Sunday, May 11, 2014

অ্যাতো বড়ো আকাশতলে জীবন ক্যানে ছোটো ?

“অ্যাতো বড়ো আকাশতলে জীবন ক্যানে ছোটো ?
          পীরিতি-ফুল মনবৃক্ষে ঝরবে জেনেই ফোটো...

'তিন প্রজন্ম একসাথে...'  
ছোটবেলায় জামা-কাপড় তো বটেই, এমন কি ছেঁড়া কোনো বইপত্র দেখলে তাকে সযত্নে আঠা দিয়ে মেরামত করে নিজের কাছে রেখে দিতাম - ফেলে দেবার কথা ভাবতেই পারতাম না। সিনেমায় দেখা নায়কদের মতো ইস্পাতকঠিন মানসিকতা গড়ে তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে বাস্তবে দেখা গেলো আমি হয়ে উঠেছি ঠিক তাদের উল্টো !! বেশ আবেগপ্রবণ এবং দুঃখ-কষ্টে যথেষ্ঠ কাতর হয়ে পড়ি। 

এদেশের সিরিয়ালগুলি আমার তেমন দেখা হয়ে ওঠে না। অল্প যে কয়েকটা দেখি তার মধ্যে “স্যুটস” (Suits) হলো একটি। কয়েক সপ্তাহ আগে স্যুটসের 'সিজন ফিনালে'-র শেষ এপিসোডে যখন দেখলাম কাহিনীর মূল দুই চরিত্র, মাইক ও হার্ভি, একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে, লক্ষ্য করলাম সেই একই রকম তীব্র বিষন্নতা, একই রকম মন খারাপ লাগা আবার ফিরে এসেছে। কল্পনার এইসব মানুষগুলো আর সেই একই রকম ভাবে হেসে-খেলে বেড়াবে না, এটা ভেবে নেওয়াটা যেন প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি। দীর্ঘদিন ধরে চলা কোন ধারাবাহিক সিরিয়াল শেষ হয়ে গেলে খারাপ লাগাটা খুব স্বাভাবিক, কিন্তু লক্ষ্য করেছি কোন কিছুর পরিবর্তন আমাকে যথেষ্ঠ বিচলিত করে তোলে। আরও দু:খের কথা হলো যে না-চাইলেও পরিবর্তন কিন্তু নিজের নিয়মেই চলে আসে। কিছুদিন আগে আমার এক অফিস-কলিগের রিজাইন করার কথা শুনে সারাটা দিন মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে রইলো, অথচ তার সঙ্গে আমি একসাথে কাজ করেছি মাত্র হাতে-গোনা কয়েকটা দিন মাত্র!!! কেবল দু'দিনের পরিচয়ে একটা মানুষের জন্য মন খারাপ করার মতো ছেলেমানুষি আর কিছু হয় না! কিন্তু নাছোড়বান্দা দুঃখেরা কি হিসেব-নিকেশের মারপ্যাঁচে আটকে পড়তে চায়? সম্পর্ক নিয়ে এইসব উপলব্ধি, এগুলোই ধীরে ধীরে আমাদের বয়স্ক করে তোলে। একটা সময়ের পরে তাই নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হলেও বন্ধুত্ব আর ঠিক গড়ে ওঠে না। মাঝে মাঝে ভাবি সেই সময়টায় কি চলে এলাম নাকি !

গোটা জীবনের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী সময় কাটিয়েছি মায়ের সাথে, একই বাড়িতে। কিন্তু "মায়ের সাথে কতোটা সময় কাটিয়েছি ?", তা বিশেষ প্রশ্ন বটে !! ক্লাস থ্রী-ফোরে পড়ার সময়ে আমাদের পাড়ার সিনেমাহলে এলো তখনকার দিনের উত্তম-সুপ্রিয়ার হিট ছায়াছবি 'বনপলাশীর পদাবলী' - একান্নবর্তী বিশাল সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম সেরে, আমার মা ও আরো কয়েকজনে মিলে 'ম্যাটিনীর শো'-তে দেখতে গেলেন সেই সিনেমাটি। যাবার মিনিট দশেক বাদেই দেখা গেলো মা বাড়ি ফিরে এসেছেন, প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে। কি ব্যাপার - না একটা সিনেমার টিকিট রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া গেছে, তাই উনি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে এসেছেন। ফ্রী-তে সিনেমা দেখার লোভে মায়ের সাথে আমি প্রায় ছুটতে ছুটতে গিয়ে হাজির হলাম সিনেমাহলে। কিন্তু ঢুকতে গিয়ে বেশ ঝামেলা হলো - জানা গেলো যে ওটা সেই দিনের টিকিট হলেও, ওটা ছিলো Noon শোয়ের টিকিট!! মায়ের উপর প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে, রেগেমেগে একা একা বাড়ি ফিরে এলাম - কিন্তু মা যে কতো আগ্রহ করে, কতো কষ্টে, দ্রুত হেঁটে আমাকে নিয়ে যেতে এসেছিলেন, তা সেই তখনকার আমি ভেবেও দ্যাখেনি !!

বছর পেরিয়ে গেলো অনেকদিনই - মা'র সঙ্গে দেখা হয়না। কতদিন বেঁচে থাকবো আর আমি? মা-ই বা আর কদিন বাঁচবেন? কবার যাওয়া হবে দেশে তদিনে? কদিন থাকবো মায়ের কাছে? প্রতিদিন কঘন্টা করে মায়ের পাশে বসে থাকা হবে? এই জীবনে যদি সব হিসেব একশোভাগও মিলে যায়, যদি কোন বিপর্যয় না হয়, যদি কোন ব্যতিক্রম না হয়, তাহলে মায়ের পাশে বসে থাকা হবে ঠিক কতো ঘন্টা? কী অদ্ভুত যে মানুষের জীবন !!

সবকিছুই বদলায়, সবকিছুই দূরে সরে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় সম্প্রসারণশীল এই মহাবিশ্বের কারণেই যেন আমরা সবাই সবার থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। এমন প্রতিটা সরে যাওয়াই কষ্ট নিয়ে আসে আমার জন্য, নিশ্চুপ বসে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা। নৈর্ব্যক্তিকভাবে চিন্তা করলে, প্রতিটা সম্পর্কই শুরু হওয়া মাত্রই সেটার জন্য কষ্ট পাওয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। সম্পর্কগুলি যেন অনেকটা টাইমারের মতো। কোন সম্পর্কের শুরু মানেই যেন কেউ সেই টাইমারটা চালু করে দেয়। তারপর যতো আনন্দই, বা যতো প্রাপ্তিই আসুক না কেন, সেই সম্পর্কের থেকে নির্ধারিত কষ্টটুকু নিশ্চিতভাবেই আমাদের ফিরে পেতে হবে। ভাবি, সে জন্যেই কি গৌতম বুদ্ধ স্বেচ্ছায় গৃহত্যাগী হয়েছিলেন? 

সুখেদের শরীরে মালিন্যের আস্তরণ জমে উঠে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে একসময় তারা একেবারেই উধাও হয়ে যায়। দুঃখরাই কেবল শুধু ঝাড়বংশে বেড়ে চলতেই থাকে - দুঃখরাই থেকে যায় আমাদের সারা জীবনভ'রে। 'বন পলাশীর পদাবলী'-তে উদাস বাউল মনের দু:খে গান গেয়ে উঠেছিলো: অ্যাতো বড়ো আকাশতলে জীবন ক্যানে ছোটো ?” - এটাই মনে হয় সবচেয়ে খাঁটি কথা। যতবারই কারও কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় ভেবেছি, এদের সাথে আর হয়তো কখনো দেখা হবে না, মনটা অজান্তেই হু-হু করে কেঁদে উঠেছে। এমন নয় যে এদের আমি প্রতিদিন দেখি - কিন্তু চাইলেই যে আর এদের ফিরে পাওয়া যাবে না, এই অনুভূতিটা খুব কষ্টের। 

দিনে দিনে বুঝেছি মানুষের জীবন আসলেই হলো এক ধূমকেতুর মতো, সব কিছুই ক্ষণিকের দেখা, ক্ষণিকের পাওয়া। সম্পর্কের টাইমারেরা প্রতিমুহূর্তে টিক-টিক করে বেজেই চলেছে আমাদের চারপাশে। জানি কোন লাভ নেই, এই কষ্টের সবটুকুই অনতিক্রম্য নিয়তি। এই দুঃখ, এই বিষণ্ণতা, এই শূন্যতাই শুধু শ্বাশত সত্য - “ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে...

2 comments:

  1. দারুণ দারুণ লেখা সত্যি মন ভরে গেল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. Thanks প্রিয়াঙ্কা for visiting & reading my blog - 'ভালো লেগেছে' জেনে ভালো লাগলো :) - আপনার/তোমার ব্লগটাও আগের দিনই দেখেছিলাম - চলতে থাকুক লেখা পত্তর, অবিরাম গতিতে...

      Delete