Clock
ছোটবেলাকার সময়ে যে কোনো পূজায় চাঁদা তোলার গুরু দায়িত্বটি সাধারনত পাড়ার দাদা টাইপের, (অ)কাজ-খুঁজে-বেড়াই ছেলেরাই সাগ্রহে লুফে নিতো। কারণটা সেই বয়সেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম - কিছুই না, এই ফাঁকতালে চাঁদা-প্রদানকারী বাড়িতে থাকা অবিবাহিত সুন্দরী (সুশ্রী হলেও চলবে) বালিকা, তরুণী বা বৌদিদের সাথে ক্ষণিকের বাক্যালাপ, একটু চোখে চোখ রাখা, মুখ টিপে হাসার ভঙ্গি করা - আর নিতান্তই কিছু না হলে 'ঝাড়ি' মারার সুযোগটা at least মিলে যেতো ! এর সাথে জুড়ে থাকতো চাঁদা তুলতে গিয়ে ঘন ঘন জল-পিপাসা রোগ। মনে আছে পাড়ার পল্টুদা (আসল নাম নয়) এই সব দিনগুলোতে নিজের পেটের ছোট ব্লাডারের ওপর কি রাগা-ই না রেগে যেতো ! কারণ চেয়ে চেয়ে অযথা গ্লাসের পর গ্লাস জল খাবার ফলে কয়েকটা বাড়ি হানা দেবার পর পরই তাকে 'জল-ত্যাগ'-এর জায়গা খুঁজতে হতো - আর যাই হোক চাঁদা তুলতে গিয়ে তো আর বাথরুমে যাবার মতো দৃষ্টিকটু আব্দার করা যায় না ! কখনো কখনো পুরানো বছরের নকল রিসিপ্ট দেখিয়ে, ভুলিয়ে ভালিয়ে আরও বেশি amount-এর চাঁদা তোলা হতো ! সে ছিলো এক অদ্ভুত আনন্দ আর উত্তেজনার দিন !
তো, সেই সময়কার পূজার চাঁদা-তোলা পার্টির জুলুমবাজদের হাত থেকে বাঁচতে আমার স্বর্গীয় পিতৃদেব এক অন্য উপায় বার করেছিলেন - একে শিক্ষণীয়ও বলা যেতে পারে । তিনি একটু গম্ভীরভাবে চাঁদা তুলতে আসা জনগণকে 'দেবী'র নামের বানান উচ্চারণ করতে বলতেন - বাকিটা তারপর হতো এক দর্শনীয় এবং শ্রবণীয় আরাম ! বিশেষ করে সরস্বতী পূজার সময়ে তাঁর এই পদ্ধতি 100% খেটে যেতো। বানান উচ্চারণের ভুলের মাত্রার উপরে চাঁদার amount directly নির্ভর করতো। একবার মনে আছে সরস্বতী ঠাকুরের নামের বানান 'ষরোস-শতি' শুনে তিনি তাঁর পায়ের খড়ম খুলে মারতে গিয়েছিলেন। বেশিরভাগ সময়েই ভুলটা হতো 'ব' টা কোথায় থাকবে, সেই নিয়ে। সেই প্রথম আমার 'Permutation' নামক বিষয়টির সাথে পরিচয়! এই কারণেই মনে হয় চাঁদা তোলার লিস্টে আমাদের বাড়ির নাম সবার লাস্টে থাকতো। তবে দূর্গা বা কালী ঠাকুরের নামের বানান অপেক্ষাকৃত সোজা হবার দরুণ, এই ধরনের ভুলের মাত্রা অনেকটাই কমে যেতো - যার ফলে দূর্গা বা কালী পূজার সময়ে পিতৃদেবের সেই ট্যাকটিক্স তেমন খাটতো না।
আজকালকার পূজা অবশ্য অনেকটাই বদলে গেছে - শহরের বেশিরভাগ পূজার বাজেট আজকাল আর শুধু চাঁদাতে তোলা টাকার উপরে নির্ভর করে থাকে না। এখন হলো কর্পোরেট স্পনসরশীপের যুগ। পূজা কমিটি এখন তাঁদের 'Branding Rights' হয় কোনো TV channel বা কোনো উঠতি রক বা পপ ব্যান্ডকে দিয়ে দেয়। বেশ কয়েক বছর আগে কোনো এক পত্রিকায় বা আর্টিকেলে পূজার Sponsorship আর বাজেট স্ট্রাটেজি নিয়ে একটা মজার প্রতিবেদন পড়েছিলাম - যার কিছু কিছু অংশ এখনো বেশ মনে আছে। পূজার গন্ধে গন্ধে সেই প্রতিবেদনটির কথা আবার মনে পড়ে যাচ্ছে।
সে বছরটা ছিলো সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় - আমাদের Big-M তখনো তেমন 'বি-গ' হয়ে ওঠেন নি - কেবল তিনি তাঁর দলবল নিয়ে 'Tata Nano'-র প্ল্যান্টে ঢুকতে যাওয়া লোকেদের বেদম মারধর শুরু করেছেন - এর সাথে ঢিল-পাটকেল ছোড়া আর 'টাটা বাই-বাই'-এর উদ্দাম হুঙ্কার তো চলছেই। উঠতি মিউজিক ব্র্যান্ড পার্টি আর টিভি চ্যানেলের দৌলতে পূজার স্পন্সরশিপ যোগাড় করাটা আর তেমন কোনো সমস্যাই নয় ! অন্যদিকে পলিটিকাল ঝ্যাঁটার মার সইতে সইতে ইন্ড্রাস্টিগুলো একের পর এক অন্য রাজ্যে চলে যাওয়ায় জায়গাও অফুরন্ত। পূজা প্যান্ডেল যত বড়োই হোক না কেন, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা দেখা দিচ্ছে অন্য দিকে - lots of other compromise... পূজা কমিটিতে কিছু বাম-ঘেঁষা লোকজনও আছেন, যেরকম থাকেন আর কি সব জায়গাতেই। তাঁরা চাইছেন মা-দূর্গার মুখের আদল 'মমতা'দির মতো করতে, এবং দু-মুখো অসুর করতে, যাতে এক মুখে 'রতন টাটা' আর অন্য মুখে 'বুদ্ধদেব ভট্টচার্জি' থাকতে পারেন। খুব অন্যায় আব্দার কিছু নয় - কিন্তু পূজা কমিটির অন্য সদস্যেরা এতে মন খুলে সায় দিচ্ছেন না - কারণ দিদি সবেমাত্র তাঁর PhD (dubious) 'লাভ' করেছেন। দূর্গা ঠাকুরের গলায় তাঁর মুখ বসালে যদি দিদির vegetarian সমর্থকেরা এসে চেয়ার নিয়ে ভাঙ্গা-ভাঙ্গি শুরু করে? তখন সেই গরুর দলকে সামলাবে কে? এর থেকে বরং ঠাকুরের জন্যে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, বা জ্যেসিকা সিম্পসন অথবা আমাদের দীপিকা পাড়ুকনের মুখ দেওয়া অনেক, অনেক better। হয়তো বা এতে 'Red Bull' শারদ সম্মানটাও মিলে যাবে ! আর যদি এতেও মতের মিল না হয়, তখন 'কলাবউ' তো আছেনই। দিদির লাজুক মুখের একটা মিষ্টি ছবি কলাগাছে লাগিয়ে ঘোমটা টেনে ঢেকে দেওয়া যাবে - তাহলে তো দুই-দিকই বজায় থাকবে।
অন্য দিকে কপিরাইট পাওয়া টিভি চ্যানেলের কর্ণধার ঠাকুরের মূর্তির দিকে ক্যামেরা না বসিয়ে বরং প্যান্ডেলে জমা হওয়া দর্শনার্থীদেরকে ঘিরে একগুচ্ছ ক্যামেরা বসাতে চাইছেন - ভিন্ন, ভিন্ন অ্যাঙ্গেলে। কারণ গতবছরে নাকি তাঁরা নিজেদেরকে 'তেমন করে' প্রচার করতে পারেন নি - এবছরে তাই তাঁরা কোমর বেঁধে নামতে চাইছেন। উর্বর মস্তিস্কের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ব্যবহার করে তাঁরা নতুন এক প্রোগ্রাম-এর বিজ্ঞাপণ অলরেডি শুরু করে দিয়েছেন: "ঘরে বসে ঝাড়ি" - অর্থাৎ মৃন্ময়ীর কাছে আসা চিন্ময়ীদের টেরিয়ে-বেঁকিয়ে, লুকিয়ে-চুরিয়ে না দেখে, বাড়িতে সোফায় বসে আরাম করে, Lays চিপস-এর প্যাকেট হাতে নিয়ে, তারিয়ে তারিয়ে দেখুন। ঠাকুরের মুখ থাকবে প্রতি তিন মিনিটে ১৫ সেকেন্ড, বাকিটা সব-ই close রেন্জ-এ 'backless blouse' বা দিদিমনিদের 'টাইট কামিজ' - বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে !! দেবীর মূর্তিকে নকল ভক্তি দেখানোর হাত থেকে এক সম্মানীয় রেহাই। ঘরে যদি ভট করে ঠাকুমা কি বাবা ঢুকে পড়েন, তো কোনো অসুবিধা নেই - ১৫ সেকেন্ডের ঝটতি মূর্তি-প্রদর্শন তো রয়েছেই ! এছাড়া terrorist-রা যদি পূজাতে নিজেদের খুশি মতো participate করে, তাতেও কোনো সমস্যা নেই - গায়ে একটু আঁচ পর্যন্ত লাগবে না !
প্রমোশনাল মিউজিক ভিডিওতে থাকছেন বাংলার সুকুখ্যাত মেগাস্টার প্রসেনজিৎ - তিনি খালি পায়ে দুলে দুলে নাচবেন উজবেকিস্তান থেকে উড়িয়ে আনা একদল যুবতী মডেলদের সাথে - all dressed in ট্রাডিশনাল বাঙালী লাল-পাড়-সাদা-শাড়ি। প্রোগ্রামের গালভরা নামও ঠিক হয়ে গেছে: "জীবন্ত প্রতিমা দর্শন" । মুম্বাইয়ের হিমেশ রেশমিয়া-কে টুপি ছাড়া হাজির করানোর জোর চেষ্টা চলছে। যদি সেটা একান্তই না খাটে তো 'অনীক ধর' রয়েছেনই। তিনি অবিকল মেয়েলি গলায় 'কাজরা রে...', কি শচীন কত্তার 'তুমি এসেছিলে পরশু...' নাঁকি সুরে গেয়ে আসর মাত করে দেবেনই দেবেন।
Individual কর্পোরেট স্পনসরশিপ যোগাড়ের নানান প্রচেষ্টা আশাপ্রদ গতিতে এগিয়ে চলছে - যেমন 'Dr. Lal’s Weight Loss Clinic' লর্ড গনেশজিকে আর 'M. P. Jewellery' লক্ষ্মীদেবীকে স্পনসর করার ব্যবস্থা করেছেন। যদি সরস্বতী ঠাকুরের মাথায় 'Flier' সাঁটকাতে দেওয়া হয় তো 'Sharma IIT Definitive' এক কথায় রাজি আছেন। এছাড়া Raymonds-এর কেস্টু-বিস্টুরা গত সপ্তাহেই কার্তিক-ঠাকুরের বডি-র মাপ-জোক নিয়ে গেছেন, তাঁরাই ওনাকে এবছর নিজেদের ড্রেস-এ সাজিয়ে স্পনসর করবেন।
স্বয়ং মা দূর্গার ভার নিয়েছেন KKR অধিপতি মি: খান, মাত্র ১৫ লাখের বিনিময়ে। প্রতিদানে মা দূর্গাকে KKR-এর উদ্ভট Golden হেলমেট পরানো হবে, আর মায়ের হাতে ত্রিশুলের বদলে উইকেট ধরিয়ে দেওয়া হবে। মায়ের মাথার পিছনে শোলার কাজের বদলে, সেমি-সার্কেল করে এক ফেস্টুনে বড়ো বড়ো করে লেখা থাকবে "করবো , লড়বো , জিতবো রে..."। অসুরের এক হাতে অস্ত্র হিসাবে থাকবে বোমার আদলে তৈরী করা লাল ক্রিকেট বল, আর অন্য হাতে গ্রেনেড-এর আদলে 'উইকেটের বেল'। আর অসুরের মুখ ও শরীর যদি সলমন খানের আদলে করা হয় তো এক্সট্রা ৫ লাখের প্রতিশ্রুতিও তিনি দিয়ে রেখেছেন। উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে 'ঋতুপর্ণ'-দাকে আনার কথা প্রথমে ভাবা হয়েছিলো, কিন্তু কারা যেন বেয়াড়া প্রশ্ন তুলেছে যে নিয়ম ভেঙ্গে যদি মহিলাকে দিয়েই উদ্ধোধন করানো স্থির হয়ে থাকে, তো why not 'ঋতুপর্ণা'-দি? দিদির সেক্স appeal ঋতু-দা(?)র থেকে কম কোন দিক থেকে? নাও, বোঝো ঠ্যালা! অগত্যা ঋতুপর্ণা-দিদি-ই আসছেন।
প্রতিমা বিসর্জনের রাতে 'Gangnam' স্টাইলের ভাংড়া নাচের জন্যে নৃত্য পটিয়সী Rakhi Sawant-কে কন্টাক্ট করা হয়েছিলো - কিন্তু তিনি তাঁর রেট হট করে বাড়িয়ে দিয়ে বসে আছেন। এমন কি 'all-covered' জামা-কাপড় পরে নাচের প্রোপোজালেও বেশি টাকা চাইছেন। তাই সেই বাড়তি টাকা তোলার জন্যে গত সপ্তাহ থেকে মেন রাস্তাগুলোতে অবরোধ বসিয়ে, ট্রাক-লরী থামিয়ে জোর করে "মা-দূর্গা" ট্যাক্স নেওয়া শুরু হয়েছে। প্রথম প্রথম কিছু আপত্তি-প্রতিবাদের মুখোমুখি হলেও, যবে থেকে হকি স্টিক দিয়ে গাড়ির কাঁচ ভাঙ্গা আর প্রকাশ্যে গাড়ির গায়ে গণ-মূত্র বিচ্ছ্ররণ শুরু হয়েছে, তবে থেকে লাভের মুখ দেখা দিয়েছে। এছাড়া petty cash-এর জন্যে তো usual intimidation, vandalism, scratching car body with Thums-Up cap, বাড়ির দরজার সামনে 'মল-ত্যাগ' করে দেওয়া, ইত্যাদি তো চলছেই, - মানে যেমন চলার কথা আর কি !!
Hopefully মা দূর্গা আমাদের সহায় হবেন, আর বিগত বছরগুলোর মতোই দু-হাত ভ'রে আশীর্বাদ দিয়ে তবে মর্ত্যধাম থেকে বিদায় নেবেন।
"জয় মা দূর্গা, দূর্গতিনাশিনী, কৈবল্য-দায়িনী, সর্ব দুঃখ-হরণী, সর্ব পাপ-বিনাশকারিনী..."
2013 সালে ক্যালিফোর্নিয়া বে-এরিয়ার "পশ্চিমী" পুজা সংগঠন থেকে দূর্গাপুজা উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হওয়া 'অঞ্জলি' পুজা-ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিলো আমার এই আর্টিকেলটি।
এইখানে দেওয়া হলো সেই গল্পের লিঙ্কটি