Wednesday, January 1, 2014

“পশ্চিম দিগন্তে তখন রঙের আগুন...”

Sunset while driving on I-5...
চলেছি I-5 হাইওয়ে দিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসের দিকে। মাত্র দুটো করে লেন - মোটামুটি বাঁশের মতো মসৃণ, স্ট্রেট রাস্তা মাইলের পর মাইল - চলেছি তো চলেছিই - পথ আর যেন ফুরায় না। এই I-5-এর দূর্নাম আছে ঘুমপাড়ানি হাইওয়ে বলে!! সামনের গাড়ীর পিছনে জ্বলে থাকা লাল আলোর দিকে একটানা চেয়ে থাকতে থাকতে ঝিম ধরে গিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, যার অবশ্যম্ভাবী ফল ক্লান্ত চোখে অজান্তেই ঘুম নেমে আসা। তাই ক্রমাগত বকবক করে কথা বলে বলে, এদিক-সেদিক তাকিয়ে, বা অযথাই লেন বদল করে করে চলতে হয়। এমনভাবেই চলেছি আমরা, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার উপক্রম করছে - হঠাৎই পাশের জানলার দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেলো - পশ্চিম দিগন্তে শুরু হয়েছে যেন রঙের আগুন-খেলা। 'ক্রিমসন' রঙ দিয়ে মহাকাল দিগন্তের অসীম ক্যানভাসে যা-তা শুরু করে দিয়েছেন। আর তারই ফলস্বরূপ পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরের সূর্য্য ঠিক যেন গলে গলে মিলিয়ে যাচ্ছে সেই দূরের দিগন্তরেখায়। অপূর্ব সে দৃশ্য... আবারও একবার মনে মনে বলে উঠলাম এক-পৃথিবী সৌন্দর্য দেখার জন্য, এক পৃথিবীর পথ চলার জন্য, এক জীবন বড়োই অল্প সময়।
Sunset while driving on I-5...
Sunset while driving on I-5...
স্কুলে আমাদের জীবনবিজ্ঞান বা বায়োলজীর টিচার ছিলেন মূলত দু'জন। দু'জনেই দারুণ পড়াতেন। ব্ল্যাকবোর্ডে চকের কয়েকটা মাত্র আঁচড়ে প্রায়-নিখুঁত ছবি এঁকে এঁকে আমাদের জীবনবিজ্ঞানের জটিলতা বোঝাতেন, আর আমরা হাঁ করে তা দেখতাম আর খাতায় সব নোট করে নিতাম। যতদুর মনে পড়ে ক্লাস এইটে ওঠার পর আমাদের এই সাবজেক্টের টিচার বদলে গিয়ে 'দিব্যেন্দুবাবু' ক্লাস নেওয়া শুরু করলেন। অনাড়ম্বর জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী সেই স্যারের জ্ঞানের বহর দেখে তাঁকেই রোল মডেল করে নিয়ে পরবর্তী জীবনে বায়োলজীর টিচার হবোই হবো বলে একপ্রকার দৃড়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলাম। একদিন ক্লাসের পড়ানোর ফাঁকে স্যার গল্পচ্ছলে বলে চলেছিলেন তাঁর জীবনের কিছু কথা - খুব ইচ্ছা ছিলো তাঁর এয়ার-পাইলট হবার। এক্সজামে পাস করে ইন্টারভিউতেও ভালো করেছিলেন। কিন্তু বাড়িতে তাঁর ঠাকুমার কনসিস্টেন্ট আপত্তি আর কান্নাকাটিতে তা আর হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত জীবনের দিশা বদলে এই 'স্কুল-টিচারী'-র কাজ তাঁকে শুরু করতে হয়। খানিকটা চাপা ক্ষোভ, বা হয়তো কিছুটা হতাশার আঁচ তাঁর সেদিনের কথার মধ্যে ফুটে উঠেছিলো। হঠাৎই স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা বলতো, সূর্যাস্তের ঠিক আগে পশ্চিম আকাশে যে রংটা হয়, তার নাম কি?” - আমরা তখন মুষ্টিমেয় কতকগুলো রঙের কথা জানি - মোটামুটি 'ভিবজিওর (বা বেনিআসহকলা)' অবধি আমাদের দৌড় ! সেই মতো আমরা কেউ কেউ 'রেড' বা 'গোল্ডেন' বলে উঠলাম। স্যার মুখে চু: চু: শব্দ করে হেসে উঠে বললেন, “যা:হ! তোদের কপালেও এয়ার-পাইলটের চাকরি লেখা নেই !!” - একটু থেমে তিনি বললেন, “ওই সময়ের রঙটাকে বলে 'ক্রিমসন'...” - তারপর ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে সেই ক্রিমসন word-টার spelling-টা লিখে দিলেন। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “স্যার, আপনি এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে পেরেছিলেন?” - ক্লাসের ঘন্টা পড়ে যাওয়ায় তিনি উঠে পড়েছিলেন, যেতে যেতে বললেন, না পারলে আর চাকরিটা পেলাম কি করে ! কিন্তু ঐযে বলে না, কপালে না থাকলে কি আর হয় কিছু !!

আজ এই পড়ন্ত বিকেলের, সেই ক্রিমসন রঙের আলোয় স্কুলের 'দিব্যেন্দুবাবু'-র কথা আরও একবার মনে পড়ে গেলো। আমার কপালেও বায়োলজীর টিচার হওয়ার কথা লেখা ছিলোনা নিশ্চয়ই!!



No comments:

Post a Comment