সেকেন্ডারী স্কুলে পড়াকালীন আমার খুব পছন্দের একটা বিষয় ছিলো ভূগোল। সত্যি বলতে কি, স্কুলের স্যার এমন কিছু আহামরি পড়াতেন না, কিন্তু বিভিন্ন ধরণের এতো বাহারী বাহারী সব অপরিচিত নাম ছিলো, যেমন অভ্র, প্রেইরি, উত্তমাশা, জেরিকো, কায়রো, মন্টানা, টেক্সাস, সেন্ট পিটার্সবার্গ, লুক্সেমবার্গ, কতো অজস্র দ্বীপ, অন্তরীপ - এরাই আমার মাথা ঘুরিয়ে দিতো। মনে হতো অনেক অনেক দূরের দেশের এই সমস্ত জায়গাগুলোর সাথে কোনোদিন পরিচয় হয়নি বলেই হয়তো এতো আগ্রহ, এতো রোমাঞ্চ আমার। গ্রীষ্মের সেই রাতগুলোতে, যখন অসহ্য গরমে কিছুতেই ঘুম আসতে চাইতো না, তখন আমরা মাঝে মাঝে ছাদে বা উঠানের মাঝখানে কোনমতে জোড়া-তাপ্পি দিয়ে মশারি খাঁটিয়ে, তার মধ্যে একটা মাদুর পেতে, বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়তাম। রাত বারোটার পর দেশের বেশিরভাগ রেডিও চ্যানেলগুলো যেতো বন্ধ হয়ে, তখন আমি রেডিওর নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দূর দুরান্তের স্টেশনগুলো ধরার চেষ্টা করতাম। বাড়িতে মেজদা রেডিও সারাতো ভালোই - আমাদের রেডিওতে সে বেশ কিছু শর্ট-ওয়েভ ব্যান্ড আসার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলো - ফলে নেপালী, সিংহলীজ তো বটেই, এমন কি বার্মিজ, চীনা আরও কতো অদ্ভুত দেশের গান-বাজনা আর কথাবার্তা ধরা পড়তো সেই নিঝুম রাতের রেডিওতে। এতো রোমাঞ্চ লাগতো যে মাঝে মাঝে ঘুমানোর কথাই যেতাম ভুলে। আস্তে আস্তে ক্রমশ: সেটা নেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। না-জানা কোন জিনিষের মুখোমুখি হওয়া মনে হয় চেনা ভালো জিনিষের মুখোমুখি হবার থেকে বেশি আকর্ষনীয়। সেই সময়ে নেপালী একটা চ্যানেলে, সপ্তাহের এক নির্দিষ্ট রাতে পুরানো আমলের সব হিন্দী সিনেমার গান ব্রডকাস্ট হতো। সে সব গানের বেশিরভাগই আমি আগে কখনো শুনিনি। “না জানে ক্যায়সে, পল মে বদল যাতে হ্যায়...” বলে একটা অদ্ভুত সুরেলা হিন্দী গান আমি প্রথম শুনি এইভাবে। এতো ভালো লেগেছিলো সেদিন, যে বলার কথা নয়। সে রাতের অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, আকাশে তারাদের মিটিমিটি চেয়ে থাকা, গাছের পাতাদের চুপচাপ থাকার আওয়াজ, সব মিলিয়ে মিশিয়ে গানটার আমেজ ও আবেদন যেন আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে তুলেছিলো। সে রাতের ওই গানের পাত্তা লাগাতে আমাকে আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিলো - কিন্তু সেই অপেক্ষা করে খুঁজে পাওয়ার মধ্যেও অদ্ভুত আনন্দ আর উত্তেজনা লুকিয়ে ছিলো - যা এখনকার হাই-স্পিড ইন্টারনেট সার্চিংয়ের যুগে আশা করা আজ ঘোরতর অন্যায়।
ভূগোল পরীক্ষার উত্তরপত্রে আমি পটাপট ইন্ডিয়ার ম্যাপ এঁকে দিতাম - অনেক সময় কিছুটা অকারণেই আঁকতাম। যেমন “কয়লা কোথায় পাওয়া যায়” প্রশ্নের উত্তরে আমি ইন্ডিয়ার ম্যাপ এঁকে রিলেটেড স্টেটগুলোকে পেন্সিলে ঘষে শেডেড করে দিতাম, যার জন্যে অন্যদের থেকে আমায় বেশি নম্বর দিতে স্যারেরা বাধ্য
হতেন।বন্ধুরা অনেকেই মাঝে মাঝে জানতে চাইতো যে এতো দ্রুত ম্যাপ আঁকার কোন কৌশল আছে কিনা - আমি থাকতাম চুপ করে। ট্রিকস একটা ছিলোই, যেটার মেজরিটিতে ছিলো স্রেফ প্র্যাকটিস, আর কিছুটা ছিলো ইন্ডিয়ার ম্যাপ প্রিন্ট করা এক-টাকার গোল এক কয়েন, যা আমার জ্যামিতি বক্সে সব সময় রাখা থাকতো। স্যারেরা পরীক্ষায় গার্ড দেবার সময় সেটা দেখেও কখনো খেয়াল করতেন না, কারণ ম্যাপ আঁকার সময় ছাড়া বাকি সময় সেটা অন্য মুখে চেয়ে থাকতো !! তবে মূলত: সেটার কাজ ছিলো আমার ম্যাপ আঁকার সময়ে ফাইন টিউনিংয়ে হেল্প করা !
হতেন।বন্ধুরা অনেকেই মাঝে মাঝে জানতে চাইতো যে এতো দ্রুত ম্যাপ আঁকার কোন কৌশল আছে কিনা - আমি থাকতাম চুপ করে। ট্রিকস একটা ছিলোই, যেটার মেজরিটিতে ছিলো স্রেফ প্র্যাকটিস, আর কিছুটা ছিলো ইন্ডিয়ার ম্যাপ প্রিন্ট করা এক-টাকার গোল এক কয়েন, যা আমার জ্যামিতি বক্সে সব সময় রাখা থাকতো। স্যারেরা পরীক্ষায় গার্ড দেবার সময় সেটা দেখেও কখনো খেয়াল করতেন না, কারণ ম্যাপ আঁকার সময় ছাড়া বাকি সময় সেটা অন্য মুখে চেয়ে থাকতো !! তবে মূলত: সেটার কাজ ছিলো আমার ম্যাপ আঁকার সময়ে ফাইন টিউনিংয়ে হেল্প করা !
আজ সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে এসে অবাক হয়ে দেখি যে কতো অচেনা, অজানা সংস্কৃতির হাজার হাজার লোক এখানে এসে একসাথে, মিলেমিশে দিব্যি রয়েছে, অথচ আমাদের নিজেদের দেশে আমরা সেটা করতে পারলাম না কেন? ফিফটি স্টেটের “ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা” আজও সেই ফিফটি স্টেটই হয়ে আছে, অথচ আমরা? স্বাধীনতার পরে কতো যে নতুন স্টেটের জন্ম দিতে ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট বাধ্য হলো, ভাবতেও লজ্জা লাগে ! শিক্ষিত মানুষেরা আজও আলাদা আলাদা স্টেটের দাবি নিয়ে আমরণ অনশনের হুমকি দেয়, আর একদল ধুয়োধরা জনতা তাদেরকেই সাপোর্ট করে চলে! দেশ মানে কি শুধুই সীমারেখা? দেশ মানে কি ভালোবাসা নয়?
এখন বুঝতে পারি, ছোটবেলার সে রোমাঞ্চের কারণ পরিচয় না থাকার কারণে হলেও হতে পারে, তাই বলে 'দূর দেশ' বলে কিন্তু ছিলো না। বরং, পরবর্তীকালে নিজের দেশের কিছু নামই হয়ে উঠেছে আমার কৈশোরের রূপকথার রাজ্যের কল্পনার সব চরিত্র। ভুগোল বইয়ের পাতা থেকে এখনো চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠে সেই সব জাদুকরী নামগুলো: কৃষ্ণচুড়া, অর্জুন, সুন্দরী, কেওড়া, গেওয়া, গরান, গোলপাতা, - ভেজা কদম, শুকনো খড়, পানের বরজ, নদীতে জোয়ার-ভাঁটা, আশ্বিনের ঝড়, আকাশ কালো করে ঝুম বৃষ্টি, মেঘ-কুয়াশার লুকোচুরি, ভোরের দোয়েল পাখি, সোনালি ফসলের মাঠ, ছায়াময় স্নিগ্ধ ঘাসের পাটি, রূপশালী ধান আর কুশ কুটিকাটি।
চলুক বেজায় রাজনীতি - যাক জিতে কেউ, যাক হেরে কেউ। কিন্তু সূর্যমুখী ফুলের রঙ দেখা আমাদের ছোট্ট জীবন টিকে থাকুক নিশ্চিন্তে, নিরাপদে। তারার আলোয় আলোকিত হয়েই বেঁচে থাকুক, চিরকাল এক হয়ে থাকুক আমার ছোটোবেলার 'সে দেশ' - আমারই স্বদেশ।