পূজা বাঙালীর জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ - বাঙালী thrives on পূজা। বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগে থাকলেও আমাদের ছোটবেলাকার সময়ে 'পূজা' বলতে মোটামুটি তিনটে পূজাকেই ধরা হতো। প্রথম obviously দেবী দূর্গা - অর্থাৎ দূর্গাপূজা - যা কিনা বাঙালী ঐতিহ্য আর জাঁকজমকের প্রতীক। তাঁরই হাত ধরে ধরে চলে আসতেন শক্তিময়ী কালীঠাকুর, যে পূজা ছিলো মূলত: আতসবাজি আর আলোর রোশনাইয়ের যুগল সম্মেলন। এরই মাস তিন-চার পরে আসতো সরস্বতী পূজা - যা ছিলো এককথায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের, এবং বিদ্যার্থীদের একান্ত আপনার পূজা। লক্ষ্মী, জগদ্ধাত্রী বা বিশ্বকর্মা পূজোগুলোকে ঠিক সেই অর্থে পূজা বলে মনে হতো না। অবশ্য এসবই সেকালের কথা। আজকাল অবশ্য যে কোন পূজা এলেই সর্বপ্রথম ডোনেশন, শব্দ-হুঙ্কার, মদ-মারামারি আর দূর্ধর্ষ জ্যামের কথাই মনে চলে আসে - ভক্তি আর তেমন ঠিক আসেনা।
আমাদের বাড়ির ছাদ |
বাবা এর কয়েকদিন আগে থেকে, বাজার থেকে কিনে যোগাড় করে রাখতেন চাঁদমালা, শোলার কারুকাজ করা ঠাকুরকে সাজানোর নানান ধরনের জিনিষ, যাবতীয় পুজাসামগ্রী, আর কিনে আনতেন রং-বেরঙের পাতলা পাতলা ঘুড়ির কাগজ - লাল-নীল-হলুদ-বেগুনী-সবুজ-সাদা-কমলা। রাত জেগে জেগে সেগুলো কাঁচি দিয়ে ট্র্যাঙ্গেল আকারে কেটে, থাক-থাক করে গুছিয়ে রাখা হতো। ঠাকুরের হাতে থাকা বীণার গায়ে কয়েকটা সাদা মোটা সুতো আলপিন দিয়ে সযত্নে বেঁধে দেওয়া হতো, সেটার 'তার' হিসাবে। পূজার দিন ভোরসকালে উঠে, ঘাড়ে করে কাঠের মই নিয়ে, বাড়ির ছাদে গিয়ে হাজির হতাম সেইসব রঙিন কাগজগুলোকে সঙ্গে করে - সাথে থাকতো একবাটি আঠা আর টুনদড়ির গোলা। বাড়ির ছাদের ঠাকুরঘরের মাথা থেকে ছাদের রেলিঙের নানান দিক পর্যন্ত টুনদড়ি টাঙিয়ে টাঙিয়ে সেই সব তিনকোণা কাগজগুলোকে, রঙের কম্বিনেশন বজায় একের পর এক আঠা দিয়ে লাগিয়ে চলতাম। শীতশেষের সকালের মৃদুমন্দ হাওয়ায় সেই রঙিন কাগজের দলেরা যেন হেসে হেসে কাঁপতে থাকতো। বাড়ির অন্যান্য সদস্যরাও এসময় ঠাকুর ঘর সাজানোর নানান কাজে লেগে যেতো - সে ছিল এক অদ্ভুত আনন্দ, উত্তেজনা আর ভালোলাগা সময়। এরই মাঝে নীচের তলা থেকে মায়ের হাঁক শোনা যেতো, "ওরে! ঠাকুর মশায় এসে গেছেন!" - তড়িঘড়ি করে স্নান করার জন্যে নিচে নেমে আসতাম। ঠাকুরমশায় এই দিন থাকতেন মহাব্যস্ত - কিছুতেই একমুহূর্ত বেশি অপেক্ষা করতে চাইতেন না। শাঁক-কাঁসরঘন্টা বাজানোর মধ্য দিয়ে দাদা ঘাড়ে করে দেবীপ্রতিমাকে নিয়ে চলতেন নিচের তলা থেকে ছাদের ঠাকুরঘরের দিকে। ছোটদি বাড়ির টবে ফুটে থাকা গাঁদাফুল তুলে, মালা তৈরী করে ঠাকুরের গলায় দিয়ে দিতেন। বাজার থেকেও কিনে আনা হতো হালকা-হলুদ, গাড়-হলুদ, কমলা রঙের একগুচ্ছ গাঁদাফুলের মালা। সেই সমস্ত মালা পরে, চাঁদমালা হাতে নিয়ে সুসজ্জিত হয়ে, আমাদের ছোট্ট ঠাকুরঘর আলোয় ভরিয়ে দিয়ে বিরাজমান হতেন দেবী সরস্বতী। আমরা পুকুর থেকে চট করে একটা ডুব দিয়ে, বা কলঘরে ঢুকে কোনোমতে এক বালতি জল মাথায় দিয়ে, গা-হাত মুছে, নতুন জামাকাপড় পরে ঠাকুরঘরের দিকে ছুটতাম, হাতে থাকতো বেশ কয়েকটা পড়ার বই - যার মধ্যে কেশবচন্দ্রের অঙ্কের বই, মাইতি-চৌধুরীর কেমিস্ট্রির বই, আর রেনে-মার্টিনের ইংরাজি গ্রামারের বই অবশ্যই থাকতো প্রাইম সদস্য হিসাবে। সেই বইগুলোকে দেবীর পায়ের কাছে সারি দিয়ে সাজিয়ে, হাত জড়ো করে বসে যেতাম ঠাকুর মশায়ের পাশে বা পিছনে - যে যেরকম পারে। মেঘমন্দ্র কন্ঠে ঠাকুরমশায় দেবী-স্ত্রোত্র পাঠ করে চলতেন। ধুপ-ধুনোর অপরূপ গন্ধে ভরা সেই ঠাকুরঘরে বসে, একগাদা গাঁদাফুলের মালায় সুসজ্জিত সেই দেবী প্রতিমার প্রশান্তি-ভরা, অসম্ভব সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে বিভোর হয়ে যেতাম - অবাক মনে বিস্ময় জাগতো গতরাতের থেকেও আজ যেন তাঁকে আরো, আরও বেশী করে সুন্দর এবং প্রাণময়ী লাগছে !
অঞ্জলীর দেওয়ার পর প্রণাম-প্রাথর্ণা শেষ করে আমরা ছাদ সাজানোর কাজকর্ম, যা-কিছু বাকি থাকতো, সব ঝটপট কমপ্লিট করে নীচে নেমে আসতাম। দিদিরা এর মধ্যে ঠাকুরঘরের কাজ গুছিয়ে প্রসাদ বিতরণ শুরু করে দিতেন। তার পর শুরু হতো বাড়ির দাওয়ায়, রোদ্দুরে মাদুর পেতে বসে, একসাথে খই-মুড়ি-কড়াইশুঁটি-নারকেল-শাঁকালু-মোয়া-নলেনগুড় সহযোগে নিরামিষ ব্রেকফাস্ট-কাম-লাঞ্চ - আর তার সাথে নির্ভেজাল আড্ডা, গল্পের বই পড়া - সময়ের কোনো হিসেবই থাকতো না। দূর-দূরান্তের পূজামন্ডপগুলো থেকে ভেসে আসতো মাইকে বেজে চলা একের পর এক বাংলা গান - যার একটা আজ খুব করে মনে পড়ছে: “রূপকুমারী মেয়ে মান করেছে - বাঁধবে না চুল, সে বাঁধবে না রে - হলুদ গাঁদার ফুল দে এনে দে...”