Tuesday, June 10, 2014

আবার একটা বিশ্বকাপ এসে গেলো !!

1982 সালের বিশ্বকাপ - পড়ি তখন ক্লাস থ্রী, কি ফোরে। কোথায় বিশ্বকাপ হচ্ছে তা জানি না, জানার দরকারও ঠিক মনে আসেনি, কারণ কলকাতার মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের থেকে ফাটাফাটি খেলা, জগতে আর কোথাও
হতে পারে, এই বিশ্বাস তখনও জন্ম নেয় নি। ছোটদার মুখে একদিন শুনলাম 'জিকো' বলে নাকি ব্রাজিলের এক দূর্ধর্ষ প্লেয়ার আছে, যাকে অনেকে 'সাদা পেলে' বলে ডাকে। এই কথাটা শুনে নড়েচড়ে বসলাম। কারণ ব্রাজিলের নাম একটু আধটু শুনলেও, 'পেলে' আমাদের প্রায় ঘরের, আদরের ছেলে - বিশেষ করে তার গায়ের রং 'কালো' বলে, তাকে যেন আরও বেশী করে ভালো লাগে। আমাদের তখন টিভি কেনার মতো সামর্থ্য আসেনি। শুধু টিভি কেন, মাঠে গিয়ে সত্যিকারের চামড়ার ফুটবলে খেলার মতো পয়সাও পাড়ার ক্লাবটার ছিলো না। বাড়ি থেকে মাঝে মধ্যে দু-একটা সস্তা, প্লাস্টিকের ছোটো ছোটো বল কিনে দিতো - তাই নিয়েই খুব খেলতাম - মাঝে-সাঝে বাতাবি লেবুও দিব্যি ফুটবলের কাজ করে দিতো !! বাড়িতে সব দাদাই কম-বেশী ফুটবল খেলতে ভালোবাসতো। ছোটদা বললো, 'চল, আমার এক বন্ধুর বাড়িতে টিভি আছে - সেখানে তোকে নিয়ে যাবো - ব্রাজিল আর রাশিয়ার (সোভিয়েত ইউনিয়ন) খেলা দেখতে পাবি...' - শুনেই এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। 'সাদা পেলে'-কে দেখার সুযোগ কি কেউ ছাড়ে !! মনে মনে ঠিক করে নিলাম যে আমি রাশিয়া, অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নকেই সাপোর্ট করবো। কারণ বাড়িতে তখন 'মিশা' আর 'সোভিয়েত দেশ' নামে দুটো রাশিয়ান ম্যাগাজিন আসে, খোদ মস্কো থেকে পোস্টাল সার্ভিসে। সেই সব বইয়ের (বাংলায় অনুবাদ করাগল্পগুলো পড়তে মন্দ লাগেনা - তার থেকেও বড়ো কথা ওই সব বইয়ের পাতার কোয়ালিটি খুব ভালো। বই-খাতার 'মলাট' দিতে আর বিশেষ করে কালীপূজার সময় 'ছুঁচো বাজি'-র খোল তৈরী করতে সেগুলো খুব কাজে আসে!! তাছাড়া জ্ঞান হওয়া থেকেই শুনে আসছি, অ্যামেরিকা মানেই 'নোংরা, অসভ্য, লোচ্চা - শয়তানের দেশ, ক্যাপিটালিস্ট কান্ট্রি' - অন্যদিকে 'রাশিয়া' মানেই 'মার্ক্সবাদ', অর্থাৎ স্বর্গ। এমন কি রাশিয়ানদের 'হাগু-পাদু'ও নাকি বেশ সুস্বাদু!!

তো, সেই রাতে ছোটদার সাথে সাইকেলে করে গেলাম তার সেই বড়লোকি বন্ধুর বাড়ি - গিয়ে দেখি চারিদিক সব কেমন যেন চুপচাপ, শুনশান। আস্তে করে ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখি, আরে ব্বাপ - এ তো জন-সমুদ্র !! ঘরভর্তি একগাদা লোক - কচি-কাচা থেকে ইয়ং থেকে বুড়ো, যে যেখানে পেরেছে বসে গেছে। খেলা তখন অলরেডি শুরু হয়ে গেছে - সবাই হাঁ-করে সাদা-কালো ছোট্ট একটা টিভির পটলের মতো স্ক্রিনটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আমরা যে ঘরে ঢুকেছি তা কেউ ভ্রূক্ষেপই করলো না। কোনোমতে মেঝেতে গুঁজে-সুজে থেবড়ে বসে পড়ে আমিও খেলা দেখতে লাগলাম - কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মুখও literally হাঁ-হয়ে গেলো !! এ কি দেখছি - এ তো ভাই ফুটবল খেলা নয় - এটা একটা আর্ট !! ব্রাজিলের প্রত্যেকটা প্লেয়ার যেন পায়েতে আঠা লাগিয়ে নেমেছে - বল যেন তাদের পা-থেকে বিপক্ষের প্লেয়ারদের কাছে যেতেই চায় না !! অন্যদিকে একই অবস্থা রাশিয়ান গোলকিপারটারও, সেও হাতে যেন আঠা মেখে নেমেছে (পরে তার নাম জেনেছিলাম 'দাসায়েভ') - সে ব্যাটা কিছুতেই গোলে বল ঢুকতে দেবে না !! মাছির মতো উড়ে উড়ে, ড্রাইভ মেরে মেরে ব্রাজিলের যাবতীয় শট আটকে দিচ্ছে। রাশিয়াও মাঝে মাঝেই বেশ ভালো আক্রমণ করছে - একটা পেনাল্টি পেতে গিয়েও পেলো না - এসময় হঠাৎই, দুম করে ব্রাজিলিয়ান গোলকিপার এক হাস্যকর গোল খেয়ে বসলো। ফার্স্ট হাফ শেষে খেলার স্কোর লাইন দাঁড়ালো: রাশিয়া 1, ব্রাজিল 0 - মনটা খারাপ খারাপ লাগছে - কেন তা জানিনা। আমার পছন্দের টিম জিতছে, কিন্তু তবুও ব্রাজিলের জন্যে একটা অদ্ভুত চিনচিনে, মন খারাপ ভাব শুরু হয়ে গেছে - এটাকেই কি বলে ভালোবাসা?

10 মিনিট বাদেই শুরু হলো সেকেন্ড হাফ - বাপরে বাপ, আক্রমন কাকে বলে তা এবারে স্বচক্ষে দেখলাম। জিকো, সক্রেটিস আর ফ্যালকাও-দের একের পর এক আক্রমণে রাশিয়া একেবারে নাজেহাল হয়ে, কোনঠাসা হয়ে পড়লো। শেষ পর্যন্ত পর পর দুটো অসাধারণ গোল দিয়ে ব্রাজিল ম্যাচটা ঠিক বার করে নিলো। ব্রাজিলের দ্বিতীয় গোলটার সময় আমিও যে কেমন উর্দ্ধবাহু হয়ে, তারস্বরে 'গো-ও-ও-ল' বলে চিল্লাতে শুরু করেছি, সেটা দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। 

এর পরে বহুবার নানান বিশ্বকাপে, নানান দেশের খেলা দেখেছি - মারাদোনা, রোসি, গুলিট, জিদান, লিনেকার, বেকহ্যাম, রোনাল্দিনহো, কাকা, ইত্যাদি থেকে হালফিলের ইনিয়েস্তা, রুনি, মেসি, রোনাল্ডো, নেইমার... বহু গোলকিপারও দেখেছি। কিন্তু ব্রাজিল-রাশিয়া ম্যাচের সেই আক্রমনাত্মক টিম গেম, আর রুশ গোলকিপার, 'দাসায়েভের' সেই সব অবিশাস্য গোল-বাঁচানো, এখনো ভুলতে পারিনি। দেখি, এবারের বিশ্বকাপ আমার সেই আক্ষেপ ঘোচাতে পারে কি না...

YouTube Video:  Brazil v USSR (June 14th, 1982 ) <= Click to watch

No comments:

Post a Comment