Sunday, November 24, 2013

একটি ওয়াশিং মেশিনের আত্মকথা

আমাদের বাড়িতে প্রথম আয়েশীয়ানার প্রচলন শুরু করে দেয় আমার মেজদা। চাকরি পাবার কিছু পরে পরেই মেজদা তার 'নিয়ন্ত্রিত' জীবনযাপন শুরু করে দেয়। রাত দেড়টা অবধি জেগে থেকে 'কলকাতা DD2 (মেট্রো)' চ্যানেলের বাংলা নাটকগুলোর সব ক'টা রিপিট টেলিকাস্ট দেখে তবে সে ঘুমোতে যেতো। যেদিন কোনো নাটক থাকতো না, সেদিন বারান্দার লম্বা বেঞ্চটাতে বসে বসে সে বাঁশি বাজাতে থাকতো। পাশে বসে থাকা বাড়ির  বিড়ালটা হতো তার একান্ত গুণমুগ্ধ শ্রোতা।  তেমন কোনো চেনাজানা সুর নয়, কিছুটা random, কিছুটা ভুল note-এ ঘুরেফিরে বেড়াতো তার দু'হাতের আঙুল গুলো। নিস্তব্ধ রাতে বাঁশির সেই অচেনা সুর  শুনতে খুব একটা খারাপ লাগতো না। মাঝে মাঝেই ঝিম ধরে আসতো। পরের দিন সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠতো অফিস যাবার ঠিক আধঘন্টা আগে - শুরু হতো প্রচন্ড ব্যস্ততা। আর ছুটির দিন হলে সে উঠতো, কিছু না-হলেও সকাল সাড়ে-ন'টার পরে। তারপর শুরু হতো তার একের পর এক বায়ানাক্কা - খবরের কাগজ কৈ, চা পেতে এতো দেরী হচ্ছে কেন, সকালের জল-খাবারে ডিম-সিদ্ধ নেই কেন, রেডিওটা কোথায় গেলো, বাথরুম খালি হচ্ছে না কেন, রোদ্দুরে বসার কোন জায়গা নেই কেন, বিড়ালটাকে খাবার দেওয়া হয়নি কেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। চা অবশ্য শুধুমাত্র ছুটির দিনগুলোতেই বানানো হতো, অন্যান্য দিনে চা-খাওয়া প্রায় নিষিদ্ধ ছিলো আমাদের বাড়িতে -  কোনো গেস্ট এলে অবশ্য এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটতো। চা-খাওয়া নিয়ে এতো কড়াকড়ির জন্যেই সেই ছোটোবেলা থেকে ওই চায়ের প্রতি একটা দূর্দম্য আকর্ষণ গড়ে উঠেছিলো - স্রেফ চা দিয়েই সব কটা রুটি খেয়ে ফেলেছি কতোবার। এমন কি আমাদের বাড়ির বেড়ালটা পর্যন্ত চায়ের বড়ো ভক্ত ছিলো। বহুবারই তাকে লোভে পড়ে ফেলে দেওয়া কষটা, চা-পাতা মুখে নিয়ে তারপর 'ওয়াক' তুলে ফেলে দিতে দেখেছি ! 

এই মেজদা শুরু করলো 'মূল্য ধরে' নিজের জামা-কাপড় অন্য কাউকে দিয়ে কাচানোর সিস্টেম। তখন 'ওয়াশিং মেশিন' বলে যন্ত্রটি আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে তেমন খ্যাবলা মেরে বসেনি। ছুটির দিনে কলতলায় বা পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে বসে আছাড় মেরে মেরে জামা-কাপড় কাচা ছিলো যে কোন বাড়িরই একটা খুব কমন দ্বিপ্রাহরিক অ্যাক্টিভিটি, আর  একই সাথে খুব ইউসফুল এক্সারসাইজ। 'সানলাইট' আর 'সুপার-রিন' ছিলো আমাদের 'De facto' সোপ বার। আর ভারী ভারী, কম দামী জিনিস, যেমন শতরঞ্চি, কাঁথা, চাদর, বালিশের ঢাকনা, আসন, পর্দা, ইত্যাদি কাচার জন্যে বাবা কিনে আনতেন কাপড় কাচা সোডা-গুঁড়ো। একটা বড়ো ডিশের  হাঁড়িতে জল ভরে, তাতে সেই সোডা-গুঁড়ো ভালো করে মেশানো হতো। তারপর সেই হাঁড়ির মধ্যে সব কাপড়-চোপড় দিয়ে কম আঁচে উনুনে কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখা হতো। একটা মোটা লাঠি হাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে মাঝে মাঝে জিনিষপত্র গুলোকে উল্টে-পাল্টে দেওয়া হতো। এরপর সেগুলোকে নিয়ে পুকুর ঘাটে বসে থ্যাবড়া মেরে মেরে কেচে, ধুয়ে ছাদে নিয়ে গিয়ে মেলে দেওয়া হতো।   

তো মেজদা হঠাৎই একদিন স্থির করলো যে নিজের জামা-কাপড় আর নিজে কেচে 'সময় নষ্ট' করবে না। সেই সময়ে বরং কিছু 'ক্রিয়েশনাল' কাজ করবে - যেমন ধরা যাক ম্যাগাজিন বা কমিকস পড়া, লুডো-ক্যারাম খেলা, কাঁচি দিয়ে কাগজ কেটে কেটে অরিগ্যামি শেখা, শীতের রোদ্দুরে বসে খেঁজুর রস খেয়ে কেঁপে কেঁপে হু-হু করা, পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরা, বাড়ির ছাদে টবেতে করে টমেটো, বেগুন, বা গাঁদাফুল গাছের চাষ করা, কিম্বা তেমন কোন কিছু করার না থাকলে নিছকই ঘুম, স্রেফ ঘুম। সেই মতো কাচার পারিশ্রমিক ঠিক হলো - যতদুর মনে পড়ে জামা-পাজামার জন্যে ৭৫ পয়সা, আর প্যান্টের জন্যে ১ টাকা বা ১ টাকা ২৫ পয়সা ধার্য্য করা হয়েছিলো। বাড়ির কাজের মেয়েটি ছাড়াও আমি আর আমার ছোটদি, অর্থাৎ যারা তখনো বেকার ছিলো, তারা সাধারনত এ ধরনের সাপ্তাহিক, টেম্পোরারী  Job offer-এ ভালোই রেসপন্ড কোরতাম। 'ঝোপ বুঝে কোপ মারার মতো' তাল বুঝে কখনো কখনো আমরা বিড করে করে রেট দিতাম বাড়িয়ে। স্পেশালি যেদিন গুলোতে কোন ওয়ান-ডে ক্রিকেট থাকতো, বা বাড়িতে কোনো আত্মীয় আসতো, বা খুব জোরে বৃষ্টি শুরু হতো, বা রবিবারের দুপুরের টিভিতে আঞ্চলিক সিনেমার ন্যাশনাল প্রোগ্রামে কোনো ভালো বাংলা সিনেমা থাকতো। জামা-কাপড়ের সংখ্যা বেশি থাকলেও রেট যেতো বেড়ে, কারণ আমাদের নিজের জামা-কাপড়ও আমাদেরকেই কাচতে হতো। মাঝে মাঝে মেজদাকে রেট বাড়ানোর পরেও 'প্যাকেজড ডীল' হিসাবে এক্সট্রা আরও কিছু দিতে হতো! 

কাপড়-জামা কেচে ধুয়ে, পুকুরে স্নান করে যখন উঠে আসতাম তখন হাত-পায়ের আঙ্গুলের চামড়া গুলো দেখতাম কিছুটা ফুলে ফুলে গেছে। কিন্তু সেই 'উপরি' পাওনার লোভে খুব একটা মাইন্ড করতাম না। বাড়ির কিছুদুরেই কয়েকটা ধোপা বা লন্ড্রীর দোকান ছিলো। তাদের রেটও খুব সম্ভবত এই একই রকমের ছিলো। কিন্তু মেজদা কেন যে আমাদেরকেই প্রেফার করতো, তা এখন মাঝে মাঝে বসে ভাবি। হয়তো 'same day shipping'-এর কনসেপ্ট - কি হয়তো বা নিজের ফ্যামিলির মধ্যেই investment-কে  সীমাবদ্ধ রাখা - কে জানে !!  শরৎচন্দ্রের 'শ্রীকান্ত' উপন্যাসের 'মেজদা'-র সাথে আমার মেজদার চরিত্রের বেশ কিছুটা মিল ছিলো। মাঝে মাঝে মনে হয় 'বাড়ির মেজদারা' বোধহয় সব ঐরকমই হয় !! 


একান্নবর্তী ফ্যামিলি আজ বহুদিনই চলে গেছে বিলুপ্তির পথে। যে'কটা এখনো কোনরকমে জোড়া-তালি দিয়ে টিকে আছে, মনে হয়না এমন মজার ঘটনা আজও কোথাও ঘটে চলেছে। ফ্রি-টাইম বলে আজকাল আর মানুষের কিছু নেই - সবাই কিছু না কিছু নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। সোফা-টিভি-ফ্রিজের মতো ঘরে ঘরে আজকাল অ্যাকোয়াগার্ড, ওয়াশিং মেশিন, কম্পুটার আর ট্যাবের ছড়াছড়ি। কোন কোন বাড়িতে আবার একাধিক সংখ্যায়ও এদের দেখা যায়। ডিশ-ওয়াশার কিম্বা ভ্যাকুয়াম ক্লীনারও আজকাল নাক-উঁচু কোন কিছু নয়। 'রোটি-মেকার' বলে আরেক যান্ত্রিক-প্রজাতিও সম্প্রতি ঘরে ঘরে হানা দিয়েছে। এ সবই হয়তো মানুষের জীবনকে আরও বেশি করে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে তুলেছে, কিন্তু একই সাথে মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসাও হু-হু করে কমিয়ে দিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে খুব দ্রুত হারে  বদলে যাচ্ছে সেই চির-চেনা মায়াবী পৃথিবীটা। একে-অপরের প্রতি নির্ভরশীলতা হারিয়ে আমরাও যেন হয়ে উঠছি দিনের পর দিন আরও, আরও বেশি করে  'প্রায়-যন্ত্র' একেকটা সব মানুষ।       

1 comment: