ছোটবেলার কথা বলতে গেলে প্রথমেই যে স্মৃতিটা মনে ভেসে আসে সেটা হলো, মাদুরের উপরে বাবু হয়ে বসে দুলে দুলে রবিঠাকুরের 'সহজ পাঠ' থেকে পড়ে চলা সেই কবিতাটা: 'আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে' - তবে বৈশাখ মাসের থেকে শরৎ আর শীতকালের জন্যেই আমরা সবাই মুখিয়ে থাকতাম। শীতকাল মানেই স্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষা, সেটা কোনোমতে শেষ করে দিতে পারলেই স্বর্গলাভ - যথেচ্ছা খেলা-ধুলা, ঘুড়ি ওড়ানো, গল্পের বই পড়া, মামার বাড়ি যাওয়া, পিকনিক, আরো কত্তো কি! অন্যদিকে শরৎকাল মানেই দুর্গাপুজো। তা, পুজো তো প্রায় এসেই গেলো - দেখতে দেখতে আবার ঠিক চলেও যাবে। যাওয়া-আসার এই দোলনায় চেপে আমার ছেলেবেলাকার পুজোর দিনগুলো থেকে একটু ঘুরে আসতে ভারি ইচ্ছা করছে।
দুর্গাপুজোর সূত্রপাত হয়ে যেতো 'রান্না পুজো' থেকে। তবে 'রান্না পুজো'র কথা শুনে অনেকে হয়তো ভ্রু কোঁচকাতেই পারেন, কারণ 'রান্না পুজো' হলো পুরোপুরি এদেশীয় অর্থাৎ 'ঘটি'দের বাপকেলে অনুষ্ঠান। রান্না পুজো মানে 'রান্না'-র পুজো আবার সেই সঙ্গে 'অরন্ধন', অর্থাৎ না-রান্নাও বটে! ভাদ্র সংক্রান্তিতে, বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন পরিবারের যাবতীয় মেয়েরা, অর্থাৎ মা-মাসিপিসি, নিজের এবং জ্যাঠতুতো-মাসতুতো দিদি-বোনেরা, সবাই মিলে একজোট হয়ে হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে সারারাত ধরে চালাতো কুটনো-বাটনা আর রান্না - সে ছিলো এক অদ্ভুত আনন্দযজ্ঞ। 'ভাদ্রে রেঁধে আশ্বিনে খাওয়ার' এই রীতির মূলে লুকিয়ে ছিলো এক চিরায়ত বিশ্বাস: 'ভাদ্রের জল হাঁড়িতে পড়লে তবেই নাকি আশ্বিনের ঢাকে বোল ফুটবে, আর ধানের ক্ষেত সব শস্যভারে ফুলেফেঁপে উঠবে'। বাড়ির পুরুষদের কাজ ছিলো রান্নাঘরটাকে ঝাড়াই-পোঁছাই করে রাখা, ব্যাগ বোঝাই করে বাজার করে আনা, উনুনের জ্বালানির জোগাড় করে দেওয়া, টেম্পোরারী কানেকশন দিয়ে ইলেকট্রিক লাইট এবং হ্যাজাকের বন্দোবস্ত করা, সেই সঙ্গে ক্যাসেট প্লেয়ারে ঝকমারি গানের ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি, মানে যত্তোসব অকাজ আর কি! সেই রান্নার বিশাল পর্ব শেষ হতে হতে পরের দিন ভোর না-হলেও, রাত দুটো তো হয়েই যেতো ! না-ঘুমানোর কঠিন পণ করেও কখন যে ঠিক ঘুমিয়ে পড়তাম, কে জানে। ঘুমের মধ্যেই একসময় শুনতে পেতাম শাঁকের আওয়াজ, আর বুঝে যেতাম ব্যস, আমাদের বাড়ির রান্নার পালা সাঙ্গ হয়ে গেছে! পরের সকালে সেই সব রান্নাবান্নার প্রত্যেকটি পদ থেকে একটু করে নিয়ে, শাঁপলাপাতায় সাজিয়ে ভক্তিভরে 'দেবী মনসাকে' সর্বপ্রথমে নিবেদন করা হতো, তারপরে শুরু হয়ে যেতো আমাদের খাওয়া-দাওয়া। হাঁড়িভর্তি পান্তাভাতের সাথে গতরাতের রান্না করা পদগুলি খেতে যে কি অপূর্ব লাগতো, তা বলে বোঝানো যাবে না। এই রান্নাপূজা উপলক্ষ্যে বিভিন্ন বাড়িতে বিভিন্ন রান্নার চল থাকলেও মোটামুটি সব বাড়িতেই 'ডাল শুকনো', ওল, কচুশাক, চিংড়ি-ইলিশ ভাজা, উচ্ছের একটা রান্না, আর গোলগোল করে কাটা মোটা আলুভাজা হতো। আমাদের বাড়ির স্পেশাল আইটেম ছিলো বাগানের নারকেল গাছের নারকেল দিয়ে বানানো পিসিমার নিজের হাতের করা নারকেল-ছাঁই আর নারকেল নাড়ু। গোটা পনেরো বড়ো বড়ো নারকোল ভেঙে কুরনি-বঁটি দিয়ে কোরা হতো। পিসিমা খুব মিহি করে নারকোল কোরাতে পারতেন। বেশ কঠিন ছিলো সে'কাজ - ক্রমাগত হাত ঘোরাতে ঘোরাতে একসময় হাতে ব্যথা হয়ে যেতো - তাই অন্যরাও এসে পালা করে হাত লাগাতেন। সেই কোরা নারকেল কড়াইতে ফেলে ভেজে, তার মধ্যে নলেনগুড় ঢেলে, ময়ান করে বানানো হতো নারকেল নাড়ু - অসাধারন ছিলো তার স্বাদ। গরম অবস্থাতেই নামিয়ে গোল্লা করে নাড়ু বানাতে হতো, কারণ ঠান্ডা হয়ে গেলে সেগুলো আর গোল করা যেতো না। মা-পিসিমা-দিদিদের সবারই হাত ওই তাপে লাল হয়ে যেতো, কিন্তু খেয়ে 'দারুণ হয়েছে' বললেই তাঁদের মুখে ফুটে উঠতো পরিতৃপ্তির অনাবিল হাসি। বাড়ির পুকুর থেকে তুলে আনা শাঁপলাডাঁটার ডাল আর আলপনা দিয়ে সাজানো রান্নাঘরের হাঁড়ি-কড়াইগুলিকে দেখে কেমন যেন গা-ছমছম করে উঠতো। একান্নবর্তী পরিবারের নানান আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে, দাদা-দিদিদের বন্ধু-বান্ধবী, পাড়ার নানান লোকেদের যাওয়া-আসায় আমাদের বাড়িটা সারাটা দিন ধরে গমগম করতো। ফলস্বরূপ রাতের বেলা খেতে বসে পান্তাভাতের সাথে ভালো কিছু আর জুটতো না, অন্তত: চিংড়ি বা ইলিশমাছ ভাজা তো নয়ই!
ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়ে যাওয়াটাই এ জগতের চিরাচরিত নিয়ম। কিন্তু সেই সময়ে আমরা বড্ড বেশি করে চাইতাম 'চট' করে বড়ো হয়ে যেতে। তা'হলে দাদার মতো একলা একলা সাইকেল চেপে যেখানে খুশি যেতে পারবো, বা কাউকে না-বলেই ট্রেনে চেপে কলকাতা ঘুরে আসতে পারবো, এ'সবই আর কি ! কিন্তু আজ পিছু ফিরে বুঝতে পারি যে কি সাংঘাতিক ভুল চাওয়াই না সেদিন চেয়েছিলাম। 'বড়ো' হওয়া আর 'মেকি' হওয়ার মধ্যে আদপেই যে কোনো পার্থক্য নেই, তা বোঝার ক্ষমতা সেদিনের 'সেই আমি'-র ছিলো না।
পাড়ার মোড়ে যখন বিশ্বকর্মা পুজো হতো তখন থেকেই বুঝে যেতাম যে নতুন জামাকাপড়ের পাট ভাঙার সময় এখন না-এলেও, দুর্গাপুজো কিন্তু আর মাত্র কয়েক হাত দূরেই। পরিবেশে যেন একটা পুজো-পুজো গন্ধ সে দিন থেকেই পেতে শুরু করতাম। তার কিছুদিন পরেই হঠাৎ করে এসে যেতো 'মহালয়া'। ভোর সকালে আধো ঘুম আধো জাগরণে, বীরেনবাবুর মন্দ্রমধুর কন্ঠে চন্ডীপাঠ: ‘যা দেবী সর্বভূতেষু…’ শুনে চমকে উঠতাম - অকারণেই সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতো - যাক, পুজো তাহলে সত্যি সত্যিই এসে গেছে!! চোখ কচলে বিছানায় উঠে বসে খেয়াল করতাম কাছে-দূরের সবকটা বাড়ির রেডিও থেকেই মহালয়া শোনা যাচ্ছে। কাছের রেডিওটা যেন দূরের রেডিওটারই প্রতিধ্বনি - তারপর এক সময়ে সবকটা মিলেমিশে যেতো - দূরের বীরেন ভদ্র আর কাছের বীরেন ভদ্র মিলেমিশে এক হয়ে যেতেন। মনে পড়ে ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ গানটা শুরু হবার সাথে সাথেই মা দরজা খুলে দাওয়ায় বেরিয়ে আসতেন, শিউলি-গন্ধ মাখা আবছা আলো আঁধারির সেই ভোরে। আকাশটা লাগতো কেমন অদ্ভুত রকমের শান্ত আর নীলাভ। অচেনা একটা শিরশিরে ভাবে ভরে থাকা, শারদীয়ার সুবাস মাখা সেই ভোরে পাখিদের ঘুম তখনও ভাঙতো না। ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির’, কথাগুলো শুনলেই সারা শরীরে অদ্ভুত এক আবেগ উথলে উঠতো! সে আবেগের পুরোটাই ছিলো নির্ভেজাল আনন্দের। পুজো শুরু হওয়ার আনন্দের সঙ্গে যেমন মিশে থাকতো দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়ে নিয়ম ভাঙার আনন্দ, তেমনই থাকতো পড়াশোনা ভুলে আপন খুশিতে মেতে ওঠার আনন্দ। স্তোত্রে জেগে ওঠা ভোর কেমন করে যেন ‘আধুনিক’ হয়ে যেতো বেলা বাড়ার সাথে সাথেই। মহালয়ার গানের সঙ্গে মিশে যেতো লতা-সলিল-হেমন্ত কিশোর-আশার পুজোর গান। আকাশের ধূসর, গোমড়া মুখটা পাল্টে গিয়ে কি আশ্চর্য্য রকমের ঝকঝকে নীল হয়ে উঠতো। সেই নীল-জুড়ে ভাগ বসাতে চলে আসতো পেঁজা তুলোর মতো সাদা-সাদা মেঘেদের দল। রোদ্দুরটাও হয়ে উঠতো মায়ামাখা, সোনা-রঙা। আর তারই মধ্যে এক সপ্তাহান্তে বাবা বলে উঠেতেন, 'আজ পুরানো গল্পের বইগুলোকে সব রোদ্দুরে দিতে হবে'। ঘরের দেয়ালজোড়া আলমারিগুলোতে থাকা অগুন্তি বইগুলোকে একে একে নিয়ে আমি চলতাম তিনতলার ছাদে মাদুর বিছিয়ে রোদ খাওয়াতে। সবকটা রোদে দেওয়া হয়ে গেলে, বাবা আকাশের দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলে উঠতেন: ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি - নাহ্:, আর বৃষ্টি হবে না - শরৎ এসে গেছে...’ - আর অমনিই সেইসব বইয়ের পাঁজা ছুঁয়ে, ঝলমলে সোনা-রঙা রোদ আর একরাশ খুশি নিয়ে আমার মনেও হুড়মুড়িয়ে এসে পড়তো শরৎ।
স্কুলের ছুটি পড়ে যেতো মোটামুটি তৃতীয়া কি চতুর্থীর দিন থেকেই। একমাস ছুটির পরেই থাকতো অ্যানুয়াল পরীক্ষা, কিন্তু দুর্গাপুজো শেষ না-হওয়া পর্যন্ত ভুলেও আমরা পড়ার বইয়ের ধারেকাছে ঘেঁষতাম না। পুজোর কেনাকাটা সারতে আমরা কলকাতার দিকে গেলেও ঠাকুর দেখার সময় কিন্তু নিজেদের এলাকাটা চষে বেড়াতেই পছন্দ করতাম। শহরতলীর মাইল দশেক জায়গা জুড়ে হয়ে থাকা ঠাকুরের সংখ্যা নেহাৎ কমকিছু ছিলো না। বনেদী বাড়ির পুজো, প্যান্ডেলের পুজো মিলিয়ে গোটাদশেক দেবীপ্রতিমা দর্শন করতেই কেমন করে যেন সময় ফুরিয়ে যেতো। পুজোর নতুন জুতোর দেওয়া "পুজোর ফোস্কা" পায়ে নিয়ে সপ্তমী-অষ্টমী খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, নবমী থেকে আবার পুরনো জুতো সম্বল করেই মাইলের পর মাইল হেঁটে ঠাকুর দেখা, শেষ হয়েও যেন ঠিক শেষ হতোনা। সকাল হতে না-হতেই নাকেমুখে কিছু গুঁজে প্যান্ডেলে চলে যাওয়া, বাড়ি ফিরতে ফিরতে হয়ে যেতো প্রায় মাঝরাত। ঠাকুর দেখা মানে তো শুধু ঠাকুরের কাছে যাওয়াই নয় - কে কিরকম সেজেগুজে বেরিয়েছে, পরিচিত-স্বল্পপরিচিত সমবয়সী সুন্দরী মেয়েদের দিকে ইতিউতি তাকানো, একটু হাসি, একটু ইশারা, একটু মান-অভিমান, একটু আশা-দু:সাহস - মানে চটপট প্রেমিক-প্রেমিকা বেছে নেবার মতো এরকম সুলভ সুযোগ বছরে আর দুটো আসতো না। রঙিন ফ্রক আর শাড়ির দল, সামান্য স্নো-পাউডারের প্রসাধনীতে হঠাৎ করেই প্রজাপতির মতো সুন্দরী হয়ে ওঠা মেয়েরা চোখে যেন সম্মোহনের মায়াজাল বুনে দিয়ে যেতো। মোটামুটি সপ্তমীর সকালের মধ্যেই আমাদের পছন্দের লিস্ট কমপ্লিট হয়ে যেতো - তারপরেই শুরু হয়ে যেতো পুজোর প্রেম। সেই প্রেম চলতো টানা কালীপুজো পর্যন্ত। অষ্টমীর অঞ্জলিতে প্যান্ডেলে হয়ে চলা আরতির সময় হাত জোড় হয়ে থাকতো দশভূজা দেবীর দিকে, কিন্তু মুন্ডু আপনা-আপনিই ঘুরে যেতো দ্বিভূজা চিন্ময়ীদের দিকে। কান্ড দেখে দেবী প্রতিমার মুখ হাসিতে ভরে উঠলেও কেন যে সেই মাটির প্রতিমা সজীব হয়ে সে'দিন দশহাতে আমার কানমূলে দিয়ে যাননি তা ভেবে আজ নিজের মনেই আক্ষেপ জাগে!! রাতের প্রতিমা দর্শনের ফাঁকে ফাঁকে চলতো রাস্তার ধারে ভূঁইফোঁড়ের মত গজিয়ে ওঠা মেক-শিফ্ট স্টলগুলোতে অনবরত: খাওয়া-দাওয়ার পালা। ভীড়ের মধ্যে রীতিমত লড়াই করে ঘুগনি-ফুচকা-আলুকাবলি-এগরোল খতম করার পর থামস-আপের বোতলের শেষ বিন্দুটুকু পর্যন্ত গলায় ঢেলে 'হেউ' করে একটা বিকট শব্দে ঢেঁকুর তোলার মধ্যে কি যেন এক অনাস্বাদিত আনন্দ লুকিয়ে থাকতো, যার দেখা বছরের অন্য কোনো সময়ে মিলতো না।
দেখতে দেখতেই চলে আসতো দশমী - বিসর্জনের সময়, ঢাকের কাঠিতে বেজে উঠতো বিদায়ের বোল। বুকের ভিতর চলতো উথাল-পাতাল, আবেগের তোলপাড় - মা যে চলে যাচ্ছেন। চোখ ভেঙে নেমে আসতো জল, অভিমানও হতো খুব। তবুও বড়োদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে মায়ের চলে যাওয়াকে কান্নাভেজা চোখে দেখতে হতো। ঝড়ের মতো হঠাৎ করেই যে পুজো এসেছিলো, তার চেয়েও দ্রুত বেগে চলে যেতো সে, যেমনটি চিরকালই আসে আর যায়। নবমী নিশি যেন বড়ো দ্রুত অতিক্রান্ত হয়ে যেতো। অনেকদিন আগে এক আধুনিক কবি লিখেছিলেন ---
“বোধনের ঢুলি বাজাবেই শেষে,
বিসর্জনের বাজনা,
থাক থাক সে তো আজ না,
সে তো আজ নয়, আজ না...”
কিন্তু থাক থাক করে কিছুই কি ধরে রাখা যায়? কিছুই কি ধরে রাখা যাবে? অবশেষে ঢাকের শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যায়। শুন্য মন্ডপে সঙ্গীহীন ক্ষীণ প্রদীপশিখা স্মরণ করিয়ে দেয় গতদিনের উৎসব রজনীর কথা। বাতাসে হিমেল ভাব আরেকটু বেড়ে যায়, শরতের শেষ শেফালী ঝরে পড়ে অনাদরে ধুলোভরা রাস্তায়। পুরানো গৃহস্থ বাড়ির ছাদের শিখরে মিটমিটিয়ে জ্বলে ওঠে কোন সনাতন পৃথিবীর অমল আকাশপ্রদীপ...
আজ দেশ ছেড়ে, সাতসমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এই বিদেশে-বিঁভুইয়ে এসে, এতোটা কাল কাটিয়েও অনুভব করছি ছেলেবেলার সেই সব সোনা-ঝরা দিনগুলোর স্মৃতি ভোলা সহজ কথা নয়। আজন্মের বাড়ি, যেখানে জীবনের প্রথম আনন্দ, প্রথম দুঃখ, প্রথম পাপ আর প্রথম পূণ্যের অনুভব। যেখানে বেড়ে ওঠা, কিশোর থেকে যুবক হওয়া - অথচ কি যেন রহস্যময়, কি যেন নতুন - শিরশিরে, ভয় মেশানো গভীর আনন্দ - সেই জায়গার আকর্ষণ কাটানো মোটেও সহজ কথা নয়। সোনালী ফসলে ভরে থাকা দেশের মাঠ, ভোরের দোয়েল পাখির মিঠে শিস, বাড়ীর পাশে হয়ে থাকা ছোট্ট ফুলের গাছ, শালুক-শাপলার পাতায় বসে থাকা কৃষ্ণকালো ভ্রমর, বৃষ্টিভেজা কদমের অদম্য সুগন্ধ, রুপোলী জরির ফিনফিনে জ্যোৎস্নাভরা রাত, আকাশ ঝমঝম করা তারাদের একদৃষ্টে চেয়ে থাকা, মাঠ শেষের দিগন্তরেখাকে আবীর রাঙা আভায় ভরিয়ে সূর্যের অস্ত যাওয়া, কমলালেবুর গন্ধ-ভরা শীতদুপুরের রোদে পা-মেলে বসে থাকা, নিঝুম আঁধারে ঝোপঝাড়ে বেজে চলা ঝিঁঝিঁদের সম্মিলিত অর্কেস্ট্রা, এই সবই কি আমাদের জীবনের সব চাইতে বড় পাওয়া নয় ?
(ছবি: ইন্টারনেট) |
ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়ে যাওয়াটাই এ জগতের চিরাচরিত নিয়ম। কিন্তু সেই সময়ে আমরা বড্ড বেশি করে চাইতাম 'চট' করে বড়ো হয়ে যেতে। তা'হলে দাদার মতো একলা একলা সাইকেল চেপে যেখানে খুশি যেতে পারবো, বা কাউকে না-বলেই ট্রেনে চেপে কলকাতা ঘুরে আসতে পারবো, এ'সবই আর কি ! কিন্তু আজ পিছু ফিরে বুঝতে পারি যে কি সাংঘাতিক ভুল চাওয়াই না সেদিন চেয়েছিলাম। 'বড়ো' হওয়া আর 'মেকি' হওয়ার মধ্যে আদপেই যে কোনো পার্থক্য নেই, তা বোঝার ক্ষমতা সেদিনের 'সেই আমি'-র ছিলো না।
'মা' আসছেন (ছবি: ইন্টারনেট) |
স্কুলের ছুটি পড়ে যেতো মোটামুটি তৃতীয়া কি চতুর্থীর দিন থেকেই। একমাস ছুটির পরেই থাকতো অ্যানুয়াল পরীক্ষা, কিন্তু দুর্গাপুজো শেষ না-হওয়া পর্যন্ত ভুলেও আমরা পড়ার বইয়ের ধারেকাছে ঘেঁষতাম না। পুজোর কেনাকাটা সারতে আমরা কলকাতার দিকে গেলেও ঠাকুর দেখার সময় কিন্তু নিজেদের এলাকাটা চষে বেড়াতেই পছন্দ করতাম। শহরতলীর মাইল দশেক জায়গা জুড়ে হয়ে থাকা ঠাকুরের সংখ্যা নেহাৎ কমকিছু ছিলো না। বনেদী বাড়ির পুজো, প্যান্ডেলের পুজো মিলিয়ে গোটাদশেক দেবীপ্রতিমা দর্শন করতেই কেমন করে যেন সময় ফুরিয়ে যেতো। পুজোর নতুন জুতোর দেওয়া "পুজোর ফোস্কা" পায়ে নিয়ে সপ্তমী-অষ্টমী খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, নবমী থেকে আবার পুরনো জুতো সম্বল করেই মাইলের পর মাইল হেঁটে ঠাকুর দেখা, শেষ হয়েও যেন ঠিক শেষ হতোনা। সকাল হতে না-হতেই নাকেমুখে কিছু গুঁজে প্যান্ডেলে চলে যাওয়া, বাড়ি ফিরতে ফিরতে হয়ে যেতো প্রায় মাঝরাত। ঠাকুর দেখা মানে তো শুধু ঠাকুরের কাছে যাওয়াই নয় - কে কিরকম সেজেগুজে বেরিয়েছে, পরিচিত-স্বল্পপরিচিত সমবয়সী সুন্দরী মেয়েদের দিকে ইতিউতি তাকানো, একটু হাসি, একটু ইশারা, একটু মান-অভিমান, একটু আশা-দু:সাহস - মানে চটপট প্রেমিক-প্রেমিকা বেছে নেবার মতো এরকম সুলভ সুযোগ বছরে আর দুটো আসতো না। রঙিন ফ্রক আর শাড়ির দল, সামান্য স্নো-পাউডারের প্রসাধনীতে হঠাৎ করেই প্রজাপতির মতো সুন্দরী হয়ে ওঠা মেয়েরা চোখে যেন সম্মোহনের মায়াজাল বুনে দিয়ে যেতো। মোটামুটি সপ্তমীর সকালের মধ্যেই আমাদের পছন্দের লিস্ট কমপ্লিট হয়ে যেতো - তারপরেই শুরু হয়ে যেতো পুজোর প্রেম। সেই প্রেম চলতো টানা কালীপুজো পর্যন্ত। অষ্টমীর অঞ্জলিতে প্যান্ডেলে হয়ে চলা আরতির সময় হাত জোড় হয়ে থাকতো দশভূজা দেবীর দিকে, কিন্তু মুন্ডু আপনা-আপনিই ঘুরে যেতো দ্বিভূজা চিন্ময়ীদের দিকে। কান্ড দেখে দেবী প্রতিমার মুখ হাসিতে ভরে উঠলেও কেন যে সেই মাটির প্রতিমা সজীব হয়ে সে'দিন দশহাতে আমার কানমূলে দিয়ে যাননি তা ভেবে আজ নিজের মনেই আক্ষেপ জাগে!! রাতের প্রতিমা দর্শনের ফাঁকে ফাঁকে চলতো রাস্তার ধারে ভূঁইফোঁড়ের মত গজিয়ে ওঠা মেক-শিফ্ট স্টলগুলোতে অনবরত: খাওয়া-দাওয়ার পালা। ভীড়ের মধ্যে রীতিমত লড়াই করে ঘুগনি-ফুচকা-আলুকাবলি-এগরোল খতম করার পর থামস-আপের বোতলের শেষ বিন্দুটুকু পর্যন্ত গলায় ঢেলে 'হেউ' করে একটা বিকট শব্দে ঢেঁকুর তোলার মধ্যে কি যেন এক অনাস্বাদিত আনন্দ লুকিয়ে থাকতো, যার দেখা বছরের অন্য কোনো সময়ে মিলতো না।
দেখতে দেখতেই চলে আসতো দশমী - বিসর্জনের সময়, ঢাকের কাঠিতে বেজে উঠতো বিদায়ের বোল। বুকের ভিতর চলতো উথাল-পাতাল, আবেগের তোলপাড় - মা যে চলে যাচ্ছেন। চোখ ভেঙে নেমে আসতো জল, অভিমানও হতো খুব। তবুও বড়োদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে মায়ের চলে যাওয়াকে কান্নাভেজা চোখে দেখতে হতো। ঝড়ের মতো হঠাৎ করেই যে পুজো এসেছিলো, তার চেয়েও দ্রুত বেগে চলে যেতো সে, যেমনটি চিরকালই আসে আর যায়। নবমী নিশি যেন বড়ো দ্রুত অতিক্রান্ত হয়ে যেতো। অনেকদিন আগে এক আধুনিক কবি লিখেছিলেন ---
“বোধনের ঢুলি বাজাবেই শেষে,
বিসর্জনের বাজনা,
থাক থাক সে তো আজ না,
সে তো আজ নয়, আজ না...”
কিন্তু থাক থাক করে কিছুই কি ধরে রাখা যায়? কিছুই কি ধরে রাখা যাবে? অবশেষে ঢাকের শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যায়। শুন্য মন্ডপে সঙ্গীহীন ক্ষীণ প্রদীপশিখা স্মরণ করিয়ে দেয় গতদিনের উৎসব রজনীর কথা। বাতাসে হিমেল ভাব আরেকটু বেড়ে যায়, শরতের শেষ শেফালী ঝরে পড়ে অনাদরে ধুলোভরা রাস্তায়। পুরানো গৃহস্থ বাড়ির ছাদের শিখরে মিটমিটিয়ে জ্বলে ওঠে কোন সনাতন পৃথিবীর অমল আকাশপ্রদীপ...
* * * * * * * * *
শরতের সোনা-ঝরা রোদ আর উপচে পড়া খুশি নিয়ে ভরে থাকা আমার ছোট্টবেলার শরৎ আজ যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে চলে গেছে আমার প্রিয় মানুষরা, সঙ্গে নিয়ে শরতের সবকটা সোনা-রোদ মাখা ছবি! সেই ছোটবেলার প্রিয় শরৎ আর কখনোই ফিরে আসবেনা আমার জীবনে। চোখ বুজে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর টুকরো টুকরো ছবি নিয়ে একটা অসম্পূর্ণ কোলাজ তৈরির চেষ্টা করে চলি মনে মনে, যদিও জানি এই কোলাজটা আর সম্পূর্ণ হবেনা কখনোই। দুর্গাপুজো আজ বিশ্বজুড়ে - সচিনকত্তার গাওয়া টাকডুম টাকডুমের ভাঙা ঢোলটা কোথাও তবু যেন একটানা বেজেই চলেছে মনে হয়। আজ দেশ ছেড়ে, সাতসমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এই বিদেশে-বিঁভুইয়ে এসে, এতোটা কাল কাটিয়েও অনুভব করছি ছেলেবেলার সেই সব সোনা-ঝরা দিনগুলোর স্মৃতি ভোলা সহজ কথা নয়। আজন্মের বাড়ি, যেখানে জীবনের প্রথম আনন্দ, প্রথম দুঃখ, প্রথম পাপ আর প্রথম পূণ্যের অনুভব। যেখানে বেড়ে ওঠা, কিশোর থেকে যুবক হওয়া - অথচ কি যেন রহস্যময়, কি যেন নতুন - শিরশিরে, ভয় মেশানো গভীর আনন্দ - সেই জায়গার আকর্ষণ কাটানো মোটেও সহজ কথা নয়। সোনালী ফসলে ভরে থাকা দেশের মাঠ, ভোরের দোয়েল পাখির মিঠে শিস, বাড়ীর পাশে হয়ে থাকা ছোট্ট ফুলের গাছ, শালুক-শাপলার পাতায় বসে থাকা কৃষ্ণকালো ভ্রমর, বৃষ্টিভেজা কদমের অদম্য সুগন্ধ, রুপোলী জরির ফিনফিনে জ্যোৎস্নাভরা রাত, আকাশ ঝমঝম করা তারাদের একদৃষ্টে চেয়ে থাকা, মাঠ শেষের দিগন্তরেখাকে আবীর রাঙা আভায় ভরিয়ে সূর্যের অস্ত যাওয়া, কমলালেবুর গন্ধ-ভরা শীতদুপুরের রোদে পা-মেলে বসে থাকা, নিঝুম আঁধারে ঝোপঝাড়ে বেজে চলা ঝিঁঝিঁদের সম্মিলিত অর্কেস্ট্রা, এই সবই কি আমাদের জীবনের সব চাইতে বড় পাওয়া নয় ?
আমারই মনের কথা যেন।
ReplyDelete