Friday, March 21, 2014

পরবেশ আলী...

নারিকেল-সুপারি-কাঁঠাল-জামরুল গাছে ঘেরা এক ঘন বাগান ছিলো আমাদের একসময়। আমার ছোটবেলার প্রচুর সময় কেটে গেছিলো সেই বাগানে, বেশিরভাগ সময়ই একা-একা খেলতে। বাগানের গাছের ডাব-সুপারি-ডাঁটা-কাঁঠাল-ইত্যাদি পাড়া, পাতা-কাটা, জঞ্জাল সাফ করা থেকে যাবতীয় কাজ করে দিতো 'পরবেশ আলী' নামে এক বিশ্বাসী মুসলমান। আসতো সে লক্ষীকান্তপুরের এক অজ পাড়া-গাঁ থেকে - আমরা ডাকতাম তাকে 'পরবেশদা' বলে। মা ঠাট্টা করে বলতেন, ও হলো গিয়ে 'শুনে-মোল্লা' - অর্থাৎ দেশভাগের পরে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার সময়ে ওকে জোর করে, প্রাণের হুমকি দিয়ে মুসলমান হতে বাধ্য করা হয়েছিলো। বাড়ির যে-কোন অনুষ্ঠান বা পরিশ্রমের কাজে পরবেশদা এক কথায় রাজি হয়ে যেতো। কোনো মজুরি তাকে সাধারনত: দেওয়া হতো না, বিনিময়ে সে কিছুটা কমদামে গাছের ডাব-নারকেল-সুপারি আমাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে, বাজারে বেশী দামে বিক্রি করতো - এটাই যা ছিলো তার লাভ। শীতকালের দিকে বাগানের কোন উঁচু  গাছে ঘুড়ি আটকে পড়লে, আমি ভোর-সকালে ঘুম থেকে উঠে পরবেশদার আসার জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম - কখন সে এসে, গাছে চড়ে সেই ঘুড়িটা আমায় নামিয়ে দেবে !! লম্বা যে-কোন নারকেল গাছের একেবারে মাথায় উঠে যেতে তার লাগতো দু' থেকে তিন মিনিট - কিন্তু সেই দু-তিন মিনিট সময়ই যেন মনে হতো কয়েক ঘন্টা !! নিচে দাঁড়িয়ে থেকে, মাথা সোজা উপরের দিকে তুলে আমি কড়া নজর রেখে চলতাম যে ঘুড়িটার কোন ক্ষতি যেন সে না-করে ফেলে - কিন্তু তার নিজের কষ্টের কথা কখনো মাথাতেই আসে নি। একবার সে পাড়ার অন্য এক লোকের বাগানের নারকেল গাছ থেকে নামতে গিয়ে, গাছের প্রায় মাঝমাঝি থেকে পা-স্লিপ করে, সোজা নীচে পড়ে গিয়ে বেশ ভালোমতো জখম হয়ে যায় !! আমাদের বাড়ি থেকেই তার সুশ্রুষার সব খরচ দেওয়া হয়। অস্বাভাবিক প্রাণশক্তির কল্যাণে সে মাস খানেকের মধ্যেই আবার সুস্থ হয়ে ওঠে। 

আজ আমাদের সেই বাগান ও গাছপালা তাদের জীবনের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে - পরবেশ আলীরও অনেক বয়স হযে গেছে। আগের মতো অতো দ্রুত সে গাছে চড়তে পারে না। অনিয়মিত হলেও, সে তবু আসে আমাদের বাড়িতে - বাগানের খুচ-খাচ কাজ করে দিয়ে যায়, আগের মতোই যত্ন করে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের বাগান, গাছপালা, আর বাবা-মাকে, আমাদের চেয়েও সে  চিরটাকালই অনেক, অনেক বেশি ভালবেসেছিলো...

No comments:

Post a Comment