেও টিম্পা কিন্তু এই কলকাতারই ছেলে। ওর বাবা ইনস্পেকটর দত্ত কলকাতা পুলিশে কাজ করেন, সেই সুবাদে বহু সময়েই টিম্পার বাড়িতেই রহস্যের জাল ঘনীভূত হতে থাকে। আর সেই জাল ছাড়ানোর কাজে টিম্পা ওর দাদু  এবং কুকুর রেক্সিকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে কখনো মুর্শিদাবাদ, কখনো শিলিগুড়ি আবার কখনো বা আন্দামানে। কিন্তু টিনটিনের তুলনায় টিম্পাতে অনেক বেশী ‘স্পীচ বাবল’ থাকত এবং প্রত্যেকটি বাবলে লেখার পরিমাণও থাকতো বেশ অনেক। তাই যারা আগে টিনটিন পড়ে ফেলেছিলো, তাদের কাছে টিম্পা তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। আশির দশকের শেষে ইন্দ্রজাল কমিকস  উঠে যাওয়ার পর দারা, বাহাদুরের মতন নিখাদ ভারতীয় কমিকসগুলোর মতনই টিম্পা-ও বন্ধ হয়ে যায়। জাহাঙ্গীর কেরাওয়ালা-ও কলকাতা ছেড়ে চলে যান পুনেতে। 


অ্যাস্টেরিক্সের সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিলো কলেজে পড়ার সময় - তখন ক্লাস শেষে বাড়ি না-ফিরে যাদবপুর থেকে মাঝে মাঝে বাসে করে আমি সোজা গোলপার্কের পুরানো বইয়ের দোকানগুলোতে ঢু-মারতে চলে আসতাম, আর ফিরতাম ট্রেনে চেপে, বালিগঞ্জ হয়ে। আমার মূল লক্ষ্য থাকতো দেবসাহিত্য কুটীরের পুরানো পূজাবার্ষিকী, কি টিনটিন অথবা অরণ্যদেব/ম্যানড্রেক সস্তায় কেনা - কিন্তু দোকানদার গুলো 'কি বই চাই দাদা, কি বই?' বলে এতো ঘ্যান-ঘ্যান করতো যে তাদের থামানোর জন্যে আমি গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করতাম 'অ্যাসটেরিক্স আছে?', কারণ কোথা থেকে যেন শুনেছিলাম যে অ্যাসটেরিক্সের দাম অনেক বেশী, আর নিউ মার্কেট ছাড়া কোলকাতার আর কোথাও সেটা পাওয়া যায় না। কিন্তু অ্যাসটেরিক্স যে টিনটিনের মতোই আরেকটা জলজ্যান্ত ক্যারেক্টার সেটা বুঝতে পারিনি। 
গোলপার্কের Roadside বইয়ের দোকান
আমি ভাবতাম এটা কোন একটা বিশেষ বইয়ের নাম। তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দোকানদার গুলো হতাশ কন্ঠে জবাব দিতো, 'না দাদা! অ্যাসটেরিক্স তো নেই, কিন্তু টিনটিন আছে - টিনটিন নিন না...' - আর আমিও এমন ভাব দেখাতাম যে টিনটিন আমার সব পড়া - সুতরাং তারা আর আমাকে বিরক্ত করতো না, আর আমিও আমার নিজের মতো করে বইপত্র ঘেঁটে চলতাম। এইভাবে চলছিলো বেশ, কিন্তু গন্ডগোল হলো একদিন। এক ব্যাটা দোকানদার বেশ অনেক ক'টা অ্যাসটেরিক্স-এর বই এনে রেখেছিলো। সেদিন আমি যথারীতি একই প্রশ্ন করে ফেলতেই, সে ব্যাটা ঝট করে এক বান্ডিল অ্যাস্টেরিক্স আমার সামনে নামিয়ে এনে বললো, 'কোনটা আপনার চাই ?' - এবারে তো আমি পড়ে গেছি বিপাকে। মিথ্যে কথা প্রিপারেশান ছাড়া বলা সহজ নয় - অন্তত আমার কাছে তো নয়ই। সুতরাং ঢোক গিলে, তো-তো, ইয়াম-য়াম করতে করতে বললাম, 'ও, এগুলোই বুঝি অ্যাসটেরিক্স? ঠিক আছে, দেখি একটা...' - সেই প্রথম আমার অ্যাসটেরিক্স কেনা - বইটার নাম ছিলো: "Asterix And The Golden Sickle" - অনেক পরে যেটা আনন্দ পাবলিশার্স "সোনালী কাস্তে" নামে প্রকাশ করে।
প্রথমবার অ্যাসটেরিক্স পড়ে চমকে গিয়েছিলাম - এটাও একটা অ্যাডভেঞ্চার, কিন্তু টিনটিনের সাথে এর অনেক ফারাক। এর পাতায় পাতায় হাসির ফোয়ারা লুকানো - রোমান ইতিহাসের নানান তথ্যও এই গল্পগুলোতে ছড়িয়ে আছে। আর অ্যাসটেরিক্স-ওবেলিক্স-গেটাফিক্স-এর কম্বিনেশন অনাবিল হাসি আর মজার উদ্রেক করে তোলে, প্রায় প্রতিটি মুহুর্তেই। সুতরাং আরও ঘনঘন আমার গোলপার্ক যাওয়া শুরু হলো, যদিও তখন মূল লক্ষ্য গেছে কিছুটা বদলে। এরপর এক এক করে, কলকাতায় থাকাকালীন প্রায় সবকটা অ্যাসটেরিক্সই কিনে ফেলেছিলাম - শুধুমাত্র "How Obelix Fell into the Magic Potion"-বইটা  ছাড়া - সেটাও বোধ হয় এখন দেশে পাওয়া যায়। তবে বাংলায় লেখা অ্যাসটেরিক্স পড়ে আমার খুব একটা ভালো লাগেনি। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মহাশয়ের অভাব অনুভব করেছি পদে পদে। 


অবশেষে অ্যাসটেরিক্সের ৩৫তম বই, "Asterix and the Picts" বার হচ্ছে এই ডিসেম্বরে। ইন্ডিয়াতে অবশ্য কিছুটা আগেই এটা বেরিয়ে গেছে - Amazon.in ভালোই বিক্রি করছে। কিন্তু অ্যামেরিকায় এখনো এটা বার হয়নি।  Amazon.com রিলিজ করবে ডিসেম্বর থার্ড উইকে। যদিও এই গল্পের রিভিউ তেমন ভালো হয়নি, তবুও সাগ্রহে অপেক্ষা করে আছি নতুন অ্যাসটেরিক্সের জন্যে। Ironically এদেশের kids-দের মধ্যে টিনটিন বা অ্যাসটেরিক্সের প্রতি তেমন কোন আগ্রহ দেখিনি, বরং তারা ভিডিও গেমস নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। এমন কি স্পিলবার্গের "টিনটিন মুভি"ও অনেকেই দেখেনি - দেখে অবশ্য হাসির থেকে মাঝে মাঝে বেশ করুণাই জাগে মনে। আমাদের দেশেও হয়তো এই একই অবস্থা চলছে। কিন্তু 'আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ' - সুতরাং আমি বসে আছি কবে সেই নতুন অ্যাসটেরিক্সের মুখোমুখি হবো বলে!

No comments:

Post a Comment