Friday, October 18, 2013

তোতলামি আর টলা-দা

তার আসল নাম যে কি ছিলো তা এখন ভুলে গেছি - বয়সে কিছুটা বড়ো ছিলো - সবাই ডাকতো 'টলা' বলে। তাই শুনে শুনে আমরাও বলতাম 'টলা-দা '। খুব সম্ভবত হাইটে বেশ কিছুটা লম্বা হবার দরুণই তার এরকম নাম হয়ে গেছিলো। তো সেই টলা-দার সাথে আমার প্রথম পরিচয় খেলার মাঠে। স্কুলে ইন্টার-ক্লাস ফুটবল লীগ চলছে। সে বছর সবাইই খুব সিরিয়াস - এমন কি স্যারেরাও পর্যন্ত মাঝেসাঝে মাঠে এসে খেলা দেখছেন। নিজের ক্লাসের ফুটবল টিমে চান্স না পেলেও মোটিভেশন বাড়ানোর জন্যে টিমের সাথে সাথে আমরা সবসময়ই মাছির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। এরকমই এক দিন আমাদের উপরের দুই ক্লাসের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক খেলা চলেছে। আমরা যথারীতি মাঠের ধারে বসে গলা ফাঠিয়ে  চলেছি যে টিম জিতলে আমাদের নিজের ক্লাসের সুবিধা হয়, তার হয়ে।


খেলা শেষ হতে তখন আর মিনিট পনেরো বাকি - এখনও পর্যন্ত কেউ কোনও গোল দিতে পারেনি। খেলা ড্র হয়ে গেলে আমাদের ক্লাসেরই লাভ হবে, তাই আমরা মোটামুটি খোশ মেজাজেই আছি। কিন্তু বিধি বাম - খেলা শেষ হবার কিছু আগে হঠাৎ করেই ফরোয়ার্ডে খেলা একজনের পায়ের মাসলে লেগে গেলো খিঁচ - একটা সাবস্টিটিউশানের দরকার। দেখতে পেলাম লম্বা মতন একটা ছেলে খুব কষে, কায়দা করে করে ওয়ার্ম-আপ শুরু করে দিয়েছে - বুঝলাম সেইই মাঠে নামবে এবার। নাম জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম তার নাম নাকি  'টলা' - তবে পুরো নাম কেউই বলতে পারলো না। ভাবলাম ভালোই তো - বেশ লম্বা আছে, কর্ণার থেকে যদি হেড করে একটা গোল করে ফেলতে পারে তো পোয়া-বারো ! কিন্তু ও মা! কোথায় কি! টলা-দা দেখি লম্বা লম্বা পায়ে খালি টেরে-বেঁকে দৌড়েই বেড়াচ্ছে - বল পজেশান-এর কোনো সেন্স-ই নেই। এমন কি সোজা সোজা বল রিসিভ করতে গিয়েও অপোন্যান্টের পায়ে তুলে দিচ্ছে। এমনিতেই বৃষ্টিতে ভেজা মাঠ পিচ্ছিল হয়ে আছে, তার ওপরে টলা-দা ছুটতে গিয়েও আছাড় খেয়ে খেয়ে মাঠে হাসির রোল তুলে দিলো। এদিকে না-জানি কেন আমাদের টেনশান হতে শুরু  করে দিয়েছে - শেষ মিনিট দশেকই যেন অনন্তকাল বলে মনে হতে লাগলো। বিপক্ষ টিম হঠাৎই যেন তেড়েফুঁড়ে খেলা শুরু করেছে - আমরা রেফারির বাপ-বাপান্ত শুরু করে দিয়েছি - কেন সে খেলা শেষের হুইসিল বাজাচ্ছে না !

 

অন্তিম মুহুর্তের দিকে খেলা চলে এসেছে - পেনাল্টি বক্সের সামনে এবার একটা লুজ বল এসেছে।  টলা-দা গোলের দিকে পিছন করে বলটা ভালোই ব্লক করেছে - আমরা তারস্বরে চেঁচাচ্ছি 'মার, মার - মেরে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দে...' এমন সময় বিপক্ষ টিমের স্টপার, বিজেন মুখ দিয়ে 'এইই... টলা... এদিকে, হুসস, হুসস...' করে শিস দিয়ে ইশারা করতেই দেখি টলা-দা কোনদিকে না-দেখেই টুক করে বেমালুম বলটা বাঁ-দিকে পাস দিয়ে দিলো। আমরা তো 'থ' হয়ে গেছি। আর যায় কোথায়, বিজেন ব্যাটাচ্ছেলে দাঁড়িয়ে ছিলো ফাঁকায় সেকেন্ড পোস্টের দিকে - কিন্তু গোলকীপার তখন ফার্স্ট পোস্টের দিকে রয়েছে। বল পাওয়া মাত্রই বিজেন চোখের পলকে সজোরে মারলো, যাকে বলে এক গোলা শট। গোলকীপারকে নড়াচড়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ না-দিয়েই বল চলে গেলো গোলপোস্টের মধ্যে দিয়ে একেবারে সোজা মাঠের বাইরে। ভাগ্যিস গোলপোস্টে কোনো জাল লাগানো ছিলো না - থাকলে নির্ঘাৎ ছিঁড়ে যেতো ! 


ঘটনার ঘনঘটায় আমাদের সকলের মুখ বাস্তবিকই 'হাঁ' হয়ে গেছে - শোকে-দুঃখে পাথর, কথা বলার অবস্থাটুকুও যেন কারোর নেই। বল কুড়িয়ে এনে সেন্টার হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই রেফারির শয়তানি হুইসিল বেজে উঠলো। যাহ: খেলা শেষ ! এবং স্কোরলাইন ০-১ !! ঠিক যে ভয়টা করেছিলাম, সেইটাই হলো। মাঠের অন্যদিকে তখন টলা-কে ঘিরেই একটা জটলা শুরু হয়ে গেছে। তার নিজের টিমের প্লেয়াররাই তাকে নিয়ে তখন তুলোধোনা শুরু করে দিয়েছে। আমরা সবাই দৌড়ে গেলাম - শুনতে পেলাম টলা-দার খ্যাঁকারী কন্ঠস্বর: 'আররে! আমায় শুধু শুধু মা-মারলে হবে? আ-আ-আম্মি, কি-কি-ক্করে বুজজজবো যে, শা-শালা  বি-বিজেনটাই শিস দিয়েছে...'। দুঃখের মধ্যেও হাসি চলে এলো - বুঝলাম টলা-দা আদপেই হলো গিয়ে একটি খাঁটি রত্ন - তোতলামিও রয়েছে তার  মধ্যে !!


এই টলা-দাই বেশ কয়েকবার পরীক্ষায় গাড্ডা মারার পর অবশেষে আমাদের সাথেই ক্লাস শুরু করলো - দেখলাম কোনও দিকে কোন গুণ না-থাকা স্বত্তেও একজন মানুষকে অন্যেরা কতোটা পছন্দ করতে পারে। এটাকেই কি তা'হলে  বলে 'base less ভালো-লাগা'? শক্ত হোক, সোজা হোক, যে কোন কাজেই টলা-দা এক কথায় রাজি, যদিও ততোদিনে আমরা সবাই জেনে গেছি যে নেহাৎ উপায় না থাকলে ওকে কোন কাজ দেওয়া উচিত নয়,  তা সে যতো সোজা কাজই হোক না কেন! কিন্তু আবার টলা-দা ছাড়া কোন কিছুই তেমন জমে ওঠে না! বিশেষ করে উত্তেজিত হয়ে গেলে তার তোতলামির মাত্রা  যেতো বহু গুণে বেড়ে, আর সেটা  যে কোন ঘটনার seriousness বা টেনশান, মুহুর্তের মধ্যে লঘু করে দিতো - ঠিক যেমন ব্লটিং পেপার জল শুষে নেয়। অগত্যা আমাদের সকল অভিযানেই টলা-দা রইলো জড়িয়ে  - অনেকটা পাঁচমেশালী তরকারির 'বেগুনের' মতো হয়ে !

 

আলাপ পরিচয় ক্রমশ বেড়ে উঠলে জানতে পারলাম যে টলা-দা হলো পরিবারের এক মাত্র ছেলে, যাকে বলে বংশের প্রদীপ - বড়ো এক দিদি আছেন, তাঁর বিয়ে হয়ে গেছে৷ গ্রামের বাড়িতে সম্পত্তির পরিমাণ বেশ ভালোই৷ বাস্তু-ভিটে, বড়ো দুই পুকুর, ধানী-জমি, বাগান-বাড়ি, প্রায় খান-শয়েক সুপারি আর নারকেল গাছ - সব যোগ করলে আয় মন্দ নয়৷ গোঁত্তা খেতে খেতে বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় স্কুলের গন্ডী  কোনভাবে পার করার পর টলা-দার বাবা তাকে আদেশ দিলেন পারিবারিক সম্পত্তির দেখাশুনার। এর সাথে টলা-দাকে ব্যবসায় নামতে হবে, চিংড়ি মাছের ভেড়ির ব্যবসা৷ টলা-দা তখন নব্য যুবক, আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গায়ে। মাঝে মাঝেই হেঁড়ে গলায় কিশোরকুমারের "আর তো নেই বেশি দিন, মিলবো এবার দু'জনে..." গেয়ে উঠছে। খুব ইচ্ছে কলকাতায় থেকে একটা চাকরি, আর কোন একটা মেয়ের সাথে সাচ্চা প্রেম করার !  কিন্তু দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাবা বা জ্যেঠুর সামনে মুখ খোলার দু:সাহস নেই৷ তাই অনিচ্ছাসত্বেও সে মাছের ব্যবসাতেই মনোনিবেশ করলো৷ গোল বাঁধলো কিয়ৎকাল পরে যখন তার জ্যেঠু হুকুম দিলেন বিয়ের পিঁড়িতে বসার৷ টলা-দা পুরোপুরি বেঁকে বসলো - সে কিছুতেই বিয়ে করবেনা অ্যাতো কম বয়সে৷ এমন নয় যে সে অন্য কাউকে কথা দিয়ে রেখেছে, তবু সে মেয়ে-দেখে কিছুতেই "অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ" করতে পারবে না৷ অন্যদিকে তার বাবা-জ্যেঠুরাও অনড় - মেয়ের বাড়ি গিয়ে তাঁরা ততদিনে মেয়ে দেখে-শুনে  প্রাথমিক কথাবার্তা সেরে রেখে এসেছেন - অর্থাৎ জল অনেকদূরই গেছে গড়িয়ে, এখন সহসা বেঁকে বসলে ঘোর প্রেস্টিজ ইস্যু৷ অগত্যা মাঠে নামলেন টলা-দার মা ও জ্যেঠিমা। তাঁরা অনেক কষ্ট করে টলা-দাকে কোনওভাবে রাজি করালেন, বললেন: "অন্তত: একটিবার যা,  গিয়ে মেয়েটাকে দেখে আয়... তারপর না'হয়..." - গোঁজ হয়ে টলা-দা শেষমেষ রাজি হলো যেতে। 

বিজয়া দশমীর পরের সপ্তাহে, এক রবিবারের দুপুরে মেয়ে দেখতে যাওয়া স্থির হলো৷ ঠিক হলো আমরাও, মানে তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধুরা মিলে এক সাথে যাবো মেয়ের বাড়ি অবধি কাছাকাছি গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে আমরা কোনো একটা দোকানে অপেক্ষা করবো তারপর টলা-দার  মেয়ে দেখা শেষ হলে আবার সবাই মিলে হৈচৈ করতে করতে যেমন এসেছিলাম তেমন ফিরে আসবো। এতে টলা-দার মনখারাপ ভাবটা কিছুটা কমবে। তো সেইমতো দুটো গাড়ি ঠিক করা হলো - একটাতে টলা-দা আর তার জামাইবাবু আমাদের সাথে উঠে বসলেন - আর অন্য গাড়িতে চললেন টলা-দার পরিবারের বয়ঃজ্যেষ্ঠরা ৷ গাড়িতে উঠেই শুরু হলো টলাদার গজগজানি, আর তার সাথে যোগ হলো তোতলামো: "আমার প-প-প্রবলেম টা তোরা কেউই বু-বু-বুঝছিস না৷ আমি এখন কি-কি-কিচচচুতেই ব্যে ক-করবো না..." এই একই কথা বলে চললো ফাটা রেকর্ডের মতো৷ মাঝরাস্তায় গাড়ি থামলো চা-সিগারেটের জন্য। আমি আর তার জামাইবাবু তাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গিয়ে বোঝালাম, "শোন, জ্যেঠুদের সাথে বাওয়ালী করে কোনও লাভ নেই - বেয়াড়া পাবলিক - কায়দা করে সব সামলাতে হবে৷ তুই স্মার্টলি যাবি - ঘ্যাম নিয়ে মেয়ে দেখবি - যা যা খাবার দেবে সবকিছু  খেয়েদেয়ে স্মার্টলি চলে আসবি, আর ফিরে এসে বলবি যে মেয়ে তোর পছন্দ হয় নি৷ ব্যাস, হয়ে গেলো - খেল খতম, পয়সা হজম..." - বুদ্ধিটা তার মনে ধরলো - অত:পর আবার যাত্রা শুরু হলো।  

মেয়ের বাড়ির কাছাকাছি এক মোড়ে এসে আমরা সবাই প্ল্যান মাফিক গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম
টলা-দারা যথারীতি আবার রওনা দিয়ে দিলো। আমার মনটা একটু খচখচ করতে লাগলো, তোতলাবে না তো ? আবার না-জানি কোন হাসির খোরাক হয়ে দাঁড়ায়! ঘন্টাদেড়েক বাদে টলা-দারা ফিরে এলো - শুনলাম মেয়ের বাড়িতে বেশ ভালোই খাতির-যত্ন হয়েছে। আর টলা-দাও না-তুতলিয়ে বেশ সপ্রতিভ ভাবেই সবার সাথে কথা বলেছে - তারপর যথাসম্ভব বিনয়ী হয়ে তারা বিদায় নিয়ে এসেছে৷ শুনে আমরা সবাই মিলে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম !


সন্ধ্যা নেমে এসেছে - রবিবারের নির্জন রাস্তা দিয়ে আমাদের গাড়ি হু-হু করে ছুটে চলেছে বাড়ির পথেপেছনের সিটে আমরা আর টলা-দার জামাইবাবু। সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসে আনমনা টলা-দা৷ জামাইবাবু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলেন, "তা'হলে, বাড়ি গিয়ে ওই কথাই হচ্ছে তো?" - টলা-দার দৃষ্টি সামনের কাঁচে নিবদ্ধ, খানিকক্ষন চুপচাপ, তারপর ঘাড় না ঘুরিয়েই বলে উঠলো, "অপ-প-পছন্দের  ক-ক-কো-নও  কারণ  তো  দে-দেখলাম না..." - আমরা আবার 'থ' মেরে গেলাম - আগেই বলেছি, উত্তেজিত হলেই টলা-দা তোতলায় !!

No comments:

Post a Comment