এদেশে আসার আগে জানতাম যে BF মানে হলো গিয়ে 'বয় ফ্রেন্ড', যে রোলে পার্ট করার চান্স আমি খুব একটা পাই-ই নি। আরেকটা দুষ্টু মানে হলো গিয়ে 'নীল সিনেমা', যেটাও সময়কালে দেখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এদেশে আসার পর জানলাম BF-র আরেকটা অন্য মানে - সেটা হলো 'Black Friday' অর্থাৎ 'কালো শুক্রবার' - আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে, 'ThanksGiving'-এর ঠিক পরের শুক্রবার। আনওফিসিয়ালি এই দিন থেকে এদেশে হলিডে শপিং শুরু হয়ে যায়। প্রায় যাবতীয় রিটেলার ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলো অনেক জিনিসের ওপর স্পেশাল ডিসকাউন্ট বা 'bargain deal' দেয়, যাতে পুরানো স্টকের জিনিসপত্র সব বিক্রি হয়ে যায় - অনেকটা আমাদের দেশের 'চৈত্রের সেলের' মতোই। Black বলার কারণ, সাধারণত অ্যাকাউন্টিয়ে হিসাবের খাতায় লাল কালি ব্যবহার করা হয় 'loss' বোঝাতে আর কালো কালি ব্যবহার করা হয় 'profit' বোঝানোর জন্যে। বহু রিটেলারের কাছেই বছরের সেরা প্রফিটেবল দিন হলো এটাই। তো বছরের এই স্পেশাল দিনটিতে আমেরিকানরা শপিং-এর জন্যে ভীষনভাবে সিরিয়াস ও পাগল-প্রায় হয়ে ওঠে। ভাবখানা এমন করে যেন এদিন কিছু না-কিনতে পারলে গোটা জীবনটাই তাদের বৃথা হয়ে যাবে - কিছু একটা কিনতে হবেই যেন তাদের! অবশ্য আমেরিকানদের সাথে পাল্লা দিয়ে এশিয়ানরা, এমন কি ইন্ডিয়ানরাও কিছু কম যায় না। 'ঝাঁকের কই'-এর মতো সেই স্রোতে গা-
ভাসিয়ে বেশ কয়েক বছর আগে আমিও এক Black Friday-র কনকনে ঠান্ডা, শীতের ভোরে ৪:১৫ থেকে FRY'S নামের এখানকার এক পপুলার ইলেকট্রনিক্স স্টোরের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে গেছিলাম। সামনে পিছনে অজস্র লোক - সবাই যেন কেমন মোহগ্রস্ত হয়ে এক অজানা কোন চরম প্রাপ্তির জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করে যাচ্ছে। সে দোকান খুললো কাঁটায় কাঁটায় সকাল ৬টায়। মুহুর্তের মধ্যে প্রায় হাজারটা লোক একসাথে দোকানের বিশাল দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করলো। পদ-পিষ্ট হতে হতে কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে, ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে দোকানে ঢুকলাম।তারপর যা কিছুই কিনতে যাই সেখানেই দেখি আমার আগে অন্তত গোটা ৭০ জন লোক এসে হাজির হয়ে জটলা পাকাচ্ছে - লাইন বলে কোন কিছু নেই। দোকানের customer service-র ছেলেগুলো দেখি সব স্টেপ-আপ টুলের মাথায় উঠে প্যাকেজিং বক্স গুলো নিয়ে নিচের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে। আর নিচে দাঁড়িয়ে থাকা পাগলা জনতা সেগুলোকে 'হরিলুটের বাতাসা লোটার' মতো করে লুফে, কেড়ে নিচ্ছে। আমিও ওদের দেখাদেখি ভীড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে, লাফিয়ে লাফিয়ে কোনরকমে একটা পোর্টেবল DVD প্লেয়ার লুফে নিলাম। তারপর এদিক সেদিক ঘুরে কিছু পড়ে থাকা USB drive, কয়েকটা ডিসকাউন্টেড ডিভিডি, আরও বেশ কিছু হাবি-জাবি জিনিস কিনে, খুশি খুশি মুখে সকাল সাড়ে-সাতটায় বাড়ি ফিরলাম। উদভ্রান্ত চেহারা, ঘুম না-হয়ে চোখদুটো লাল, মাথা ঝিমঝিম, কিন্তু মুখে 'সব পেয়েছির হাসি' - ঝোঁকে পড়ে কেনা সেইসব জিনিসগুলোর বেশিরভাগই এখনো তেমন ব্যবহার করা হয়ে ওঠেনি। কিছু কিছু এখনও প্যাকড অবস্থায় পড়ে আছে। DVD প্লেয়ারটা বেশ কিছুদিন ব্যবহার করা হয়েছিলো - সম্প্রতি আমার স্বনামধন্য পুত্র সেটাকে নিয়ে “দেখি, ভাঙে কি না” পরীক্ষা করতে গিয়ে এক আছাড়ে প্রায় দ্বি-খন্ডিত করে দিয়েছে - কিন্তু তাও সেটা এখনো চলছে। শুধু তার স্ক্রিনটাকে সাপোর্ট দেবার জন্যে একটা আলাদা করে বালিশ লাগে।
তার পর থেকে বেশ কয়েক বছর আর স্রোতে গা-ভাসাই নি। 'যেতে দাও, গেলো যারা' বলে ঘুম থেকেই উঠিনি। এবছর ঠিক করলাম যে যাই ঘুরে আসি, দেখি অবস্থা আদৌ improved হয়েছে কিনা - না কি 'সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলছে...' - সেই মতো ঘুম থেকে উঠে সকাল আটটা নাগাদ বার হলাম - কোনো তাড়া নেই, জাস্ট উইন্ডো শপিং করবো বলে। কিন্তু যে দোকানেই যাই না কেন, গাড়ি আর পার্ক করতে পারি না। রাস্তার দু'ধার সহ সব পার্কিং লট একেবারে পুরো প্যাকড। লোকজন সব কতো দূরে দূরে গাড়ি পার্ক করে হাঁটতে হাঁটতে আসছে - দেখে আমাদের দেশের দূর্গা পূজার রাতের ঠাকুর দেখার কথা মনে পড়ে গেলো।
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ ধরে নানান জায়গায় চক্কর কেটে কেটে, শেষমেষ বিরক্ত হয়ে বাড়ি ফিরবো কিনা ভাবছি, হঠাৎই নজরে এলো রাস্তার এক ধারে, মেক্সিকান এক ফ্যামিলি ট্রাকে করে প্রচুর তরমুজ নিয়ে হাজির হয়েছে, বিক্রির জন্যে। একজন দুশমন চেহারার বেঁটে লোক, সঙ্গে দুটো ছোট বাচ্চা - সম্ভবত এদের নিজেদের ক্ষেতেরই ফল। তরমুজগুলোর সাইজ দেখতে রীতিমত ঈর্ষণীয়। মনে মনে ভাবলাম দেখতেই যদি এতো ভালো হয়, না-জানি খেতে কতো ভালো হবে। চিন্তা করে দেখলাম একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, একদম খালি হাতে বাড়ি না ফিরে, বরং একটা তরমুজ কিনে ফেরা যাবে, at least কিছু তো কেনা হবে। ছোটবেলায় বাবার সাথে বাজার করতে গিয়ে জেনেছিলাম যে তরমুজ সব সময় পাকা অবস্থায় কিনতে হয়, না'হলে খেতে ভালো নাগে না। যদি দেখা যায় যে তরমুজের গায়ে অনেক অনেক স্ট্রাইপ, তো সেই তরমুজ মোটেই পাকা নয়। বরং যেগুলোর তলার দিকটা একটু হলদেটে রংয়ের, সেগুলোরই পাকা হওয়ার চান্স অনেক বেশি। কিন্তু আমার সামনে থাকা তরমুজগুলো দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না - এগুলোর গায়ে স্ট্রাইপও আছে, আবার নিচের দিকটা কিছুটা হালকা রংয়েরও বটে। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে মেক্সিকান বিক্রেতাওয়ালা ও তার দুই ছেলে 'হোলা, হোলা' করে মাথা ধরিয়ে দিলো। আমি আমার বেংলিশ ভাষায় গম্ভীর ভাবে বললাম, দেখো বাপু, ছোটবেলা থেকে বাজার করে এসেছি - সারা জীবনে প্রচুর ধোঁকাও খেয়েছি - তাই এই বুড়ো বয়সে নতুন করে আর আমাকে ধোঁকা খাওয়াতে পারবে না। যদি তরমুজের ভিতরটা টকটকে লাল হয় তো আমি ক্যাশ দিয়ে কিনবো, নইলে কিন্তু আমি 'বাপের কু-পুত্তুর' - একটা পয়সাও, থুড়ি! একটা পেনিও দেবো না ! অনেক কষ্টের পর সে 'হোলা ফ্যামিলি'কে আল্টিমেটলি বোঝানো গেলো আমার সেই শর্ত। তারা রাজিও হলো, বললো, 'ঠিক আছে, তরমুজ যদি টকটকে লাল না-হয়, তাহলে তোমাকে দাম দিতে হবে না' - তো সেই শর্তে ওজন করে কেনা হলো বেশ বড়সড় একটা তরমুজ। এবার তাদেরকে বললাম, “তাহলে এখন কেটে দেখাও যে ভিতরটা কি রকম লাল”- কিন্তু ও হরি !! কাটার পর দেখা গেলো, তরমুজের ভিতরটা প্রায় চালকুমড়ার মতোই সাদা, শুধু ধারের দিকটা একটু গোলাপী রংয়ের। এদিকে ধেড়ে মেক্সিকান বিক্রেতা ও তার সঙ্গীসাথীরা সবাই একযোগে “ওয়াও! ওয়াও!” রব তুলে সমস্বরে বলতে থাকলো “এর থেকে লাল আর তরমুজ হয় না, কি সুন্দর টমেটোর মতো লাল তরমুজ - দিন, এবার টাকা দিন...” - আমি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম। ভাবলাম হয়তো আমার চোখের 'cone cell'-এর সংখ্যা ঝট করে কমে গেছে। চোখ কচলে ভালো করে নিজের গাড়ির দিকে তাকালাম - দেখলাম নাতো! লাল গাড়ির রং তো ঠিকঠাক লাল-ই দেখাচ্ছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমি তাদেরকে বোঝাতে পারলাম না যে সেটা লাল তরমুজ নয়। অগত্যা কি আর করা - বুঝলাম তরমুজওয়ালা ব্যাটারা আইনস্টাইনের “থিওরি অফ রিলেটিভিটি” প্রয়োগ করতে শিখে গেছে। “যাহা আমার কাছে সাদা, তাহাই উহাদের কাছে টুকটুকে লাল”। সবই আপেক্ষিকতাবাদের লীলা খেলা। স্বর্গত: আইনস্টাইনের উদ্দেশ্যে গালাগালি করা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই! অত:পর নগদ টাকা দিয়ে এক পেল্লায়, সাদা তরমুজ কোলে করে গাড়ীতে উঠলাম। বামফ্রন্ট জমানায় প্রচুর বাইরে-সবুজ-ভিতরে-লালওয়ালা তরমুজে-রাজনীতিবিদ দেখেছি - দিদির আমলে নিশ্চয় তারা এখন রং পাল্টিয়েছে, স্বভাব না পাল্টে। কিন্তু গিন্নীকে কি করে ভজাই আমি... তারই ফিকির খুঁজতে খুঁজতে গাড়ী স্টার্ট দিলাম!
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ ধরে নানান জায়গায় চক্কর কেটে কেটে, শেষমেষ বিরক্ত হয়ে বাড়ি ফিরবো কিনা ভাবছি, হঠাৎই নজরে এলো রাস্তার এক ধারে, মেক্সিকান এক ফ্যামিলি ট্রাকে করে প্রচুর তরমুজ নিয়ে হাজির হয়েছে, বিক্রির জন্যে। একজন দুশমন চেহারার বেঁটে লোক, সঙ্গে দুটো ছোট বাচ্চা - সম্ভবত এদের নিজেদের ক্ষেতেরই ফল। তরমুজগুলোর সাইজ দেখতে রীতিমত ঈর্ষণীয়। মনে মনে ভাবলাম দেখতেই যদি এতো ভালো হয়, না-জানি খেতে কতো ভালো হবে। চিন্তা করে দেখলাম একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, একদম খালি হাতে বাড়ি না ফিরে, বরং একটা তরমুজ কিনে ফেরা যাবে, at least কিছু তো কেনা হবে। ছোটবেলায় বাবার সাথে বাজার করতে গিয়ে জেনেছিলাম যে তরমুজ সব সময় পাকা অবস্থায় কিনতে হয়, না'হলে খেতে ভালো নাগে না। যদি দেখা যায় যে তরমুজের গায়ে অনেক অনেক স্ট্রাইপ, তো সেই তরমুজ মোটেই পাকা নয়। বরং যেগুলোর তলার দিকটা একটু হলদেটে রংয়ের, সেগুলোরই পাকা হওয়ার চান্স অনেক বেশি। কিন্তু আমার সামনে থাকা তরমুজগুলো দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না - এগুলোর গায়ে স্ট্রাইপও আছে, আবার নিচের দিকটা কিছুটা হালকা রংয়েরও বটে। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে মেক্সিকান বিক্রেতাওয়ালা ও তার দুই ছেলে 'হোলা, হোলা' করে মাথা ধরিয়ে দিলো। আমি আমার বেংলিশ ভাষায় গম্ভীর ভাবে বললাম, দেখো বাপু, ছোটবেলা থেকে বাজার করে এসেছি - সারা জীবনে প্রচুর ধোঁকাও খেয়েছি - তাই এই বুড়ো বয়সে নতুন করে আর আমাকে ধোঁকা খাওয়াতে পারবে না। যদি তরমুজের ভিতরটা টকটকে লাল হয় তো আমি ক্যাশ দিয়ে কিনবো, নইলে কিন্তু আমি 'বাপের কু-পুত্তুর' - একটা পয়সাও, থুড়ি! একটা পেনিও দেবো না ! অনেক কষ্টের পর সে 'হোলা ফ্যামিলি'কে আল্টিমেটলি বোঝানো গেলো আমার সেই শর্ত। তারা রাজিও হলো, বললো, 'ঠিক আছে, তরমুজ যদি টকটকে লাল না-হয়, তাহলে তোমাকে দাম দিতে হবে না' - তো সেই শর্তে ওজন করে কেনা হলো বেশ বড়সড় একটা তরমুজ। এবার তাদেরকে বললাম, “তাহলে এখন কেটে দেখাও যে ভিতরটা কি রকম লাল”- কিন্তু ও হরি !! কাটার পর দেখা গেলো, তরমুজের ভিতরটা প্রায় চালকুমড়ার মতোই সাদা, শুধু ধারের দিকটা একটু গোলাপী রংয়ের। এদিকে ধেড়ে মেক্সিকান বিক্রেতা ও তার সঙ্গীসাথীরা সবাই একযোগে “ওয়াও! ওয়াও!” রব তুলে সমস্বরে বলতে থাকলো “এর থেকে লাল আর তরমুজ হয় না, কি সুন্দর টমেটোর মতো লাল তরমুজ - দিন, এবার টাকা দিন...” - আমি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম। ভাবলাম হয়তো আমার চোখের 'cone cell'-এর সংখ্যা ঝট করে কমে গেছে। চোখ কচলে ভালো করে নিজের গাড়ির দিকে তাকালাম - দেখলাম নাতো! লাল গাড়ির রং তো ঠিকঠাক লাল-ই দেখাচ্ছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমি তাদেরকে বোঝাতে পারলাম না যে সেটা লাল তরমুজ নয়। অগত্যা কি আর করা - বুঝলাম তরমুজওয়ালা ব্যাটারা আইনস্টাইনের “থিওরি অফ রিলেটিভিটি” প্রয়োগ করতে শিখে গেছে। “যাহা আমার কাছে সাদা, তাহাই উহাদের কাছে টুকটুকে লাল”। সবই আপেক্ষিকতাবাদের লীলা খেলা। স্বর্গত: আইনস্টাইনের উদ্দেশ্যে গালাগালি করা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই! অত:পর নগদ টাকা দিয়ে এক পেল্লায়, সাদা তরমুজ কোলে করে গাড়ীতে উঠলাম। বামফ্রন্ট জমানায় প্রচুর বাইরে-সবুজ-ভিতরে-লালওয়ালা তরমুজে-রাজনীতিবিদ দেখেছি - দিদির আমলে নিশ্চয় তারা এখন রং পাল্টিয়েছে, স্বভাব না পাল্টে। কিন্তু গিন্নীকে কি করে ভজাই আমি... তারই ফিকির খুঁজতে খুঁজতে গাড়ী স্টার্ট দিলাম!
No comments:
Post a Comment