চাওয়া-পাওয়ার পথে পথে দিন কেটেছে, কোনো মতে,
এখন সময় হলো তোমার কাছে আপনাকে দিই আনি,
জানি, বন্ধু জানি, তোমার আছে তো হাতখানি ...
চাওয়া-পাওয়ার পথে পথে দিন কেটেছে, কোনো মতে,
এখন সময় হলো তোমার কাছে আপনাকে দিই আনি,
জানি, বন্ধু জানি, তোমার আছে তো হাতখানি ...
অবশেষে বর্ষা বিদায় নিলেন। শরৎ এসেছে নীল আকাশের আঁচল উড়িয়ে। তারার চুমকি বসান রাত। পেঁজা তুলার মতো পাহাড়ের formation - ভাঙা কলকাতার দক্ষিণের আকাশের দিকে ঘাড় তুলে তাকালে মনে হয় যেন ডুন ভ্যালিতে লেংটে বেড়াচ্ছি। মৃদু মন্দ বাতাস ঘাড়ের কাছে প্রেয়সীর নিশ্বাসের মতো বলতে চাইছে 'আমার রাজা, শরৎ এলো, মৃগয়ায় যাবে না...' - হায়, কোথা সে বনসখী, আর কোথা সে জল। রাজারা আজকাল আর মৃগয়ায় যান না। এখন অন্য মৃগয়ার যুগ। কথায় কথায় লাশ পড়ে যায়।
দেখতে দেখতে আরও একটা পূজা এসে গেলো... বয়স আরও একটা বছর বেড়ে গেলো... Final destination-এ পৌঁছাতে আরও একটা বছর কম লাগবে। প্রতি বছর জন্মদিনে, আর বিশেষ করে পূজার সময়ে এই ভাবনাটা মাথায় চাড়া দিয়ে ওঠে । ভাবতেই কি রকম অদ্ভুত একটা শিহরণ জাগে... কিন্তু এসব তো 'এই আমি'-র চিন্তা। সেই সুদূর 'অতীতের আমি' সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতো ক-খ-ন পূজা আসবে। আমাদের বাৎসরিক কালেন্ডার খোলাই হতো দূর্গা পূজার তারিখ গুলোকে পেন দিয়ে গোল মার্ক করে করে। তারপর শুরু হতো এক এক করে দিন গোনা: "তোমারই পথ পানে চাহি..." - সত্যি, মা-জননী তোমার তুলনা নেই। এই ক'টা দিন তুমি শহরকে একেবারে মাতিয়ে দাও।
পুরানো দিনের এক লেখক বলেছিলেন পূজায় যাঁরা কলকাতা ছাড়তে চান না তাঁরা হয় অথর্ব, নয় তো হা'ঘরে। এ সময়টা হলো, "চলো রীণা, ক্যাসুরিনার ছায়া গায়ে মেখে..." - হিলটপ হোটেলে ফায়ার প্লেসের ধারে কেৎরে বসো। জল নয়, লাল পানীয় থাকুক হাতে, দামী লম্বা বিদেশী সিগারেট ঠোঁটে - সঙ্গে লো-ভলিউমে চলতে থাকুক গুলাম আলী সাহেবের মায়াবী গজল: "হাঙ্গামা হ্যায় কিউ বারপা, থোড়ি সি যো পি-ই লি হ্যায়..." (note to self: তবে 'পি' টা শুধু হিন্দিতেই সীমাবদ্ধ থাকুক !) বাইরের আকাশ ঢালু হতে হতে বহু নীচে, গুঁড়ি গুঁড়ি গাছ, দেশলাই-দেশলাই বাড়ি, আর ফিতে ফিতে নদীর উপর টাল খেয়ে পড়েছে। বহু দূরের আকাশের তলায় সেই একঘেয়ে ধ্যাদধেরে, ম্যাটমেটে কলকাতা। ঢাক বেজেই চলেছে, 'ঢ্যাম কুড়-কুড়, ঢ্যাম কুড়া-কুড়'। প্যান্ডেলের বাঁশের আড়ায় উঠে, সস্তা নীল প্যান্ট পরা দস্যি ছেলের দল বাঁদরের মতো লাট খেয়েই যাচ্ছে। লাঠি সুদ্ধু কাঁপা-কাঁপা হাতদুটো জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বৃদ্ধ মানুষেরা মা দূর্গাকে নমস্কার করতে করতে মনে মনে বলছেন 'কি যুগ-ই না এনে ফেললেন দেবী'।
ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি পূজা মানেই প্রচুর প্ল্যানিং, প্রচুর স্বপ্ন - প্রচুর ঘুরে ঘুরে, 'প্রচুর কম' কেনাকাটা... ছোটবেলার বেশিরভাগ পূজার সময়েই দাদা-দিদিদের হাত ধরে ট্রেনে চাপতাম কলকাতা থেকে পূজার বাজার করবো বলে। সে এক অবর্ণনীয় উত্তেজনা - বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতেন লোকাল দোকানগুলোর কি দোষ - কিন্তু কে শোনে কার কথা ! পার্টিকুলার কোনো দোকান ঠিক করা ছিলো না আমাদের - বৌবাজার, বাগবাজার, কলেজ স্ট্রিট, কিম্বা গড়িয়াহাটের সারি সারি দোকানগুলো ঢু মেরে মেরে যতক্ষণ না এনার্জির ব্যাটারি শেষ হতো, হেঁটেই চলতাম - 'চলতি কা নাম গাড়ি', বাবা !
সেই সুদূর অতীতে কলকাতায় প্রথমবার পূজার বাজার করতে এসে শক খেলাম যখন দেখলাম লম্বা, সুন্দরী এক মহিলাকে এক কাঁচের শো-কেসের মধ্যে রঙ্গীন শাড়ি পরিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। আমার থমকে দাঁড়ানো ভয়ার্ত মুখ-চোখ তখন পথ চলতি লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করেছে । দিদির বকা খেয়ে সহসা সম্বিত ফেরে - "হাঁদা কোথাকার - ওটাকে বলে ম্যানিকুইন - এবারে চল সোজা..." --- শাড়ি বিক্রির সাথে সুন্দরী ম্যানিকুইনের বন্দী থাকার কি সম্পর্ক সেটা বোঝা গেল না। অনিচ্ছা স্বত্তেও হাঁটা শুরু করলাম, পিছু ফিরে ফিরে তাকাতে তাকাতে - আমার স্পষ্ট মনে হচ্ছিলো যে মেয়েটির চোখের পাতা দুটো থির থির করে কাঁপছে - যেন ওখান থেকে সে বেরুতে চাইছে - কিন্তু কি করে এদেরকে তা বোঝাই?
কলকাতার ফুটপাথগুলোতে তখন হকারদের রমরম অবস্থা - 'Big-M' তখনও ক্ষমতায় আসেনি - বামফ্রন্টের মাথাতে তখনও 'Operation Sunshine'-এর সু বা কুবুদ্ধি ঢোকেনি। চারিদিকে ভীড়ে ভীড়াক্কার - হাঁটা চলাই দায় হয়ে উঠেছে, তো কেনাকাটা !! এর মধ্যেই কানে আসে হকারদের কর্ন-ভেদী হুঙ্কার: "সেল, বৌদি সেল..." - আবার থমকে দাঁড়াই - তাহলে বৌদিও 'সেল' হচ্ছে? এই তো সুযোগ - একটা কিনে নিয়ে গেলেই তো হলো। বাড়িতে সবই আছে, কিন্তু একটাও বৌদি নেই... আবার বকা খাওয়া । বাংলা ভাষা এতদিনে জানতাম খুবই বোধগম্য - কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বেশিরভাগ কথার-ই দুটো করে মানে আছে - Heisenberg-র Uncertainty Principle?
এর ঘামের সঙ্গে তার ঘাম, তার সাথে আমার ঘাম সব মিলে মিশে একেবারে জগাখিচুড়ি - ঠিক যেন গনসঙ্গীতের মতো: "তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা..." - শক্ত করে দিদির হাত খামচে ধরে এগিয়ে চলেছি - একবার হারিয়ে গেলে এই জনসমুদ্রে আমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। নানাবিধ হুঙ্কারে চমকে চমকে উঠছি: "আসুন দাদা, আসুন দিদি - নতুন শার্ট, নতুন প্যান্ট - সব হোল-সেল, হোল-সেল..." - যা দেখি তাই-ই আমার পছন্দ হয়ে যাচ্ছে - কিন্তু এই সব স্টলগুলোতে না ঢুকে আমরা কেন যে বড় বড় দোকানের পর দোকান ঘুরে চলেছি তা বোধগম্য হচ্ছে না। জিজ্ঞাসা করে বকা খাওয়ার চেয়ে চুপচাপ observe করে যাওয়াই better - সুতরাং চলেছি তো চলেছিই... ... এই দোকানের জামা পছন্দ হয় তো ম্যাচিং প্যান্ট পিস পাই না - আবার সব কিছু ঠিকঠাক হয় তো দামে কুলায় না ! শাড়ি সমুদ্রে ভাসমান হয়ে, গুনে গুনে পাক্কা বিয়াল্লিশ খানা শাড়ি দেখানোর পর যখন দোকানের মালিক শুনতেন যে "রং গুলো তেমন ঠিক পছন্দ হচ্ছে না...", তখন তাঁর বিরক্তি চাপা, মাপা হাসির মুখটা ক্রমশ: থমথমে আর চোখ দুটো লাল হয়ে উঠতো। তখনই বুঝতাম now is the time to move out ! পূজার বাজার করতে এসে কি বেঘোরে, চোরাগুপ্তে খুন হয়ে যাবো?
একই দোকানের লোকজন, যারা শুরুতে আমাদের দেখে আহ্লাদে ফেটে পড়লো, যাবতীয় কুশল জানতে চাইলো - চা, না কফি, না কোল্ড ড্রিংক্স খাবো জিজ্ঞেস করতে করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো, সেই তারাই হিসেবের বেলায় এসে সহসাই কেমন যেন গোমড়ামুখো হয়ে উঠতেন - সবই এক অচেনা রহস্য !
একই দোকানের লোকজন, যারা শুরুতে আমাদের দেখে আহ্লাদে ফেটে পড়লো, যাবতীয় কুশল জানতে চাইলো - চা, না কফি, না কোল্ড ড্রিংক্স খাবো জিজ্ঞেস করতে করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো, সেই তারাই হিসেবের বেলায় এসে সহসাই কেমন যেন গোমড়ামুখো হয়ে উঠতেন - সবই এক অচেনা রহস্য !
পথচলতি নানান ঝক্কির মধ্যে মজার ঘটনাও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যখন শিবের বাহন মাথা গরম করে লেজ তুলে রাস্তা ছেড়ে ফুটপাথের দিকে গঁতগঁত করে দৌড়ে তেড়ে আসে - মুহুর্তের মধ্যে ঘিঞ্জি ফুটপাথ প্রশস্ত হয়ে ওঠে ! কিম্বা হকারের নিষ্পাপ আর্তনাদ: "বৌদি, ও বৌদি - আরে, আমার ব্লাউস নিয়ে চলে যাচ্ছেন..." - পুরুষ মানুষেরও কি তাহলে ব্লাউসের দরকার পড়ে? আরে নাহ: দড়ির ডিসপ্লেতে ঝোলা ব্লাউসের ক্লিপ-টি পথচলতি কোনো এক মহিলার মাথার চুলে আটকে গিয়ে সব সুদ্ধু ছুটে চলেছে তাঁর খোঁপার শোভা বাড়িয়ে !!
অবশেষে ক্লান্ত সৈনিকের দলের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে - either পুঁজি শেষ অথবা পায়ে খিঁচ লাগা - "ক্ষ্যামা দে ভাই পূজার কেনাকাটা - চল বাবা, বাড়ি ফিরে চল - প্লিজ আর না, অনেক হয়েছে কেনাকাটা..."। ক্ষুধায় ক্লান্তিতে বেঁকে-চুরে যাওয়া অবসন্ন শরীরটাকে কোনোমতে টানতে টানতে দল বেঁধে আমরা দাঁড়িয়ে পড়ি এক রোড-সাইড ফাস্ট ফুড, রোলের দোকানের সামনে। "এই ভোলা ! চটপট পাঁচটা এগ-চিকেন এদিকে - তুরন্ত !" - আ:হ কি আরাম। শুনেও যেন প্রাণে তৃপ্তির ছোঁয়া - বেঁচে থাক বাবা ভোলা, ভোলানাথ আমার ।
~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~ ~
আজ সেই রামও নেই, রাজত্বও নেই - পড়ে আছি শুধু আমি একা... যাঁদের হাত ধরে একদিন নিশ্চিন্তে ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম, তাঁদের অনেকেই আর আজ নেই, বা থাকলেও যোগাযোগ গেছে অনেক, অনেক কমে - রয়ে গেছে শুধু মার্ক করা ক্যালেন্ডার, আর কিছু ধূসর হতে শুরু করা স্মৃতির দল। ভরপুর আনন্দ দিয়ে শুরু হওয়া জীবনের রং আস্তে আস্তে ফিকে হতে শুরু করেছে। কার কাছেই বা কমপ্লেন করি ! মহাকালের অদৃশ্য খেলায় না-চাইলেও তো অংশ নিতেই হবে... পালাবার উপায় তো নাই। কবিগুরু মহাজ্ঞানী, তাই ঠিকই বলে গেছেন:
"জীবনদোলায় দুলে দুলে আপনারে ছিলেম ভুলে,
এখন জীবন মরণ দু-দিক দিয়ে নেবে আমায় টানি,
জানি, বন্ধু জানি, তোমার আছে তো হাতখানি ..."
.
.
.
.
.
Resource inspiring this post (গান@YouTube - click to listen):
asadharon !
ReplyDelete