Sunday, October 26, 2014

'মন্টোভানী' অর্কেস্ট্রার হাত ধরে...

ছোটবেলায়, অর্থাৎ ৮০-র দশকের শুরুতে আমার একবার টাইফয়েড অসুখ হয়েছিলো। অসুখটা সিরিয়াস ধরণের হলেও শহরতলীতে এটা তেমন কোন চিন্তার বিষয় ছিলো না। মা অভয় দিলেন 'টাইফয়েড', 'বসন্ত', এসব ধরনের অসুখ সবার জীবনে একবার না-একবার হবেই - হাজার সাবধানতার মধ্যে থাকলেও হবে। তাই অযথা ভয়ের কোনো কারণ নেই, সময়মত ওষুধ আর পথ্যির দরকার। সেইমতো আমাকে পাড়ার এক অ্যালোপ্যাথী ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো - তিনি  সব দেখে-শুনে বেশ কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ক্যাপসুল দিয়ে দিলেন। আমার ইস্কুলে যাওয়া, মাঠে খেলতে যাওয়া সব বন্ধ হয়ে গেলো। রাতদিন আমি শুধু বিছানায় শুয়ে বসে, নানান গল্পের বই পড়ে পড়ে সময় কাটাতে লাগলাম। অদ্ভুত ব্যাপার হলো অন্য সময়ে একটু গল্পের বই পড়ার জন্যে মন ছোঁক-ছোঁক করলেও, অসুখের সময় কিন্তু সেই একই বইগুলো পড়তে তেমন ভালো লাগে না। বরং কিছুক্ষণ বাদেই চোখ জ্বালা-জ্বালা করে ওঠে, হাতে ব্যাথা শুরু হয় - বেসিক্যালি শক্ত অসুখ হলে কিছুই আর তেমন ভালো লাগে না। সপ্তাহখানেক পরে অসুখ গেলো সেরে, আমি আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করে দিলাম। এর ঠিক দু'দিনের মাথাতেই আমি স্কুল থেকে আবারও ভালো জ্বর গায়ে ফিরলাম। শুরু হলো আবার বকুনি, একগাদা অযাচিত উপদেশের বন্যা, শুয়ে-বসে বাবার অন্ন ধংসের জন্যে প্রচ্ছন্ন তিরস্কার - আবার ডাক্তারখানার উদ্দেশ্যে যাত্রা। এইবারে কিন্তু ডাক্তারবাবু মুখ গোমড়া করে বললেন যে আরও কড়া ডোজের ক্যাপসুল তিনি দিয়ে দিয়েছেন বটে, তবে সে'টাতে কাজ না'হলে কিন্তু সত্যিকারেরই চিন্তার বিষয় আছে। শুনে আমার শুকনো মুখ আরও শুকিয়ে গেলো। সেই অশুভ সংবাদ নিয়ে বাড়ি ফিরতেই শুরু হয়ে গেলো একেবারে জেড-ক্যাটেগরির কঠোর নিরাপত্তা বলয়। ঘরের দরজা বন্ধ করে, মশারির মধ্যে আমাকে সর্বক্ষণ থাকার নির্দেশ দেওয়া হলো। একমাত্র বড়ো আর ছোটো-বাইরের জন্যেই আমি পারমিশান নিয়ে ঘরের বাইরে যেতাম। বন্দী জীবনের যে কি মাহাত্ম্য তা আমি এর আগে কখনোই এমন করে রিয়ালাইজ করিনি।
বাড়ির  বিশাল উঠান - একসময় ছিলো অসাধারণ সুন্দর -
আজ  অনাদর ও অবহেলায় সেও গেছে 
বুড়িয়ে... 
ক্যাপসুলের কড়া ডোজে ধীরে ধীরে আমার শরীরের জ্বরের ওঠানামা কমে যেতে লাগলো - কিন্তু সেই সাথে শরীর আরও দুর্বল হয়ে পড়লো। ডাক্তার বলে দিয়েছে প্রচুর রেস্ট নিতে। একতলার মাঝের এক ঘরে আমি পড়ে থাকি। মা আর কাজের লোক ছাড়া সেই ঘরে অন্য কারুর ঢোকা বারণ। মাথার কাছে বিরাট জানালা - সেই জানালা দিয়ে আমাদের বাড়ির বিশাল উঠানটার প্রায় পুরোটাই দেখা যায়। সারাদিন শুয়ে থাকি বলে রাতের ঘুম অনেকটাই কমে গেছে। একরাতে হঠাৎই ঘুম গেলো ভেঙে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি ঝকঝকে রুপালি আলোর জ্যোৎস্নায় আমাদের সারা উঠানটা ভরে উঠেছে। রাত তখন নিশ্চয়ই বারোটার বেশি হবে, কারণ বাড়ির সব আলো নিভে গেছে। রান্নাঘরের দিক থেকে কোনো আওয়াজও কানে আসছে না। ঝিমঝিম করছে দুপুর রাত - আমার চোখে তখন ঘুম-ঘুম ভাব লেগে আছে। সেই আবছা চেতনার মধ্যে অবাক হয়ে দেখলাম, উঠানের ঠিক মাঝখানে আমার মেজদা রেডিও চালিয়ে, একটা মাদুর পেতে বাবু হয়ে বসে আপনমনে বাঁশি বাজিয়ে চলেছেন - তাঁর পাশে বসে রয়েছে আমাদের বাড়ির মোটা সাদা বিড়ালটা। মেজদার বাঁশির ধবনি, আর রেডিওতে বেজে চলা এক অদ্ভুত অর্কেস্ট্রার অপূর্ব সুরের যুগলবন্দীতে কেমন যেন দুলছে আশেপাশের সারা জগটা। সেই সুরের মূর্ছনায় আমার দুর্বল মাথাও কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। আমি অসুস্থ শরীরেই ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসলাম। মনে হতে লাগলো রেডিও থেকে কি-একটা যেন তরঙ্গের মতো আভা কেঁপে কেঁপে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, কিম্বা হয়তো সে'সবই আমার অসুস্থ মস্তিষ্কের অলীক কল্পনা মাত্র! অজানা এক ভয়ে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম, আর একমনে সেই বাজনা শুনে চললাম। এরপর কখন যে অজান্তেই বিছানায় হেলে পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছি, তা টেরও পাই নি। পরের দিন সকালে মেজদাকে ডেকে গতরাত্রের  সেই বাজনাটার কথা জিজ্ঞাসা করে তেমন কোনো সদুত্তর পেলাম না। প্রতি রাত্রেই মেজদা খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে গেলে রেডিওতে আকাশবাণীর 'খ' চ্যানেল চালিয়ে গান শোনেন। রাত বারোটার পর সেখানে বেজে চলে নাম-না-জানা নানান দেশের বিখ্যাত বিখ্যাত শিল্পীদের অর্কেস্ট্রা, ইনস্ট্রুমেন্টাল, পপ, কান্ট্রি, ইত্যাদি বিচিত্র ধরনের সঙ্গীত। তাদের প্রতিটির নামধাম মনে রাখা মুখের কথা নয়। যাই হোক, তিন সপ্তাহ কঠোর নিয়ম-কানুনের মধ্যে থাকার পর আমার সেই কঠিন অসুখ পুরোপুরি সেরে গেলো, কিন্তু মাথার মধ্যে গেঁথে রইলো সেই অজানা অর্কেস্ট্রার অদ্ভুত মায়াবী সুর। সেই সুরের উৎস খোঁজার জন্যে আমার মধ্যে এক অদ্ভুত ছটপটানি  শুরু হয়ে গেলো। কিন্তু আমার ক্ষমতা বা জ্ঞান, দুইই খুব সীমিত - আর কি করেই বা আমি অন্য কাউকে সেই সুরের সাথে পরিচয় করে তার সম্বন্ধে আরও ডিটেলস জানবো!! অত:পর শুরু করে দিলাম মেজদার সাথে রাত জাগা। নিশীথ রাতে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের শ্রোতার সংখ্যা আরও একটা বাড়লো - মেজদাও আরেকটা সঙ্গী পেয়ে বেশ খুশিই হলেন। রাত বারোটার পর থেকে শুরু হতো আমাদের পালা করে রেডিও শোনা - সঙ্গে নিয়ে বোসতাম এক মিনি টেপ-রেকর্ডার, একটা ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেট পুরে, যাতে সেই অর্কেস্ট্রা আবার শুনতে পেলেই সেটাকে ঝটপট ক্যাসেটে বন্দী করে ফেলা যায়।    

এইরকম ভাবে মাস আট-নয় কেটে গেলো - শীত শেষ হয়ে নতুন বছর এসে গেলো। তারা-ভরা অন্ধকার একরাতে বাড়ির দাওয়ায় আমরা যথারীতি বসে আছি তিনজনে। বাগানের গাছপালা থেকে ঝিঁঝিঁ পোকাদের অস্পষ্ট ডাক শোনা যাচ্ছে - গাছে গাছে কিছু নিশি-পাওয়া পাখিদের ছটপটানি। এমনই নিঝুম এক  রাতে রেডিওতে আবার শোনা গেলো সেই অর্কেস্ট্রা। এবার হাতের কাছেই রেডি করাই ছিলো টেপ-রেকর্ডারটা - নিমেষের মধ্যেই সেটা দিলাম চালু করে। অর্কেস্ট্রার প্রথম দিকের কিছুটা অংশ ছাড়া, প্রায় পুরোটাই ক্যাসেট-বন্দী করা গেলো। অদ্ভুত এক প্রাপ্তির আবেশ নিয়ে ঘুমাতে গেলাম সেই রাতে। সেই সে রাতের মতো 'আনন্দের ঘুম' আমি জীবনে আর কখনো ঘুমাইনি - এমনকি প্রথম চাকরি পাবার দিনেও নয় !!   

কিন্তু সমস্যার পুরোটা সমাধান হলোনা - অর্কেস্ট্রার নামটা কি, কেইই  বা তার রচয়িতা, তা কিছুই জানা হয়নি, কারণ সেটা ক্যাসেট চালু করার অনেক আগেই রেডিওতে বলে দিয়েছে। অত:পর এক দুপুরে সেই ক্যাসেট পকেটে করে গেলাম গোলপার্কের বিখ্যাত গানের দোকান 'দি মেলোডি'-তে। কাউন্টারে বসে থাকা এক বয়স্ক ভদ্রলোককে বেশ কিছুক্ষণ ধরে অনুরোধ করার পর তিনি রাজি হলেন আমার সেই ক্যাসেটের বাজনাটা শুনতে। কয়েক মিনিট শুনেই তিনি বলে দিলেন যে সেটা হলো বিখ্যাত ওয়েস্টার্ন মুভি "ডক্টর জিভাগো"-র "Somewhere My Love"-এর সুর। সে'কথা জেনেই তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু অর্কেস্ট্রাটা যে কে পরিচালনা করেছেন সেটা তিনি বলতে পারলেন না। কারণ ওয়েস্টার্ন গানের জগতে পপুলার কোনো মিউজিক নানান শিল্পীরা নিজেদের মতো করে গেয়ে রেকর্ড করে থাকেন, সেই ভাবে অনেকেই অর্কেস্ট্রা হিসাবেও গান রেকর্ড করে থাকেন। কিন্তু যা জেনেছি তাতেই আমি অনেক খুশি, কারণ একটা পয়েন্টার ততক্ষণে আমি পেয়ে গেছি - বাকিটা এবার আমি ঠিক ম্যানেজ করে নিতে পারবো। 

সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে একের পর এক মাস কেটে যেতে লাগলো, অর্কেস্ট্রার কথা আমার মাথাতেই আছে, কিন্তু ক্যাসেট কিনে কিনে সেই সুরের খোঁজ করে বেড়ানো সম্ভব হলো না, কারণ পাশ্চাত্য সংগীতের ক্যাসেটের বেশ ভালোই দাম, তাছাড়া  কলকাতার হাতে-গোনা কয়েকটি নামী দোকান ছাড়া বেশির ভাগ দোকানেই সে'সব পাওয়া যায় না। তখনকার দিনে গ্রীষ্মের সন্ধ্যাগুলোতে লোডশেডিং হওয়াটা একটা বাঁধা-ধরা ব্যাপার ছিলো। আমরা সবাই তাই ল্যাম্প-হ্যারিকেন, দেশলাই সব হাতের কাছে গুছিয়ে রেখে পড়তে বসতাম। এরকমই এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় আমি দোতলার দখিন দিকের বারান্দায় বই-খাতা-পত্র নিয়ে পড়তে বসেছি। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে, সারাটা দিন অসহ্য গরমে কেটে যাবার পর ধীরে ধীরে আবহাওয়াটা একটু একটু করে শীতল হতে শুরু করেছে। বারান্দার রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে দেখছি আকাশ জুড়ে চাঁদের আলোর ঢল নেমেছে আমাদের বাড়ির উঠানে। সামান্য বাতাসে নারকেল গাছের পাতাগুলো খুব মৃদু ভাবে নড়াচড়া করছে, চারিদিক প্রায় নিস্তব্ধ, নিঝুম। বাগানের দিকে কিছু জোনাকির দল উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে - উঠানের এক দিকে কুকুরটা শুয়ে মুখ দিয়ে কামড়ে কামড়ে মশা মারার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে। নীচের রান্নাঘরে উনুন জ্বেলে মা একা একা রান্না করে চলেছেন। উঠানের সিঁড়িতে বসে মেজদি অলসভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। চাঁদের আলোয় তার মুখটা কি অসম্ভব দু:খী দু:খী লাগছে। কানে এলো রেডিওতে বেজে চলা পুরুষ কন্ঠের একটা গান। গায়কের কন্ঠ, বা গায়কী আহামরি তেমন কিছু নয়, কিন্তু গানের সুরটা ছিলো অসাধারণ - যা শুনেই আমার গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে উঠলো - আরে! এতো আমার সেই haunted অর্কেস্ট্রাটারই সুর!!! এই বাংলা গানে ছন্দের রকমফের থাকলেও, মূল সুর কিন্তু এক। দোতলা থেকে একদৌড়ে নেমে এসে মেজদির পাশে বসে পড়লাম - দু'জনে চুপচাপ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে চললাম সেই অপূর্ব সুরের মাতন নাচ: 'কে ডাকে আমায়, আজি এ নিরালায় - সে কি চেনা মোর, মন কি তারে চায় ?'। কিছুক্ষণ পরেই গানটা শেষ হয়ে গেলো - কিন্তু মন-কেমন করা সেই সুরের রেশ রয়েই গেলো, অনেকটা যেমন বাজি পুড়ে যাবার পরও তার গন্ধ আশেপাশের বাতাসে থেকে যায়। মেজদি বললো সেই বাংলা গানটার শিল্পী ছিলেন, 'দিলীপ সরকার' - এই প্রথম আমি সেই শিল্পীর গাওয়া কোনো গান শুনলাম। মনে মনে ভীষণ উত্তেজনা অনুভব করলেও আমি তা কাউকেই ঠিক বোঝাতে পারলাম না। উল্টে লক্ষ্য করলাম এক বিচিত্র মন খারাপ করা ভাব জমা হয়ে যাচ্ছে আমার মধ্যে। মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকলো এই গানটার সুর - এই বাংলা গান, আর সেই রাতের নাম না-জানা অর্কেস্ট্রা, দুটোরই সুর এক ও অভিন্ন !! 

এর অনেক বছর পরের কথা - তখন আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি - মাঝে মধ্যেই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে একা একা সেন্ট্রাল ক্যালকাটার ওয়েলিংটন স্কোয়ারের পুরানো রেকর্ডের দোকানগুলোতে ঢুঁ-মারি। কিনি যতো না, তার থেকে বেশি করি নাড়াচাড়া। দেখতে দেখতে ওখানকার দোকানদাররা সবাই আমাকে চিনে গেলো। আমি গেলে তারা আর কোনো উৎসাহ দেখাতো না। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে দোকানদারের সাথে সাথে আমিও ক্রেতাদের নানান প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছি - যার জন্যে আমি রেকর্ডপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলেও অনেক দোকানদারই খুব বেশি মাইন্ড করতো না। এই ভাবে রেকর্ড ঘাঁটতে ঘাঁটতে একদিন আমি পুরানো দিনের এক অর্কেস্ট্রার রেকর্ডের সন্ধান পেয়ে গেলাম, যাতে রয়েছে সেই "Somewhere My Love" গানটা, আর দেখলাম সেটা পরিচালনা করেছেন 'Mantovani (মন্টোভানী)' বলে একজন অ্যাঙ্গলো-ইটালিয়ান সংগীতকার। রেকর্ডের উল্টো পিঠের মিউজিকটির নাম ছিলো: "Games That Lovers Play" - দোকানদার জানালো যে সেই মন্টোভানী নাকি লন্ডনের খুব বিখ্যাত এক মিউজিক ডিরেক্টর। কিছুক্ষণ দরাদরি করে পাক্কা দশ টাকায় কিনে ফেললাম সেই পুরানো, রং চটে যাওয়া, স্ক্র্যাচে ভরা SP-রেকর্ডটা।  
সেই সময় এই দশ টাকাই  ছিলো অনেক টাকা, কিন্তু আমি তখন এক অদ্ভুত উত্তেজনায় কাঁপছিলাম। কতক্ষণে যে বাড়ি ফিরে রেকর্ড চালিয়ে সেই বাজনাটা শুনবো, তার জন্যে তর যেন আর সইছিলো না। রাস্তাঘাটের সামান্য জ্যামও অসহ্য মনে হতে লাগলো - আধঘন্টার ট্রেন-জার্নি যেন মনে হলো অনন্তকাল! অবশেষে বাড়িতে ফিরে এসে, কোনো রকমে জামা-প্যান্ট বদল করে, রেকর্ড-প্লেয়ারটা বার করে সেটাতে চালিয়ে দিলাম কিনে আনা সেই রেকর্ডটা। মন্টোভানী অর্কেস্ট্রার অসম্ভব মায়াবী সুরের মূর্ছণায় আমি চোখ বুজে ফেললাম - ফিরে গেলাম বছর ছয়েক আগেকার সেই মায়াবী নিশুতি রাতে। সুরের দোলায় ভাসতে ভাসতে মনে হলো যেন আমি কোনো এক অতিলৌকিক জগতে চলে যাচ্ছি। সেই সন্ধ্যায় একলা ঘরে চুপচাপ বসে বারবার আমি সেই একই রেকর্ডের বাজনা শুনে চললাম। বাংলা গানটা খুঁজে না-পেলেও, অরিজিনাল অর্কেস্ট্রার রেকর্ডটা at least কিনতে পেরেছি বলে নিজেকে অসম্ভব ভাগ্যবান বলে মনে হতে লাগলো। 
        
এর পরে আরো বহুকাল কেটে গেলো - টেকনোলজির ধাক্কায় পরে রেকর্ড, ক্যাসেট সব বিলুপ্ত হয়ে CD/MP3-র রূপ ধারণ করলো। চিরসুন্দর বাংলা আধুনিক গানকে পিছনে ফেলে ব্যান্ডের গান আর জীবনমুখী গান, পিঁপড়ের মতো চারিদিক থেকে গানের বাজার ছেয়ে ফেললো। মুড়ি-মুড়কির মতো গুচ্ছ গুচ্ছ গান বার হতে লাগলো - এ বলে আমায় দ্যাখ তো, ও বলে আমায় দ্যাখ। 'দিলীপ সরকারের' সেই সে গানের খোঁজ আমি চালিয়ে যেতেই লাগলাম - কিন্তু কোথাও আশার তেমন কিছু খুঁজে পেলাম না। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের পুরানো রেকর্ডের দোকানগুলোর অবস্থাও দ্রুতহারে পড়তে শুরু করলো। অনেকই দোকানে রেকর্ডের বদলে স্রেফ সিডি/MP3 বিক্রি আরম্ভ করে দিলো - কেউ কেউ দোকানের পাটই দিলো তুলে! চাকরিসুত্রে আমি এর মধ্যে দেশ ছেড়ে পরবাসী হয়ে পড়েছি - সাথে করে নিয়ে এসেছি সেইসব মলিন হয়ে যাওয়া ক্যাসেটগুলো। রেডিওর সামনে বসিয়ে রেকর্ড করা সেই সব গানগুলোকেই আমি যত্ন করে MP3-তে কনভার্ট করে, নয়েজ ফিল্টার্ড করে, সময়ে অসময়ে শুনতে থাকি। মন্টোভানী অর্কেস্ট্রার বহু অ্যালবামই আমি কিনে কিনে ঘরের আলমারি ভরিয়ে ফেলেছি। কিন্তু আমার না-পাওয়া haunted গানের লিস্টে 'দিলীপ সরকার'-এর গাওয়া সেই বাংলা গান ঠিকই রয়ে গেছে। গত কালীপূজার রাতে ছেলের সাথে ফুলঝুরি জ্বালাতে গিয়ে কি যেন হঠাৎ করে মনে হলো আমার। ভাবলাম, দেখি তো আরও একবার Google-সার্চ করে - হয়তো আমার মতোই বোরিং কোনো মানুষ সেই গানকে এতোদিনে কোথাও আপলোড করে রাখলেও রাখতে পারে। টেকনোলজির হাজার গন্ডা মন্দ দিকের সাথে সাথে কিছু ভালো দিকও তো রয়েছে। এইভাবে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎই খেয়ালে এলো YouTube-এ এক সুহৃদয় ভদ্রলোক আমার সেই হারানো গানটি বেশ কিছুদিন হলো আপলোড করে দিয়েছেন !!! এতোদিনের হারানো সেই গানকে এতো সহজে খুঁজে পেয়ে, আনন্দে আমার দু'চোখ অজান্তেই জলে ভরে উঠলো। তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়েও যেন আমার মন থামতে চাইলো না। মনে হলো কাছে-দূরের, চেনা-জানা সবাইকে জানাই যে একটা গানের সুর অ্যাতো সুন্দরও কি কখনো হতে পারে? যে মানুষ একে অপরের ধংসলীলায় মেতে ওঠার জন্যে অবিশ্রান্ত ভাবে কতো কি-ই না করে চলেছে, সেই একই মানুষের মধ্যে এরকম অসম্ভব সুন্দর সুর-সৃষ্টির আশ্চর্য্য ক্ষমতা ঈশ্বর যে দিলেকি করে, সেটাই এক চরম বিস্ময়...... 
~ ~ ~
এখানে একসাথে শেয়ার করলাম সেই অসাধারণ ওয়েস্টার্ন মিউজিকটি, ও সেই অপূর্ব রোম্যান্টিক বাংলা গানটি। 
>>> ইউটিউব লিঙ্ক 


Tuesday, October 7, 2014

"ও কাঠঠোকরা বউ মান কোরো না, শোনো কথা..."


"আবেশে মুখ রেখে পিয়াল ডালে
ওই সাতরঙা পাখি বলে মনের কথা, 
                   গরবী মানিনী তার সাথী রে,
বলে নীড়  সাজানোর কতো কথা
ও কাঠঠোকরা বউ মান কোরো না, 
                                         শোনো কথা...."

Black rumped golden flame-back 'Woodpecker'
(Scientific Name: Dinopium Bengalensi)
আমার ছোটবেলায় শোনা, নির্মলা মিশ্রের গাওয়া একটা খুব মিষ্টি আর মজার গান - দিদিদের মুখে যে কতোবার শুনেছি, তার ঠিক নেই। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে, ১৯৬৯ সালে পুজার গান হিসাবে HMV থেকে প্রকাশিত হয়েছিলো এই গানের রেকর্ডটি। গানটির গীতিকার ছিলেন শ্রদ্ধেয় পুলক বন্দোপাধ্যায়, আর এতে সুর দিয়েছিলেন সে'সময়কার প্রখ্যাত সুরকার, রতু মুখোপাধ্যায়। বাংলা গানের জগতে পাখিদেরকে নিয়ে গান খুব একটা শোনা যায় না, তার উপরে কাঠঠোকরার মতো সাধারণ পাখিকে নিয়ে গান তো নয়ই।

আমার বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব মোটামুটি সাড়ে নয় মাইলের মতো। রাস্তায় খুব একটা ভীড় না থাকলে মোটামুটি মিনিট কুড়ি থেকে পঁচিশের মতো লাগে আমার অফিসে যেতে, বা অফিস থেকে ফিরতে। যাবার সময় আমি সাধারনত গাড়ির রেডিওর FM ট্র্যাফিক চ্যানেলটা (KCBS FM106.9) চালিয়ে দিই, যাতে প্রতিদিন কোথায় কি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে,বা কোন রাস্তায় কিরকম জ্যাম হয়ে চলেছে, সেসব তথ্য জানতে পারি। বে-এরিয়ার এই লোকাল চ্যানেলে সকালের দিকে প্রতি দশ মিনিট অন্তর করে করে ট্র্যাফিক আপডেট দিয়ে চলে, আর তার ফাঁকে ফাঁকে নানান ধরনের ছোট ছোট খবর এবং বিজ্ঞাপন শোনায়। তবে সেগুলো আমাদের দেশের মতো তিতি-বিরক্তিকর, গান-ওয়ালা, আলতু-ফালতু নাটকীয় বিজ্ঞাপন নয় - বেশিরভাগই ট্যেকনোলজি ওরিয়েন্টেড, আর যথেষ্ঠ শিক্ষণীয়। এই যেমন গতকাল সকালে Woodpecker, অর্থাৎ "কাঠ-ঠোকরা" পাখিকে নিয়ে দু'মিনিটের, ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপন-কাম-প্রতিবেদন হলো, যেটা শুনে আমি এতো অবাক হয়ে গেলাম যে ঠিক করলাম বাড়ি ফিরেই সেটা নিয়ে একটা কিছু লিখবো !!
~ ~ ~ ~ ~

সম্প্রতি চাইনিজ সায়েন্টিস্টরা কাঠঠোকরা-র একটা 3D কম্প্যুটার মডেল তৈরী করেছে, যাতে বোঝা যায় যে কি করে কাঠঠোকরা পাখিরা খাবার খোঁজার সময়ে কাঠের উপরে তাদের ছোট্ট ঠোঁট দিয়ে করে চলা অবিশ্রান্ত ঠোকরানোর ধাক্কার ধকল সামলে নেয়। গবেষণায় জানা গেছে যে তারা খুব কম করে হলেও, ১৬ মাইল স্পীডে কাঠের উপরে ঠুকরিয়ে চলে - ওই একই স্পীডে আমরা যদি কোনো শক্ত গাছে আমাদের মাথা ঠোকরাই তো কয়েকবার ঠোকরানোর পরেই আমাদের মাথাটা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যাবে!!  Obviously এই সব গবেষণার মূল উদেশ্য হলো, কি করে আমরা মোটরগাড়ির shock absorber-কে আরও ইমপ্রুভড করতে পারি, যাতে চলন্ত দুটো গাড়ির মধ্যে মুখোমুখি, ভয়ানক collision হলেও, মৃত্যুর হাত থেকে গাড়ির ড্রাইভাররা অন্তত: প্রানে বেঁচে যায়, এবং গাড়িরও কম physical ড্যামেজ হয়।

তো, দেখা গেছে কাঠঠোকরার ছোট্ট মাথাটা হলো এক ধরনের অত্যাধুনিক "শক অ্যাবজর্ভার" - যেটা কিনা প্রতিটি ধাক্কায় উৎপাদিত এনার্জির 99%-এরও বেশি শুষে, বা অ্যাবজর্ভ করে নেয় !! আর তারপর সেই এনার্জিকে "Strain Energy"-তে রুপান্তরিত করে, নিজেদের দেহের মধ্যেই চালান করে দেয় !! যার ফলে কাঠঠোকরার ব্রেনে সেই এনার্জির প্রভাব খুব সামান্যই এসে 
পৌঁছায় - in fact এক পার্সেন্টের এক-তৃতীয়াংশেরও কম এনার্জি তাদের ব্রেনে গিয়ে পৌঁছায়। আর সেই এনার্জি তাদের ব্রেন থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের দেহের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে দেহের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যে জন্যে তারা ঠোকরানোর সময়ে কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর ছোট্ট করে একটা break নিয়ে নেয়।

শুধু এইই নয়, আরো জানা গেছে যে কাঠঠোকরার মাথার খুলি, আর ঠোঁঠের structure, সময়ের সাথে সাথে ক্রমাগতই  evolved হয়ে চলেছে, যাতে আরো, আরও কম ধাক্কার ধকল তাদের শরীরকে সইতে হয়। আমরা (মানুষেরা) তাদের এই উন্নত পদ্ধতিকে ফলো করে আরো better অ্যান্টি-শক
যন্ত্র (anti-shock devices) বানাতে পারি - যেগুলো আমাদের মোটরগাড়িদের মুখোমুখি, ভয়ানক ধাক্কা এড়াতে, কিম্বা আরও নির্ভরযোগ্য স্পেস ক্র্যাফট তৈরিতে অনেক কাজে আসবে।

এই ছোট্ট পাখির দেহে যতো কলাকৌশল আছে, মানুষ তা এতোদিনেও নিজেদের জগতে আয়ত্ত করতে পারেনি !! ভাবলেই ভীষণ অবাক হয়ে যেতে হয় !! 
 ঈশ্বর কি তাহলে সত্যিই কোথাও আছেন ?


Monday, October 6, 2014

“রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে, একি তব হরি খেলা”





টিন-এজেড বয়সের মাঝামাঝি পর্যন্তও “বড়ো কত্তা” অর্থাৎ শচীনদেব বর্মণের গানকে ভাবতাম আদ্যিকালের, বুড়োটে লোকেদের গান - কি নাঁকি নাঁকি গলায় খালি “ইঁয়া, ইঁয়া, ইঁয়া...” করে যান। কিন্তু ও মা! সেই বুড়োর গানে যে এতো প্রেমরস লুকিয়ে ছিলো তা আগে কে জানতো !! সেকেন্ডারী এক্সজামের প্রিপারেশন নেবো কি, মন যেন বিদ্রোহ করে বলে উঠলো “ওরে! ভালোবাসা না থাকলে তোদের কোনওদিন কিস্যুটি হবে না, এটা নিশ্চিত করে জেনে রাখ। ভালোবাসা ছাড়া কোনও গতি নেই-রে! কোন-ও উপায় নেই!! কিসের এতো তোদের হিসেবের জীবন, কিসেরই বা এতো লক্ষ্য - খালি এগিয়ে চলা, আর এগিয়ে চলা !! শুধু ভালোবেসে যা রে, আচ্ছা-সে ভালোবেসে যা...” 


শীতের বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে - ঠিক সন্ধ্যের মুখে চিরাচরিত লোডশেডিংয়ের আঁধার। সুগন্ধি চেসমী গ্লিসারিন দিয়ে স্নান করা শরীরে ভালো করে সাদা শালটা জড়িয়ে, ঠোঁটে “সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রীম, বোরোলীন” লাগিয়ে, কষে জানুয়ারীর শীত উপভোগ করে চলেছি। বাইরে টুপটাপ ঝরে চলেছে শীত। হাতে রয়েছে আধ-খাওয়া চায়ের কাপ, কোলে বিরাজমান সঞ্জীব চ্যাটুজ্জ্যের 'লোটাকম্বল'-এর প্রথম পর্ব, অসহায় ভাবে ভাঁজ হয়ে পড়ে। মন প্রেমরসে একেবারে যাকে বলে টই-টম্বুর। কোন দূরের একটা বাড়ির রেডিও থেকে লোডশেডিং ভেদ করে, তুলোর মতো দুলতে দুলতে ভেসে এলো শচীন-কত্তার নাঁকি কন্ঠের মায়াবী সুর: “মুক্তা যেমন শুক্তির বুকে তেমনি আমাতে তুমি, আমার পরাণে প্রেমের বিন্দু তুমি শুধু তুমি...” - ব্যাস ! হয়ে গেলো - লোডশেডিং আর আমাকে একা থাকতে দিলো না। কল্পনার প্রেমিকার মুখ বুকে পোস্টার করে, ভালবাসার সাগরে ভেসে গিয়ে, আবেগে দু'চোখ বুজে আমিও কূঁই কূঁই করে তাঁর সাথে গলা মিলিয়ে উঠলাম: “তুমিই, শু-ধু তুমি...” - এমন সময়ে হঠাৎই জ্বলে উঠলো ঘরের টিউবলাইট, আর তার সাথে সাথে দেখলাম আমার পিতৃদেব গম্ভীর চালে ঘরে প্রবেশ করছেন, কঠিন মতো একটা মুখ নিয়ে। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো - প্রেমরস মুহুর্তেই হাওয়া চৈত্রের খাঁ-খাঁ দুপুরে। হাত থেকে বই গেলো পড়ে অসাড়ে। কি করি, কি করি, ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত স্কুলের ইংলিশ-গ্রাম্যার টিচার, শ্যামলবাবুর ময়রা-মুখ আর তাঁর স্নেহময়ী কানমলার রেওয়াজি স্বাদ মনে এনে, সঙ্গে সঙ্গে সুরের হেরফের ঘটিয়ে করুণ মুখে গুনগুনিয়ে উঠলাম: “তোমায় আমায় মিলে, এমনি বহে ধারা... তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা...” - পিতৃদেব কিছুক্ষণমাত্র সময় নিলেন ব্যাপারটা কি ঘটে চলেছে তা অনুধাবনে। তার পর “উঁহুমমম” শব্দের একটা বিকট গলা-খাঁকারি দিয়ে ঘরের খোলা জানালাটা বন্ধ করতে এগিয়ে গেলেন। মুহুর্তেই নিজেকে যেন মনে হলো একটা 'মুষিক' মাত্র !! - “যাক বাব্বা ! আলো এসে গেছে, বাঁচা গেছে - যাই এবার পড়তে বসি গিয়ে...” বলে আমি হন্তদন্ত করে উঠে পড়লাম...



Friday, October 3, 2014

"দিন যাক এই ভরসায়, কথা দাও আবার আসবে 
এমনি করেই ভালোবাসবে..."



এক একটা পুজো যায়, আর জীবনের আয়ু থেকে এক কটা বছর সাদা মেঘের মেলায় ভাসতে ভাসতে অনন্তে মিশে যায়। আমাদের মাথার চুলে পাক ধরে, দাঁতের গোড়া নড়ে ওঠে, কপালে আরেকটা নতুন রেখা যোগ হয়। চোখের চশমার কাঁচ বদল হয়, কারো বা পরচুলা ঝোলে মশারির পাশে পেরেকে। মহালয়ার শেষ রাতে শুরু হয়ে যায় 'স্মৃতি তুমি বেদনা' - তারপর বিসর্জনের  গঙ্গায় দেবী প্রতিমার সঙ্গে ভাসান হয়ে যায় জীবনের আরেকটা দায়সারা বছর, অসফল তিনশো পঁয়ষট্টিটা দিন। 

পুজো এলো এবং চলে গেলো, যেমন চিরকাল আসে যায়। ঝড়ের মতো আসে, তার চেয়েও দ্রুত বেগে চলে যায়। নবমী নিশি বড়ো দ্রুত অতিক্রান্ত হয়। অনেকদিন আগে এক আধুনিক কবি লিখেছিলেন ---
বোধনের ঢুলি বাজাবেই শেষেবিসর্জনের বাজনা
থাক থাক সে তো আজ না, 
              সে তো আজ নয়, আজ না...
দেবী বিসর্জন...
কিন্তু থাক থাক করে কিছুই কি ধরে রাখা যায়? ঢাকের শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যায়। শুন্য মন্ডপে সঙ্গীহীন ক্ষীণ প্রদীপশিখা স্মরণ করিয়ে দেয় গতদিনের উৎসব রজনীর কথা। বাতাসে আরেকটু হিমেল ভাব, শরতের শেষ শেফালী ঝরে পড়ে অনাদরে ধুলোভরা রাস্তায়। পুরানো গৃহস্থ বাড়ির ছাদের শিখরে জ্বলে ওঠে কোন সনাতন পৃথিবীর অমল আকাশ প্রদীপ...

স্মৃতি, তুমি বেদনা
এক বিদেশী কবরখানায় কোন এক সমাধিলকে লেখা দেখেছিলাম: "I know this will happen, but it is too quick to think" -- প্রত্যেকবার পুজোর পরে ওই সমাধিফলকের কথা আমার মনে পড়ে যায় - জানতাম আরেকটা পুজো ফুরিয়ে যাবে, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সেটা ভাবিনি। তবুও দিন আসে, দিন যায় - বিষন্ন মনটাকে সোজা করে নিই আগামী বছরের পুজার প্রত্যাশায়। আবার শুরু হয় অপেক্ষার পালা, নতুন এক উদ্যমে। পুজোর পর যথারীতি যেমন ছিলাম দ্রুত তেমন অবস্থায় প্রত্যাবর্তন। কোনো প্রভেদ হয়না, শুধু দিন আরেকটু ছোট, রাত আরেকটু ঠান্ডা - কলকাতার জীবনের তার একটু নিচুতে বাঁধা ....


Wednesday, August 27, 2014

"তুমি কষে ধরো হাল, আমি তুলে বাঁধি পাল --"

পূজার গন্ধ আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে দিয়েছে - নীল-নীল আকাশে সাদা মেঘের খুচরো প্রাসাদ দেখা যাচ্ছে - রাতের দিকে বাতাসে একটু যেন হিমেল হিমেল ভাব, শেফালীরা ইতিমধ্যেই সুগন্ধ ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে, দোকান-পত্তরে কেনাকাটার ভীড় ক্রমশ: উপছে পড়ছে পূজার বাজার সেরে ফেলার জন্যে - Yesss !! it is now time for another Durga Puja. Nostalgia, memories, food and Durga Puja festivities are inseparable. But it is the 'nostalgia' that tears the heart apart - silent sighs and sweet memories are all that we are now left with...
'Kash' flowers - glowing in the sun looking out towards the Statue of Liberty...
(Photo credit: Bottledworder)
বাংলার বাইরে চলে গিয়ে, সবথেকে বেশি করে মিস করে চলেছি যে occasion-টা, সেটা হলো গিয়ে 'দূর্গা পূজা'। প্রতি বছরই যেন এই অভাবটা আরও বেশি মাত্রায় অনুভব করে উঠি। হয় হয় বাবা, এখানেও দূর্গাপূজা হয়, ভীড়-ভাট্টাও হয়, গান-বাজনা-হাসি-তামাশাও যথেষ্ঠ হয় - কিন্তু কোথায় যেন কিসের একটা definite অভাব থেকেই যায়। সেই যে মন্ডপে বসে জমিয়ে আড্ডা মেরে চলা, ঠাকুর দেখার দোহাই দিয়ে নীল-শাড়ি কোথায় যাচ্ছে সেদিকে কনস্ট্যান্ট নজর রাখা, মাইকে কার গান কখন বাজানো হবে সে-নিয়ে অহেতুক তর্কাতর্কি, প্যান্ডেলের পিছনে গিয়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে সদ্য শেখা জ্বলন্ত সিগারেটে সুখটান দেওয়া আর তারপরেই ধোঁয়া গিলে ফেলে খক-খক করে কাশতে থাকা, আবার আচমকাই বাড়ির বড়োদেরকে দেখতে পেয়ে দু'হাত জড়ো করে অযথাই মুখে ভক্তি-ভাব ফুটিয়ে তোলার নকল চেষ্টা - এ সব আর কখনোই ফিরে আসবে না - definitely 'না'।

Back then, life was much easier, simpler, rosier and prettier - all we would care about is how exactly to spend this one festival that we so eagerly planned and waited for the year long. We all had our own share of worries - which of the pandals were must-a-visit, and which others could be optional, which new dress to select on which Puja-day, what would be the menu at dinner (it had to be different all five days, with the most delicious food: পোলাও-মাংস reserved for মহানবমী), who would start the 'ধুনুচি-নাচ' in the prime time-slot, and so on.... .

~~~ * ~~~ * ~~~

Gradually, as we moved out of home, as years pass by, everything else tends to lose its glamorous sheen - that tradition too faded away somewhere into dormancy. But the glitz and charm of Durga Puja still holds strong... a thousand miles away from home, from Bengal... হৃদয়ে দাঁড়ের শব্দের সাথে কানে না-শোনা ঢাকের 'ঢ্যাম কুড়াকুড়' ছন্দ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে থাকে...



Sunday, June 22, 2014

আকাশ ঢাকা দৈত্য গাছেদের দল (যত্তোসব)...

Ancient Giant Sequoia Trees - Nature's ever-growing wonders...
...
.....
অতি ধীর কচ্ছপের গতিতে চলতে চলতে আমরা শেষমেষ সিকোয়া ন্যশনাল পার্কের ঢোকার মুখের কাছাকাছি চলে আসলাম। সামনে গাড়িদের বিশাল লম্বা লাইন। লং উইকেন্ড বলে যেন সারা ক্যালিফোর্নিয়ার লোকজন এখানে চলে এসেছে - আধ মাইল স্পিডে গাড়ি এগুচ্ছে। মাথার উপরে ঝকঝকে, ঘন নীল আকাশ - দেখেই মনে হয় ফটোশপড - নাহলে এতো নীল হয় কি করে? আমাদের পাশে পাশেই চলেছে হালকা জঙ্গুলে জায়গা। আমাদের ঠিক সামনের একটা কনভার্টিবলে এক ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী (সম্ভবত:) খুব করুণ মুখ করে বসে আছেন। গাড়ির নেমপ্লেটে লেখা: 'KANCHWA' - দেখেই আমার 'কানচা রে কানচা রে, প্যার মেরা সাচ্চা, রুক যা না-যা দিল তোড়কে...' বলে গান গাওয়ার বেজায় ইচ্ছা হতে লাগলো। একটু পরে সামনের সেই দুঃখী মানুষদ্বয় বিরক্ত হয়ে গাড়ির ছাদটা লাগিয়ে দিলো! অবশেষে গেটের কাছে এসে আমরা পার্কে ঢোকার টিকিট কিনে নিলাম। এক্কেবারে দুর্গম জায়গা - কোনো মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, খাবার দোকানপত্র কিচ্ছু নেই, গার্বেজ-বিন প্রায় চোখেই পড়ে না - কিন্তু পার্কিং লট আর স্যানিটারী টয়লেট ঠিক বানিয়ে রেখেছে। রেস্টরুমখানা আবার কাঠের লগের সুদৃশ্য বাড়ির মতো দেখতে। ভুলে করে আমি আবার সেটার খান কয়েক ছবি তুলে নিলাম!! যাই হোক এবার সিকোয়া ন্যশনাল পার্কের মধ্যে দিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো আমাদের - ধীরে সুস্থে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাড়ি জমালাম। ধীরে সুস্থে কথাটা অবশ্যি ঠিক নয় - বেশ আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ - জিকজ্যাক মোচড় - 90 ডিগ্রী নয়, একেবারে 180 ডিগ্রীর মোচড়। এক মোচড় দিয়ে গাড়ি সোজা করতে না করতেই আরেকটা এসে হাজির হয়। রাস্তার পাশে রেলিং-ফেলিং বলে কিছু নেই। মাঝে মাঝেই পাশে খাড়া খাদ - সেইখানে আবার এক্সট্রা খাতির হিসেবে বিশাল থামের মতো ইয়া লম্বা লম্বা সিকোয়া গাছ। এর মধ্যে আরেক জ্বালা হলো, উপরে উঠছি বলে কান বন্ধ হয়ে শ্রবণশক্তি লোপ পেতে চলেছে। রাস্তার আশে পাশে 60 ডিগ্রীতে খাড়া খাড়া পর্বতের ঢাল উঠে গেছে। সেই ঢালগুলোতে আবার 30 ডিগ্রী কোণে অগুন্তি সিকোয়া আর পাইন গাছ। পথের মাঝে মাঝে এক একটা পর্বত সামনা-সামনি অ্যাতো কাছে চলে আসছে যে বুক ধ্বক করে ওঠে।

থাকি একটা মেগা-সিটিতে - অর্ধেক জীবন কাটিয়ে দিয়েছি উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর মনুমেন্ট দেখে। কলকাতায় সাউথ সিটির পঁয়ত্রিশতলা বিল্ডিং-এর টংয়ে উঠেছি। শিকাগোর সীয়ার্স টাওয়ারে চড়েছি - টরন্টোর সিএন টাওয়ারেও ওঠা হয়েছে। কিন্তু এরকম বিশাল কিছু আমি বাস্তবে কেন, স্বপ্নেতেও কখনো দেখিনি। দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে, উচ্চতা, গভীরতায়, অপ্রতিসমতায়, কোনভাবেই কোন কিছুর সাথেই আমি এই গাছগুলোর তুলনা করতে পারছিলাম না। এরা অ্যাতোটাই উঁচু, আর বিশাল যে সরাসরি উপরের দিকে না তাকালে আকাশ আর দেখা যায় না। চিন্তার অতীত কোন প্রাচীনকালে এই দৈত্য-সমাকৃতি গাছেদের সৃষ্টি হয়েছিলো - আরও অনিদির্ষ্ট কাল থাকার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এরা দাঁড়িয়ে আছেই তো আছে। দেখলেই কেমন জানি নিজেকে খুব ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, আর নশ্বর বলে মনে হয়। ছোটবেলায় গাছের মাথায় বাড়ি বানিয়ে থাকার খুব শখ হতো - আমাদের বাগানের বড়ো আমগাছটায় উঠে, তার দুই বিশাল কান্ডের জয়েন্টে গ্যাট্টুস হয়ে বসে থাকতাম। কিন্তু আজ এই সব বিশাল বিশাল গাছ দেখে হঠাৎ করে মন বলে উঠলো, 'বাপধন, সে শখের দরকার তোর আর নেই...'

Tuesday, June 10, 2014

আবার একটা বিশ্বকাপ এসে গেলো !!

1982 সালের বিশ্বকাপ - পড়ি তখন ক্লাস থ্রী, কি ফোরে। কোথায় বিশ্বকাপ হচ্ছে তা জানি না, জানার দরকারও ঠিক মনে আসেনি, কারণ কলকাতার মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের থেকে ফাটাফাটি খেলা, জগতে আর কোথাও
হতে পারে, এই বিশ্বাস তখনও জন্ম নেয় নি। ছোটদার মুখে একদিন শুনলাম 'জিকো' বলে নাকি ব্রাজিলের এক দূর্ধর্ষ প্লেয়ার আছে, যাকে অনেকে 'সাদা পেলে' বলে ডাকে। এই কথাটা শুনে নড়েচড়ে বসলাম। কারণ ব্রাজিলের নাম একটু আধটু শুনলেও, 'পেলে' আমাদের প্রায় ঘরের, আদরের ছেলে - বিশেষ করে তার গায়ের রং 'কালো' বলে, তাকে যেন আরও বেশী করে ভালো লাগে। আমাদের তখন টিভি কেনার মতো সামর্থ্য আসেনি। শুধু টিভি কেন, মাঠে গিয়ে সত্যিকারের চামড়ার ফুটবলে খেলার মতো পয়সাও পাড়ার ক্লাবটার ছিলো না। বাড়ি থেকে মাঝে মধ্যে দু-একটা সস্তা, প্লাস্টিকের ছোটো ছোটো বল কিনে দিতো - তাই নিয়েই খুব খেলতাম - মাঝে-সাঝে বাতাবি লেবুও দিব্যি ফুটবলের কাজ করে দিতো !! বাড়িতে সব দাদাই কম-বেশী ফুটবল খেলতে ভালোবাসতো। ছোটদা বললো, 'চল, আমার এক বন্ধুর বাড়িতে টিভি আছে - সেখানে তোকে নিয়ে যাবো - ব্রাজিল আর রাশিয়ার (সোভিয়েত ইউনিয়ন) খেলা দেখতে পাবি...' - শুনেই এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। 'সাদা পেলে'-কে দেখার সুযোগ কি কেউ ছাড়ে !! মনে মনে ঠিক করে নিলাম যে আমি রাশিয়া, অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নকেই সাপোর্ট করবো। কারণ বাড়িতে তখন 'মিশা' আর 'সোভিয়েত দেশ' নামে দুটো রাশিয়ান ম্যাগাজিন আসে, খোদ মস্কো থেকে পোস্টাল সার্ভিসে। সেই সব বইয়ের (বাংলায় অনুবাদ করাগল্পগুলো পড়তে মন্দ লাগেনা - তার থেকেও বড়ো কথা ওই সব বইয়ের পাতার কোয়ালিটি খুব ভালো। বই-খাতার 'মলাট' দিতে আর বিশেষ করে কালীপূজার সময় 'ছুঁচো বাজি'-র খোল তৈরী করতে সেগুলো খুব কাজে আসে!! তাছাড়া জ্ঞান হওয়া থেকেই শুনে আসছি, অ্যামেরিকা মানেই 'নোংরা, অসভ্য, লোচ্চা - শয়তানের দেশ, ক্যাপিটালিস্ট কান্ট্রি' - অন্যদিকে 'রাশিয়া' মানেই 'মার্ক্সবাদ', অর্থাৎ স্বর্গ। এমন কি রাশিয়ানদের 'হাগু-পাদু'ও নাকি বেশ সুস্বাদু!!

তো, সেই রাতে ছোটদার সাথে সাইকেলে করে গেলাম তার সেই বড়লোকি বন্ধুর বাড়ি - গিয়ে দেখি চারিদিক সব কেমন যেন চুপচাপ, শুনশান। আস্তে করে ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখি, আরে ব্বাপ - এ তো জন-সমুদ্র !! ঘরভর্তি একগাদা লোক - কচি-কাচা থেকে ইয়ং থেকে বুড়ো, যে যেখানে পেরেছে বসে গেছে। খেলা তখন অলরেডি শুরু হয়ে গেছে - সবাই হাঁ-করে সাদা-কালো ছোট্ট একটা টিভির পটলের মতো স্ক্রিনটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আমরা যে ঘরে ঢুকেছি তা কেউ ভ্রূক্ষেপই করলো না। কোনোমতে মেঝেতে গুঁজে-সুজে থেবড়ে বসে পড়ে আমিও খেলা দেখতে লাগলাম - কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মুখও literally হাঁ-হয়ে গেলো !! এ কি দেখছি - এ তো ভাই ফুটবল খেলা নয় - এটা একটা আর্ট !! ব্রাজিলের প্রত্যেকটা প্লেয়ার যেন পায়েতে আঠা লাগিয়ে নেমেছে - বল যেন তাদের পা-থেকে বিপক্ষের প্লেয়ারদের কাছে যেতেই চায় না !! অন্যদিকে একই অবস্থা রাশিয়ান গোলকিপারটারও, সেও হাতে যেন আঠা মেখে নেমেছে (পরে তার নাম জেনেছিলাম 'দাসায়েভ') - সে ব্যাটা কিছুতেই গোলে বল ঢুকতে দেবে না !! মাছির মতো উড়ে উড়ে, ড্রাইভ মেরে মেরে ব্রাজিলের যাবতীয় শট আটকে দিচ্ছে। রাশিয়াও মাঝে মাঝেই বেশ ভালো আক্রমণ করছে - একটা পেনাল্টি পেতে গিয়েও পেলো না - এসময় হঠাৎই, দুম করে ব্রাজিলিয়ান গোলকিপার এক হাস্যকর গোল খেয়ে বসলো। ফার্স্ট হাফ শেষে খেলার স্কোর লাইন দাঁড়ালো: রাশিয়া 1, ব্রাজিল 0 - মনটা খারাপ খারাপ লাগছে - কেন তা জানিনা। আমার পছন্দের টিম জিতছে, কিন্তু তবুও ব্রাজিলের জন্যে একটা অদ্ভুত চিনচিনে, মন খারাপ ভাব শুরু হয়ে গেছে - এটাকেই কি বলে ভালোবাসা?

10 মিনিট বাদেই শুরু হলো সেকেন্ড হাফ - বাপরে বাপ, আক্রমন কাকে বলে তা এবারে স্বচক্ষে দেখলাম। জিকো, সক্রেটিস আর ফ্যালকাও-দের একের পর এক আক্রমণে রাশিয়া একেবারে নাজেহাল হয়ে, কোনঠাসা হয়ে পড়লো। শেষ পর্যন্ত পর পর দুটো অসাধারণ গোল দিয়ে ব্রাজিল ম্যাচটা ঠিক বার করে নিলো। ব্রাজিলের দ্বিতীয় গোলটার সময় আমিও যে কেমন উর্দ্ধবাহু হয়ে, তারস্বরে 'গো-ও-ও-ল' বলে চিল্লাতে শুরু করেছি, সেটা দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। 

এর পরে বহুবার নানান বিশ্বকাপে, নানান দেশের খেলা দেখেছি - মারাদোনা, রোসি, গুলিট, জিদান, লিনেকার, বেকহ্যাম, রোনাল্দিনহো, কাকা, ইত্যাদি থেকে হালফিলের ইনিয়েস্তা, রুনি, মেসি, রোনাল্ডো, নেইমার... বহু গোলকিপারও দেখেছি। কিন্তু ব্রাজিল-রাশিয়া ম্যাচের সেই আক্রমনাত্মক টিম গেম, আর রুশ গোলকিপার, 'দাসায়েভের' সেই সব অবিশাস্য গোল-বাঁচানো, এখনো ভুলতে পারিনি। দেখি, এবারের বিশ্বকাপ আমার সেই আক্ষেপ ঘোচাতে পারে কি না...

YouTube Video:  Brazil v USSR (June 14th, 1982 ) <= Click to watch

Thursday, June 5, 2014

একশো টাকার প্রজেক্ট

আর কিছু না চাই, যেন আকাশখানা পাই,
        আর একটা পালিয়ে যাওয়ার মাঠ...

আমাদের ছোটোবেলায় চারিদিকে ছিলো ধূ-ধূ প্রান্তর, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ আর মাঠ। একগাদা খেলার মাঠ তো ছিলোই, এছাড়াও বাড়ির কিছুটা দূরেই ছিল আদিগন্ত ধানক্ষেত, আর আগুনরাঙা ফুলে ভরা কৃষ্ণচূড়া, শিমূল গাছেদের সারি। এক একসময় মনে হতো বিরাট মাঠ-সমুদ্রের মধ্যে কয়েকটা ছোটো ছোটো বাড়ি-ঘর মাথা তুলে কোনোমতে বেঁচে আছে!! গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়া সূর্য্যের আলো গায়ে মাখতে মাখতে বিকেলগুলোতে মাঝে মাঝেই আমি বন্ধুদের সাথে হেঁটে হেঁটে, সবাই মিলে অনেক দূরে চলে যেতাম। একবার একটা সুন্দর মাঠ খুঁজে বার করেছিলাম, অনেকটা সেই রূপকথার গল্পে থাকা 'তেপান্তরের মাঠ'-টার মতোই। মাঠের মাঝে সটান চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে, উপরে থাকা অসীম ঘন নীল সেই আকাশের দিকে চেয়ে মন কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠতো। ভাবতাম কোথাও কোনো ভিন নক্ষত্রের গ্রহমন্ডলীতে হয়তো আছে প্রাণ, হয়তো আছে আমাদের মতনই বুদ্ধি-জ্ঞান সম্পন্ন কোনো জীব, যাদের কেউ কেউ হয়তো আমার মতনই এমনি করে কল্পনা করছে যে এই মহাবিশ্বে ওরা নিঃসঙ্গ কিনা। 

বয়সের সাথে সাথে মানুষের চিন্তা-ভাবনা, চাহিদা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা-নেশা, সব কিছুই বদলে যায়। সেই সুদূর ছোটোবেলায় কেবলই ভাবতাম আর একটু বড়ো হলেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। পালিয়ে যাওয়া ঠিক নয় - নিছক রোমাঞ্চের আশায় বাড়ি ছেড়ে, মাঠ-ঘাট পেরিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো। বাড়িতে শাসন থাকলেও, সেটা এমন কিছু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে ছিলো না।  কিন্তু অতিরিক্ত অ্যাডভেঞ্চার গল্প ও কমিকস বই পড়ার দৌলতে সব সময়ই মনে হতো বাড়ি ছাড়তে না-পারলে এ-জীবনে কিছুই করা হবে না। বাইরের জগৎ মানেই অনেক, অনেক মজা আর স্বাধীনতা - নিয়মের তেমন কোনো বেড়াজাল নেই। কিংবা হয়তো আরও অন্য কিছু ভাবতাম, আজ সেইসব আর মনে পড়েনা, শুধু মনে পড়ে মাঠ ছাড়িয়ে বেড়িয়ে পড়ার সেই অলীক হাতছানিকে। ছোট্ট মাথায় অনেক চিন্তা করে ঠিক করলাম যে মোটামুটি 'একশো' টাকা হলেই বেরিয়ে পড়া যায়।  একশো টাকা ছিলো তখনকার দিনে একটা বিশাল ব্যাপার - কারণ সে'সময় জিনিপত্রের দাম ছিলো অনেক কম। বিশ পয়সাতেই মিলতো পাঁউরুটি - সিঙারার দাম ছিল দশ পয়সা। মাত্র দুই টাকাতেই বাক্সভর্তি সন্দেশ কেনা যেতো। বাবার সাথে বাজার করতে করতে বেঁচে থাকার জন্যে নূন্যতম জিনিষপত্রগুলোর দাম সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা গড়ে উঠেছিলো। কোথায় থাকবো, বা কি কাজ করে টাকা রোজগার করবো, সেই সব নিয়েও অনেক প্ল্যান করা হয়েছিলো, তবে তার বেশিরভাগটাই এখন আর মনে পড়েনা !! এইরকম করেই সে পরিকল্পনার নানান ফাইন টিউনিং-এর মধ্যে দিয়ে আমার দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো। এমন সময়ে ঘটলো সেই উত্তেজনার ঘটনাটি - যা আমি করবো করবো করেও করে উঠতে পারিনি, সেটাই করে দেখালো আমার এক পিসতুতো দাদা। ক্লাস নাইনে ওঠার পরীক্ষায় পরপর দু'বার ফেল করে, নিজেদের আলমারী থেকে বেশ কিছু টাকা-পয়সা হাতিয়ে, সে বাড়ি ছেড়ে বেমালুম হাওয়া হয়ে গেলো। বাড়ির বড়োদের কপালে চিন্তার ভাঁজের সাথে সাথে আমার মনে আশার আলো বেশ জোরালো হয়ে উঠলো - অ্যাতোদিনে একটা সত্যিকারের রোল মডেল পাওয়া গেছে !! দিন তিন-চার কেটে গেলো - কিন্তু তার পরে ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস হয়ে উঠলো - পুলিশে ফরম্যালী জানানো উচিত হবে কিনা এই নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়ে গেলো। ওদিকে তার মা কেঁদে কেঁদে একেবারে প্রায় পাগল-প্রায় হয়ে উঠলেন। 

তখনকার দিনে মোবাইল ফোন জন্ম নেয়নি - ল্যান্ড ফোনও কারোর বাড়িতে ছিলো না। চিঠি, আর খুব দরকার পড়লে টেলিগ্রাম, এই দুটোই ছিলো যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু মানুষের নিজেদের মধ্যে ভালোবাসার নেটওয়ার্ক ছিলো অনেক জোরদার আর রিলায়েবল। লোকজন একে-অপরের বিপদে স্বেচ্ছায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতো। সেরকমই কে-একজন এক বিকেলে এসে জানালো  যে সেই পিসতুতো দাদাকে নাকি আলিপুরের দিকে কোথায় যেন দেখা গেছে। আবার শুরু হলো নতুন করে খানা-তল্লাশ, জিজ্ঞাসাবাদ। এইবারে সেই দাদার আরেক ক্লোজড ফ্রেন্ডের কাছ থেকে মিললো সম্ভাব্য এক ঠিকানা। পরের দিন সকালেই আমার বাবা সহ বেশ আরো কয়েকজন পাড়ি দিলো সেই অ্যাড্রেস নিয়ে। এর পরের ঘটনাগুলো অনেকটা গতানুগতিক ও হতাশের। বন্ধুর বন্ধু, তস্য বন্ধুর বাড়ি থেকে উবড়ে আনা হলো আমার সেই পিসতুতো দাদাকে। 'চল বাবা - চল বাবা, বাড়ি চল এবার' ইত্যাদি নানান ভালো ভালো কথা বলে তাকে ফিরিয়ে আনা হলো বাড়িতে।  আর ফিরে আসার পরপরেই শুরু হলো তার বাবার বেদম প্রহার - সোজা ভাষায় যাকে বলে 'রাম প্যাঁদানি' - সঙ্গে থাকা অন্যান্যেরা সময়মতো হস্তক্ষেপ না-করলে হয়তো থানা-পুলিশই করতে হতো সে'দিন!! মার খাবার পর তার সেই হতদরিদ্র, ভাঙাচোরা চেহারার খবর শুনে আমার নিজের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হলো - বাড়ি-ছাড়ার প্ল্যানের কিছু রদ-বদল করতে হলো। অত:পর সেই পরিকল্পনাকে ব্যাক-লটে ফেলে রেখে, দূরের সেই মাঠটার ওপারে একটা দো'তলা খাবারের দোকান চালু করার নতুন প্রোজেক্ট শুরু হলো, সঙ্গে জুটে গেলো আমার মতোই স্বপ্নবিলাসী আরেক বন্ধু - মূলধন সেই একশো টাকাই !  কিন্তু সে পরিকল্পনাও খুব বেশী দিন টিকলো না - কারণ খাবারের সম্ভাব্য মেনু নিয়ে আমার ও সেই হবু পার্টনারের মধ্যে ঘোরতর মতবিরোধ দেখা দিলো। এইভাবে নানাবিধ একশো-টাকার পরিকল্পনার স্রোতে ভেসে চললাম আমি - কিন্তু নিষিদ্ধ সেই ফল আর আমার নাগালে এলো না। ধীরে ধীরে কেমন করেই না-জানি মনের নানান পরতের পর পরতের তলায় চাপা পড়ে গেলো 'বাড়ি ছেড়ে হারিয়ে যাবার' সেই অদম্য বাসনা। কঠোর বাস্তবের নাগপাশ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো আমায়। ডাঁয়ে-বাঁয়ে অজস্র লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে সময় যেন কোথা দিয়েই হুশশ করে কেটে গেলো। স্মৃতির সেই পরত পরত লেয়ারগুলো আজ সরিয়ে দেখি পালিয়ে যাবার সেই মাঠখানা এখনও খুঁজে চলেছি আমি... 


Tuesday, May 20, 2014

হাতপাখা থেকে টেবিল ফ্যান থেকে No-ফ্যান...

'উতল হাওয়া' বলতেই টেবিল ফ্যানের কথা মনে এসে যায় - কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি আদৌ টেবিল ফ্যানের হাওয়া খেতেন ? 

ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে কোনো ইলেকট্রিক ফ্যান ছিলো না - না সিলিং ফ্যান, না টেবিল ফ্যান। তার বদলে ছিলো একগাদা রং-বেরঙের তালপাতার হাতপাখা - তাদের কোনো কোনটার ধার বরাবর লাল রঙের সিল্কের কাপড় দিয়ে সুন্দর করে সেলাই করা থাকতো, যাতে তালপাতাগুলো সহজে ভেঙ্গে না যায়। বেশিরভাগ হাতপাখার গায়েতে বা হাতলের উপরে আমরা নিজেদের নাম পেন দিয়ে যত্নের সাথে খোদাই করে রাখতাম, যাতে অন্যেরা সহজে দখল করে না নিতে পারে !! হাতপাখাগুলো অবশ্য হাওয়া-খাওয়া ছাড়াও অন্য আরো কয়েকটা কাজে ব্যবহার করা হতো - যেমন পড়া না-পারলে শাস্তি হিসাবে মাথায় বা পিঠে পাখার ডাঁটি দিয়ে সজোরে মারা, কিম্বা কোন নামী-দামী অতিথির ভাত খাবার সময়ে পাখা নাড়িয়ে মাছি তাড়ানো, এরকম কিছু কিছু কাজে। 

বাড়িতে প্রথম টেবিল ফ্যান এসেছিলো এক বিয়ে উপলক্ষ্যে, মাত্র কয়েকদিনের জন্যে ভাড়া করে - তাও আমাদের নিজেদের কোন আত্মীয়ের বিয়ে নয় - যতদূর মনে পড়ে মেজদির এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে। তারা থাকতো এক ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে, অবস্থা ছিলো আমাদের থেকেও খারাপ। তাই আমাদের বাড়িতেই বিয়ের অনুষ্ঠানটা সংক্ষেপে সারানোর অনুমতি চায়। তাদের সে প্রস্তাবে আমাদের বাড়ি থেকে প্রথমে নানান আপত্তি উঠলেও, শেষমেষ সবাই রাজি হয়ে যায়। আমাদের বাড়ি এমন কিছু আহামরি ছিলো না - কিন্তু দোতলা বাড়ি, অনেক কটা ঘর, বিশাল ছাদ আর এক বড়সড় উঠান ছিলো - এছাড়া বাড়ির লাগোয়া বাগান আর পুকুর তো আছেই - যা সবই যেকোনো বিয়েবাড়ির লোভনীয় ফিচারের মধ্যে পড়ে। আমাদের আনন্দের আর সীমা রইলো না - পড়াশুনা সব শিকেয় তুলে আমরা বিয়েবাড়ির আয়োজন নিয়ে মেতে উঠলাম - যেন এ আমাদের নিজেদেরই কোন এক আত্মীয়ের বিয়ে। বিয়ের দিন ক্রমশ: এগিয়ে এলে আস্তে আস্তে আসবাবপত্র ও বিয়ের অন্যান্য জিনিষপত্রদের আসা শুরু হলো। এই ভাবে বিয়ের ঠিক দুদিন আগে এসে গেলো চার-ব্লেডওয়ালা, মাঝারি সাইজের এক টেবিল-ফ্যান। জীবনের প্রথম টেবিল ফ্যানকে হাতে পেয়ে আমাদের সে কি উত্তেজনা ! সুইচ টিপলেই হাওয়া পাওয়া যাচ্ছে, এর থেকেও আরামের আর  কি-ই বা থাকতে পারে ! তার ওপর ফ্যানটা আবার আপনা-আপনিই এদিকে-সেদিকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারিদিকে হাওয়া দিতে পারে। এই সব দেখে আমি আর আমার ছোটদি 'হাঁ' হয়ে গেলাম - পারলে প্রায় সারাক্ষণই টেবিল ফ্যানটার কাছে বসে থাকি আর হাওয়া খেয়ে চলি। বিয়ের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমি তাড়াতাড়ি করে সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলার বারান্দায় ছুটে এলাম, যেখানে ফ্যানটাকে রাখা হয়েছিলো। কিন্তু আমার আগেই ছোটদিকে দেখলাম সেখানে গিয়ে বসে আছে - দেখেই তো আমার গা-পিত্তি জ্বলতে শুরু করে দিলো। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখলাম ছোটদি তার ডান-হাতের আঙুলগুলো অন্য হাত দিয়ে চেপে ধরে, মাথা নীচু করে বসে আছে - আর একটা আঙুল দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়েই চলেছে, একই সাথে পাল্লা দিয়ে তার চোখ থেকে টসটস করে জলের দল। বুঝলাম ভুল করে, না-বুঝে সে নিশ্চই চালু থাকা অবস্থায় ফ্যানের কভারের মধ্যে একটা আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছে, আর মুহুর্তের মধ্যে ফ্যানের ব্লেডের আঘাতে সে আঙুল কেটে গেছে। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে থাকার পর সম্বিৎ ফিরে আসতেই আমি হাঁকডাক শুরু করে দিই - মুহূর্তের মধ্যে বাড়ির বাকিরা সব পড়িমড়ি করে ছুটে এলো। তার পরেই শুরু হলো কম্বাইন্ড ট্রিটমেন্ট - কিছুটা ব্যান্ডেজ-ডেটল দিয়ে, আর বেশিরভাগটাই বাছা-বাছা শব্দ সহ বকুনি দিয়ে। এতক্ষণ ধরে কষ্ট চেপে মুখ বুজে থাকার পর, সম্মিলীত বকুনির বহরে আচমকাই ছোটদি সজোরে কেঁদে উঠলো !!! 
~ * ~ * ~
আজ বহুদিনই হলো দুজনার সংসার থেকে হাতপাখার অস্তিত্ব লোপ পেয়ে গেছে। Cooler আর AC-র দাপটে আজকাল টেবিল ফ্যান তো বটেই, এমনকি সিলিং ফ্যানের ব্যবহারও অনেক, অনেক কমে গিয়েছে। ইনফ্লেশানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আজকাল লোকে গরম পড়তেই পাহাড়ের দিকে বেড়াতে চলে যায় - পুরী, গোপালপুর, মন্দারমণি তো লোকে যখন-তখন গাড়ী করে ঘুরে আসে। 

ছোটদির সাথে বেশ অনেকদিনই হলো আর কথা হয়ে ওঠেনি - ভৌগোলিক দূরত্বের সাথে সাথে মানসিক দূরত্বও অনেকটা বেড়ে গেছে - কিছুটা অজান্তেই। হঠাৎ করে চলে আসা বেয়াড়া সব স্মৃতির দল মাঝে মাঝে সেই পুরানো দিনগুলোর কিছু কিছু ঘটনা আচমকা মনে পড়িয়ে দিয়ে মনকে অযথাই বিষন্নে ভারাতুর করে তোলে...



Sunday, May 11, 2014

অ্যাতো বড়ো আকাশতলে জীবন ক্যানে ছোটো ?

“অ্যাতো বড়ো আকাশতলে জীবন ক্যানে ছোটো ?
          পীরিতি-ফুল মনবৃক্ষে ঝরবে জেনেই ফোটো...

'তিন প্রজন্ম একসাথে...'  
ছোটবেলায় জামা-কাপড় তো বটেই, এমন কি ছেঁড়া কোনো বইপত্র দেখলে তাকে সযত্নে আঠা দিয়ে মেরামত করে নিজের কাছে রেখে দিতাম - ফেলে দেবার কথা ভাবতেই পারতাম না। সিনেমায় দেখা নায়কদের মতো ইস্পাতকঠিন মানসিকতা গড়ে তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে বাস্তবে দেখা গেলো আমি হয়ে উঠেছি ঠিক তাদের উল্টো !! বেশ আবেগপ্রবণ এবং দুঃখ-কষ্টে যথেষ্ঠ কাতর হয়ে পড়ি। 

এদেশের সিরিয়ালগুলি আমার তেমন দেখা হয়ে ওঠে না। অল্প যে কয়েকটা দেখি তার মধ্যে “স্যুটস” (Suits) হলো একটি। কয়েক সপ্তাহ আগে স্যুটসের 'সিজন ফিনালে'-র শেষ এপিসোডে যখন দেখলাম কাহিনীর মূল দুই চরিত্র, মাইক ও হার্ভি, একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে, লক্ষ্য করলাম সেই একই রকম তীব্র বিষন্নতা, একই রকম মন খারাপ লাগা আবার ফিরে এসেছে। কল্পনার এইসব মানুষগুলো আর সেই একই রকম ভাবে হেসে-খেলে বেড়াবে না, এটা ভেবে নেওয়াটা যেন প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি। দীর্ঘদিন ধরে চলা কোন ধারাবাহিক সিরিয়াল শেষ হয়ে গেলে খারাপ লাগাটা খুব স্বাভাবিক, কিন্তু লক্ষ্য করেছি কোন কিছুর পরিবর্তন আমাকে যথেষ্ঠ বিচলিত করে তোলে। আরও দু:খের কথা হলো যে না-চাইলেও পরিবর্তন কিন্তু নিজের নিয়মেই চলে আসে। কিছুদিন আগে আমার এক অফিস-কলিগের রিজাইন করার কথা শুনে সারাটা দিন মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে রইলো, অথচ তার সঙ্গে আমি একসাথে কাজ করেছি মাত্র হাতে-গোনা কয়েকটা দিন মাত্র!!! কেবল দু'দিনের পরিচয়ে একটা মানুষের জন্য মন খারাপ করার মতো ছেলেমানুষি আর কিছু হয় না! কিন্তু নাছোড়বান্দা দুঃখেরা কি হিসেব-নিকেশের মারপ্যাঁচে আটকে পড়তে চায়? সম্পর্ক নিয়ে এইসব উপলব্ধি, এগুলোই ধীরে ধীরে আমাদের বয়স্ক করে তোলে। একটা সময়ের পরে তাই নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হলেও বন্ধুত্ব আর ঠিক গড়ে ওঠে না। মাঝে মাঝে ভাবি সেই সময়টায় কি চলে এলাম নাকি !

গোটা জীবনের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী সময় কাটিয়েছি মায়ের সাথে, একই বাড়িতে। কিন্তু "মায়ের সাথে কতোটা সময় কাটিয়েছি ?", তা বিশেষ প্রশ্ন বটে !! ক্লাস থ্রী-ফোরে পড়ার সময়ে আমাদের পাড়ার সিনেমাহলে এলো তখনকার দিনের উত্তম-সুপ্রিয়ার হিট ছায়াছবি 'বনপলাশীর পদাবলী' - একান্নবর্তী বিশাল সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম সেরে, আমার মা ও আরো কয়েকজনে মিলে 'ম্যাটিনীর শো'-তে দেখতে গেলেন সেই সিনেমাটি। যাবার মিনিট দশেক বাদেই দেখা গেলো মা বাড়ি ফিরে এসেছেন, প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে। কি ব্যাপার - না একটা সিনেমার টিকিট রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া গেছে, তাই উনি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে এসেছেন। ফ্রী-তে সিনেমা দেখার লোভে মায়ের সাথে আমি প্রায় ছুটতে ছুটতে গিয়ে হাজির হলাম সিনেমাহলে। কিন্তু ঢুকতে গিয়ে বেশ ঝামেলা হলো - জানা গেলো যে ওটা সেই দিনের টিকিট হলেও, ওটা ছিলো Noon শোয়ের টিকিট!! মায়ের উপর প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে, রেগেমেগে একা একা বাড়ি ফিরে এলাম - কিন্তু মা যে কতো আগ্রহ করে, কতো কষ্টে, দ্রুত হেঁটে আমাকে নিয়ে যেতে এসেছিলেন, তা সেই তখনকার আমি ভেবেও দ্যাখেনি !!

বছর পেরিয়ে গেলো অনেকদিনই - মা'র সঙ্গে দেখা হয়না। কতদিন বেঁচে থাকবো আর আমি? মা-ই বা আর কদিন বাঁচবেন? কবার যাওয়া হবে দেশে তদিনে? কদিন থাকবো মায়ের কাছে? প্রতিদিন কঘন্টা করে মায়ের পাশে বসে থাকা হবে? এই জীবনে যদি সব হিসেব একশোভাগও মিলে যায়, যদি কোন বিপর্যয় না হয়, যদি কোন ব্যতিক্রম না হয়, তাহলে মায়ের পাশে বসে থাকা হবে ঠিক কতো ঘন্টা? কী অদ্ভুত যে মানুষের জীবন !!

সবকিছুই বদলায়, সবকিছুই দূরে সরে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় সম্প্রসারণশীল এই মহাবিশ্বের কারণেই যেন আমরা সবাই সবার থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। এমন প্রতিটা সরে যাওয়াই কষ্ট নিয়ে আসে আমার জন্য, নিশ্চুপ বসে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা। নৈর্ব্যক্তিকভাবে চিন্তা করলে, প্রতিটা সম্পর্কই শুরু হওয়া মাত্রই সেটার জন্য কষ্ট পাওয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। সম্পর্কগুলি যেন অনেকটা টাইমারের মতো। কোন সম্পর্কের শুরু মানেই যেন কেউ সেই টাইমারটা চালু করে দেয়। তারপর যতো আনন্দই, বা যতো প্রাপ্তিই আসুক না কেন, সেই সম্পর্কের থেকে নির্ধারিত কষ্টটুকু নিশ্চিতভাবেই আমাদের ফিরে পেতে হবে। ভাবি, সে জন্যেই কি গৌতম বুদ্ধ স্বেচ্ছায় গৃহত্যাগী হয়েছিলেন? 

সুখেদের শরীরে মালিন্যের আস্তরণ জমে উঠে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে একসময় তারা একেবারেই উধাও হয়ে যায়। দুঃখরাই কেবল শুধু ঝাড়বংশে বেড়ে চলতেই থাকে - দুঃখরাই থেকে যায় আমাদের সারা জীবনভ'রে। 'বন পলাশীর পদাবলী'-তে উদাস বাউল মনের দু:খে গান গেয়ে উঠেছিলো: অ্যাতো বড়ো আকাশতলে জীবন ক্যানে ছোটো ?” - এটাই মনে হয় সবচেয়ে খাঁটি কথা। যতবারই কারও কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় ভেবেছি, এদের সাথে আর হয়তো কখনো দেখা হবে না, মনটা অজান্তেই হু-হু করে কেঁদে উঠেছে। এমন নয় যে এদের আমি প্রতিদিন দেখি - কিন্তু চাইলেই যে আর এদের ফিরে পাওয়া যাবে না, এই অনুভূতিটা খুব কষ্টের। 

দিনে দিনে বুঝেছি মানুষের জীবন আসলেই হলো এক ধূমকেতুর মতো, সব কিছুই ক্ষণিকের দেখা, ক্ষণিকের পাওয়া। সম্পর্কের টাইমারেরা প্রতিমুহূর্তে টিক-টিক করে বেজেই চলেছে আমাদের চারপাশে। জানি কোন লাভ নেই, এই কষ্টের সবটুকুই অনতিক্রম্য নিয়তি। এই দুঃখ, এই বিষণ্ণতা, এই শূন্যতাই শুধু শ্বাশত সত্য - “ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে...