Tuesday, May 20, 2014

হাতপাখা থেকে টেবিল ফ্যান থেকে No-ফ্যান...

'উতল হাওয়া' বলতেই টেবিল ফ্যানের কথা মনে এসে যায় - কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি আদৌ টেবিল ফ্যানের হাওয়া খেতেন ? 

ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে কোনো ইলেকট্রিক ফ্যান ছিলো না - না সিলিং ফ্যান, না টেবিল ফ্যান। তার বদলে ছিলো একগাদা রং-বেরঙের তালপাতার হাতপাখা - তাদের কোনো কোনটার ধার বরাবর লাল রঙের সিল্কের কাপড় দিয়ে সুন্দর করে সেলাই করা থাকতো, যাতে তালপাতাগুলো সহজে ভেঙ্গে না যায়। বেশিরভাগ হাতপাখার গায়েতে বা হাতলের উপরে আমরা নিজেদের নাম পেন দিয়ে যত্নের সাথে খোদাই করে রাখতাম, যাতে অন্যেরা সহজে দখল করে না নিতে পারে !! হাতপাখাগুলো অবশ্য হাওয়া-খাওয়া ছাড়াও অন্য আরো কয়েকটা কাজে ব্যবহার করা হতো - যেমন পড়া না-পারলে শাস্তি হিসাবে মাথায় বা পিঠে পাখার ডাঁটি দিয়ে সজোরে মারা, কিম্বা কোন নামী-দামী অতিথির ভাত খাবার সময়ে পাখা নাড়িয়ে মাছি তাড়ানো, এরকম কিছু কিছু কাজে। 

বাড়িতে প্রথম টেবিল ফ্যান এসেছিলো এক বিয়ে উপলক্ষ্যে, মাত্র কয়েকদিনের জন্যে ভাড়া করে - তাও আমাদের নিজেদের কোন আত্মীয়ের বিয়ে নয় - যতদূর মনে পড়ে মেজদির এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে। তারা থাকতো এক ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে, অবস্থা ছিলো আমাদের থেকেও খারাপ। তাই আমাদের বাড়িতেই বিয়ের অনুষ্ঠানটা সংক্ষেপে সারানোর অনুমতি চায়। তাদের সে প্রস্তাবে আমাদের বাড়ি থেকে প্রথমে নানান আপত্তি উঠলেও, শেষমেষ সবাই রাজি হয়ে যায়। আমাদের বাড়ি এমন কিছু আহামরি ছিলো না - কিন্তু দোতলা বাড়ি, অনেক কটা ঘর, বিশাল ছাদ আর এক বড়সড় উঠান ছিলো - এছাড়া বাড়ির লাগোয়া বাগান আর পুকুর তো আছেই - যা সবই যেকোনো বিয়েবাড়ির লোভনীয় ফিচারের মধ্যে পড়ে। আমাদের আনন্দের আর সীমা রইলো না - পড়াশুনা সব শিকেয় তুলে আমরা বিয়েবাড়ির আয়োজন নিয়ে মেতে উঠলাম - যেন এ আমাদের নিজেদেরই কোন এক আত্মীয়ের বিয়ে। বিয়ের দিন ক্রমশ: এগিয়ে এলে আস্তে আস্তে আসবাবপত্র ও বিয়ের অন্যান্য জিনিষপত্রদের আসা শুরু হলো। এই ভাবে বিয়ের ঠিক দুদিন আগে এসে গেলো চার-ব্লেডওয়ালা, মাঝারি সাইজের এক টেবিল-ফ্যান। জীবনের প্রথম টেবিল ফ্যানকে হাতে পেয়ে আমাদের সে কি উত্তেজনা ! সুইচ টিপলেই হাওয়া পাওয়া যাচ্ছে, এর থেকেও আরামের আর  কি-ই বা থাকতে পারে ! তার ওপর ফ্যানটা আবার আপনা-আপনিই এদিকে-সেদিকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারিদিকে হাওয়া দিতে পারে। এই সব দেখে আমি আর আমার ছোটদি 'হাঁ' হয়ে গেলাম - পারলে প্রায় সারাক্ষণই টেবিল ফ্যানটার কাছে বসে থাকি আর হাওয়া খেয়ে চলি। বিয়ের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমি তাড়াতাড়ি করে সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলার বারান্দায় ছুটে এলাম, যেখানে ফ্যানটাকে রাখা হয়েছিলো। কিন্তু আমার আগেই ছোটদিকে দেখলাম সেখানে গিয়ে বসে আছে - দেখেই তো আমার গা-পিত্তি জ্বলতে শুরু করে দিলো। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখলাম ছোটদি তার ডান-হাতের আঙুলগুলো অন্য হাত দিয়ে চেপে ধরে, মাথা নীচু করে বসে আছে - আর একটা আঙুল দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়েই চলেছে, একই সাথে পাল্লা দিয়ে তার চোখ থেকে টসটস করে জলের দল। বুঝলাম ভুল করে, না-বুঝে সে নিশ্চই চালু থাকা অবস্থায় ফ্যানের কভারের মধ্যে একটা আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছে, আর মুহুর্তের মধ্যে ফ্যানের ব্লেডের আঘাতে সে আঙুল কেটে গেছে। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে থাকার পর সম্বিৎ ফিরে আসতেই আমি হাঁকডাক শুরু করে দিই - মুহূর্তের মধ্যে বাড়ির বাকিরা সব পড়িমড়ি করে ছুটে এলো। তার পরেই শুরু হলো কম্বাইন্ড ট্রিটমেন্ট - কিছুটা ব্যান্ডেজ-ডেটল দিয়ে, আর বেশিরভাগটাই বাছা-বাছা শব্দ সহ বকুনি দিয়ে। এতক্ষণ ধরে কষ্ট চেপে মুখ বুজে থাকার পর, সম্মিলীত বকুনির বহরে আচমকাই ছোটদি সজোরে কেঁদে উঠলো !!! 
~ * ~ * ~
আজ বহুদিনই হলো দুজনার সংসার থেকে হাতপাখার অস্তিত্ব লোপ পেয়ে গেছে। Cooler আর AC-র দাপটে আজকাল টেবিল ফ্যান তো বটেই, এমনকি সিলিং ফ্যানের ব্যবহারও অনেক, অনেক কমে গিয়েছে। ইনফ্লেশানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আজকাল লোকে গরম পড়তেই পাহাড়ের দিকে বেড়াতে চলে যায় - পুরী, গোপালপুর, মন্দারমণি তো লোকে যখন-তখন গাড়ী করে ঘুরে আসে। 

ছোটদির সাথে বেশ অনেকদিনই হলো আর কথা হয়ে ওঠেনি - ভৌগোলিক দূরত্বের সাথে সাথে মানসিক দূরত্বও অনেকটা বেড়ে গেছে - কিছুটা অজান্তেই। হঠাৎ করে চলে আসা বেয়াড়া সব স্মৃতির দল মাঝে মাঝে সেই পুরানো দিনগুলোর কিছু কিছু ঘটনা আচমকা মনে পড়িয়ে দিয়ে মনকে অযথাই বিষন্নে ভারাতুর করে তোলে...



2 comments:

  1. এই রকম একটা বিষয় নিয়েও যে এত ভাল লেখা যায় সেটা আমার সত্যি জানা ছিলনা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. Thanks প্রিয়াঙ্কা for visiting & reading my blog - 'ভালো লেগেছে' জেনে ভালো লাগলো :) - আর হ্যাঁ, মাঝে মাঝে এইসব ছাইপাঁশ লিখলে মনটা একটু হালকা হালকা লাগে !

      Delete