Saturday, March 8, 2014

আমজনতা


'আমজনতা' শব্দটার অর্থ প্রায় সবারই জানা - কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কথাটার উৎপত্তি হলো কি করে। অনেকেই বলবে উর্দুতে 'আম' মানে হলো গিয়ে 'সাধারণ' - কিন্তু উর্দুতেই বা 'আম' কথাটা এলো কি করে? আমগাছের 'আম' থেকে? যদি তাই হয়, তা'হলে আম কি একসময় এতোটাই সস্তা আর সুলভ ছিলো যে জনসাধারণ সবাই-ই আম খেতে পেতো? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় - অন্তত: ইদানিং যে হারে স্বাদু আমের প্রতুলতা কমছে। সে যাই হোক এতোকাল ধরে আমি নিজেকে ঐ 'আমজনতা' হিসাবেই গণ্য করে এসেছি - কারণ আমাদের জ্ঞাতি-গুষ্ঠির মধ্যে চেনা-জানা কারোরই কোনও রকমের পলিটিক্যাল পাওয়ার তো দূরের কথা, পলিটিকসের সাথে চেনা-জানা কারোর আলাপ পর্যন্ত নেই। এমনকি পুলিশ, ল-ইয়ার, পঞ্চায়েত-নেতা, পার্টিবাজ, বোমাবাজ, নিদেনপক্ষে গুন্ডা বা চাঁদাবাজ কারোর সাথে কোন জানা-শোনা নেই। সুতরাং আমি 'আমজনতা' হবো না তো, কি 'ইয়ে' হবো ?

কবিগুরু বলে গিয়েছিলেন “আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না” - খুবই খাঁটি কথা। বছরখানেক আগে শীতের ছুটিতে দেশে গিয়েছি। এখান থেকে নিয়ে যাওয়া আমার মোবাইল সেটটিকে এক বই-কাগজ-বিক্রীওয়ালা ভালোবেসে 'নিজের মনে' করে নিয়ে চলে গেছে। অত:পর দেশী এক চায়না-মোবাইল সেট কিনে কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু চাইনিজরা বোধহয় তেমন জল-টল খায় না। এক দুপুরে জামাকাপড় কাচার সময় বালতির জলের মধ্যে মাত্র একবার চোবানি খেয়েই প্যান্টের পকেটে বন্দী থাকা সেই চাইনিজ সেটটি যুগপৎ বোবা আর অন্ধ হয়ে গেলো। কি আর করা ! মোড়ের কাছের মোবাইল ফোনের বুথটাতে গেলাম। আগে এই ছোট্ট দোকানটা শুধুমাত্র STD/ISD-র ব্যবসা করেই লালে-লাল হয়ে উঠেছিলো। বামফ্রন্ট জমানার মতোই সে সুখের দিন আর নেই - মুঠো-ফোন আসার পর ইদানিং সে-ব্যবসায় বেশ কিছুটা ভাঁটা পড়ে গেছে। এখন বেচারাকে ফোন কার্ড বিক্রির সাথে সাথে জেরক্স-এর কাজ করে দিন গুজরান করতে হচ্ছে। আমি আমার সেই মৃত সেটটা দোকানদারকে দেখালাম। দোকানদার অভিজ্ঞ এক ডাক্তারের মতোই উল্টে-পাল্টে, বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেটটাকে দেখে গম্ভীর মুখে রায় দিলো, 'আপনার মোবাইলটা ফ্ল্যাশ করাতে হবে' - আমি গোবেচারার মতো পাশের টুলটায় বসে পড়লাম। যস্মিন দেশে যদাচার.... বসে আছি তো আছিই। ডাক্তারসাহেব মোবাইলটাকে তার কম্পুটারের সাথে লাগিয়ে দিয়ে আমাকে ছাইপাঁশ কি সব দেখিয়ে চললো। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেনে গেলাম যে এ দোকানে মোবাইল সার্ভিসিং-এর পাশাপাশি মোবাইলে গান ভরেও দেওয়া হয়, 'ফেলো কড়ি মাখো তেল' পন্থায়। কিছুক্ষণ পরপর নিরীহগোছের মানুষেরা মোবাইল ফোন নিয়ে আসছে - আর ফোনের মেমরি কার্ড ভর্তি করে গান নিয়ে যাচ্ছে। 'কপিরাইট' বলে কোনো কিছু এরা বাপের জন্মে শুনেছে বলে মনে হয় না। বুঝলাম ট্রেনে কিংবা বাসের ভীড়ের মধ্যে তারা তাদের আদরের চায়না-সেটগুলোতে অত্যন্ত মমতা নিয়ে এইসব গানগুলো বিকট স্বরে চালিয়ে, আশেপাশের সবাইকে গান-পাগল করে তুলে, নিজেরা উদাস হয়ে যাবে। আমি ধৈর্য্য ধরে বসেই আছি আমার মোবাইলটার চিকিৎসা হওয়ার অপেক্ষায়। এ সময় আমার পিছন থেকে এক বয়স্ক লোক এসে তার ফোনের মেমরি কার্ডটা দোকানদারকে দিয়ে বললেন, 'কিছু ভালো গান ভরে দ্যান তো...' - তার গলা শুনে আর মুখ দেখে আমার কিছুটা চেনাচেনা লাগলো। যতদূর মনে পরে সে একসময় হাত দেখা, ঘটকালির সাথে সাথে পার্ট-টাইম পূজারী গোছের কিছু কাজ করে বেড়াতো। দোকানদার জিজ্ঞেস করলো, 'এখনকার গান দেবো, না কি পুরানো দিনের'? তো সে জবাব দিলো, 'দাও কিছু মান্না-হেমন্ত, কিছু দ্বিজেন্দ্রগীতি, নজরুল-বাউল, লোকগীতি, সব মিলিয়ে মিশিয়ে' - শুনে মনে হলো গান নয়, যেন মশলা-মুড়ি বা পাপড়ি-চাটের অর্ডার দেওয়া হচ্ছে !! কিন্তু তবুও মনে মনে তার তারিফ না-করে পারলাম না। এ ঘোর অরাজকতার যুগে হিন্দী লারেলাপ্পা, রক বা so called জীবনমুখী গান ছেড়ে নজরুল-দ্বিজেন্দ্রলালের গান, বা বাউল গান শোনার মতো লোক স্বচক্ষে দেখতে পাওয়া মুখের কথা নয়। ফোনে গান গোঁজা শেষ হলে দোকানদার লোকটার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকালো, যদি আরও কিছু ব্যবসা বাড়ানো যায় আর কি - বললো: 'এটাতে অনেকটা জায়গা খালি আছে - আর কিছু দেবো কি ?' - এবার সেই লোকটা আমার দিকে একটু আড়চোখে তাকিয়ে, কিছুটা চাপা স্বরে ফিসফিসিয়ে বললো, 'দ্যান, কিছু বাংলা-এক্স ভিডিও-গান ঢুকিয়ে দ্যান...' - দমকা কাশির মতোই আমার হঠাৎ ভীষণ হাসি এসে গেলো। অনেক কষ্টে নিঃশ্বাস চেপে, মুখটাকে শক্ত করে আমি বসে রইলাম। কিছুই যেন শুনতে পাইনি এমন ভঙ্গিতে উল্টো দিকে তাকিয়ে রইলাম - লোকটার দিকে তাকালে হয়তো সে লজ্জা পাবে। এবারও দ্রুত গান-গোঁজা শেষ করে দোকানদার বললো, 'এখনও কিছু জায়গা খালি আছে, আর কি দেবো তাড়াতাড়ি বলুন...' - লোকটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলো, 'ভাটিয়ালি কিছু আছে কি ?' - দোকানদার এবার না-সূচক মাথা নাড়লো - অর্থাৎ ভাটিয়ালি গান তার গান-গুদামে নেই। লোকটার আচরণে আমি এবার একই সঙ্গে আশ্চর্য এবং দুঃখিত হলাম। হঠাৎ করে আমার মনে হলো এরাই হচ্ছে আমাদের দেশের আসল 'আমজনতা' - যাদের কাছে 'খচ্চর-গাধা-ঘোড়া-ময়ূর-বুনিপ', সবারই এক দাম। এরা 'সোনার কেল্লা' দেখেও আনন্দ পায়, আবার 'মিশর রহস্য' দেখেও হাততালি দেয় !! তবে দোকানদারটাই বা কেমন ধরণের মানুষ !! খারাপ জিনিস রাখে, এটা নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ করার অধিকার আমার নেই - তাহলে 'ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে' - তা-বলে তুই হতচ্ছাড়া দু'চারটে ভালো জিনিষও রাখবি না !! “এ তুমি কেমন তুমি - অ্যা:?” - ইচ্ছা করছিলো ব্যাটার পশ্চাৎদেশে কষে একটা লাথি মারি। কিন্তু 'টেকনিক্যাল ডিফিকাল্টির' জন্যে সেটা করা গেলো না - কারণ দোকানদারের স্বাস্থ্য আমার চেয়ে অনেক ভালো !! 

রিয়ালাইজেশান: 'আমজনতা'-র ক্ষমতা খুবই কম - তাই ইচ্ছা থাকলেও বেশিরভাগ সময়ই কোনও উপায় থাকে না।

No comments:

Post a Comment