Saturday, November 30, 2013

মন যতো দূর চাইছে যেতে, ঠিক ততো দূর আমার দেশ...

সেকেন্ডারী স্কুলে পড়াকালীন আমার খুব পছন্দের একটা বিষয় ছিলো ভূগোল। সত্যি বলতে কি, স্কুলের স্যার এমন কিছু আহামরি পড়াতেন না, কিন্তু বিভিন্ন ধরণের এতো বাহারী বাহারী সব অপরিচিত নাম ছিলো, যেমন অভ্র, প্রেইরি, উত্তমাশা, জেরিকো, কায়রো, মন্টানা, টেক্সাস, সেন্ট পিটার্সবার্গ, লুক্সেমবার্গ, কতো অজস্র দ্বীপ, অন্তরীপ - এরাই আমার মাথা ঘুরিয়ে দিতো। মনে হতো অনেক অনেক দূরের দেশের এই সমস্ত জায়গাগুলোর সাথে কোনোদিন পরিচয় হয়নি বলেই হয়তো এতো আগ্রহ, এতো রোমাঞ্চ আমার। গ্রীষ্মের সেই রাতগুলোতে, যখন অসহ্য গরমে কিছুতেই ঘুম আসতে চাইতো না, তখন আমরা মাঝে মাঝে ছাদে বা উঠানের মাঝখানে কোনমতে জোড়া-তাপ্পি দিয়ে মশারি খাঁটিয়ে, তার মধ্যে একটা মাদুর পেতে, বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়তাম। রাত বারোটার পর দেশের বেশিরভাগ রেডিও চ্যানেলগুলো যেতো বন্ধ হয়ে, তখন আমি রেডিওর নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দূর দুরান্তের স্টেশনগুলো ধরার চেষ্টা করতাম। বাড়িতে মেজদা রেডিও সারাতো ভালোই - আমাদের রেডিওতে সে বেশ কিছু শর্ট-ওয়েভ ব্যান্ড আসার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলো - ফলে নেপালী, সিংহলীজ তো বটেই, এমন কি বার্মিজ, চীনা আরও কতো অদ্ভুত দেশের গান-বাজনা আর কথাবার্তা ধরা পড়তো সেই নিঝুম রাতের রেডিওতে। এতো রোমাঞ্চ লাগতো যে মাঝে মাঝে ঘুমানোর কথাই যেতাম ভুলে। আস্তে আস্তে ক্রমশ: সেটা নেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। না-জানা কোন জিনিষের মুখোমুখি হওয়া মনে হয় চেনা ভালো জিনিষের মুখোমুখি হবার থেকে বেশি আকর্ষনীয়। সেই সময়ে নেপালী একটা চ্যানেলে, সপ্তাহের এক নির্দিষ্ট রাতে পুরানো আমলের সব হিন্দী সিনেমার গান ব্রডকাস্ট হতো। সে সব গানের বেশিরভাগই আমি আগে কখনো শুনিনি। “না জানে ক্যায়সে, পল মে বদল যাতে হ্যায়...” বলে একটা অদ্ভুত সুরেলা হিন্দী গান আমি প্রথম শুনি এইভাবে। এতো ভালো লেগেছিলো সেদিন, যে বলার কথা নয়। সে রাতের অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, আকাশে তারাদের মিটিমিটি চেয়ে থাকা, গাছের পাতাদের চুপচাপ থাকার আওয়াজ, সব মিলিয়ে মিশিয়ে গানটার আমেজ ও আবেদন যেন আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে তুলেছিলো। সে রাতের ওই গানের পাত্তা লাগাতে আমাকে আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিলো - কিন্তু সেই অপেক্ষা করে খুঁজে পাওয়ার মধ্যেও অদ্ভুত আনন্দ আর উত্তেজনা লুকিয়ে ছিলো - যা এখনকার হাই-স্পিড ইন্টারনেট সার্চিংয়ের যুগে আশা করা আজ ঘোরতর অন্যায়। 

ভূগোল পরীক্ষার উত্তরপত্রে আমি পটাপট ইন্ডিয়ার ম্যাপ এঁকে দিতাম - অনেক সময় কিছুটা অকারণেই আঁকতাম। যেমন “কয়লা কোথায় পাওয়া যায়” প্রশ্নের উত্তরে আমি ইন্ডিয়ার ম্যাপ এঁকে রিলেটেড স্টেটগুলোকে পেন্সিলে ঘষে শেডেড করে দিতাম, যার জন্যে অন্যদের থেকে আমায় বেশি নম্বর দিতে স্যারেরা বাধ্য
হতেন।বন্ধুরা অনেকেই মাঝে মাঝে জানতে চাইতো যে এতো দ্রুত ম্যাপ আঁকার কোন কৌশল আছে কিনা - আমি থাকতাম চুপ করে। ট্রিকস একটা ছিলোই, যেটার মেজরিটিতে ছিলো স্রেফ প্র্যাকটিস, আর কিছুটা ছিলো ইন্ডিয়ার ম্যাপ প্রিন্ট করা এক-টাকার গোল এক কয়েন, যা আমার জ্যামিতি বক্সে সব সময় রাখা থাকতো। স্যারেরা পরীক্ষায় গার্ড দেবার সময় সেটা দেখেও কখনো খেয়াল করতেন না, কারণ ম্যাপ আঁকার সময় ছাড়া বাকি সময় সেটা অন্য মুখে চেয়ে থাকতো !! তবে মূলত: সেটার কাজ ছিলো আমার ম্যাপ আঁকার সময়ে ফাইন টিউনিংয়ে হেল্প করা !


আজ সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে এসে অবাক হয়ে দেখি যে কতো অচেনা, অজানা সংস্কৃতির হাজার হাজার লোক এখানে এসে একসাথে, মিলেমিশে দিব্যি রয়েছে, অথচ আমাদের নিজেদের দেশে আমরা সেটা করতে পারলাম না কেন? ফিফটি স্টেটের “ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা” আজও সেই ফিফটি স্টেটই হয়ে আছে, অথচ আমরা? স্বাধীনতার পরে কতো যে নতুন স্টেটের জন্ম দিতে ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট বাধ্য হলো, ভাবতেও লজ্জা লাগে ! শিক্ষিত মানুষেরা আজও আলাদা  আলাদা স্টেটের দাবি নিয়ে আমরণ অনশনের হুমকি দেয়, আর একদল ধুয়োধরা জনতা তাদেরকেই সাপোর্ট করে চলে! দেশ মানে কি শুধুই সীমারেখা? দেশ মানে কি ভালোবাসা নয়? 

এখন বুঝতে পারি, ছোটবেলার সে রোমাঞ্চের কারণ পরিচয় না থাকার কারণে হলেও হতে পারে, তাই বলে 'দূর দেশ' বলে কিন্তু ছিলো না। বরং, পরবর্তীকালে নিজের দেশের কিছু নামই হয়ে উঠেছে আমার কৈশোরের রূপকথার রাজ্যের কল্পনার সব চরিত্র। ভুগোল বইয়ের পাতা থেকে এখনো চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠে সেই সব জাদুকরী নামগুলো: কৃষ্ণচুড়া, অর্জুন, সুন্দরী, কেওড়া, গেওয়া, গরান, গোলপাতা, - ভেজা কদম, শুকনো খড়, পানের বরজ, নদীতে জোয়ার-ভাঁটা, আশ্বিনের ঝড়, আকাশ কালো করে ঝুম বৃষ্টি, মেঘ-কুয়াশার লুকোচুরি, ভোরের দোয়েল পাখি, সোনালি ফসলের মাঠ, ছায়াময় স্নিগ্ধ ঘাসের পাটি, রূপশালী ধান আর কুশ কুটিকাটি। 

চলুক বেজায় রাজনীতি - যাক জিতে কেউ, যাক হেরে কেউ। কিন্তু সূর্যমুখী ফুলের রঙ দেখা আমাদের ছোট্ট জীবন টিকে থাকুক নিশ্চিন্তে, নিরাপদে। তারার আলোয় আলোকিত হয়েই বেঁচে থাকুক, চিরকাল এক হয়ে থাকুক আমার ছোটোবেলার 'সে দেশ' - আমারই স্বদেশ।


ঘুম তাড়ানোর মোক্ষম দাওয়াই...

মানুষের জীবদ্দশায় তার নানান রকমের নাম থাকে - বাবা-মায়ের দেওয়া ফরম্যাল নাম, ডাক নাম, নিক-নেম, মামা-দাদু-পিসী-মাসীদের দেওয়া আদরের নাম, বন্ধুদের দেওয়া হ্যান্ডফুল নাম, প্রেমিকার দেওয়া সোহাগের নাম, বৌয়ের দেওয়া গলু-মলু নাম, পাবলিকের দেওয়া বদনাম, আরও কতো নাম!! কিন্তু মানুষ মরে যাবার পর তার "একটাই" নাম হয়ে যায়, সেটা হলো 'body' বা সোজা বাংলায় 'লাশ' বলে যাকে। তো সেই লাশ নিয়ে রাত কাটানো মুখের কথা নয়, অনেক সাহসের দরকার পড়ে। ভাগ্যের একান্ত ফেরে না পড়লে সেরকম রাত কেউ কাটাতে চায় বলে আমার বিশ্বাস হয় না। কিন্তু মাথা ঘুরে কেউ যদি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়, তখনও কি তাকে 'লাশ' বলা চলে? তা যদি হয় তো, লাশের সাথে আমি কাটিয়েছি বেশ কিছুটা সময় - 'রাত' হয়তো ঠিক নয়, তবে 'ক্লাস' বলা চলে। 


ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ড থেকে গ্রাজুয়েশনের জন্যে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে প্রথম যে সমস্যার সম্মুক্ষীণ হয়েছিলাম, সেটা হলো সেমিস্টার সিস্টেমে পরীক্ষার ব্যবস্থা। অর্থাৎ প্রতি ছয় মাস অন্তর পরীক্ষা, এবং প্রতিটি পরীক্ষাই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মানে হাফ-ইয়ার্লি বলে রিলাক্সড থাকার কিছু নেই - প্রতিটি পরীক্ষাই ফাইন্যাল। অবশ্য এ সমস্যা আমার মতো আরও অনেকেরই হয়েছিলো। আমরা কয়েকজন গ্রুপ করে, নিজেদের মধ্যে নোটস আদান-প্রদান করে সব পরীক্ষার প্রিপারেশন নিতাম। এ ঘটনার সূত্রপাত সেকেন্ড ইয়ার চলাকালীন - তখন পরীক্ষা প্রায় আসন্ন। আমরা সব সিরিয়াস হয়ে উঠেছি, সিনিয়রদের কাছ থেকে নোটস যোগাড় করে রীতিমত আলোচনা শুরু করে দিয়েছি। এসময়ই আমাদের এক ক্লাসমেট, তার আসল নাম এখন ভুলে গেছি, যাকে আমরা 'মামা' বলে ডাকতাম, সে এসে আমাদের গ্রুপে ঢুকতে চাইলো। মামা ছিলো বয়সে একটু বড়ো, নাদুস-নুদুস চেহারা, আর 'গুল' দিতো বেশ ভালোই। সে কাঁচুমাচু মুখে তার সমস্যা নিয়ে এসে হাজির হলো। সমস্যাটি হলো সে নাকি কিছুতেই রাত-জেগে পড়াশোনা করতে পারছে না। রাত দশটার পর তার চোখে অবশ্যম্ভাবী ভাবে ঘুম নেমে আসছে - আর সে ঘুম যেন মরণের ঘুম। অবশ্য এ সমস্যা নতুন কিছু নয়, আমাদের সবারই কম-বেশি হতো, বা হয় এখনো। পরীক্ষা যত কাছে চলে আসে, ঘুমও ততো চোখের পাতায় ভর করে বসে - এটা অনেকটাই মেন্টাল সমস্যা। আমার মনে আছে "Mr. Bean"-এ রন অ্যাটকিনসন ঘুম তাড়ানোর জন্যে প্রথমে তার চোখের পাতায় scotch tape আটকে ট্রাই করেছিলো, কিন্তু সেটাতেও কাজ না-হওয়ায় শেষ অবধি আলপিন দিয়ে চোখের পাতাদুটোকে তার কপালে ভ্রুয়ের সাথে আটকে রাখে !! কিন্তু সে 'ব্রিটিশ সমাধান' মামা কাজে লাগাতে পারবে না বলে, আশ্বাস দিয়ে বললাম, যে অনেক করে চা-কফি খা, না-হলে কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর বিড়ি-সিগারেট ফোঁক - নিশ্চয়ই কাজ হবে। কিন্তু মামা জানালো যে এই সবকিছু সে অলরেডি ট্রাই করে দেখেছে - কিস্যু হয়নি, বরং আরও বেশি বেশি করে তার চোখে ঘুম চলে এসেছে। আমার আরেক ক্লাসমেট, সে আবার "হাততালি-নেশা", অর্থাৎ 'খৈনি'তে ঘোর বিশ্বাসী ছিলো। যতদুর মনে পড়ে 'রাজা খৈনি'ই সে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতো সে সময়। তো সেই অত্যাধিক খৈনি সেবনের কারণে তার নিচের ঠোঁটটা সবসময় ফুলে থাকতো। প্রথম প্রথম দেখতে একটু অস্বস্তি লাগলেও, পরে সেটা আমাদের চোখ-সয়ে গিয়েছিলো। সে-ই মামাকে সাজেশন দিলো যে 'খৈনি' ট্রাই করে দেখতে - হাতেনাতে অব্যর্থ ফল সে পাবেই পাবে। মামাও উৎসাহিত হয়ে তার কাছ থেকে কার্যকরী খৈনির ব্র্যান্ড, তার অনুপানের মাত্রা, প্রস্তুত প্রণালী, সেবনের পদ্ধতি, সময়কাল ইত্যাদি সব ডিটেলসে জেনে নিয়ে, একটুখানি স্যাম্পেল তার কাছ থেকে নিয়ে তখনি ট্রাই করবে কিনা ভেবে দোনামনা করতে লাগলো। সেটা ছিলো একটা অফ-পিরিয়ড, পরের ক্লাসের জন্যে আমরা সবাই ওয়েট করছি। তো আমরা সবাই তাকে অভয় দিলাম যে খুবই ভালো বুদ্ধি এটা - আর সামান্য একটু ট্রাই করে দেখলে কোনো ক্ষতি নেই, বরং সে অনেক বেশি energized ফিল করবে। মামা এতোদিনে আমাদের অনেক 'হ্যান-করেঙ্গা, ত্যান-করেঙ্গা' বলে গুল দিয়ে এসেছে কার্য্যকালে এসে দেখা গেলো বেসিক্যালি সে বেশ ভীতু আর নার্ভাস টাইপের ছেলে, যাকে বলে নিখাদ বাঙালি। যাই হোক আমাদের সবাইয়ের মিলিত অভয়্দানে কিছুটা ভরসা পেয়ে সে সামান্য একটু খৈনি আর চুন ভালো করে ডলে ডলে, 'জয় মা' বলে হাততালি মেরে, তার তলার ঠোঁটটার নিচে ঢুকিয়ে দিলো। তাকে নির্দেশ দেওয়া ছিলো কিছুক্ষণ ওয়েট করে, সামান্য একটু ঢোঁক গেলার। কিন্তু তারপর আল্টিমেটলি যা ঘটলো সেটা ঠিক লিখে প্রকাশ করা যাবে না, বরং হ্যান্ডিক্যামে রেকর্ড করা থাকলে ভালো হতো। মামার চোখ দুটো ফুলে গোল-গোল আর লাল হয়ে উঠলো। ঘড়ির পেন্ডুলামের দুলুনির ভঙ্গিতে সে তার মাথাটা সামান্য করে দোলাতেই থাকলো - ধীরে ধীরে দুলুনির স্পিড বাড়তে থাকলো। তারপর আমাদের সকলকে হতবাক করে দিয়ে, 'অ্যা-আ-ওঁ-ওঁ-ক' করে বেঞ্চে লুটিয়ে পড়লো। ঘটনাটা শুনতে যতোটা মজার, বাস্তবে কিন্তু ততোটা মজার হয়ে ওঠেনি আমাদের কাছে। শক খেয়ে উঠে আমাদের মাথায় সর্বপ্রথম চিন্তা এলো যে ব্যাটা মরে যায় নি তো? কিন্তু তার কানের তলায় আর নাকের নিচে হাত দিয়ে আমাদের ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এলো - নাহ: বেঁচে আছে ঠিকই - শুধু একটু ভিরমি খেয়েছে মাত্র !!! তখন আমাদের হাসি দেখে কে !! 

এদিকে আমাদের স্যারের আসার সময় তখন হয়ে এসেছে। আমাদের ক্লাস হতো দোতলায়, স্যার আসতেন অন্য এক বিল্ডিং থেকে। কে একজন দৌড়ে হলের বারান্দায় গিয়ে দেখে এসে জানালো যে স্যার প্রায় আমাদের বিল্ডিংয়ের সামনে চলে এসেছেন। এদিকে আমরা মামার সেই অচেতন বডি নিয়ে কি করবো ভেবে পেলাম না। তখন আমদের ক্লাসরুম ছিলো গ্যালারি প্যাটার্নের। একজন বুদ্ধি দিলো যে মামাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে একদম উপরের সারির বেঞ্চের নিচে শুইয়ে রেখে আসা যাক - কারোর নজরে চট করে পড়বে না। আর হোপফুলি ক্লাস চলাকালীন মামারও জ্ঞান ফিরে আসবেনা - at least let's pray for that - যেই বলা সেই কাজ। চারজনে মিলে মামার দুই হাত-পা ধরে, চ্যাংদোলা করে তুলে, কোনমতে একদম উপরের সারির বেঞ্চের নিচে শুইয়ে রেখে এসে, ভালো ছেলের মতো আমরা দ্রুত যে-যার জায়গায় বসে পড়লাম। যথারীতি স্যার এসে ক্লাস নেওয়া শুরু করলেন। তাঁর নজর অতো দূর অবধি গেলো না, যাবার কোন কারণও ছিলো না - কারণ সেই গ্যালারিতে প্রায় আশি জনের বসার সিট ছিলো, কিন্তু আমাদের ক্লাসে টোটাল স্টুডেন্ট ছিলো পঁয়ত্রিশজনের মতো। সুতরাং স্যারের সন্দেহ করার কোনো কিছু ছিলো না। কিন্তু একটা কিছু যে ঘটে চলেছে সেটা তিনি আঁচ করতে পেরে মাঝে মাঝেই লেকচার বন্ধ করে, আমাদের দিকে কিছুক্ষন ধরে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। সেই প্রথম, আমরা ছেলেরা, একের পর এক প্রশ্ন করে করে তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললাম। আমাদের এতো উৎসাহ দেখে, আর অগুন্তি প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে স্যার পর্যন্ত অবাক হয়ে গেলেন - কিছুটা খুশীও হলেন। এইভাবে কোনমতে হাসি চেপে, আর তীব্র মনোযোগ দেখিয়ে আমরা সে পিরিয়ডটা কাটিয়ে দিলাম। 

ক্লাস শেষ হয়ে গেলে জলের ছিটে দিয়ে দিয়ে মামার জ্ঞান ফেরানো হলো।পুনর্জীবন পেয়ে মামার সে হম্বি-তম্বি দেখে কে তখন! আমাদেরকে ধরে এই মারে তো সেই মারে! কিন্তু দোষটা পুরোপুরি আমাদের নয়। সামান্য খৈনির ঝাঁজ যে সে সহ্য করতে পারবেনা তা কে জানতো ! নিজের হাতে করে সে ডলে ডলে, নিজের বুদ্ধিতেই খৈনিটা খেয়েছে - তো আমরা যদি দোষী হই, তো সেও কম দোষী কিছু নয়। এই সব আবোল-তাবোল যুক্তি দেখিয়ে তাকে সেদিনের মতো কোনরকমে থামানো হলো। বলাবাহুল্য সেবারের পরীক্ষায় মামা সবকটা পেপার ক্লিয়ার করতে পারেনি - দুটো না তিনটেতে 'রিপিট' পেয়ে গেছিলো। হাততালি-নেশা তাকে সে যাত্রায় বাঁচাতে পারেনি। কিন্তু ক্লাসে থাকা মেয়েদের দল সেদিন 'giggling' কাকে বলে তা হাড়ে হাড়ে আমাদের বুঝিয়ে ছেড়েছিলো।


Friday, November 29, 2013

টিনটিন আর অ্যাসটেরিক্সের সাথে

On January 10th (Le 10 Janvier)
"আনন্দমেলা" প্রকাশিত হতে শুরু করে বাংলায় ১৩৮২-র বৈশাখ মাস থেকে অর্থাৎ ইংরেজিতে ১৯৭৫ সাল থেকে। সুখপাঠ্য কিশোর সাহিত্যের একটা স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দিয়ে গিয়েছিলো আনন্দমেলা। শুধু তাই নয় রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত ঘরের হাজার হাজার বাবা-মার ঘোর আপত্তিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে টিনটিনকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলো। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মহাশয়ের অসাধারণ সাবলীল বাংলা কথোপকথনে টিনটিনের 'স্নোয়ি' নিমেষেই হয়ে উঠেছিলো আমাদের অতি প্রিয় 'কুট্টুস' - গল্পের বাঁধুনি, চরিত্রের বৈচিত্র্য, দুরন্ত সব পটভূমিকা, তার সাথে টিনটিনের স্রষ্টা আরজে বা হার্জে-র প্রবর্তিত Ligne Claire (‘লিনেউ ক্লেয়ার’) স্টাইলটাও টিনটিনের সাফল্যের একটা অন্যতম বড় ফ্যাক্টর। পরবর্তীকালে অন্যান্য ফ্রেঞ্চ এবং বেলজিয়ান আর্টিস্টরাই মূলত হার্জের দেখাদেখি এই স্টাইলটা ফলো করতে থাকেন। 
টিনটিন - কাঁকড়া রহস্য
তবে সেই সুদুর কৈশোরে প্রথমবার টিনটিন পড়তে গিয়ে Ligne Claire ব্যাপারটা সেরকম ভাবে কোনো ছাপই ফেলেনি মনে, কারণ টিনটিনের গল্পগুলো ছিল এতোই টানটান, আর চরিত্রগুলো এতোই বর্ণময়, যে কমিকস পড়ছি বলে মনেই হতো না - বরং মনে হতো যেন ফেলুদার মতনই ঝরঝরে কোনো গোয়েন্দা কাহিনী বা অ্যাডভেঞ্চার পড়ছি কমিকস হিসাবে। আশির দশকের মাঝামাঝি ইন্দ্রজাল কমিকস নিয়ে এসেছিলো আর একটি নতুন ক্যারেক্টার, ‘টিম্পা’ - যার স্রষ্টা ছিলেন, জাহাঙ্গীর কেরাওয়ালা। অরণ্যদেব, ম্যানড্রেক, বাহাদুর, ফ্ল্যাশ গর্ডন জাতীয় মূল কমিকসের শেষে চার-পাঁচ পাতা বরাদ্দ থাকত টিম্পার জন্য - ঠিক যেমন একটি বা দুটি পাতা বরাদ্দ থাকত হেনরি (গুণধর/গাবলু), চকি ইত্যাদি চরিত্রগুলির জন্য। সোজা বাংলায় টিম্পা হল টিনটিনের স্পিন-অফ ক্যারাক্টার, সারা পৃথিবী জুড়ে এরকম চরিত্রের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু তারপরেও টিম্পার জন্য অনেক কলকাত্তাইয়া কমিকস-প্রেমীর মনে আলাদা একটা জায়গা আছে, কারণ ইন্দ্রজাল কমিকস সর্বভারতীয় হলেও টিম্পা কিন্তু এই কলকাতারই ছেলে। ওর বাবা ইনস্পেকটর দত্ত কলকাতা পুলিশে কাজ করেন, সেই সুবাদে বহু সময়েই টিম্পার বাড়িতেই রহস্যের জাল ঘনীভূত হতে থাকে। আর সেই জাল ছাড়ানোর কাজে টিম্পা ওর দাদু  এবং কুকুর রেক্সিকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে কখনো মুর্শিদাবাদ, কখনো শিলিগুড়ি আবার কখনো বা আন্দামানে। কিন্তু টিনটিনের তুলনায় টিম্পাতে অনেক বেশী ‘স্পীচ বাবল’ থাকত এবং প্রত্যেকটি বাবলে লেখার পরিমাণও থাকতো বেশ অনেক। তাই যারা আগে টিনটিন পড়ে ফেলেছিলো, তাদের কাছে টিম্পা তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। আশির দশকের শেষে ইন্দ্রজাল কমিকস  উঠে যাওয়ার পর দারা, বাহাদুরের মতন নিখাদ ভারতীয় কমিকসগুলোর মতনই টিম্পা-ও বন্ধ হয়ে যায়। জাহাঙ্গীর কেরাওয়ালা-ও কলকাতা ছেড়ে চলে যান পুনেতে। 


অ্যাস্টেরিক্সের সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিলো কলেজে পড়ার সময় - তখন ক্লাস শেষে বাড়ি না-ফিরে যাদবপুর থেকে মাঝে মাঝে বাসে করে আমি সোজা গোলপার্কের পুরানো বইয়ের দোকানগুলোতে ঢু-মারতে চলে আসতাম, আর ফিরতাম ট্রেনে চেপে, বালিগঞ্জ হয়ে। আমার মূল লক্ষ্য থাকতো দেবসাহিত্য কুটীরের পুরানো পূজাবার্ষিকী, কি টিনটিন অথবা অরণ্যদেব/ম্যানড্রেক সস্তায় কেনা - কিন্তু দোকানদার গুলো 'কি বই চাই দাদা, কি বই?' বলে এতো ঘ্যান-ঘ্যান করতো যে তাদের থামানোর জন্যে আমি গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করতাম 'অ্যাসটেরিক্স আছে?', কারণ কোথা থেকে যেন শুনেছিলাম যে অ্যাসটেরিক্সের দাম অনেক বেশী, আর নিউ মার্কেট ছাড়া কোলকাতার আর কোথাও সেটা পাওয়া যায় না। কিন্তু অ্যাসটেরিক্স যে টিনটিনের মতোই আরেকটা জলজ্যান্ত ক্যারেক্টার সেটা বুঝতে পারিনি। 
গোলপার্কের Roadside বইয়ের দোকান
আমি ভাবতাম এটা কোন একটা বিশেষ বইয়ের নাম। তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দোকানদার গুলো হতাশ কন্ঠে জবাব দিতো, 'না দাদা! অ্যাসটেরিক্স তো নেই, কিন্তু টিনটিন আছে - টিনটিন নিন না...' - আর আমিও এমন ভাব দেখাতাম যে টিনটিন আমার সব পড়া - সুতরাং তারা আর আমাকে বিরক্ত করতো না, আর আমিও আমার নিজের মতো করে বইপত্র ঘেঁটে চলতাম। এইভাবে চলছিলো বেশ, কিন্তু গন্ডগোল হলো একদিন। এক ব্যাটা দোকানদার বেশ অনেক ক'টা অ্যাসটেরিক্স-এর বই এনে রেখেছিলো। সেদিন আমি যথারীতি একই প্রশ্ন করে ফেলতেই, সে ব্যাটা ঝট করে এক বান্ডিল অ্যাস্টেরিক্স আমার সামনে নামিয়ে এনে বললো, 'কোনটা আপনার চাই ?' - এবারে তো আমি পড়ে গেছি বিপাকে। মিথ্যে কথা প্রিপারেশান ছাড়া বলা সহজ নয় - অন্তত আমার কাছে তো নয়ই। সুতরাং ঢোক গিলে, তো-তো, ইয়াম-য়াম করতে করতে বললাম, 'ও, এগুলোই বুঝি অ্যাসটেরিক্স? ঠিক আছে, দেখি একটা...' - সেই প্রথম আমার অ্যাসটেরিক্স কেনা - বইটার নাম ছিলো: "Asterix And The Golden Sickle" - অনেক পরে যেটা আনন্দ পাবলিশার্স "সোনালী কাস্তে" নামে প্রকাশ করে।
প্রথমবার অ্যাসটেরিক্স পড়ে চমকে গিয়েছিলাম - এটাও একটা অ্যাডভেঞ্চার, কিন্তু টিনটিনের সাথে এর অনেক ফারাক। এর পাতায় পাতায় হাসির ফোয়ারা লুকানো - রোমান ইতিহাসের নানান তথ্যও এই গল্পগুলোতে ছড়িয়ে আছে। আর অ্যাসটেরিক্স-ওবেলিক্স-গেটাফিক্স-এর কম্বিনেশন অনাবিল হাসি আর মজার উদ্রেক করে তোলে, প্রায় প্রতিটি মুহুর্তেই। সুতরাং আরও ঘনঘন আমার গোলপার্ক যাওয়া শুরু হলো, যদিও তখন মূল লক্ষ্য গেছে কিছুটা বদলে। এরপর এক এক করে, কলকাতায় থাকাকালীন প্রায় সবকটা অ্যাসটেরিক্সই কিনে ফেলেছিলাম - শুধুমাত্র "How Obelix Fell into the Magic Potion"-বইটা  ছাড়া - সেটাও বোধ হয় এখন দেশে পাওয়া যায়। তবে বাংলায় লেখা অ্যাসটেরিক্স পড়ে আমার খুব একটা ভালো লাগেনি। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মহাশয়ের অভাব অনুভব করেছি পদে পদে। 


অবশেষে অ্যাসটেরিক্সের ৩৫তম বই, "Asterix and the Picts" বার হচ্ছে এই ডিসেম্বরে। ইন্ডিয়াতে অবশ্য কিছুটা আগেই এটা বেরিয়ে গেছে - Amazon.in ভালোই বিক্রি করছে। কিন্তু অ্যামেরিকায় এখনো এটা বার হয়নি।  Amazon.com রিলিজ করবে ডিসেম্বর থার্ড উইকে। যদিও এই গল্পের রিভিউ তেমন ভালো হয়নি, তবুও সাগ্রহে অপেক্ষা করে আছি নতুন অ্যাসটেরিক্সের জন্যে। Ironically এদেশের kids-দের মধ্যে টিনটিন বা অ্যাসটেরিক্সের প্রতি তেমন কোন আগ্রহ দেখিনি, বরং তারা ভিডিও গেমস নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। এমন কি স্পিলবার্গের "টিনটিন মুভি"ও অনেকেই দেখেনি - দেখে অবশ্য হাসির থেকে মাঝে মাঝে বেশ করুণাই জাগে মনে। আমাদের দেশেও হয়তো এই একই অবস্থা চলছে। কিন্তু 'আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ' - সুতরাং আমি বসে আছি কবে সেই নতুন অ্যাসটেরিক্সের মুখোমুখি হবো বলে!

Monday, November 25, 2013

Black Friday অ্যান্ড আইনস্টাইনের 'থিওরী অফ রিলেটিভিটি'

এদেশে আসার আগে জানতাম যে BF মানে হলো গিয়ে 'বয় ফ্রেন্ড', যে রোলে পার্ট করার চান্স আমি খুব একটা পাই-ই নি। আরেকটা দুষ্টু মানে হলো গিয়ে 'নীল সিনেমা', যেটাও সময়কালে দেখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এদেশে আসার পর জানলাম BF-র আরেকটা অন্য মানে - সেটা হলো 'Black Friday' অর্থাৎ 'কালো শুক্রবার' - আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে, 'ThanksGiving'-এর ঠিক পরের শুক্রবার। আনওফিসিয়ালি এই দিন থেকে এদেশে হলিডে শপিং শুরু হয়ে যায়। প্রায় যাবতীয় রিটেলার ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলো অনেক জিনিসের ওপর স্পেশাল ডিসকাউন্ট বা 'bargain deal' দেয়, যাতে পুরানো স্টকের জিনিসপত্র সব বিক্রি হয়ে যায় - অনেকটা আমাদের দেশের 'চৈত্রের সেলের' মতোই। Black বলার কারণ, সাধারণত অ্যাকাউন্টিয়ে হিসাবের খাতায় লাল কালি ব্যবহার করা হয় 'loss' বোঝাতে আর কালো কালি ব্যবহার করা হয় 'profit' বোঝানোর জন্যে। বহু রিটেলারের কাছেই বছরের সেরা প্রফিটেবল দিন হলো এটাই। তো বছরের এই স্পেশাল দিনটিতে আমেরিকানরা শপিং-এর জন্যে ভীষনভাবে সিরিয়াস ও পাগল-প্রায় হয়ে ওঠে। ভাবখানা এমন করে যেন এদিন কিছু না-কিনতে পারলে গোটা জীবনটাই তাদের বৃথা হয়ে যাবে - কিছু একটা কিনতে হবেই যেন তাদের!  অবশ্য আমেরিকানদের সাথে পাল্লা দিয়ে এশিয়ানরা, এমন কি ইন্ডিয়ানরাও কিছু কম যায় না। 'ঝাঁকের কই'-এর মতো সেই স্রোতে গা-
ভাসিয়ে বেশ কয়েক বছর আগে আমিও এক Black Friday-র কনকনে ঠান্ডা, শীতের ভোরে ৪:১৫ থেকে FRY'S নামের এখানকার এক পপুলার ইলেকট্রনিক্স স্টোরের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে গেছিলাম। সামনে পিছনে অজস্র লোক - সবাই যেন কেমন মোহগ্রস্ত হয়ে এক অজানা কোন চরম প্রাপ্তির জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করে যাচ্ছে। সে দোকান খুললো কাঁটায় কাঁটায় সকাল ৬টায়। মুহুর্তের মধ্যে প্রায় হাজারটা লোক একসাথে দোকানের বিশাল দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করলো। পদ-পিষ্ট হতে হতে কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে, ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে দোকানে ঢুকলাম।তারপর যা কিছুই কিনতে যাই সেখানেই দেখি আমার আগে অন্তত গোটা ৭০ জন লোক এসে হাজির হয়ে জটলা পাকাচ্ছে - লাইন বলে কোন কিছু নেই। দোকানের customer service-র ছেলেগুলো দেখি সব স্টেপ-আপ টুলের মাথায় উঠে প্যাকেজিং বক্স গুলো নিয়ে নিচের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে। আর নিচে দাঁড়িয়ে থাকা পাগলা জনতা সেগুলোকে 'হরিলুটের বাতাসা লোটার' মতো করে লুফে, কেড়ে নিচ্ছে। আমিও ওদের দেখাদেখি ভীড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে, লাফিয়ে লাফিয়ে কোনরকমে একটা পোর্টেবল DVD প্লেয়ার লুফে নিলাম। তারপর এদিক সেদিক ঘুরে কিছু পড়ে থাকা USB drive, কয়েকটা ডিসকাউন্টেড ডিভিডি, আরও বেশ কিছু হাবি-জাবি জিনিস কিনে, খুশি খুশি মুখে সকাল সাড়ে-সাতটায় বাড়ি ফিরলাম। উদভ্রান্ত চেহারা, ঘুম না-হয়ে চোখদুটো লাল, মাথা ঝিমঝিম, কিন্তু মুখে 'সব পেয়েছির হাসি' - ঝোঁকে পড়ে  কেনা সেইসব জিনিসগুলোর বেশিরভাগই এখনো তেমন ব্যবহার করা হয়ে ওঠেনি। কিছু কিছু এখনও প্যাকড অবস্থায় পড়ে আছে। DVD প্লেয়ারটা বেশ কিছুদিন ব্যবহার করা হয়েছিলো - সম্প্রতি আমার স্বনামধন্য পুত্র সেটাকে নিয়ে দেখি, ভাঙে কি না পরীক্ষা করতে গিয়ে এক আছাড়ে প্রায় দ্বি-খন্ডিত করে দিয়েছে - কিন্তু তাও সেটা এখনো চলছে। শুধু তার স্ক্রিনটাকে সাপোর্ট দেবার জন্যে একটা আলাদা করে বালিশ লাগে। 

তার পর থেকে বেশ কয়েক বছর আর স্রোতে গা-ভাসাই নি। 'যেতে দাও, গেলো যারা' বলে ঘুম থেকেই উঠিনি। এবছর ঠিক করলাম যে যাই ঘুরে আসি, দেখি অবস্থা আদৌ improved হয়েছে কিনা - না কি 'সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলছে...' - সেই মতো ঘুম থেকে উঠে সকাল আটটা নাগাদ বার হলাম - কোনো তাড়া নেই, জাস্ট উইন্ডো শপিং করবো বলে। কিন্তু যে দোকানেই যাই না কেন, গাড়ি আর পার্ক করতে পারি না। রাস্তার দু'ধার সহ সব পার্কিং লট একেবারে পুরো প্যাকড। লোকজন সব কতো দূরে দূরে গাড়ি পার্ক করে হাঁটতে হাঁটতে আসছে - দেখে আমাদের দেশের দূর্গা পূজার রাতের ঠাকুর দেখার কথা মনে পড়ে গেলো। 
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ ধরে নানান জায়গায় চক্কর কেটে কেটে, শেষমেষ বিরক্ত হয়ে বাড়ি ফিরবো কিনা ভাবছি, হঠাৎই নজরে এলো রাস্তার এক ধারে, মেক্সিকান এক ফ্যামিলি ট্রাকে করে প্রচুর তরমুজ নিয়ে হাজির হয়েছে, বিক্রির জন্যে। একজন দুশমন চেহারার বেঁটে লোক, সঙ্গে দুটো ছোট বাচ্চা - সম্ভবত এদের নিজেদের ক্ষেতেরই ফল। তরমুজগুলোর সাইজ দেখতে রীতিমত ঈর্ষণীয়। মনে মনে ভাবলাম দেখতেই যদি এতো ভালো হয়, না-জানি খেতে কতো ভালো হবে। চিন্তা করে দেখলাম একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, একদম খালি হাতে বাড়ি না ফিরে, বরং একটা তরমুজ কিনে ফেরা যাবে, at least  কিছু তো কেনা হবে। ছোটবেলায় বাবার সাথে বাজার করতে গিয়ে জেনেছিলাম যে তরমুজ সব সময় পাকা অবস্থায় কিনতে হয়, না'হলে  খেতে ভালো নাগে না। যদি দেখা যায় যে তরমুজের গায়ে অনেক অনেক স্ট্রাইপ, তো সেই তরমুজ মোটেই পাকা নয়। বরং যেগুলোর তলার দিকটা একটু হলদেটে রংয়ের, সেগুলোরই পাকা হওয়ার চান্স অনেক বেশি। কিন্তু আমার সামনে থাকা তরমুজগুলো দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না - এগুলোর গায়ে স্ট্রাইপও আছে, আবার নিচের দিকটা কিছুটা হালকা রংয়েরও বটে। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে মেক্সিকান বিক্রেতাওয়ালা ও তার দুই ছেলে 'হোলা, হোলা' করে মাথা ধরিয়ে দিলো। আমি আমার বেংলিশ ভাষায় গম্ভীর ভাবে বললাম, দেখো বাপু, ছোটবেলা থেকে বাজার করে এসেছি - সারা জীবনে প্রচুর ধোঁকাও খেয়েছি - তাই এই বুড়ো বয়সে নতুন করে আর আমাকে ধোঁকা খাওয়াতে পারবে না। যদি তরমুজের ভিতরটা টকটকে লাল হয় তো আমি ক্যাশ দিয়ে কিনবো, নইলে কিন্তু আমি 'বাপের কু-পুত্তুর' - একটা পয়সাও, থুড়ি! একটা পেনিও দেবো না ! অনেক কষ্টের পর সে 'হোলা ফ্যামিলি'কে আল্টিমেটলি বোঝানো গেলো আমার সেই শর্ত। তারা রাজিও হলো, বললো, 'ঠিক আছে, তরমুজ যদি টকটকে লাল না-হয়, তাহলে তোমাকে দাম দিতে হবে না' - তো সেই শর্তে ওজন করে কেনা হলো বেশ বড়সড় একটা তরমুজ। এবার তাদেরকে বললাম, “তাহলে এখন কেটে দেখাও যে ভিতরটা কি রকম লাল”- কিন্তু ও হরি !! কাটার পর দেখা গেলো, তরমুজের ভিতরটা প্রায় চালকুমড়ার মতোই সাদা, শুধু ধারের দিকটা একটু গোলাপী রংয়ের। এদিকে ধেড়ে মেক্সিকান বিক্রেতা ও তার সঙ্গীসাথীরা সবাই একযোগে “ওয়াও! ওয়াও!” রব তুলে সমস্বরে বলতে থাকলো “এর থেকে লাল আর তরমুজ হয় না, কি সুন্দর টমেটোর মতো লাল তরমুজ - দিন, এবার টাকা দিন...” - আমি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম। ভাবলাম হয়তো আমার চোখের 'cone cell'-এর সংখ্যা ঝট করে কমে গেছে। চোখ কচলে ভালো করে নিজের গাড়ির দিকে তাকালাম - দেখলাম নাতো! লাল গাড়ির রং তো ঠিকঠাক লাল-ই দেখাচ্ছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমি তাদেরকে বোঝাতে পারলাম না যে সেটা লাল তরমুজ নয়। অগত্যা কি আর করা - বুঝলাম তরমুজওয়ালা ব্যাটারা আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটি প্রয়োগ করতে শিখে গেছে। যাহা আমার কাছে সাদা, তাহাই উহাদের কাছে টুকটুকে লাল। সবই আপেক্ষিকতাবাদের লীলা খেলা। স্বর্গত: আইনস্টাইনের উদ্দেশ্যে গালাগালি করা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই! অত:পর নগদ টাকা দিয়ে এক পেল্লায়, সাদা তরমুজ কোলে করে গাড়ীতে উঠলাম। বামফ্রন্ট জমানায় প্রচুর বাইরে-সবুজ-ভিতরে-লালওয়ালা তরমুজে-রাজনীতিবিদ দেখেছি - দিদির আমলে নিশ্চয় তারা এখন রং পাল্টিয়েছে, স্বভাব না পাল্টে। কিন্তু গিন্নীকে কি করে ভজাই আমি... তারই ফিকির খুঁজতে খুঁজতে গাড়ী স্টার্ট দিলাম!   

Sunday, November 24, 2013

একটি ওয়াশিং মেশিনের আত্মকথা

আমাদের বাড়িতে প্রথম আয়েশীয়ানার প্রচলন শুরু করে দেয় আমার মেজদা। চাকরি পাবার কিছু পরে পরেই মেজদা তার 'নিয়ন্ত্রিত' জীবনযাপন শুরু করে দেয়। রাত দেড়টা অবধি জেগে থেকে 'কলকাতা DD2 (মেট্রো)' চ্যানেলের বাংলা নাটকগুলোর সব ক'টা রিপিট টেলিকাস্ট দেখে তবে সে ঘুমোতে যেতো। যেদিন কোনো নাটক থাকতো না, সেদিন বারান্দার লম্বা বেঞ্চটাতে বসে বসে সে বাঁশি বাজাতে থাকতো। পাশে বসে থাকা বাড়ির  বিড়ালটা হতো তার একান্ত গুণমুগ্ধ শ্রোতা।  তেমন কোনো চেনাজানা সুর নয়, কিছুটা random, কিছুটা ভুল note-এ ঘুরেফিরে বেড়াতো তার দু'হাতের আঙুল গুলো। নিস্তব্ধ রাতে বাঁশির সেই অচেনা সুর  শুনতে খুব একটা খারাপ লাগতো না। মাঝে মাঝেই ঝিম ধরে আসতো। পরের দিন সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠতো অফিস যাবার ঠিক আধঘন্টা আগে - শুরু হতো প্রচন্ড ব্যস্ততা। আর ছুটির দিন হলে সে উঠতো, কিছু না-হলেও সকাল সাড়ে-ন'টার পরে। তারপর শুরু হতো তার একের পর এক বায়ানাক্কা - খবরের কাগজ কৈ, চা পেতে এতো দেরী হচ্ছে কেন, সকালের জল-খাবারে ডিম-সিদ্ধ নেই কেন, রেডিওটা কোথায় গেলো, বাথরুম খালি হচ্ছে না কেন, রোদ্দুরে বসার কোন জায়গা নেই কেন, বিড়ালটাকে খাবার দেওয়া হয়নি কেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। চা অবশ্য শুধুমাত্র ছুটির দিনগুলোতেই বানানো হতো, অন্যান্য দিনে চা-খাওয়া প্রায় নিষিদ্ধ ছিলো আমাদের বাড়িতে -  কোনো গেস্ট এলে অবশ্য এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটতো। চা-খাওয়া নিয়ে এতো কড়াকড়ির জন্যেই সেই ছোটোবেলা থেকে ওই চায়ের প্রতি একটা দূর্দম্য আকর্ষণ গড়ে উঠেছিলো - স্রেফ চা দিয়েই সব কটা রুটি খেয়ে ফেলেছি কতোবার। এমন কি আমাদের বাড়ির বেড়ালটা পর্যন্ত চায়ের বড়ো ভক্ত ছিলো। বহুবারই তাকে লোভে পড়ে ফেলে দেওয়া কষটা, চা-পাতা মুখে নিয়ে তারপর 'ওয়াক' তুলে ফেলে দিতে দেখেছি ! 

এই মেজদা শুরু করলো 'মূল্য ধরে' নিজের জামা-কাপড় অন্য কাউকে দিয়ে কাচানোর সিস্টেম। তখন 'ওয়াশিং মেশিন' বলে যন্ত্রটি আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে তেমন খ্যাবলা মেরে বসেনি। ছুটির দিনে কলতলায় বা পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে বসে আছাড় মেরে মেরে জামা-কাপড় কাচা ছিলো যে কোন বাড়িরই একটা খুব কমন দ্বিপ্রাহরিক অ্যাক্টিভিটি, আর  একই সাথে খুব ইউসফুল এক্সারসাইজ। 'সানলাইট' আর 'সুপার-রিন' ছিলো আমাদের 'De facto' সোপ বার। আর ভারী ভারী, কম দামী জিনিস, যেমন শতরঞ্চি, কাঁথা, চাদর, বালিশের ঢাকনা, আসন, পর্দা, ইত্যাদি কাচার জন্যে বাবা কিনে আনতেন কাপড় কাচা সোডা-গুঁড়ো। একটা বড়ো ডিশের  হাঁড়িতে জল ভরে, তাতে সেই সোডা-গুঁড়ো ভালো করে মেশানো হতো। তারপর সেই হাঁড়ির মধ্যে সব কাপড়-চোপড় দিয়ে কম আঁচে উনুনে কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখা হতো। একটা মোটা লাঠি হাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে মাঝে মাঝে জিনিষপত্র গুলোকে উল্টে-পাল্টে দেওয়া হতো। এরপর সেগুলোকে নিয়ে পুকুর ঘাটে বসে থ্যাবড়া মেরে মেরে কেচে, ধুয়ে ছাদে নিয়ে গিয়ে মেলে দেওয়া হতো।   

তো মেজদা হঠাৎই একদিন স্থির করলো যে নিজের জামা-কাপড় আর নিজে কেচে 'সময় নষ্ট' করবে না। সেই সময়ে বরং কিছু 'ক্রিয়েশনাল' কাজ করবে - যেমন ধরা যাক ম্যাগাজিন বা কমিকস পড়া, লুডো-ক্যারাম খেলা, কাঁচি দিয়ে কাগজ কেটে কেটে অরিগ্যামি শেখা, শীতের রোদ্দুরে বসে খেঁজুর রস খেয়ে কেঁপে কেঁপে হু-হু করা, পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরা, বাড়ির ছাদে টবেতে করে টমেটো, বেগুন, বা গাঁদাফুল গাছের চাষ করা, কিম্বা তেমন কোন কিছু করার না থাকলে নিছকই ঘুম, স্রেফ ঘুম। সেই মতো কাচার পারিশ্রমিক ঠিক হলো - যতদুর মনে পড়ে জামা-পাজামার জন্যে ৭৫ পয়সা, আর প্যান্টের জন্যে ১ টাকা বা ১ টাকা ২৫ পয়সা ধার্য্য করা হয়েছিলো। বাড়ির কাজের মেয়েটি ছাড়াও আমি আর আমার ছোটদি, অর্থাৎ যারা তখনো বেকার ছিলো, তারা সাধারনত এ ধরনের সাপ্তাহিক, টেম্পোরারী  Job offer-এ ভালোই রেসপন্ড কোরতাম। 'ঝোপ বুঝে কোপ মারার মতো' তাল বুঝে কখনো কখনো আমরা বিড করে করে রেট দিতাম বাড়িয়ে। স্পেশালি যেদিন গুলোতে কোন ওয়ান-ডে ক্রিকেট থাকতো, বা বাড়িতে কোনো আত্মীয় আসতো, বা খুব জোরে বৃষ্টি শুরু হতো, বা রবিবারের দুপুরের টিভিতে আঞ্চলিক সিনেমার ন্যাশনাল প্রোগ্রামে কোনো ভালো বাংলা সিনেমা থাকতো। জামা-কাপড়ের সংখ্যা বেশি থাকলেও রেট যেতো বেড়ে, কারণ আমাদের নিজের জামা-কাপড়ও আমাদেরকেই কাচতে হতো। মাঝে মাঝে মেজদাকে রেট বাড়ানোর পরেও 'প্যাকেজড ডীল' হিসাবে এক্সট্রা আরও কিছু দিতে হতো! 

কাপড়-জামা কেচে ধুয়ে, পুকুরে স্নান করে যখন উঠে আসতাম তখন হাত-পায়ের আঙ্গুলের চামড়া গুলো দেখতাম কিছুটা ফুলে ফুলে গেছে। কিন্তু সেই 'উপরি' পাওনার লোভে খুব একটা মাইন্ড করতাম না। বাড়ির কিছুদুরেই কয়েকটা ধোপা বা লন্ড্রীর দোকান ছিলো। তাদের রেটও খুব সম্ভবত এই একই রকমের ছিলো। কিন্তু মেজদা কেন যে আমাদেরকেই প্রেফার করতো, তা এখন মাঝে মাঝে বসে ভাবি। হয়তো 'same day shipping'-এর কনসেপ্ট - কি হয়তো বা নিজের ফ্যামিলির মধ্যেই investment-কে  সীমাবদ্ধ রাখা - কে জানে !!  শরৎচন্দ্রের 'শ্রীকান্ত' উপন্যাসের 'মেজদা'-র সাথে আমার মেজদার চরিত্রের বেশ কিছুটা মিল ছিলো। মাঝে মাঝে মনে হয় 'বাড়ির মেজদারা' বোধহয় সব ঐরকমই হয় !! 


একান্নবর্তী ফ্যামিলি আজ বহুদিনই চলে গেছে বিলুপ্তির পথে। যে'কটা এখনো কোনরকমে জোড়া-তালি দিয়ে টিকে আছে, মনে হয়না এমন মজার ঘটনা আজও কোথাও ঘটে চলেছে। ফ্রি-টাইম বলে আজকাল আর মানুষের কিছু নেই - সবাই কিছু না কিছু নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। সোফা-টিভি-ফ্রিজের মতো ঘরে ঘরে আজকাল অ্যাকোয়াগার্ড, ওয়াশিং মেশিন, কম্পুটার আর ট্যাবের ছড়াছড়ি। কোন কোন বাড়িতে আবার একাধিক সংখ্যায়ও এদের দেখা যায়। ডিশ-ওয়াশার কিম্বা ভ্যাকুয়াম ক্লীনারও আজকাল নাক-উঁচু কোন কিছু নয়। 'রোটি-মেকার' বলে আরেক যান্ত্রিক-প্রজাতিও সম্প্রতি ঘরে ঘরে হানা দিয়েছে। এ সবই হয়তো মানুষের জীবনকে আরও বেশি করে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে তুলেছে, কিন্তু একই সাথে মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসাও হু-হু করে কমিয়ে দিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে খুব দ্রুত হারে  বদলে যাচ্ছে সেই চির-চেনা মায়াবী পৃথিবীটা। একে-অপরের প্রতি নির্ভরশীলতা হারিয়ে আমরাও যেন হয়ে উঠছি দিনের পর দিন আরও, আরও বেশি করে  'প্রায়-যন্ত্র' একেকটা সব মানুষ।       

Tuesday, November 19, 2013

ছেঁড়া ঘুড়ি, রঙিন বল, এইটুকুই সম্বল...

অবশেষে শীত এলো এদেশে, সাথে নিয়ে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। প্রথম প্রেমের মতোই, প্রথম শীতের ধাক্কায় যথারীতি হাবুডুবু খাচ্ছি আমি। ঠান্ডা লেগে জ্বর-জ্বর ভাব, মাথা ভোঁ-ভোঁ শুরু হয়েছে, স্মার্ট মনিটরে ফুটে ওঠা source code গুলোকে দেখে মনে হচ্ছে সব কালো কালো স্মার্ট পিঁপড়ের দল  - দিব্যি হেসে-খেলে, নেচে-গেয়ে বেড়াচ্ছে। 'লোহা লোহে কো কাটতা হ্যায়' - সুতরাং গব্বরের মতো এই শীতকে কাবু করতে আমার চাই আরেকটা শীতল কোন কিছু। তবে এই মুহুর্তে হাতের কাছে 'শীতের গান' ছাড়া অন্য কিছুতে ভরসা রাখতে পারছিনা। 

শীতের গানের কথা ভাবলেই মাথায় প্রথমে আসে আশা ভোঁসলের গাওয়া সেই গানটা: "একটা দেশলাই কাঠি জ্বালাও, তাতে আগুন পাবে..." - এরকম witty অথচ meaningful গানের কথা খুব একটা দেখা যায় না। এই গান শীতকালের না-হয়ে যেতেই পারে না। নির্ঘাৎ কোনো এক শীতের সকালে গানের গীতিকার প্রাত:কালীন প্রেশার আনতে গিয়ে হাতের কাছে কোনো দেশলাই না-খুঁজে পেয়ে, চরম আক্ষেপে এটি লিখে ফেলেছিলেন। পরে একটু সেন্টিমেন্টাল রং-টং চড়িয়ে প্রেমের গান হিসাবে দিব্যি চালিয়ে দিয়েছেন। গানের মধ্যে দেশলাই কাঠি জ্বালানোর সেই 'ফসসজজসস....' আওয়াজ দেওয়ার বুদ্ধিটা যার মাথা থেকে বেরিয়েছে তিনিও এক 'নমস্য ব্যক্তি' - তবে আমি শিওর সেই ব্যক্তি কোনমতেই R. D. Burman নন - most probably স্বপন চক্রবর্তী, যিনি  R. D. সাহেবের গানের 'Interlude Music' গুলো কম্পোজ করতেন। গানের মুখড়ার কয়েক লাইন পরে যখন আশা-দি সুরের চড়ায় উঠে গিয়ে বলেন: "তবুও, আমায় তুমি পাবে না, আমায় তুমি পাবে ন-ন্যা..." শুনে মনে হয় এরকম একটা আগুনে-প্রেমিকা থাকলে ভালোই হতো। প্রেমাগুন দিয়ে at least শীতকালের হীটারের খরচ কিছুটা কমানো যেতো ! 
এই দেশলাই কাঠির কথাতেই মনে পড়ে গেলো ছোটবেলায়, যখন ফোর কি ফাইভে পড়ি তখন একটা হুজুক উঠেছিলো, যেটা ক্রমশই সংক্রামক ব্যাধির চেহারা নিয়েছিলো, সেটা হলো দেশলাই বাক্সের কভারগুলো জমানো। পুরানো পিচবোর্ডের মলাট লাগানো খাতার পাতাতে গঁদের আঠা দিয়ে লাগানো হতো এই সব কভারগুলো। কখনো কখনো আমরা ডুপ্লিকেট কভারগুলোকে অন্যের সাথে ট্রেড করে নিতাম। বাড়িতে যখন বাবা দিনের পর দিন সেই একই, বোরিং লাল 'জাহাজ মার্কা' দেশলাই নিয়ে আসতেন, তখন কি রাগ আর বিরক্তি হতো। বলতাম: 'অন্যের বাবারা তো কত নানান ধরনের দেশলাই কেনেন - তুমি কেনো না কেন?' - বাবা মুচকি মুচকি হাসতেন আর বলতেন 'আচ্ছা, আচ্ছা হবে - নেক্সট টাইমে ঠিক হবে' - তো সেই নেক্সট টাইম আর সহজে আসতো না। আমাদের পুকুরের অন্যদিকের বাড়ির অধিকারীদের ছেলেটা আবার এইসব কভার লুকিয়ে লুকিয়ে বিক্রি করতো। কভার যত রেয়ার হবে, দাম তত বেশী। আমি কিছু না হলেও at least গোটা ত্রিশেক কভার তার কাছ থেকে কিনেছিলাম। যখের ধনের মত আগলে রাখতাম এই কভার গুলোকে। ইস্কুলে নিয়ে গেলেও টেনশান, কেউ যদি নিয়ে নেয়, বিশেষ করে স্যারেদের চোখে পড়লে তো আর রক্ষা নেই। আবার না নিয়ে গেলেও প্রেস্টিজ পুরো পাংচার,  দেখাতে হবে না, যে কতোগুলো জমলো আমার। পরীক্ষায় কিছু নম্বর কম পেলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু দেশলাই কালেকশনে যদি নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে টপকাতে না পারি, তো ফ্রাষ্টু খাওয়ার চোটে কেস দফারফা। ছাতা, মোটর গাড়ি, মশাল, জাহাজ, পিস্তল, বরফি, লাট্টু, নৌকা, তাসের হরতন, রাজা, ঘন্টা... আরো কত্তো নানান ব্র্যান্ডের দেশলাই কভার হতো সেই সময়। একসময় কোত্থেকে ধুয়ো উঠলো যে চারশ'টা ইউনিক কভার জমা দিলে একটা রেডিও, না টিভি ফ্রী-তে পাওয়া যাবে। শুনে আমাদের সে কি উত্তেজনা - বাড়ির বড়োদেরকে দিয়ে দেশলাই কেনানোর হিড়িক পড়ে গেলো। কারোর মাথাতে একবারও এলোনা যে কোথা থেকে সেই প্রাইজ দেওয়া হবে, কারা প্রাইজ দেবে, কেনই বা দেবে, সে'সব ডিটেলস ভেরিফাই করানোর কথা!! দেশলাই বাক্স দ্রুত শেষ করানোর জন্যে আমি মাঝে মাঝে মায়ের চোখের আড়ালে দেশলাই বাক্স থেকে এক গোছা কাঠি তুলে নিয়ে উনুনের মধ্যে ফেলে দিতাম। মুহুর্তের মধ্যে আগুনের এক ঝলকে, দপ করে জ্বলে উঠে শেষ হয়ে যেতো তারা। তারপর নিজেই বলতাম যে একটা দেশলাই কিনে আনবো? মা শুনে অবাক হয়ে বলতেন 'এই তো সেদিন স'বে মাত্র একটা বার করলাম !!'


আবার কখনো কখনো কয়েকটা আস্ত দেশলাই বাক্স একসাথে নিয়ে, তাদেরকে পাশাপাশি রেখে, ইলাস্টিক-ব্যান্ড (গাডার) দিয়ে আটকে পিস্তল বানিয়ে খেলাও বেশ পপুলার ছিলো - বিশেষ করে কালীপূজার সময়ে। টিনের বা মেটালের তৈরী ক্যাপ-পিস্তল তখন এতোটা সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি, অন্তত সাধারণ মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে তো নয়ই। যতদূর মনে পড়ে অর্ডিন্যারি দেশলাইগুলোর দাম ছিলো পনেরো পয়সা, আর যদি মোমের-কাঠি হয় তো দাম কুড়ি, কি বড়জোর পঁচিশ পয়সা ! মোমের দেশলাই বাক্সগুলো ছিলো আকারে একটু ছোট, কাঠিগুলো বেশ মসৃণ ধরণের, আর জ্বলতো অনেকক্ষণ ধরে। একবার রবিবারের সকালে বাবার সাথে বাজার করতে গিয়েছি - বাবা তার এক পুরানো বন্ধুর সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। হঠাৎ সেই বন্ধুটি পকেট থেকে দেশলাই বের করে ফস করে জ্বেলে একখানা সিগারেট ধরালেন। আমি তো তাঁর হাতের সেই অনামী ব্র্যান্ডের দেশলাইখানা দেখে ঈর্ষায় বেশ জ্বলছি। একসময় আর থাকতে না পেরে, শেষমেষ বলেই ফেললাম: 'কাকু, দেশলাইটা আমায় দেবেন ?' - আমার একথা শুনে তিনি তো বটেই, এমনকি বাবা পর্যন্ত হা-হয়ে গেলেন। আমি বেগতিক দেখে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম : 'না মানে, আসলে দেশলাইয়ের কভার জমাই তো, খাতায় আঠা দিয়ে সব আটকে রাখি। আপনার দেশলাইটা আমার কাছে নেই, তাই পেলে ভালো হয়  - তাহলে বোধ হয় আমার দু'শোটা কমপ্লিট হয়ে যাবে' - সেদিন বাড়িতে ফিরে এসে যা বকা খেয়েছিলাম !!!

অবশ্যম্ভাবী পরিণতি রাস্তায় মুখ গুঁজে, শকুনের নজরে চলা। বিশেষত বাজার কিংবা বাসষ্ট্যান্ড এলাকাগুলোতে। পাঁক-কাদা, কফ-থুথু, পান-গুটকার পিক, হিসি, গোবর – কোন আনহাইজেনিক বর্জ্য পদার্থের সাধ্যি ছিলোনা আমাদের দেশলাই অন্বেষণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর। একহাতে নাক ঢেকে অন্য হাতে কাঠি দিয়ে নেড়ে-চেড়ে  দেশলাইবাক্স খোঁজার কাজে আমাদের জুড়ি ছিলো না। পরীক্ষার শেষে বা পুজোর ছুটিতে কখনো বাইরে বেড়াতে গেলে, বন্ধুরা আগে থেকে সব অগ্রিম বুকিং দিয়ে রাখতো - আমিও তাই করতাম। একবার পুরীতে বেড়াতে গিয়ে আনন্দে দশখানা হয়ে বড়দের চোখ এড়িয়ে, রাস্তাঘাট থেকে জমিয়ে কতো যে দেশলাই কুড়িয়েছি, কিনেওছিলাম অনেককটা। এমনও হয়েছে, একই দোকান থেকে তিন-চার রকমের দেশলাই কিনে দোকানদারের চোখ ছানাবড়া করে দিয়েছি। 

গতবছরে দেশে ফিরে মায়ের ঘরের পুরানো কাঠের বাক্সটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎই পেয়ে গেলাম, বা বলা ভালো আবিষ্কার করলাম পুরানো দিনের সেই প্রিয়, অতি-প্রিয় দেশলাই-জমানোর খাতাটা। ক্লাসে এইটে ওঠার পর থেকে ওটার প্রয়োজন ধীরে ধীরে কমে গিয়েছিলো। দীর্ঘ পঁচিশবছরের সময়ের ভারে, বয়সের চাপে, অনাদরে অবহেলায় মায়ের মতোই সে এখন হয়ে উঠেছে মলিন বিবর্ণ, ধুলোর আস্তরণে হয়ে উঠেছে আরও পুরু। হঠাৎ করে খাতাটার জন্যে বড়ো মায়া হলো - সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়া আবেগগুলো এক ঝটকায় উদ্গারিত হলো যেন। কতো-কি স্মৃতি মনে পড়ে গেলো ! ছেলেবেলার বকুনি খাবার কথা, স্কুলের নানান দৌরাত্ম্যির কথা, বন্ধুদের সাথে মিলে করা হাজার কান্ড-কারখানার কথা - মা-বাবা, দাদা-দিদিদের কথা, যারা দিনের পর দিন আমাকে নি:স্বার্থে ভালোবেসে, হাজার ঝক্কি সামলিয়ে মানুষ করে তুলেছিলেন। হঠাৎ কি জানি হলো, জলভরা চোখে আমি দেখলাম সেটাতে আর এক ফোঁটাও ধূলো জমে নেই - প্রথম যৌবনের প্রেমিকার মতোই তরঙ্গিত, অসাধারণ মায়াকাড়া রূপ হয়ে উঠেছে তার। শৈশব আর কৈশোরের স্মৃতিতে আচ্ছন্ন সেই খাতার ধুলোর আবরণ ঝেড়ে-পুঁছে, পাতায় আটকানো দেশলাইয়ের কভারগুলোর গায়ে খুব ধীরে ধীরে, পরম স্নেহে হাত বোলাতে লাগলাম। আর কি অদ্ভুত! তাদের গায়ে লেগে থাকা ছোটবেলার মন-কেমন করা সেই অতুলনীয় 'ম-ম' গন্ধটা যেন আবার অনুভব করলাম... অনেক, অনেক দিনের পর। 

রেডিওতে চাপা স্বরে তখন বেজেই চলেছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মোহময় গলায় হারানো দিনের সেই রোমান্টিক গান: 'তুমি এলে, অনেকদিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো...'




2014 সালে ক্যালিফোর্নিয়া বে-এরিয়ার "পশ্চিমী" পুজা সংগঠন থেকে দূর্গাপুজা উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হওয়া  'অঞ্জলি' পুজা-ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিলো আমার এই আর্টিকেলটি। 
                                          এইখানে দেওয়া হলো সেই গল্পের লিঙ্কটি   


Monday, November 18, 2013

Bjarne Stroustrup-র C++ বই

"Certainly not every good program is object-oriented, and not every object-oriented program is good..." - Bjarne Stroustrup 

আজ থেকে বছর কুড়ি আগে স্টারদেরকে সবাই তাঁদের পুরো, ভদ্রস্থ নামেই ডাকতো - সে তিনি যে বিষয়েরই হোন না কেন। যেমন কপিলদেবকে সবাই কপিলদেব-ই বলতো, কাউকে বলতে শুনিনি যে "K. N." - বা উত্তমকুমারকে অন্য কোনো নামে কাউকে ডাকতে শুনিনি কখনো। 'হেমন্ত মুখোপাধ্যায়' চিরকালই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নামেই পরিচিত ছিলেন - এমন কি 'হেমন্ত মুখার্জী' নামেও তাঁকে ডাকতে খুব কমই শুনেছি। একবার পূজার বাজারে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের HMV থেকে বার হওয়া নতুন গানের রেকর্ড কিনতে গিয়ে: "দাদা, সন্ধ্যার নতুন রেকর্ডটা কি আছে?" বলাতে যোধপুর পার্কের 'দ্য মেলোডি' রেকর্ড স্টোরের কাউন্টারে বসা সেই বয়স্ক লোকটি ব্যাঙ্গাত্মক সুরে তিরস্কার করেছিলেন: 'সন্ধ্যা কি আপনার বন্ধু হয় নাকি ?' - জীবনে দ্বিতীয়বার আর সেই একই ভুল করিনি। এখনো সেই LP রেকর্ডের শিরোনামটা মনে আছে: 'নতুন গানের, রঙীন খামে

কিন্তু আজকাল হলো গিয়ে সব 'শর্টের' যুগ। মানুষের হাইট গেছে কমে, মিনি-স্কার্টের ঝুল কমতে কমতে হয়ে গেছে রুমাল, উর্ধাঙ্গের পরিধেয় বস্তু দেখলে মনে পড়ে সেই প্রবাদ: 'কেউ পরে অভাবে, কেউ পরে স্বভাবে' ! আর বিশ্বাস, সততা, এ সবের কথা না-বলাই ভালো। শচীন তেন্ডুলকার হয়ে গেছে 'SRT' - শাহরুখ খান হয়ে উঠেছে 'SRK' - সিনেমার নামগুলো তো আরও ফানি। 'QSQT' যে আমির খানের টসটসে প্রেমের ছায়াছবি, সেটা না জানায় সুদুর অতীতে আমাকে অনেক অপদস্থ হতে হয়েছিলো। কয়েকদিন আগেই বাড়ি ফেরার পথে প্রচন্ড ট্রাফিক জ্যামে পড়েছিলাম। তিন লেনের এক্সপ্রেস রোডের কোথায় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে সেটা একটাই লেন হয়ে গেছে। 'ন-যৌ-ন-তস্থৌ' হয়ে চারিদিকে মগনলাল মেঘরাজের কথা মতো 'সব লালে-লাল' দেখছি। রাস্তাটা যে এতো গাড়ি বয়ে নিয়ে চলে সেটা আগে কখনো মনে হয়নি। জীবনে শর্টকাটের যে কি প্রয়োজন তা আবার অনুভব করলাম। কিন্তু কোথায় নিই শর্টকাট !  রাস্তা তো পুরো পার্কিং লট হয়ে আছে! চরম bored হয়ে বসে বসে ভাবছিলাম যে আমার জীবনে শর্টকাটওয়ালা কোন বস্তু বা মহাপুরুষের আবির্ভাব কখনো হয়েছিলো কিনা। স্মৃতি মানুষকে যে কতখানি প্রতারিত করতে পারে, তা আবার নতুন করে জেনে বিস্মিত হলাম। মনে পড়ে গেলো আমার জীবনের প্রথম কর্মস্থলেই এক কলিগকে আমরা ডাকতাম তার শর্টকাট নামে, 'SJD' (পুরো নামটা এখানে বলা ঠিক হবে না !)  - সে'কথাটা বেমালুম ভুলে গেছিলাম। এই SJD নাম মনে করার সাথে সাথেই একরাশ হাসির ঘটনা মনে পড়ে গেলো। তাদের সব থেকে মজারটার সাথে জড়িয়ে আছেন C++ ল্যাঙ্গোয়েজের জন্মদাতা Bjarne Stroustrup মহাশয় স্বয়ং। 

সে সময় Java ল্যাঙ্গোয়েজ এতোটা পপুলার হয়নি - বিল গেটস মনোপলিতে ভালোমতোই ডলারের পাহাড় বানিয়ে চলেছিলেন। C++ আর MFC জানা লোকেদের তখন প্রচুর ডিমান্ড। এই সময় দিল্লী, না বোম্বে-র TCS থেকে একজন বিজ্ঞ ছেলে এসে জয়েন করেছিলো আমাদের অফিসে, আমাদের থেকে মাস খানেক আগে। তাকে না-জানি কেন 'পানু' নামে ডাকা হতো। এখানেও সেই শর্টকাট নাম। তবে মিথ্যা বলবো না, সে মোটেই ঐসব 'নীল সিনেমা'-টিনেমা দেখতো না। কিন্তু নিক-নেম তো আপনা-আপনিই জন্ম নেয়, অনেকটা আগাছার মতো এবং বেশিরভাগ সময় কোনো কারণ ছাড়াই। তো এই পানুর কাছে ছিলো Stroustrup-এর লেখা অরিজিনাল বই "The C++ Programming Language"  --- এই বই নাকি  C++-এর প্রথম ও শেষ কথা। এটা ধুয়ে তার জল খেলেও নাকি গোটা IT জগৎ চলে আসবে আমাদের হাতের মুঠোয়, সিনিয়ররা মাথার মধ্যে এরকম ভাবনাই ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু বইটা ছি বিদেশী - Addison Wesley থেকে পাবলিশড হতো আর দামও ছিল অনেক বেশি - ইন্ডিয়ান টাকায় তখনকার দিনেও প্রায় সাতশো টাকার মতো। সে সময় ইন্টারনেট থেকে বই ডাউনলোডের কোনো কনসেপ্টই ছিলো না। তার উপর আমরা ছিলাম ঘোর অর্থ-সংযমী ব্যাচেলর, বই 'কিনে পড়ায়' কখনোই বিশ্বাস কোরতাম না। যাদবপুরের এইট-বি বাস স্ট্যান্ডের রামকৃষ্ণদার জেরক্সের দোকান তখন আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো, বা উল্টোটা, আমরা বাঁচিয়ে রেখেছিলাম তাঁকে। আমরা রোজ দেখতাম পানু অফিসে এসে নিজের ডেস্কে বসে বসে গম্ভীরভাবে সারাক্ষণ ওই খটমট বইটা পড়ে যাচ্ছে - কারুর সঙ্গে তেমন কথাটথা সে বিশেষ বলতো না। আমরা যখন কম্পিউটারে বসে আমাদের রোজকার ফুটবল গেমস খেলতে খেলতে চেঁচামেচি শুরু করে দিতাম, তখন সে অতি-বিরক্ত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে, শ্রাগ করে কনফারেন্স রুমে চলে যেতো, আর দরজা বন্ধ করে সেখানে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা সেই বইটা পড়ে যেতো। আমরা ভাবতাম না-জানি সে ক-তো জ্ঞানী। অনেকবারই তার কাছে Stroustrup-এর সেই বইটা পড়বো বলে চেয়েছি, কিন্তু তার সেই একই কথা: 'না ভাই, আমি বই বাড়ি নিয়ে যেতে দিই না - তুমি অফিসে বসেই অফ টাইমে পড়ো না  কেন ?' -  আমরা আমতা আমতা করি, আর মনে মনে বলি: "শালা !! আধুনিক পাগলা দাশু এসেছে কোথাকার !!  অফিসে এসে বই পড়লে খেলবোটা কখন? আর বই 'কিনে কেন' পড়বো শুনি? তাহলে জেরক্সের দোকানগুলো রয়েছে কি করতে !!"  - পানু ছিল মহা সাবধানী - লাঞ্চে যাবার সময় নিজের ব্যাকপ্যাকের মধ্যে বইটা ঢুকিয়ে তবে সে খেতে যেতো। বইটা যেন ছিল তার নন-লিভিং এক প্রেমিকা - মুহুর্তের জন্যেও সে তাকে নজর-ছাড়া করতে চাইতো না। 

এই রকম ভাবেই  চলছিলো - মাসখানেক বাদে একদিন SJD জয়েন করলো, একটা জাপানি প্রজেক্টে কাজ করার জন্যে। পানু সহ আমরা কয়েকজন অলরেডি সেই প্রজেক্টে কাজ শুরু করে দিয়েছি  - পানু ছিলো আমাদের স্বঘোষিত টিম লীড। SJD ছিলো আমাদের থেকে সামান্য বড়ো, কিন্তু ফিচকে। সেও বোধহয় কোনো একটা TCS থেকেই এসেছিলো। তো কিছুদিনের মধ্যেই জানা গেলো SJD আমাদের থেকে 'একটু বেশি C++ জানা' প্রোগ্রামার। সুতরাং অচিরেই সে হয়ে উঠলো 'বেশ মূল্যবান' বস্ত আমরা সবাই তার ভালো বন্ধু হবার চেষ্টা করতে লাগলাম - এমনকি পানুও। দেখলাম, এই হচ্ছে মোক্ষম সুযোগ, একদিন আমরা SJDকে সব খুলে বললাম। তার কাছেও সেই মহার্ঘ্য বইটা ছিলো না - দেখলাম সেও আমাদের মতো অর্থ-সংযমে বিশ্বাসী - আর হবেই-না বা কেন, সেও ছিল আমাদের মতো কলকাত্তাইয়া বাঙালি। সুতরাং সে নিমিষেই রাজি হয়ে গেলো। SJD কিছুদিন পানুর সাথে ভালো ব্যবহার করে করে তার কিছুটা বিশ্বাস অর্জন করলো।  তারপর এক শুক্রবারের সন্ধ্যায় সে পানুর কাছে ওই বইটি উইকেন্ডে বাড়িতে নিয়ে পড়ার জন্যে আব্দার করে বসলো। পানু না-না-না করতে গিয়েও আর না-করতে পারলো না। বাস্তবিকই তার C++ জ্ঞান ছিল লিমিটেড। সুতরাং SJDকে হাতে রাখার জন্যে সে বইটা ধার দিতে রাজি হয়ে গেলো। তবে সে কিন্তু SJDকে দিয়ে বার বার 'কিরা কাটিয়ে' নিলো যে তার সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা যেন না-হয়, অর্থাৎ সেই বই যেন কোনোভাবেই SJD-র কাছ থেকে হাতছাড়া না-হয়। SJD সহ আমরা সবাই থাকতাম দক্ষিণে আর পানু থাকতো উত্তরে। সুতরাং আমদের অফিস বাস ছিলো আলাদা আলাদা। ফেরার সময় বাস আমাদেরকে ড্রপ করে দিতো যাদবপুর পর্যন্ত। তো সেই রাতে যাদবপুরে নেমে আমরা সোজা দৌড়ালাম রামকৃষ্ণদার জেরক্সের দোকানে। সেখানে পাক্কা দু-ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে সেই মোটা ধুমসো বই জেরক্স করা হলো - উইথ multiple copies !!! বাড়ি ফিরলাম হে-ভ-ভি খোশ মেজাজে - একে তো ৭০০ টাকার বই যোগাড় করেছি মাত্র ৩০ টাকাতে, তার উপর পানুর বইয়ের ওপর আচ্ছা বাটপাড়ি করা গেছে !! সেটা ভেবে আরও মজা লাগলো। এখন ভেবে দেখলে অবশ্য বেশ খারাপই লাগে - কিন্তু সেই সময়ে একটুর জন্যেও মন খারাপ করে নি। মানুষ বোধ হয় সময়ের সাথে সাথে বদলিয়েই যায়। 

নেক্সট সোমবার আমরা অফিসে ঢুকলাম বেশ আলাদা আলাদা ভাবে - এমন ভাব করলাম যে SJDকে আমরা তেমন চিনিই না। যথারীতি পানু নিজে এসে SJD-র কাছ থেকে বইটা চেয়ে নিলো। আমরা তো প্রমাদ গুনছি - কম্পুটারের স্ক্রিনের দিকে মুখ করেগম্ভীর ভাবে কোনমতে হাসি চেপে বসে আছি, ভাবখানা এমন যেন NASA-র কোনো ইম্পর্টান্ট প্রজেক্টে কাজ করছি। কয়েক মুহূর্ত বাদেই পানুর গলা শোনা গেল: 'SJD, একটু শোনো তো' - কাঁচের রিফ্লেকশনে দেখতে পেলাম পানু SJDকে নিয়ে কনফারেন্স রুমে ঢুকে দরজা টেনে দিলো। ঘষাটে কাঁচের দরজার ওপাশে SJDকে দেখা গেলো ক্রমাগত হাত-পা নেড়ে নেড়ে কি-সব বলে চলেছে। আমি হাসি আর চাপতে না পেরে সোজা রেস্টরুমের দিকে হাঁটা দিলাম। 

কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে দেখলাম পানু আর SJD দুজনেই ভাসুর-ভাদ্র-বৌ-এর মতো দু'জন-দু'দিকে গম্ভীর মুখ করে বসে আছে, কেউ কাউকে চেনে বলে মনে হচ্ছে না। আমার দিকে চোখ পড়তেই SJD-র পাতলা গোঁফের তলায় লুকানো হাসিটা খন্ড সেকেন্ডের জন্যে ফুটে উঠেই আবার মিলিয়ে গেলো। বাকি দিনটা আমরা সবাই হিন্দী সিনেমার 'মনোজকুমার'-এর মতো নাকে-মুখে হাত চাপা দিয়ে, জটিল ভাবনার মধ্যে ডুবে থাকার ভাব দেখিয়ে কোনোরকমে কাটিয়ে দিলাম। বিকেলে ফেরার পথে আমরা 'মাসির দোকানের' সামনে বসে SJD-র মুখে তাদের সেই কথোপকথনের রিপ্লে শুনলাম। পানুর 'সত্যি কথাটা তুমি আমায় বলো একবার...'-এর কাতর অনুযোগে SJD নাকি প্রথমে শুরু করেছিলো 'বই পড়তে পড়তে খোলা অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আর পা-টা বোধ হয় বই-এর উপরে চলে গিয়েছিলো' - কিন্তু সেটা শোনাতে পানু আঁতকে ওঠে, তারপর নাকি কাউন্টার প্রশ্ন করে যে বইয়ের বাইন্ডারের দিকে এতো ভাঁজ কিসের, আর কালো-কালো ছোপগুলোই বা এলো কোত্থেকে? তখন SJD বলে যে মেসের ঘরের পশ্চিমের জানলা দিয়ে বিকেলের দুষ্টু রোদ্দুর এসে এসে ঐসব করে দিয়েছে। পানু সেই ভুলভাল যুক্তি সেদিন খেয়েছিলো বলে আদৌ মনে হয় না, কিন্তু SJD নাকি এর আগে জীবনে কখনো, একটা সিঙ্গেল সেশনে এতো বার করে 'বিশ্বাস করো, বিশ্বাস করো...' বলেনি।  
~~~   ~~~   ~~~

Java আজ C++এর বাজার ভালোই খেয়ে নিয়েছে। Stroustrup-এর সেই বইও আজ আর C++এর 'De facto বই' বলে অনেকেই মনে করে না। Given a chance শুধু আমি কেন, বেশিরভাগ লোকই আজকাল C++ নিয়ে আর কাজ করতে চায় না। Java made our lives much easier, as well as  richer - Open Sourceকে আঁকড়ে ধরে জীবনযুদ্ধে আমরা যে যার মতো বিভিন্ন দিকে ছিটকে গিয়েছি। আজ তারা দু'জনে কে কোথায় আছে কোন আইডিয়া নেই - তবে জানতে খুব ইচ্ছা হয় যে এখনো পানু SJDকে, কিংবা আমাদেরকে ক্ষমা করেছে কি না...