Thursday, June 5, 2014

একশো টাকার প্রজেক্ট

আর কিছু না চাই, যেন আকাশখানা পাই,
        আর একটা পালিয়ে যাওয়ার মাঠ...

আমাদের ছোটোবেলায় চারিদিকে ছিলো ধূ-ধূ প্রান্তর, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ আর মাঠ। একগাদা খেলার মাঠ তো ছিলোই, এছাড়াও বাড়ির কিছুটা দূরেই ছিল আদিগন্ত ধানক্ষেত, আর আগুনরাঙা ফুলে ভরা কৃষ্ণচূড়া, শিমূল গাছেদের সারি। এক একসময় মনে হতো বিরাট মাঠ-সমুদ্রের মধ্যে কয়েকটা ছোটো ছোটো বাড়ি-ঘর মাথা তুলে কোনোমতে বেঁচে আছে!! গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়া সূর্য্যের আলো গায়ে মাখতে মাখতে বিকেলগুলোতে মাঝে মাঝেই আমি বন্ধুদের সাথে হেঁটে হেঁটে, সবাই মিলে অনেক দূরে চলে যেতাম। একবার একটা সুন্দর মাঠ খুঁজে বার করেছিলাম, অনেকটা সেই রূপকথার গল্পে থাকা 'তেপান্তরের মাঠ'-টার মতোই। মাঠের মাঝে সটান চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে, উপরে থাকা অসীম ঘন নীল সেই আকাশের দিকে চেয়ে মন কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠতো। ভাবতাম কোথাও কোনো ভিন নক্ষত্রের গ্রহমন্ডলীতে হয়তো আছে প্রাণ, হয়তো আছে আমাদের মতনই বুদ্ধি-জ্ঞান সম্পন্ন কোনো জীব, যাদের কেউ কেউ হয়তো আমার মতনই এমনি করে কল্পনা করছে যে এই মহাবিশ্বে ওরা নিঃসঙ্গ কিনা। 

বয়সের সাথে সাথে মানুষের চিন্তা-ভাবনা, চাহিদা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা-নেশা, সব কিছুই বদলে যায়। সেই সুদূর ছোটোবেলায় কেবলই ভাবতাম আর একটু বড়ো হলেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। পালিয়ে যাওয়া ঠিক নয় - নিছক রোমাঞ্চের আশায় বাড়ি ছেড়ে, মাঠ-ঘাট পেরিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো। বাড়িতে শাসন থাকলেও, সেটা এমন কিছু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে ছিলো না।  কিন্তু অতিরিক্ত অ্যাডভেঞ্চার গল্প ও কমিকস বই পড়ার দৌলতে সব সময়ই মনে হতো বাড়ি ছাড়তে না-পারলে এ-জীবনে কিছুই করা হবে না। বাইরের জগৎ মানেই অনেক, অনেক মজা আর স্বাধীনতা - নিয়মের তেমন কোনো বেড়াজাল নেই। কিংবা হয়তো আরও অন্য কিছু ভাবতাম, আজ সেইসব আর মনে পড়েনা, শুধু মনে পড়ে মাঠ ছাড়িয়ে বেড়িয়ে পড়ার সেই অলীক হাতছানিকে। ছোট্ট মাথায় অনেক চিন্তা করে ঠিক করলাম যে মোটামুটি 'একশো' টাকা হলেই বেরিয়ে পড়া যায়।  একশো টাকা ছিলো তখনকার দিনে একটা বিশাল ব্যাপার - কারণ সে'সময় জিনিপত্রের দাম ছিলো অনেক কম। বিশ পয়সাতেই মিলতো পাঁউরুটি - সিঙারার দাম ছিল দশ পয়সা। মাত্র দুই টাকাতেই বাক্সভর্তি সন্দেশ কেনা যেতো। বাবার সাথে বাজার করতে করতে বেঁচে থাকার জন্যে নূন্যতম জিনিষপত্রগুলোর দাম সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা গড়ে উঠেছিলো। কোথায় থাকবো, বা কি কাজ করে টাকা রোজগার করবো, সেই সব নিয়েও অনেক প্ল্যান করা হয়েছিলো, তবে তার বেশিরভাগটাই এখন আর মনে পড়েনা !! এইরকম করেই সে পরিকল্পনার নানান ফাইন টিউনিং-এর মধ্যে দিয়ে আমার দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো। এমন সময়ে ঘটলো সেই উত্তেজনার ঘটনাটি - যা আমি করবো করবো করেও করে উঠতে পারিনি, সেটাই করে দেখালো আমার এক পিসতুতো দাদা। ক্লাস নাইনে ওঠার পরীক্ষায় পরপর দু'বার ফেল করে, নিজেদের আলমারী থেকে বেশ কিছু টাকা-পয়সা হাতিয়ে, সে বাড়ি ছেড়ে বেমালুম হাওয়া হয়ে গেলো। বাড়ির বড়োদের কপালে চিন্তার ভাঁজের সাথে সাথে আমার মনে আশার আলো বেশ জোরালো হয়ে উঠলো - অ্যাতোদিনে একটা সত্যিকারের রোল মডেল পাওয়া গেছে !! দিন তিন-চার কেটে গেলো - কিন্তু তার পরে ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস হয়ে উঠলো - পুলিশে ফরম্যালী জানানো উচিত হবে কিনা এই নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়ে গেলো। ওদিকে তার মা কেঁদে কেঁদে একেবারে প্রায় পাগল-প্রায় হয়ে উঠলেন। 

তখনকার দিনে মোবাইল ফোন জন্ম নেয়নি - ল্যান্ড ফোনও কারোর বাড়িতে ছিলো না। চিঠি, আর খুব দরকার পড়লে টেলিগ্রাম, এই দুটোই ছিলো যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু মানুষের নিজেদের মধ্যে ভালোবাসার নেটওয়ার্ক ছিলো অনেক জোরদার আর রিলায়েবল। লোকজন একে-অপরের বিপদে স্বেচ্ছায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতো। সেরকমই কে-একজন এক বিকেলে এসে জানালো  যে সেই পিসতুতো দাদাকে নাকি আলিপুরের দিকে কোথায় যেন দেখা গেছে। আবার শুরু হলো নতুন করে খানা-তল্লাশ, জিজ্ঞাসাবাদ। এইবারে সেই দাদার আরেক ক্লোজড ফ্রেন্ডের কাছ থেকে মিললো সম্ভাব্য এক ঠিকানা। পরের দিন সকালেই আমার বাবা সহ বেশ আরো কয়েকজন পাড়ি দিলো সেই অ্যাড্রেস নিয়ে। এর পরের ঘটনাগুলো অনেকটা গতানুগতিক ও হতাশের। বন্ধুর বন্ধু, তস্য বন্ধুর বাড়ি থেকে উবড়ে আনা হলো আমার সেই পিসতুতো দাদাকে। 'চল বাবা - চল বাবা, বাড়ি চল এবার' ইত্যাদি নানান ভালো ভালো কথা বলে তাকে ফিরিয়ে আনা হলো বাড়িতে।  আর ফিরে আসার পরপরেই শুরু হলো তার বাবার বেদম প্রহার - সোজা ভাষায় যাকে বলে 'রাম প্যাঁদানি' - সঙ্গে থাকা অন্যান্যেরা সময়মতো হস্তক্ষেপ না-করলে হয়তো থানা-পুলিশই করতে হতো সে'দিন!! মার খাবার পর তার সেই হতদরিদ্র, ভাঙাচোরা চেহারার খবর শুনে আমার নিজের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হলো - বাড়ি-ছাড়ার প্ল্যানের কিছু রদ-বদল করতে হলো। অত:পর সেই পরিকল্পনাকে ব্যাক-লটে ফেলে রেখে, দূরের সেই মাঠটার ওপারে একটা দো'তলা খাবারের দোকান চালু করার নতুন প্রোজেক্ট শুরু হলো, সঙ্গে জুটে গেলো আমার মতোই স্বপ্নবিলাসী আরেক বন্ধু - মূলধন সেই একশো টাকাই !  কিন্তু সে পরিকল্পনাও খুব বেশী দিন টিকলো না - কারণ খাবারের সম্ভাব্য মেনু নিয়ে আমার ও সেই হবু পার্টনারের মধ্যে ঘোরতর মতবিরোধ দেখা দিলো। এইভাবে নানাবিধ একশো-টাকার পরিকল্পনার স্রোতে ভেসে চললাম আমি - কিন্তু নিষিদ্ধ সেই ফল আর আমার নাগালে এলো না। ধীরে ধীরে কেমন করেই না-জানি মনের নানান পরতের পর পরতের তলায় চাপা পড়ে গেলো 'বাড়ি ছেড়ে হারিয়ে যাবার' সেই অদম্য বাসনা। কঠোর বাস্তবের নাগপাশ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো আমায়। ডাঁয়ে-বাঁয়ে অজস্র লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে সময় যেন কোথা দিয়েই হুশশ করে কেটে গেলো। স্মৃতির সেই পরত পরত লেয়ারগুলো আজ সরিয়ে দেখি পালিয়ে যাবার সেই মাঠখানা এখনও খুঁজে চলেছি আমি... 


2 comments:

  1. পড়ে ভাল লাগল। ছেলেবেলার সেই দিনগুলোয় সামান্য হলেও ঘুরে আসা গেল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ব্লগে আসার জন্যে অনেক ধন্যবাদ শিশিরদা :)

      Delete