Monday, October 28, 2013

কুটুম-কাটুম...

"চলতি পথে পাওয়া..." 
মেন রাস্তা ধরে চলছিলো গাড়ি বেশ। কথা নেই বার্তা নেই হুট করে ড্রাইভার নামিয়ে দিলো গাড়ি বাইপাস রোডে। "আরে, করো কি, করো কি" বলে বাস জুড়ে শুরু হয়ে গেলো হাউকাউ চিৎকার। ড্রাইভার বলে ওঠে "মেন রোডে গন্ডগোল দাদা, তাই সাইড কাটছি !
কোথা থেকে বাসে উঠেছিলো এক পাগল কিসিমের লোক। আমাদের হাউকাউ থেমে গেলে সে বলে কি না - "গন্ডগোল হোক আর যাই হোক, পথে থাকতি হয়। একবার বিপথে নামলি পথে ওঠা খুব কঠিন !
কথাটা বেশ মনে ধরে - এ যুগে পাগল কিসিমের মানুষগুলোই সব চাইতে সহজ করে সত্য কথাগুলো বলে।


'মরিচা গুড়' == 'নলেন গুড়'
আমাদের বাড়ির বাগানের আম,কাঁঠাল,জামরুল,কলা,ডাব,নারকেল,সুপারি, বেল,তাল,ডাঁটা, ইত্যাদি যে কোন রকমের ফল-পাতি গাছ থেকে পাড়া, বিক্রি করা থেকে বাগানের যাবতীয় কাজকর্মের জন্যে একজন বাঁধা, বিশ্বাসী লোক ছিলো। তাকে আমরা পরবেশদা বলে ডাকতাম। সে জাতে মুসলমান হলেও আমাদের বাড়ির যে কোন অনুষ্ঠানে সানন্দে যোগ দিতো - আর আমরাও তাকে কোনদিন নিজেদের থেকে আলাদা করে কখনো দেখতাম না। এই পরবেশদা হেমন্তকাল পড়লেই নলেন গুড়ের ভাঁড় নিয়ে এসে হাজির হতো। সে গুড় খেতে হতো অস্বাভাবিক রকমের সুস্বাদু - গন্ধেই প্রাণ যেতো জুড়িয়ে। বাজারের কেনা গুড়ের সাথে সেই গুড়ের স্বাদের কোনো তুলনাই চলতো না।
এক ভাঁড় গুড় মেরে-কেটে দেড় সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হয়ে যেতো। পিসিমা মাঝে মাঝে পাকা তেঁতুল আর সেই মিষ্টি গুড় দিয়ে এক দারুণ আচার তৈরী করতেন, যেটাকে আমরা 'সড়া তেঁতুল' বলতাম। যখন এমনি গুড় শেষ হয়ে যেতো, তখন আমরা ওই আচারের উপর নজর দিতাম। এছাড়া পুলি-পিঠে তো মাঝে মাঝেই বানানো হতো। সেগুলোর জন্যেও প্রচুর গুড় শেষ হয়ে যেতো। 
এদেশে এসে বহুদিন নলেন গুড়ের মুখোমুখি হইনি। শুনতাম যে বাংলাদেশী দোকানগুলো নাকি মাঝে মাঝে এনে রাখে। কিন্তু কষ্ট করে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আজ অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে দেখলাম টিভিতে সত্তরের দশকের, অমিতাভ বচ্চনের 'সওদাগর' মুভি চলছে, সৌজন্যে ইউটিউব-ডট-কম।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখা 'রস' গল্পের অবলম্বনে তৈরী হয়েছিল এই হিন্দী সিনেমাটি। কয়েক যুগ আগে কোনো এক রবিবারের সন্ধ্যায় টিভির ন্যাশনাল চ্যানেলে, বাড়িতে বসে সবার সাথে দেখেছিলাম এই সিনেমাটি। 
তাদের অনেকেই আজ আর নেই - এ কথাটা মনে করতেই মন বেশ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। 'খানিকক্ষণ দেখি' বলে বসে গিয়ে কখন যে এক ঘন্টার ওপর দেখে ফেলেছি তা খেয়ালই হয়নি। পুরানো জিনিষের মানই বোধহয় আলাদা - তাই সিনেমা শেষ হয়ে গেলেও তার রেশ রয়ে গেলো মাথার মধ্যে। গুড়ের সুবাস যেন টিভি থেকে বার হয়ে এসে সারা ঘরে ম-ম করে ছড়িয়ে পড়লো। ঠিক করলাম আজ রাতেই নলেন গুড়ের সন্ধান করতে হবে - পাওয়া যাক না যাক, অন্তত চেষ্টা তো করে দেখি। বাড়ির কাছাকাছি এক বাংলাদেশী দোকান আছে, নাম 'বাংলা বাজার' - তো গিয়ে হাজির হলাম সেই দোকানে। দোকানের কাউন্টারে বসা "বাঙালটা" আবার কিছুতেই বাংলা বলবে না !! বিশেষ করে 'ইন্ডিয়ান বাঙালি' দেখলে তো নয়ই। শেষ পর্যন্ত নিজেই উঁকি মেরে মেরে যেটা খুঁজে পেলাম সেটার নাম দেখি 'মরিচা গুড়' !! সীল করা ছোট শিশি - না খুলে তার ভিতরের গন্ধ টের পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে কাউন্টারের ত্যাঁদোড়টা কিছুতেই বলবে না যে 'মরিচা গুড়' মানে 'নলেন' বা 'খেঁজুর গুড়' কি না। গিন্নী আবার এর মধ্যে মাথায় ঢুকিয়ে দিলো যে লঙ্কাকে নাকি আবার ওই দেশীয়রা 'মরিচ' বলে ডাকে। তার মানে "গুড় with লঙ্কা"? কি জগাখিচুড়ি কম্বিনেশান রে বাবা ! ঠিক করলাম, যা হবার হবে, "জয় বচ্চন !" বলে কিনে তো ফেলি। চলে এলো 'মরিচা গুড়' আমার সাথে সাথে। বাড়িতে এসে দেখলাম, না, ভুল কিছু করিনি। যাহাই বাঙালের কাছে 'মরিচা গুড়', তাহাই বাঙালির কাছে হলো গিয়ে নলেন গুড় !! এবার তাহলে তেড়ে-ফুঁড়ে নলেন গুড়ের সন্দেশ বানানো শুরু করা যাক !


'অভিমন্যু' হতে গিয়ে 'শেল্ডন কুপার' !!!

মহাভারতে আমার অন্যতম প্রিয় এবং ট্র্যাজিক চরিত্র হলো বীর অভিমন্যু। যুদ্ধের দুর্ভেদ্য চক্রব্যুহ ফর্মেশান কি কৌশলে ভাঙ্গা যায় তা নিয়ে একদিন অর্জুন তাঁর স্ত্রী, সুভদ্রাকে শোনাচ্ছিলেন। সে সময় অভিমন্যু ছিলেন তাঁর মা, অর্থাৎ সুভদ্রার গর্ভে। সেখান থেকেই তিনি চক্রব্যুহ ভেদের গোপন কৌশলে শিখে নেন। কিন্তু কি করে চক্রব্যুহ থেকে বার হতে হয়, সে বিদ্যা তিনি জানতে পারেন নি, কারণ অর্জুন যখন চক্রব্যুহ থেকে বার হবার কৌশল নিয়ে বলছিলেন, তখন সুভদ্রা নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কেউ কেউ আবার বলেন যে শ্রীকৃষ্ণ নাকি এই সময় অর্জুনকে ডেকে নিয়ে চলে যান 'খান্ডব অরণ্য' দহনের উদ্দেশ্যে। তো সেই না-জানার খেসারত দিয়ে পরবর্তী কালে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে বীর অভিমন্যুকে মর্মান্তিক ভাবে প্রাণ হারাতে হয়েছিলো। কৌরব পক্ষের সাত মহারথী, এক সাথে মিলে ঘোর অন্যায়ভাবে বীর অভিমন্যুকে হত্যা করেছিলেন - যা হয়তো মহাভারতের সব থেকে করুণ, নিষ্ঠুর ও মর্মান্তিক ঘটনা।

মহাভারতের এই গল্প আমি সেই ছোটবেলা থেকে যে কতোবার শুনেছি, এবং নানা বইতে যে কতোবার পড়েছি তার ইয়ত্তা নেই। মনে সুপ্ত বাসনা জেগেছিলো যে সুযোগ পেলে, অর্জুনের মতো আমিও এরকম কিছু একটা করার চেষ্টা at least করবো। তো সুযোগ এলো এক সময় - আমিও উৎসাহিত হয়ে গিন্নীর জন্যে এনে হাজির কোরলাম এক গাদা মহাপুরুষের জীবনকাহিনী, ধর্ম কাহিনী, ঈশপের গল্প, মহৎ জীবন মার্কা বোরিং বই, অডিও, ভিডিও - যা কিছু পাওয়া যায় সে বাজারে - এমন কি বি. আর. চোপড়ার মহাভারতের ১৬-সেটের ডিভিডিও ছিলো সে লিস্টে। কিন্তু গিন্নী সে সবের বদলে সারাদিন বসে বসে দেখলো কিনা CBS-এ চলা "Big Bang Theory" !! 

অত:পর যা হবার তাই হলো - ছেলে এখন সারাদিন শেল্ডন কুপারের মত করে হাসতে থাকে !!!   
LINK: শেল্ডনের হাসি (সৌজন্যে YouTube.com)     

"মাল-আতঙ্ক"
আমাদের সময়ে অষ্টম-নবম শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণে একটা অধ্যায় ছিলো, 'শব্দের বিভিন্নার্থে প্রয়োগ' নিয়ে। যেমন ধরা যাক 'চাল' শব্দটি। যখন শব্দটির অর্থ খাদ্যশস্য তখন তাকে পাবার জন্যে বাজারের একটি নির্দিষ্ট অংশে যেতে হতো - তারপর ট্যাঁকের অবস্থা অনুযায়ী মনোমত Quality-র চাল কেনা হতো। কিন্তু যখন সেই একই শব্দটি ফন্দি হিসাবে ব্যবহৃত হতো, তখন তার অর্থ হতো দুরাভিসন্ধির পূর্বাভাষ। আভিধানিক ও ব্যবহারিক অর্থের কারণে শব্দের এই বিভিন্ন প্রয়োগ যে আমাদেরকে নানান বিরক্তিকর এবং বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতো তা বলাই বাহুল্য ।

বাংলাভাষায় বহুল প্রচলিত একটি শব্দ হলো 'মালামাল' বা সংক্ষেপে "মাল", যার আভিধানিক অর্থ জিনিসপত্র বিশেষ। কিন্তু বাস্তব জগতের ব্যবহারিক অর্থে এর বিস্তৃতি আরো ব্যাপক। এই শব্দটির বহুবিধ প্রয়োগের মধ্যে একটির সম্পর্কে ধারণা কৈশোর পার হবার সময়কালীনই জানা হয়ে যায়, যখন পাড়ার মোড়ের বড় দাদাদের কথাবার্তার আন-ফিল্টার্ড অংশ কর্ণকুহরে প্রবেশ করেছিলো - ''দেখ দেখ, কি দারুণ মাল !''। আবার পিতৃদত্ত টাইটেল হিসাবে পাওয়া 'মাল'-এর কারণে আমার তদকালীন ক্লাসমেট ভবানী মাল-কে যে কি দুর্ভোগ আর লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে গোটা স্কুল জীবন অতিক্রম করতে হয়েছিলো সে শুধু আমরাই জানি (হাসি) --- স্কুলের গন্ডি ছাড়িয়ে ইউনিভার্সিটি বা কলেজ চত্বরে প্রবেশের পর 'মাল' শব্দটির আরেকটি অর্থের সম্মুখীন হলাম, ফার্স্ট ইয়ার শেষ হবার অনেক আগেই ! 

যাক, এতো গেলো ব্যবহারিক কিছু প্রয়োগ। মানুষের সারা জীবন জুড়েই চলে জ্ঞান আহরণের পর্ব। পোস্ট-গ্রাজুয়েশন চলাকালীন কিছুটা বিস্ময়ের সাথেই আমরা আবার পরিচিত হলাম 'মাল' শব্দের অন্য একটি অর্থের সাথে। কম্পিউটার সায়েন্সের একটা সেমিস্টার ছিলো Low-level প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ, অ্যাসেম্বলি ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে। সেখানে x86 processor family instruction set-এ গুন অর্থাৎ multiply করার জন্য যে Keyword বা OPCode লিখতে হতো সেটা হলো MUL, বা 'মাল' - সুতরাং আবার 'মাল'-এর মুখোমুখি হলাম আমরা। তো এই 'মাল' অপারেশন পড়াতে গিয়ে আমাদের ইউনিভার্সিটির লেকচারার (তখন ছিলেন অবিবাহিত) দূর্ভাগ্যবশত: বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে ভুলে গিয়েছিলেন। তাঁর লেকচারের কিছু অংশ বাংলায় ট্রান্সলেট করলে হবে এরকম: "এখন তোমাদের যে টপিকটা পড়াবো সেটা হচ্ছে 'মাল' - মাল খুবই ইর্ম্পট্যান্ট। মালটা ভালো করে পড়তে হবে, পরীক্ষায় আসতে পারে। যদিও এটার আরেকটা ভার্সন আছে, 'আইমাল', কিন্তু মনে রেখো 'মাল'-টাই আসল . . . ." প্রথমে ভ্যাবাচাকা খেলেও একটু পরে বুঝতে পারলাম ক্লাশের বাকিরা কি কষ্ট করে হাসি আটকে রেখেছিলো। খুক খুক কাশির রোগ যেন Mexican ওয়েভের মতো সারা ক্লাসের মধ্যে বয়ে যেতে লাগলো। মিনিট কুড়ি অতিক্রম হবার পর যখন স্যার তাঁর honest mistake-এর কারণটা বুঝতে পারলেন, তখন তাঁর সেই করুণ অবস্থা দেখে আমাদেরই করুণা হতে লাগলো। 

Let's start it again বলে তিনি এরপর বাকি লেকচারের আদি হতে অন্ত পর্যন্ত সংক্ষিপ্তকরণ বাদ দিয়ে মালকে M-U-L বলতে বলতে গলা শুকিয়ে ফেললেন। লেকচার শেষে বরাবরের মতো জিজ্ঞেস করলেন: 'এটা খুব ইর্ম্পট্যান্ট। ভালো করে পড়বে, এক্সারসাইজগুলো সলভ করবে, আর .... এনি কোয়েশ্চন?' --- ক্লাশের সবচেয়ে পড়ুয়া আর অ্যাটেনটিভ স্টুডেন্ট, সুন্দর মুখের মেয়েটি নিষ্পাপ সুরে জিজ্ঞেস করলো, 'স্যার, গতবারে তো মাল এসে গিয়েছিলো - এবারেও কি মাল-ই পড়বে?' এই অবস্থায় কোন একজন ফচকে স্টুডেন্ট পিছন থেকে ফোড়ন কেটে উঠলো 'কি মাল মাইরি!' - স্যারের তখন পুরো হাজার ভোল্টের শক খাওয়ার মতো অবস্থা হলো, একটু কেশে বললেন 'এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না - আসতেও পারে, আবার নাও আসতে পারে' - বলেই তিনি দ্রুত ক্লাশের বাইরে পা বাড়ালেন। আর আমাদের এতক্ষণের দম চেপে রাখা হাসির ফোয়ারাতে গোটা ক্লাসরুম ফেটে পড়ার উপক্রম হলো...


"নরম স্বামী হবার উপায়..."
স্ত্রী শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ইস্তিরি থেকে। তো ইস্তিরির কাজ কি? আপনাকে সোজা রাখা, ভাঁজ মুক্ত রাখা। সেই ভাঁজ মুক্ত করতে গিয়ে আপনার স্ত্রী আপনাকে একটু গরম ছেঁকা দেবে এটা তো জানা কথাই। এখন আপনি বুদ্ধিমান হলে সেই গরম ছেঁকা খাওয়ার আগে নিজে নিজেই ভাঁজ ভেঙ্গে সোজা হয়ে যাবেন। আর নরম স্বামী হচ্ছে অনেকটা wrinkle free non-iron শার্ট এর মতো। কোঁচকালে বেঁকে যায়, আবার সোজা করলে সোজা হয়ে যায়। বিবাহিত জীবনের প্রতিক্ষেত্রে নরম হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনার স্ত্রী যদি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী হয়, তবে বাই-হুক-অর-বাই-ক্রুক আপনাকে প্রয়োজন মতো শক্ত বানিয়ে ছাড়বে। বাদবাকি সবখানে নরম। যাই হোক, নরম স্বামী হবার জন্য একটাই পথ, সব কিছুতে সহমত প্রকাশ করতে হবে। কিভাবে হ্যাঁ বলতে হবে সেটা সবাই জানেন, কিন্তু কত দ্রুত বলতে হবে সেটা অনেকেই জানেন না। 

ছোটবেলায় আমাদের কিন্ডারগার্টেন স্কুলে একটা প্রতিযোগিতা হতো - নাম ছিলো 'ওড়ে কি ওড়ে না' প্রতিযোগিতা। লাইন ধরে বাচ্চাদেরকে দাঁড় করিয়ে একজন একের পর এক পশু-পাখির নাম বলে যেতো। আর প্রতিযোগীদের গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে হতো সেই বস্তু ওড়ে কি ওড়ে না। শুধু কথা বলে নয়, যদি সেই বস্তু ওড়ে তবে হাত উঠিয়ে ওড়ার ভঙ্গি করে দেখাতে হতো। না উড়লে হাত উঠানো যাবে না। যে ভুল করবে সে বাতিল। এভাবে চলতে থাকতো শেষ ব্যক্তি বাতিল হবার আগে পর্যন্ত। 
ঈগল - ওড়ে, বানর - ওড়ে না, পাখি - ওড়ে, গোরু - ওড়ে না, পায়রা - ওড়ে, মুরগি - ওড়ে না ইত্যাদি। মুরগি বেশ ক্রিটিকাল ছিলো। এইখানে এসে অনেকেই বাদ পড়ে যেতো, সেইসাথে বাদানুবাদও শুরু হতো মুরগি ওড়ে কি ওড়েনা এই নিয়ে ! 

এখন কথা হচ্ছে স্ত্রীর সাথে সহমত হবার জন্য আপনাকে ছোটবেলার সেই 'ওড়ে কি ওড়ে না' খেলাটা প্র্যাকটিস করে যেতে হবে। প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, 'তুমি কি আমায় ভালোবাসো?'-এর উত্তরে পাখির ডানার মতো করে দ্রুত হাত ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে বলতে হবে, "হ্যাঁ হ্যাঁ, অথবা আবার জিজ্ঞাসা করে !" - প্রশ্নের পর রেসপন্স করার জন্য আপনার হাতে সময় আধ-সেকেন্ড। এর মধ্যে যদি হাত পা নাড়িয়ে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে উত্তর না দিতে পারেন তবে লেখক দায়ী নয়। একইভাবে "আমার চেহারা কি খারাপ হয়ে গেছে, বা আমি কি মোটা হয়ে যাচ্ছি?" ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তরে হাত-পা না-নাড়িয়ে গম্ভীর মুখে বলতে হবে "না, নেভার, পাগল, কি যে বলো, কক্ষনো না", ইত্যাদি। 

'আমি মরে গেলে তুমি কি আবার বিয়ে করবে' টাইপের প্রশ্নের উত্তর আরেকটু অ্যাগ্রেসিভ ভঙ্গিতে দিতে হবে, 'খবরদার অমন কথাটি মুখেও এনো না লক্ষ্মীটি' থেকে শুরু করে একটু ওভারঅ্যাক্টিং করে দু-চার ঘা (মিষ্টি ঘা আর কি!) বসিয়ে দিয়ে বলতে পারেন, "এমন কথা মুখে আনলে কিন্তু খুব মার", ইত্যাদি। "তোমার কি মনে হয় আমি বোকা?" টাইপের প্রশ্ন অনেকটা মুরগী ওড়ে কি ওড়েনা-এর মতো ভেজাল প্রশ্ন। তাই শুধু হ্যাঁ, বা না বলে আরও দুচার লাইন বলে বুঝিয়ে দিয়ে হবে, "তুমি বুদ্ধিমতী, তবে চালাক নও - আঙ্গুর ফল, তবে টক নও ইত্যাদি..."

তেলাকুচা শব্দটা যেন ছোটবেলার কোন চেনা বন্ধু ...
ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে মেজদার একবার খুব শখ হয়েছিলো পাখি পোষার। কোথা থেকে পাখি পাই, কি পাখি পোষা যায়, এসব ভাবতে ভাবতে ঠিক করা হলো যে আগে পাখি ধরার একটা কল তৈরী করা যাক। সেইমতো একটা ফাঁকা ঘরে খড়-কাটার বড়ো চুবড়ির মধ্যে, পেয়ারা গাছের দেড়-ফুট লম্বা একটা ডাল রেখে, তার উপরে ভর দিয়ে চুবড়িটাকে আধা-দাঁড় অবস্থায় হেলিয়ে রাখা হলো। ডান্ডাটার নিচের দিকে বাঁধা থাকলো ঘুড়ি ওড়ানোর সুতো। সেই সুতো লম্বা হয়ে হয়ে চলে এলো ঘরের অনেক বাইরে। চুবড়ির তলায় টোপ হিসাবে কিছু চাল-ধান ছড়িয়ে অন্য প্রান্তে সাগ্রহে বসে রইলাম আমরা। তখনও আমাদের বাড়ির দোতলাটা পুরোপুরি কমপ্লিট হয়নি।  ঘরগুলোতে শুধু জানালা আর দরজার ফ্রেম বসানো হয়েছে। তাই দক্ষিণদিকের ফাঁকা ঘরগুলোতে সূর্যের আলো সারা সকালবেলা হেসে-খেলে বেড়াতো। চড়ুই, শালিক, ছাতারে আর পায়রা যেখানে সেখানে ঘোরা-ফেরা করতো। কিন্তু তারা সবাই কি করে যেন আমাদের এই ফন্দিটাকে বুঝে ফেললো। তাই আমরা বসে আছি তো আছিই -  পাখি আর আসে না, আবার এলেও খুব সতর্কভাবে তারা চুবড়িটাকে এড়িয়ে যায়। ওটার নীচে পড়ে থাকা চাল-ধানের প্রতি খুব একটা আকর্ষণ তারা দেখালো না। এই ভাবে বেশ কিছুদিন চললো। পালায় পালায় আমরা নজরদারি চালাচ্ছি - নিজেদেরকে যেন জিম করবেট বলে মনে হত লাগলো। কেউ সেই ঘরের কাছে গেলেই আমরা হাঁ-হাঁ করে তেড়ে উঠতাম। পড়াশুনা, খেলা-ধুলা সব মাথায় উঠলো - পাখি ধরার নেশা আমাদেরকে পেয়ে বসলো। তারপর অবশেষে এক দুপুরের দিকে সাফল্যের দেখা মিললো। ছোট্ট একটা চড়ুই গুটি গুটি পায়ে খাবারের সন্ধানে চুবড়ির দিকে এগুলো - চুবড়ির তলায় সে আসতেই মারলাম সুতো ধরে এক হ্যাঁচকা টান। পাখি বেচারা ছোট ছিলো বলেই বোধহয় মানুষের এই চালাকির কথা তার মাথাতে আসেনি। খুব সাবধানে চুবড়ির মধ্যে হাত গলিয়ে, তাকে ধরে পোরা হলো এক খাঁচার মধ্যে। তারপর শুরু হোলো তাকে ট্রেনিং দেওয়ার পর্ব। কিন্তু প্রগ্রেসের বিন্দুমাত্র চিহ্ন না দেখা দেওয়ায় সপ্তাহখানেক বাদেই আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গলো -  কাউকে কিছু না বলে মা একদিন তাকে উড়িয়ে দিলো। রাগে-দুঃখে মেজদার সে লাফালাফি তখন দেখার মতো !! এর বেশ কিছুদিন পরে কোথাকার এক পাখি বিক্রেতার কাছ থেকে যোগাড় হলো সবুজ এক টিয়াপাখি - খুব বাচ্চা নয়, আবার খুব বড়োও নয়। তার খাবার যোগাড়ের ভার পড়লো বাড়ির বাকিদের উপরে, মূলত: আমার উপর। মেজদা কেবল শিষ দিয়ে তাকে কথা শেখানোর চেষ্টা করার মধ্যে দিয়েই তার দায়িত্ব শেষ করলো। কিন্তু একটা কথাও সেই টিয়াপাখি শিখেছিলো বলে মনে পড়ে না। 

বাড়ির বাগানে এক ঝোপের কাছে ছিলো কয়েকটা তেলাকুচা ফলের গাছ। সেখানে বেশ নিয়মিত ইন্টারভ্যালেই হয়ে থাকতো টসটসে লাল কিছু তেলাকুচা। এই তেলাকুচা ছিলো টিয়া পাখিদের খুব প্রিয় খাবার। অন্য পাখিদেরও প্রিয় বলেই মনে হয়, কিন্তু টিয়াপাখি যখন তেলাকুচা খেতো, সে দৃশ্য হয়ে উঠতো সুন্দরতর। টিয়াপাখির লাল ঠোঁট আর তেলাকুচার লাল রং মিলে যে অপার্থিব সৌন্দর্যের অবতরণা হয়, তা বোধহয় ওই শৈশবের সোনাঝরা দিনগুলিতেই অনুভব করা সম্ভব। প্রতিদিন সকাল হতেই আমরা ছুটে যেতাম সেই তেলাকুচা গাছের কাছে - তুলে নিয়ে আসতাম পাকা কয়েকটা তেলাকুচা। পাখিকে তেলাকুচা খাওয়ানোর মধ্যে দিয়েই শুরু হত আমাদের প্রাত্যহিক জীবন।
তেলাকুচা হলো লতা জাতীয় উদ্ভিদ - বহুবর্ষজীবি। সাধারণত বেড়ার গায়ে জমাট বেঁধে থাকা ঝোপঝাড় বা  সজনে গাছ এদের প্রিয় আশ্রয়স্থল। এই লতা ঠিক কতটুকু লম্বা হয় আন্দাজ করা মুশকিল। তেলাকুচার লতা নরম, খুব সহজেই ছেঁড়া যায়। লতার বেড় আধ-ইঞ্চিরও কম। তেলাকুচার পাতার রং গাঢ় সবুজ। পাতা পুরু আর নরম - দেখতে অনেকটা হৃদপিণ্ডাকৃতির। বোঁটা থেকে পাতার অগ্রভাগ পর্যন্ত পাতার দৈর্ঘ্য তিন ইঞ্চি, প্রস্থও তিন ইঞ্চির কাছাকাছি। 

তেলাকুচার পাতা রসালো, সবুজ রংয়ের ঠাণ্ডা রসে ভরা - এর মঞ্জরি একপুষ্পক, ফুলের রং সাদা। পাঁপড়ি মূলত একটা, কিন্তু পাঁচটা স্পষ্ট ভাগে বিভক্ত। প্রায় বারোমাস এর ফুল দেখা যায়। ফুলের ব্যাস ২ ইঞ্চি। তেলাকুচার ফল লম্বাটে, রং সবুজ। তবে সাদা রংয়ের ডোরাকাটা থাকে - ফলের চেহারা অনেকটা চাল কুমড়োর মতো। ফল ২-৩ ইঞ্চি লম্বা হয়। 

তেলাকুচার পাকা ফলের রং সিঁদুর-লাল - খেতে বেশ মিষ্টি, অনেকটা পাকা পটলের স্বাদের মতো। ফলের ভেতর শশার বীজের মতো ২০-২৫টা বীজ থাকে। তেলাকুচোর ইংরেজি নাম Baby Watermelon, Little Gourd,  Gentleman's Toes ইত্যাদি। আমাদের দেশে যে জাতের তেলাকুচা দেখা যায়, তার বৈজ্ঞানিক নাম Cephalandra Indica 


শুভ নববর্ষ ১৪২১
আপনি যাই বলুন না কেন, 'শুভ নববর্ষ' বলার চেয়ে 'হ্যাপি নিউ ইয়ার' বলার সময় আপনাকে একটু বেশিই স্মার্ট দেখায়, দেখায় কিনা? না না, সত্যি করে বলুন, বিদেশী ভাষায় কথা বলার মধ্যে একটা বেশ ইয়ে ইয়ে আছে, ব্যাপারটা বোঝার আছে।ফালতু বস্তাপচা সেন্টু খেয়ে কোন লাভ আছে, বলুন?

আমার তো বেশ মনে পড়ে, ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখে বেশ ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে পড়তাম।বাবার কড়া আদেশ ছিলো, অন্তত ওইদিন বেশিক্ষণ ঘুমানো চলবে না। বাড়ির উঠানে জড়ো করা থাকতো কিছু ভেজা খড়-বিচুলি আর শুকনো ঘাস-পাতা। সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হতো  - গল গল করে সাদা-কালো বিচিত্র গন্ধ-বর্ণ মাখা সেই ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়ে যেতো উপরে, আরো উপরে। আমরা সবাই একে একে ধোঁয়া মাখা সেই জায়গাটা যোগ্জ্ঞস্থান মনে করে তিনবার গোল করে প্রদক্ষিণ করতাম - তারপর এক লাফ মেরে সেই  ধোঁয়া কুণ্ডলীকে অতিক্রম করতাম। পাশ থেকে বাবা বলে উঠতেন: "বিগত বছরের যাবতীয় শোক-দুঃখ, পাপ-তাপ, ব্যথা-যন্ত্রনা ধুয়ে মুছে যাক, নতুন বছর নিয়ে আসুক হাসি-আনন্দ-সৌভাগ্য আমাদের সকলের জন্য" রেডিওতে শোনা যেতো সেই চির-চেনা রবীন্দ্রসঙ্গীত "এসো হে বৈশাখ, এসো এসো", কিম্বা "হে নূতন দেখা দিক আরবার" বেলা গড়ালে নিমপাতা বাটা, কাঁচা হলুদ বাটা, আর সর্ষে তেল একসাথে মিশিয়ে সারা গায়ে-মুখে ডলে ডলে মেখে, পুকুরে সাঁতার কেটে ভালো করে স্নান করতাম। বাড়িতে পাড়া-পড়শি, আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে নাম-না-জানা কতো লোক একের পর এক এসে হাজির হতো। কেউ কেউ আবার দিব্যি থেকে যেতো, দুপুরের খাবার খেয়ে তবে যেতো। লাঞ্চে থাকতো মায়ের হাতের রান্না, মহা সমারোহে তৈরী নানান রকমের পদ - শুক্তো দিয়ে শুরু, আর শেষ হতো চাটনি-দৈ-মিষ্টি দিয়ে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে বাবার হাত ধরে বেড়িয়ে পড়তাম বিভিন্ন দোকানে হালখাতার নেমতন্ন রাখতে - গনেশের মুদিখানা, ললিত বস্ত্রালয়, কান্ত মিত্রের সোনার দোকান, মনোহারী দোকান, আরও বেশ কিছু দোকানগুলোতে - সব মনেও পড়েনা আর এখন। কালেন্ডার আর মিস্টির প্যাকেট সব দোকানেই দিতো, কিন্তু বরফ দেওয়া ঠান্ডা লস্যি বা কোকাকোলা দিতো শুধু সোনার দোকানগুলোতে - তাই ওখানেই আগে আগে যেতাম। প্রচুর ভীড় ঠেলে, দোকান থেকে পাওয়া মিষ্টির প্যাকেট আর গোল করে পাকানো, গার্ডার-লাগানো ক্যালেন্ডার গুলোকে সাবধানে দোমড়ানোর হাত থেকে বাঁচিয়ে বাড়ি ফেরা, কোন যুদ্ধ জয়ের থেকে কম কিছু  ছিলো না। মিষ্টির প্যাকেটগুলো ভর্তি থাকতো বোঁদে, মিহিদানা, সীতাভোগ, পান্তুয়া আর ল্যাংচা দিয়ে। খুব দামী কিছু নয়, কিন্তু রাতে লুচি দিয়ে সেই মিষ্টি খেতে যে কি দারুণ লাগতো তা হয়তো ঠিক লিখে বোঝানো যাবে না। তারপর কোন ঘরে কোন ক্যালেন্ডার টাঙাবো সেটা ঠিক করতে করতেই রাত কাবার হয়ে যেতো। 

আর এখন?
"বলি শুনছো? সল্ট লেকের 'কট-এন্ড-বোল্ড', কিম্বা 'সিক্সথ বালিগঞ্জ প্লেসে' বুকিংটা আগে থেকেই করে দাও মেনুতে ডাব-চিংড়িটা আছে কিনা ভালো করে শিওর হয়ে নিও, তাহলে দারুন জমে যাবে, বুঝলে? রাঙাপিসিদের ওখানেই বলে দেবো, সোজা চলে আসবে নববর্ষ করতে। বোকার মতো আবার যেন বাংলাতে জিজ্ঞাসা কোরে বোসো না - বোলো "প্রনস কুক্ড ইন টেন্ডার কোকোনাট ক্রিম..." - আমি শুনছি আর ভাবছি - হায়রে বাঙালী ! শুভ নববর্ষ ১৪২১

 
ছেলেবেলার শীতকাল...
শীত পড়লেই আমাদের সিঁড়ির নীচের বড়ো কাঠের বাক্সটা থেকে বার করা হতো একঝাঁক কাঁথা - আমাদের প্রায় সবারই একটি করে নিজস্ব কাঁথা ছিলো। লেপ-কম্বলের চল তখন বেশি ছিলো না, তাছাড়া ওসবের দামও ছিল বেশী। ন্যাপথলিনের গন্ধ ছাড়াও সেই কাঁথাগুলোতে একটা অদ্ভুত রকমের গন্ধ লেগে থাকতো। তখন খেয়াল করিনি যে সেটা কিসের গন্ধ - আজ কিন্তু বুঝি, সেটা ছিলো মায়ের গায়ের গন্ধ।

দুপুরে সবার খাবারের পাট চুকলে, মা না-ঘুমিয়ে বসে পড়তেন কাঁথা সেলাইয়ের কাজে। কখনো নতুন কাঁথা, আবার কখনো বা পুরোনো ফুটো হয়ে যাওয়া কাঁথাদেরকে মেরামত করতে। পুরোনো পরনের শাড়ির পাড় থেকে আট-দশটা সুতোকে একসাথে ধরে টেনে বার করে আলাদা ভাবে রাখা হতো। সেই সুতো একট লম্বা, মোটা সুঁচের মধ্যে পুরে অবিশ্রাম গতিতে মা কাঁথা-সেলাই করে চলতেন ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে। রাতের বেলা কাঁথা গায়ে দিয়ে শোবার প্রথম দশ থেকে পনের মিনিট ঠান্ডা কমছে বলে মনে হতো না, কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে শরীরের
উত্তাপে সেটাও গরম হয়ে উঠতো। শীতের দাপট বাড়লে অনেক সময়েই দুপুর রোদে ছাদের রেলিংয়ে সারি সারি কাঁথা মেলে দেওয়া হতো। ঘন্টা তিন-চারেক ধরে রোদ্দুর পুয়ে কিছুটা রোদ্দুর যেন সেই কাঁথা আমাদের জন্যে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখে দিতো। সোলার প্যানেলের কনসেপ্টটা হয়তো এই কাঁথা-গরম থেকেই এসেছে !

রাতের বেলা সেই গরম কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমানোর যে আরাম, তা আজকালকার
হীটার লাগানো ঘরে দামী রেশমী কম্বলের মধ্যেও অনুভব করি না। কখনো সখনো ঘুমের মাঝে স্বপ্নের ডানায় ভর দিয়ে সেই পুরানো ছেলেবেলার দিনগুলোতে ফিরে যাই - অনুভব করি সেই হারিয়ে যাওয়া চির-পরিচিত গন্ধ। তখন কুলকুল শব্দে বুকে আনন্দ বয়ে চলে - মায়ের গন্ধের সাথেই যেন ছেলেবেলা মিশে আছে...


Thanks Giving Day - Nov 27th, 2013
অতি ব্যস্ত রাস্তা আজ বন্ধের চেহারা নিয়েছে - কাল, পরশু পরপর দু'দিন ছুটি এদেশে - ফরফরে পিঁপড়ের মতো অ্যামেরিকানরা বেরিয়ে পড়েছে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে - যে-যেখানে পারে - লং উইকেন্ড শুরু হয়ে গেলো বলে!

অফিসে আজ অঘোষিত ছুটি, গুটি কয় প্রাণী মাত্র আমরা এসেছি আজ। মনে হয় গলা ছেড়ে গেয়ে উঠি: "....আমার আর কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই...''


Road that takes me to my kid's school....
'কত সহজ দেখা-ই দেখার গুণে স্বপ্ন হয়...' - হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া অসংখ্য প্রিয় গানের মধ্যে আমার অন্যতম প্রিয় গান ছিলো এটি। এই পথে প্রায় প্রতিদিনই যাওয়া-আসা করি ছেলেকে স্কুলে দিতে বা নিতে। কোনদিন ভালো করে দেখিওনি যে এই অতি সাধারণ রাস্তাটি শীতের সাজে সেজে আস্তে আস্তে কতোটা মোহময়ী হয়ে উঠেছে। 

এক-পৃথিবী সৌন্দর্য দেখার জন্য, এক পৃথিবীর পথ চলার জন্য, এক জীবন বড়ো অল্প সময়।



Brain is a kind of “Built-in Google”
জীবনের যে-কোন প্রশ্নের উত্তর Binary-তে দেওয়া সম্ভব। যেমন ঈশ্বর আছেন কি? উত্তর, হয় আছে (১), নয় নেই (০) - ইন্ডিয়া আজ ক্রিকেট খেলায় কি জিতবে? সেখানেও একই উত্তর, হয় জিতবে(১), নয় হারবে (০) - পরীক্ষায় পাস করবো? হয়তো পাস, নয়তো ফেল। জীবনের প্রায় সমস্ত জায়গাতেই মাঝামঝি বলে কিছু নেই, বা সম্ভব নয়। কেউ যদি আমায় গত কুড়ি বছরের যাবতীয় technical advancement থেকে মাত্র দুটি জিনিষ বেছে নিতে বলে, তো আমি অবশ্যই সিলেক্ট করবো (এক) হাইস্পিড ইন্টারনেট, (দুই) গুগল সার্চ। আর বাদবাকি যে-কোন টেকি-জিনিষপত্র না থাকলেও আমার দিব্যি চলে যাবে। 
লাস্ট উইকে কোনো এক কারণে আমাদের অফিসের গোটা বিল্ডিংয়ের ইন্টারনেট অ্যাক্সেস মিনিট চল্লিশের জন্যে বন্ধ রাখা হয়েছিলো - কি একটা থ্রেট ডিটেকশানের জন্যে। সামান্য এই সময়টুকুই মনে হচ্ছিলো যেন অনন্তকাল। আমরা যেন এক একটা সব 'জম্বি' - হাত-পা বাঁধা কোন অদৃশ্য শিকলে। মেল অ্যাক্সেস বন্ধ, নো কনফারেন্স, প্রজেক্টের যাবতীয় ডকুমেন্ট জমা থাকে রিমোট ফাইল-সার্ভারে, ইন্টারনেট ছাড়া যা অ্যাক্সেস করা যাবে না। কাজ করি থিন ক্লায়েন্ট দিয়ে রিমোট ডেস্কটপ ইউস করে, সেটাও ইন্টারনেট ছাড়া নন-অ্যাক্সেসেসিবল। গল্পের বই যে পড়বো, সে উপায়ও নেই, সব কিছুই গুগল ড্রাইভে আপলোড করা, যা ইন্টারনেট ছাড়া পাওয়া যাবে না। আবার ইন্টারনেটকে বাঁচিয়ে রেখে যদি গুগল সার্চ বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলেও জীবন স্থবির হয়ে যাবে। যে কোন প্রবলেমের সমাধান বা ডিসকাশান কোন না-কোন ব্লগে বা ফোরামে ছড়িয়ে আছে, গুগল ঠিক খুঁজে খুঁজে বার করে দেয়। ব্রেন যেমন কোন কিছুর সূত্র ধরে ধরে মস্তিস্কের 'হিপোক্যাম্পাস' অঞ্চলের লুকোনো নানান জায়গা থেকে একগাদা হারিয়ে যাওয়া, relevant স্মৃতির ঝাঁককে নিমেষে খুঁজে এনে দেয়, গুগল সার্চও তাই-ই করে, সামান্য twist দিয়ে - mostly by building massive indices of stored data, which are also stored and searched through for relevant information based on the provided keywords - অর্থাৎ গোটা IT-জীবন যেন সেই দুই-নারীর (Bi-nary-র) আঁচলে আস্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। 

জীবনকে প্রভাবিত করার এতো ক্ষমতা বোধহয় অন্য কিছুর ওপর ঈশ্বর এখনো দেন নি। এটাও বোধহয় এক ধরণের ভালোবাসাই। ভাবের ভালোবাসা বেশিক্ষণ টিকে থাকে না। কিন্তু যে ভালোবাসায় নির্ভরশীলতা ঢুকে যায়, সেটা কাটানো বড়ো মুশকিল। ছোটবেলায় আমার একবার কঠিন জল-বসন্ত অসুখ হয়েছিলো। আমার প্রিয় এক বন্ধু তখন আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলো - কিন্তু আমার মা ঠিক রাত জেগে জেগে বসে থাকতেন আমার পাশে - দিনরাত সেবা করে যেতেন। কাজে-কর্মের ফেরে মায়ের যদি কখনো আসতে দেরী হতো, তখন কি বিরক্তি, রাগ আর অভিমান হতো আমার !! - ইন্টারনেট না থাকলে অভিমান অবশ্য এখনো পর্যন্ত হয় না, নিশ্চিত ভাবেই - কিন্তু রাগ বা বিরক্তি অবশ্যই হয় - অন্তত কিছু কিছু সময়ে তো বটেই। হয়তো আরও বছর কুড়ির মধ্যে যখন কম্পিউটারগুলো সব ডিজিটাল সিগন্যালের পরিবর্তে আমাদের ব্রেনের মতোই অ্যানালগ সিগন্যাল ব্যবহার শুরু করে দেবে, তখন হয়তো ঈশ্বর তাদের প্রতি অভিমানেরও জন্ম দেবেন মানুষের হৃদয়ে।

“গুরু, কি উপায় বলো না...”
অফিসে ঢুকে সবে মাত্র ডেস্কে বসেছি, এমন সময় পাশের কিউব থেকে আমার কলিগ বলে উঠলো: “হে: হে: - মেলটা দেখেছো তো!” - আমার জিজ্ঞাসু মুখ দেখে একটু বিরক্ত হয়ে সে বলে উঠলো, “আরে: ধ্যুস! কোম্পানি 'Voluntary Separation Program' চালু করেছে - কিস্যু খবর রাখো না, খোলো তোমার মেলবক্সটা !” - আমি একটু ভয় পেয়ে বলে উঠলাম "বলো কি হে!, আবারও চাকরি খুঁজতে হবে !" - সেজন্যেই বোধ হয় সকাল থেকে মনটা কু-ডাক দিচ্ছিলো, মাথার মধ্যে ব্যাটা বাউলিয়া ভাব ঘুরপাক খাচ্ছিলো: “কি উপায় বলো না, গুরু কি উপায় বলো না - তুমি সব খোলো, মন খোলো না...” - মেশিন অন করে ফিডেলিটির 401K-এর সাইটে ঢুকে দেখলাম, যা জমেছে সেখানে, তা বুদ্ধি করে সুদে খাটাতে পারলে ('সারদা' টাইপের নয়) বাকি জীবনটা তীর্থে-তীর্থে ঘুরে-ফিরে আমার একার কোনোমতে চলে যাবে। কিন্তু ছেলের কলেজ এডুকেশন তা দিয়ে সামলানো যাবে না। মাথার মধ্যে 'কু-বুদ্ধি' ফিচকেমি করে বললো: 'কলেজ মেটেরিয়াল যদি সে না হয়ে ওঠে, তবে?' - ভেবে দেখলাম কথা সত্য, ভবিষ্যতে কি হবে তা কে-উ জানে না। বামেদের কেন্নো-লাল দুর্গ পর্যন্ত দিদির পাল্লায় পড়ে সব সবুজ হয়ে যাচ্ছে, তো আমার ছেলে !! অগত্যা বাস্তবে ফিরে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, “তা নিয়ম কানুন কিছু জানো? মানে কতো বছর কাজ করলে তবে VSP-তে এলিজিবল হওয়া যাবে, বা কতো টাকা একসাথে পাওয়া যাবে, এসব কিছু?” - কলিগ বিরক্ত হয়ে বললে: “তোমার দরকার পড়ে, তো তুমি খোঁজ নিয়ে দ্যাখো গিয়ে !” - কিছুক্ষণ এটা সেটা কাজ করার চেষ্টা করলাম - কিন্তু মন বসলো না। ঠিক করলাম, 'নাহ: ভালো করে খবর নেওয়া দরকার' - দিলাম কুটুস করে একটা মাউস-ক্লিক VSP-র লিঙ্কটাতে। একের পর এক এক পেজ আসতে থাকলো - গুচ্ছের ইনফরমেশন দিয়ে চলেছি - আমার আইডি, আমার ম্যানেজারের আইডি, কবে জয়েন করেছি, কেন জয়েন করেছি, কোথায় কাজ করি, কি কাজ করি, কেন কাজ করি, কাজ করি তার প্রমাণ কি, হাবিজাবি যত্তোসব। তারপর দেখি মাউস-কার্সার বঁ-বঁ করে ঘুরেই চলেছে - যেন 'ঢুঁড়তে রহে যাও গে'-এর বিজ্ঞাপন। তারপর সব শুন্য, অর্থাৎ '404 Error' পেজ। বাধ্য হয়ে আবার গম্ভীর ভাবে কাজকর্ম করার ভাব দেখানো শুরু করলাম। কিছুক্ষণ বাদে এলো আবার আরেকখানা ইমেল - বক্তব্য: এত লোক একসাথে VSP-র ওয়েবসাইটে ঢোকার চেষ্টা করেছে যে সেটাই ডাউন হযে গেছে !! মেলের শেষদিকে আবার তির্যক ব্যঙ্গ: “কাজ করার থেকে কাজ ছাড়ার জন্যে আমাদের বড়ো বেশী উৎসাহ !! হে: হে: - যে লিখেছে সে ব্যাটা রসিক আছে - তারপর দেখি দাঁত কেলিয়ে আশে-পাশের জনতা সবাই জানালো যে তারাও একটু-আধটু VSP-র খোঁজ খবর নিচ্ছিলো, আমার মতো করেই। যাই হোক মামলার নিষ্পত্তি তো হলো না - অগত্যা শুরু হলো ফ্লোরে ঝাঁকে ঝাঁকে জটলা। উপায়ান্তর না দেখে ম্যানেজার উপরওয়ালাকে কুঁক কুঁক করে ফোন করে কি সব যেন বললো - তারপর ফ্যাচ-ফ্যাচ করে হাসতে হাসতে এসে জানালো যে: “যে-সমস্ত 'গুরুতর ডিপার্টমেন্ট' এই VSP-র আওতায় পড়বে না, তাদের মধ্যে আমরা আছি একদম শুরুর দিকে !!” ব্যাস! হয়ে গেলো ! দিলো শীতের রাতে প্যান্টের মধ্যে এককাঁড়ি বরফজল ঢেলে !! এখন যাও, খোলো গিয়ে JIRA-র ওয়েবসাইট - ধরো আর এক একটা করে Bug ফিক্স করো - ব্যাটারা, সব শ্রমিকের দল কোথাকার !!!


মনের মধ্যে বাউলিয়া ভাব আবার ছলকে উঠে গুনগুনালো: “গুরু কি উপায় বলো না - তুমি সব খোলো, মন খোলো না... ভেবেছিলাম সঙ্গে যাবো, সঙ্গে নেবে, সঙ্গ পাবো... সং সেজে কাটলো বেলা, সংগতে আর হলো না... গুরু, কি উপায় বলো না...


"একেই তো এই জীবন ভরে কাজের বোঝা-ই জমে..."
মান্না দে-র আধুনিক গান সেই সুদূর ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি - কিন্তু কেন জানি মনে তেমন করে দাগ কাটেনি, যতোটা কাটতে পেরেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা এমন কি কিছুটা কিশোর কুমারও। অজান্তে মান্না দে সেটা বোধহয় টের পেয়েছিলেন, তাই তিনি অপেক্ষায় রইলেন। এরপর এলো একদিন সেই সময়! সেই সময়, যখন সবাই প্রথম প্রেমে পড়ে, আর নিজের হাতের মুঠোয় করে হৃদয়টা নিয়ে হাঁটে। যখন প্রথমবারের মতো জানতে পারে এই পৃথিবীটা কত নিষ্ঠুর! বাঙালির ছেলে জীবনে প্রেমে পড়ে ছ্যাঁকা খায় নি, এটা ডাঁহা মিথ্যে ছাড়া কেউ মেনে নেবে না। জন্ম-মৃত্যুর মতো এটাও এক অমোঘ সত্য। সেই কঠিন সত্যের সাথে আমারও একদিন চেনাজানা হলো। দিব্যি হাসিখুশি এতদিনের সহজ-সরল মনটা "হায় চিল, সোনালি ডানার চিল" বলে হা-হুতাশ শুরু করলো। ছ্যাঁকা খাওয়ার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে দাড়ি রাখার চেষ্টা চালু হলো। বয়স অল্প থাকার জন্যে সেটাতে ফেল মেরে যাওয়ায়, 'নেক্সট বেস্ট থিং' হিসেবে করুণ মুখে মান্না দে-র বিরহী সব গান শোনা শুরু হলো। সেই প্রথম মান্না দে তাঁর অসামান্য ক্ষমতা নিয়ে এসে হাজির হলেন। তাঁর একেকটি গান আমার দুখী মনে সুখের প্রশান্তি না আনলেও কেন জানি মনে হতে লাগলো, আর কেউ না বুঝুক এই লোকটা আমার দুঃখ কিছুটা হলেও অন্তত বুঝতে পেরেছে! আমার সেই ম্রিয়মান অবস্থার উন্নয়নে বাড়িতে আমার দাদা এগিয়ে এলেন, আর মাঝে মাঝেই বাঙালি যুব সমাজের অবক্ষয়ের পিছনে মান্না দের সুপরিকল্পিত অবদান নিয়ে জ্ঞান প্রদান করে চললেন। সেই থেকে হলো শুরু... তারপর যতোবার প্রেমে পড়েছি, আর যতোবার 'পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যারা রূপ নিয়ে দূরে চলে গেছে', ততবারই আমি নতমুখে ফিরে এসেছি মান্না দে-র কাছে। সস্নেহে তিনি রেখেছেন আমার কাঁধে হাত, আর কানের কাছে এসে তাঁর গভীর মায়া জড়ানো কন্ঠে বলে গেছেন, "আজ পৃথিবীর ভালোবাসার সময়ই গেছে কমে..."

অপারেশান 'Granodiorite'...
আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টোদিকের প্রতিবেশীটির ছেলেটি আমারই সমবয়সী ছিলো, আর আমার সাথেই এক স্কুলে পড়তো। বহু ব্যাপারে আমাদের মধ্যে অনেক মিল ছিলো - একই ধরণের জীবনযাত্রা, একসাথে স্কুলে যাওয়া - সাইকেল নিয়ে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো, একই ধরণের খেলাধুলা, গল্পের বই পড়া - একই সাথে প্রেমে পড়া, মায় যতদুর মনে পড়ে একই মেয়েরও প্রেমে পড়া !! কিন্তু আশ্চর্য্যের কথাটা হলো, আমরা ক্লাস নাইন-এ ওঠার আগে অবধি নিজেদের মধ্যে কোনো কথা বলিনি। দুজন দুজনকে ভালোমতো এড়িয়ে চলতাম। এমন কি স্কুলেও মাঝেমাঝে হাতাহাতি শুরু করে দিতাম। শুধু তাই নয় ওদের বাড়ির যেকোনো কারুরই সাথে আমাদের বাড়ির যেকোন লোকের কথাবার্তা প্রায় নিষিদ্ধ ছিলো। দুই বাড়ির মধ্যে বেশ কয়েকবার তুমুল ঝগড়াও হয়েছিলো। এখন ব্যাপারগুলো মনে করলে খুবই তুচ্ছ আর ছেলেমানুষী বলে মনে হয়, কিন্তু আসল কারনটা ছিলো স্রেফ 'রাজনীতি' - যাকে বলে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, আর উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ওরা ছিলো কঠোর বামপন্থী, অর্থাৎ কাঠ-সিপিএম, এদেশীয় হওয়া স্বত্তেও। অন্যদিকে আমাদের বাড়ি ছিল ঘোর কংগ্রেসী মতবাদে বিশ্বাসী। তার উপর আমার পিতৃদেব স্বাধীনতোত্তোর যুগে নানান ধরনের কংগ্রেসীভাবাপন্ন সামাজিক কাজকর্মে লিপ্ত ছিলেন। 'সমাজ সেবাদল' বলে এক ক্লাবও চালু করেছিলেন যেটা বেশ কয়েক বছর ধরেই চলেছিলো। ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে, স্বাধীনতার পর সর্বপ্রথম যখন কংগ্রেসের (ইন্দিরা গান্ধী) ভরাডুবি হলো, তখন তাদের উল্লাসে ফেটে পড়ে, সবাইকে ডেকে ডেকে মিষ্টি খাওয়ানো ছিলো দেখার মতো - as if তারাই যেন ভোটে দাঁড়িয়েছিলো!!

সে যাই হোক পরবর্তীকালে দেখা গেলো আমাদের দুজনের মধ্যে এতোদিনের রেষারেষি, আর বাড়ি-তুতো ঝগড়া-ঝাঁটির মাঝেও কোথায় যেন একটা টানও লুকিয়ে ছিলো। এজন্যেই হয়তো বলে love and hate are two sides of the same coin - ধীরে ধীরে দুই বাড়ির মধ্যে যাওয়া-আসা শুরু হলো। ক্রমশ: জানা গেলো যে ওদের বাড়ির অনেক কিছুই আমাদের বাড়ির দ্বারা দৃশ্যত: প্রভাবিত। অর্থাৎ দুই বাড়িও যেন একে-অপরকে চোরা-টানায় পছন্দ করে চলেছিলো ! কিন্তু পলিটিক্সের মতো অতি সেনসিটিভ বিষয়টিকে আমরা রাস্তায় পড়ে থাকা বর্জ্য পদার্থ জ্ঞানে সযত্নে এড়িয়ে এড়িয়ে চলতাম। শিক্ষাজীবনের পরবর্তী পর্যায়ে আমরা দুজনে ভিন্ন ভিন্ন পথে চলে গেলেও আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ত্ব বেশ কিছুদিন continue করলো। আমার ঠিক ওপরের দাদা ছিলেন geologist - অনেকটা সেই কারণেই geology নিয়ে পড়াশোনায় তার বাড়ি থেকে তাকে এনকারেজ করা হলো। তো আড্ডা মারার সাথে সাথে, ছোটদার কাছ থেকে geology-র বই আর নোটসের জন্যেও সে মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ি চলে আসতো। এরকমই এক ছুটির দিনে আমি তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়ে নানান গল্প করে চলেছি, হঠাৎই চোখে পড়লো এক অন্যরকমের পাথর তার বুক-শেল্ফে পড়ে রয়েছে। সেসময় ছোটদার দৌলতে আমাদের বাড়িতেও আমি নানান রকমের জিওলজিক্যাল পাথর দেখেছি - কিন্তু এটা দেখতে যেন কিছুটা অন্যরকমের। নাম জিজ্ঞাসা করে জানলাম সেটার নাম নাকি 'Granodiorite', আর সেটা এসেছে তার কলেজের ল্যাবরেটরি থেকেই। আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, দেখে বেশ দুষ্প্রাপ্য বলেই মনে হচ্ছে, তো আনলি কি করে? ল্যাবে তো সব সময়ই কোন না কোন স্যার, বা ল্যাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ঘোরাফেরা করে। সে বললো, "হ্যাঁ, সে তো ছিলোই" - আমি আরও অবাক হয়ে গেলাম, কারণ সামান্য একটা এডুকেশন্যাল পাথরের জন্যে কেউ রিস্ক নিয়ে চুরি করতে যাবে না। তো সে বললো, যে এটাকে ঠিক চুরি করা বলে না - বরং পলিটিক্যাল পদ্ধতিতে পাথরটাকে সে অপহরণ করে এনেছে। অপহরণের কথা শোনামাত্রই আমি বেশ নড়েচড়ে বসলাম। সে বলে চললো, "পাথরটা হাতে নিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলতে লাগলাম যে 'এটা আমি নিয়ে যাচ্ছি কিন্তু... নিয়ে যাচ্ছি কিন্তু... নিয়ে যাচ্ছি কিন্তু...' - সবাই ভাবলো যে আমি মজা করে বলে চলেছি, তাই কেউ তেমন কোনো গুরুত্ত্ব দিলো না। আল্টিমেটলি খেয়াল করলাম যে আমি পাথরটা হাতে নিয়ে অলরেডী কখন ল্যাবের বাইরে চলে এসেছি। অগত্যা, এদিক ওদিক দেখে স্মার্টলি সেটা ব্যাগে পুরে নিয়ে বাড়ি চলে এলাম - প্লেন অ্যান্ড সিম্পল !!" আমি বললাম সে কি রে !! এরকম তো হয় জানি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্পে আর কমার্শিয়াল হিন্দী ফিল্মে। জবাবে সে বললো, কেন? আমাদের দেশের পলিটিশিয়ানরা তো এরকম হামেশাই করে - বরং কে করে-না সেটাই আসল প্রশ্ন! - আর আমি করলেই যতো দোষ !! 


সেই প্রথম আমি রাজনীতির মতো একটা জটিল, কনফ্লিক্টিং বিষয়ে তার সাথে একমত হলাম। তারপর ফেলুদার সিধু জ্যাঠার মতো করেই করমর্দনের জন্যে দিলাম হাত বাড়িয়ে - নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে উঠলাম, "বা:হ, বা:হ - দেখি তোমার আঙুলগুলো - জিতে রহো বাচ্চে !! "


The ইটালিয়ান সেলুন !

বাবা বলতেন 'ভীম নাপিতের দোকান', পিসিমা বলতেন 'ভীমে নাপ্তের দোকান', আর আমরা বলতাম 'ইটালিয়ান সেলুন' - ছবি দেখে নিশ্চয় পরিষ্কার যে এখানে 'ইটালিয়ান' কথাটা 'ইট' থেকে এসেছে, খোদ 'ইতালি' থেকে কদাপি নয়। অর্থাৎ রোড সাইডে ইটের উপর বসে, সস্তায় চুল-দাড়ি কাটার দোকান। 

ভীম নাপিত খুব সম্ভবত এসেছিলো বিহার থেকে - মুখে সবসময় খৈনী পোরা থাকতো, চোখ গুলো ছিলো লালচে টাইপের। নিজে নাপিত হওয়া স্বত্তেও তার নিজের তোবড়ানো মুখটা ভর্তি থাকতো একগাদা কাঁচা-পাকা দাড়িতে। বাবার সাথে তার কিভাবে আলাপ পরিচয় ঘটেছিলো, তা ভগবানই জানেন, তবে বাবাকে সে অসম্ভব রকমের শ্রদ্ধা করতো। আমরা গেলেই সে বাকি সবাইকে ফেলে আমাদের চুল কাটতে বসে যেতো। অন্য কারোর ওজর-আপত্তি কানেই তুলতো না। আমার ক্লাস সেভেন-এইট অবধি সেইই ছিলো আমাদের ফ্যামিলির 'de facto' নাপিত। একটা বহু পুরানো, মরচে-লাল প্লাস্টিকের জলের বোতল, একটা ক্ষুর, একটা কালো চিরুনি, দুটি কাঁচি, দেড়-হাতি ময়লা একখানা গামছা, সস্তার গোল, গোলাপী একটা সাবান, একটা খোঁচা খোঁচা সেভিং ব্রাশ, একটা স্টীলের তোবড়ানো বাটি, স্ট্যান্ড ভাঙ্গা পারা-ওঠা এক আয়না, গন্ধহীন সাদা পাউডারের ডিব্বা এবং একটি ফিটকিরি। আর ছিলো একটা পিতলের হ্যান্ড-অপারেটেড ট্রিমার, যেটা দিয়ে ক্যাটা-ক্যাটা করে সে ঘাড়ের চুলগুলো যেন প্রায় সজোরে উবড়ে নিতো। 


চুল কাটতে লাগতো মনে হয় এক টাকা, দাড়ি কামাতে চল্লিশ পয়সা। তবে চুলের সাথে যদি দাড়িও কামানো হয়, তাহলে রেট কিছুটা শুধু কমে যেতোই নয়, মিনিট পাঁচেকের মালিশ’ও ফ্রী পাওয়া যেতো। সুতরাং এমন লোভনীয় অফার ফেলে যদি কেউ নামজাদা সেলুনে চুল-দাড়ি সমেত নিজের পকেটটি কাটাতে ঢোকে, তাহলে বুঝতে হবে সে হচ্ছে নিতান্তই একটা ইয়ে। চুল কাটা নিয়ে কোন অভিযোগ বা নির্দেশ ভীম নাপিত বরদাস্ত করতো না। সে যেটা ভালো বুঝে কাটতো, সেটাই খরিদ্দারকে খুশি মনে মেনে নিতে হতো। মুখভর্তি খৈনী থাকার দরুণ অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা সে একদমই পছন্দ করতো না। শুধু তাকে বলে দিতে হতো যে মাথা কামাবে, না চুল কাটবে - ব্যাস এই টুকুই। চুল কাটার মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে, সে সামনে বসে থাকা ব্যক্তিটির ঘাড়টাকে নিচের দিকে বেঁকিয়ে এনে তার দু-হাঁটুর মাঝখানে ঢুকিয়ে দিয়ে জোর করে চেপে রাখতো - অন্তত মিনিট পাঁচেক তো বটেই। তারপর এক পৈশাচিক আনন্দে, দ্রুত গতিতে চালাতো তার ট্রিমারখানা। এই সময়টুকুই মনে হতো যেন অনন্তকাল - প্রায় দম বন্ধ করে মুক্তির অপেক্ষা করে থাকতাম আমরা। ধারহীন সেই ভোঁতা ট্রিমারের ঘাড়ের উপর ক্রমাগত ঘষটানি, নাকি তার পরনের ময়লা ধুতির দূর্গন্ধের সাথে নিজস্ব বিহারী-কোলভাগের বোঁটকা গন্ধের কম্বিনেশান, কোনটা যে বেশি পীড়াদায়ক ছিলো তা এখন বলা মুশকিল। সেজন্যে চুলকাটা শেষ হয়ে গেলে এক অপার্থিব আনন্দে মনটা যেতো ভরে। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেবার আনন্দ, প্লাস নেক্সট দু-মাস তার কোলভাগে মাথা না ঢোকানোর আনন্দ, সব মিলিয়ে-মিশে নাচতে নাচতে বাড়ির দিকে লাগাতাম দে -দৌড়। 



সেই ভীম নাপিতের দোকান আজ বহুকালই হলো আর নেই। Urbanization-এর দৌলতে সেই জায়গাটা এখন পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে হঠকারী অটো-রিক্সার দল। রাস্তা পার হতে গেলে আজকাল প্রাণ হাতে করে চলাফেরা করতে হয়। পচা নর্দমার দূর্গন্ধ, সঙ্গে কাটা-ডিজেলের তীব্র, কটু, পোড়া গন্ধ যখন আজকাল জোর করে নাকের মধ্যে ঢুকে যায় তখন মাঝে মাঝেই মনে পড়ে যায় ভীম নাপিতের সেলুনের কথা। ছোটবেলার সেই দূর্গন্ধের সাথে আজকের এই দূর্গন্ধের কোন তুলনাই হয় না। আমরা ক্রমশ: ভালোর দিকে যাচ্ছি না খারাপের দিকে, তা মাঝে মাঝেই গুলিয়ে যায়। এই pollution-এর হাত থেকে বাঁচতে আজকাল আমি হয়তো প্রতিদিনই সেই ভীম নাপিতের হাতে চুল কাটতে সানন্দে রাজি হয়ে যাবো !



"তেওড়া তালে শ্যামল মিত্র"

সঙ্গীত নিয়ে এককালে সামান্য চর্চা করতে গিয়ে জেনেছিলাম যে 'তেওড়া' তালের থেকে সোজা তাল আর কিছু হয় না - হতে পারে না। এমনকি 'দাদরা'-র (waltz) থেকেও সোজা তাল হলো তেওড়া। অথচ বিট-কনস্ট্রাকশানের দিক দিয়ে দেখলে এটার মাত্রা কিন্তু বিজোড় সংখ্যার, অর্থাৎ ৭ মাত্রার: ৩-২-২, তবলার বোল হলো: ধাধিনা, ধিনা, ধিনা। কিন্তু ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড এই odd beat-এর tempo-র সাথে তেমন পরিচিত নয়। এখনো পর্যন্ত তেওড়া তালে কোন ওয়েস্টার্ন pop, rock soul, jazz বা blues আমি শুনিনি। সিন্থেসাইজারেও তাই কখনো তেওড়া beat-এর tempo আমি খুঁজে পাই নি। সোজা বলেই হয়তো নামী-দামী সুরকাররা তেওড়া তালে খুব একটা সুর সৃষ্টি করতে চাইতেন না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ হাতে গোনা কিছু গানের সুর দিয়েছিলেন তেওড়া তালে। আধুনিক গানের জগতে সলিল চৌধুরীও এই তেওড়া তালকে তেমন পছন্দ করেন নি। যতদূর মনে পড়ে গোটা তিনেক আধুনিক গানের সুরে তিনি তেওড়া তাল ব্যবহার করেছিলেন - দুটির গায়িকা ছিলেন লতা মঙ্গেশকর আর আরেকটির গায়ক ছিলেন সাগর সেন। আরো কিছু গানেও হয়তো করেছিলেন, কিন্তু সেগুলো পপুলার হয়নি।


আমাদের বাড়ি ছোটবেলায় রাবীন্দ্রিক প্রভাবে ভালো মতো বিব্রত ছিলো। হিন্দী গান তো দুরের কথা, এমন কি কিশোরকুমার বা শ্রাবন্তীর বাংলা আধুনিক গানকেও পপ গান হিসাবে গন্য করা হতো। যার জন্যে রেডিওতে ছাড়া বাংলা আধুনিক গান শোনার সুযোগ খুব একটা হতো না। ১৯৭৭-এর পূজাতে, সে সময়কার ডাকসাইটে শিল্পী শ্যামল মিত্র, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় ও নিজের সুরে গান রেকর্ড করলেন: "জীবনে আজ তুমি নেই, তাই জীবনের কোনো দাম নেই" - এই গানে তিনি খুব সুন্দর ভাবে তেওড়া তালের ব্যবহার করেছিলেন। দেখতে অতি সাধারণ হবার মাশুল হিসেবে ঈশ্বর তাঁর গলায় অঝোরে ঢেলে দিয়েছিলেন সীমাহীন দরদ আর রোমান্টিসিজম। তো সেই বয়সে 'জীবনের দাম' বোঝার মতো বুদ্ধি বা মন কিছুই তৈরী হয় নি আমার, তবু গানটা শুনলেই মনের গহীনে থাকা দু:খ দু:খ ভাবগুলো যেন কেমন করে ফুলে ফেঁপে আরও বেড়ে উঠতো। বর্ষা ঝরা এক সন্ধ্যাবেলায়, রেডিওতে বেজে চলা গানের সাথে গলা মিলিয়ে, চোখ বুজে খুব কষে গেয়ে চলেছি এই গানটা। হঠাৎই বাবার এক ধমকে সম্বিৎ ফিরে এলো। তিনি ভৎসর্ণার সুরে বলে উঠলেন, "ছি: ছি:, কি সব গান শুনছো! হিন্দী ফিল্মের লোকেদের নামে সব ভর্তি !" - আমি সঙ্গে সঙ্গে গান থামিয়ে দিয়ে, চুপ করে থেকে তাঁর বক্তব্যটা বোঝার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। পরে একদিন খেয়াল করলাম যে সেদিনের সেই গানের মধ্যে কোন গন্ডগোল ছিলো না - বরং গন্ডগোলটা ছিল তাঁর বোঝার মধ্যে। কারণ গানের দ্বিতীয় অন্তরার কথাগুলো ছিলো এরকম: "নিভে আছে প্রদীপ, শুন্য যে দৃষ্টি - ফাগুন এলেই চোখে নামে বিনে মেঘেই বৃষ্টি। প্রেম আছে, পূজাও আছে প্রানেরই প্রণাম নেই - জীবনের কোন দাম নেই" - বোঝা গেলো যে তিনি নির্ঘাৎ সেদিন 'প্রেম', 'পূজা' আর 'প্রান'-এর কথা শুনে ভেবেছিলেন 'প্রেম চোপড়া', 'পূজা ভাট' আর ভিলেন 'প্রাণ'-এর কথা !! খামোকাই সেদিন আমাকে একগাদা বকুনি হজম করতে হয়েছিলো !!  


“ঘটি-গরম, ঘটি-গরম...”
ঘটি-গরম, চাই ঘটি-গরম....” - শুনলেই যেন জিভে জল চলে আসে, মন করে ওঠে আনচান-আনচান। আটের দশকের শেষ দিক পর্যন্তও সাধারণ বাঙালী মধ্যবিত্ত পরিবারে মেন বিনোদন বলতে ছিলো সপ্তাহান্তের, শনিবার এবং রবিবারের সন্ধ্যায় কলকাতা টিভি চ্যানেলে হওয়া বাংলা ও হিন্দী ছায়াছবি - যেখানে অবশ্যম্ভাবী ভাবে লোডশেডিং ছিলো বাঁধা-ধরা। শুধু, সন্ধ্যা সাড়ে-সাতটার বাংলা সংবাদের আগে হবে, না পরে - এটাই ছিলো আমাদের আশঙ্কামূলক প্রশ্ন। হিট ছায়াছবি থাকলে হতো “সোনায় সোহাগা !” - তখন শুধুমাত্র সন্ধ্যা সাড়ে-সাতটার, পনেরো মিনিটের বাংলা সংবাদটুকু দেখিয়েই আমাদের মহামান্য 'ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ড' (WBSEB) তার গুরুদায়িত্বটি শেষ করে দিতো! ভটভটি জেনেরাটারের বিজনেস তখনো চালু হয়নি, at least শহরতলীর দিকগুলোতে। সুতরাং লোডশেডিং হওয়ার সাথে সাথেই মায়ের, “ঐ যাহ:, শালারা আবার কারেন্ট অফ করে দিলো রে !!” আর্তনাদের সঙ্গে শুরু হতো আমাদের হ্যারিকেন, কিম্বা কেরোসিনের অভাবে বাতি জ্বালানোর প্রস্তুতি। তারপরেই শুরু হয়ে যেতো বৈঠকখানার লম্বা বিছানাটায় বসে নির্ভেজাল আড্ডা - কখনো সাপ-লুডো, কখনো শব্দছক, মাঝে সাঝে তিন-তাস, চোর-পুলিশ-দারোগা, কখনো বা আবার গল্পের বই থেকে গা-ছমছমে ভুতের বা রহস্য গল্প পড়ে পড়ে পিসিমাকে শোনানো - চলতো সেই ততক্ষণ, যতক্ষণ পর্যন্ত না বাংলা/হিন্দী ছায়াছবির শেষ হতো। তার পরে আমরা পড়াশুনার বই নিয়ে বোসতাম। আর এই লোডশেডিংয়ের সময়টুকুতে, প্রায় নিয়ম করেই, হাতে ঘন্টার বালা বাজিয়ে বাজিয়ে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁকে যেতো: “ঘটি-গরম, চাই ঘটি-গরম...” - হাঁড়ির আগুনে গরম করা ঝুরিভাজা, চানাচুর-এর মধ্যে ছোলা, বাদাম, মটর, পেয়াঁজ, নূন, লংকা, ধনেপাতা ও লেবুর রসের সলিড মিশেল, এককথায় ছিলো লা-জবাব - অপূর্ব ছিলো তার সেই স্বাদ। সে 'ঘটি-গরম'-এর ক্ষমতা ছিলো এতোটাই সুদূরপ্রসারী, যে মাঝে মাঝে আমরা যেন “কখন লোডশেডিং হবে”, তারই প্রতিক্ষায় বসে থাকতাম !! সিনেমা দেখা হয়ে উঠতো একটা গৌণ ব্যাপার...

পোকিম্যানের টি-শার্ট পরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সে 'ঘটি-গরম'-এর মর্ম বুঝলো না। সাধে কি বলে, “বাঙালী আত্মবিস্মৃত জাতি !! আত্মঘাতী বাঙালী !!










“চা-বিস্কুট”
আমরা বাঙালীরা কেউ কেউ 'ইসবগুলিস্ট', আবার কেউ বা 'জেলুসিলিস্ট' - তেমনি আবার কেউ ভালবাসি আলুর-চপ, কেউ বা আবার সিঙারা - But everyone will agree after সিঙারা or আলুর চপ, next stop is always চা-বিস্কুট....


“ক্রিসমাসে ফেলুদারা...”
লালমোহন: আচ্ছা ফেলুবাবু, 'প্রেম' ব্যাপারটা আপনাকে কখনও ইনট্রিগ করেনি ? একটু ঝেড়ে কাশুন না মশাই !
ফেলুদা (স্মিত হেসে): কেমিস্ট্রিতে একটা মিস্ট্রি রয়েছে, সেটা কখনো খেয়াল করেছেন কি ?
লালমোহন: আরি-ব্বাস! দারুণ দিলেন তো ! দাঁড়ান, দাঁড়ান - নোটবুকে এট্টু এন্ট্রি করে নিই এটার !!
....
লালমোহন: তো বলছিলাম কি, চলুন না, শুভ সান্টা-বিজয়ার কোলাকুলিস-টা সেরে নিয়ে, একটু বাইরে কোথাও থেকে ডিনারটা সেরে আসি !
ফেলুদা: এই ভর-সন্ধ্যায় যাবেনটা কোথায়? 
লালমোহন: ক্যানো, পার্ক স্ট্রীটের দিকে? হরিপদ তো রেডিই আছে। আপনি বললেই হাঁক দিয়ে দিই ! 
ফেলুদা: পার্ক স্ট্রীটের মূল সমস্যাটা কি আপনি জানেন? - “গেটিং এ পার্কিং স্পেস দেয়ার !!”
লালমোহন: হুমম... তা, ভালো বলেছেন... “পিটার-ক্যাটে বসি ছাড়ি দীর্ঘশ্বাস, 'মোকাম্বো'-তে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস...
...
লালমোহন: আচ্ছা ফেলুবাবু, আপনার কি মনে হয় ট্যাগোরের লেখা অনেক গানের মধ্যে তাঁর শরীরের নানান অসুখ-বিসুখের কথা লুকিয়ে আছে? 
ফেলুদা: কেন, আপনার কি তাইই মনে হচ্ছে আজকাল?
লালমোহন: ইয়ে, মানে, ঠিক তা' নয় - কিন্তু ধরুন গিয়ে প্রেম পর্যায়ের ওই গানটা: “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি, তোমায় দেখতে আমি পাইনি”, কিম্বা পূজা পর্যায়ের সেই সে গানটা: “আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে, দোলাও দোলাও, দোলাও আমার হৃদয়...” - শুনলেই কেন জানি মনে হয় ট্যাগোর তাঁর শরীরের প্রেশার আর কোলেস্টেরল অসুখের কথাটাই সুক্ষ ভাবে বলতে চেয়েছিলেন...
ফেলুদা: মানে, ঠিক যেমনটা আপনার লেখা রহস্য উপন্যাসের হীরো 'প্রখর রুদ্র' বলে থাকেন, আর কি !!
লালমোহন (with a modest smile): হেঁ, হেঁ, হেঁ - কি যে বলেন ! তবে কিন্তু ঠিকই ধরেছেন... ওই বোধহয় তপেশ ভায়া ফিরে এলো। চলুন, এবার তাহলে উঠে পড়ি - ভিক্টোরিয়ার 'দিলখোস' রেস্তরাঁর কেবিনে গিয়ে চটাপট কয়েকটা মাটন-কাটলেট আর ফিশ-ফ্রাই ফিনিশ করে আসি। 
ফেলুদা (আড়মোড়া ভেঙ্গে): বলছেন? আচ্ছা, চলুন যাওয়া যাক তাহলে...

লালমোহন(যেতে যেতে): 'সাকসেস' কাকে বলে জানেন? সাকসেস হলো গিয়ে “moving from one cutlet to another without stopping for digestives” - হে: হে:, ভাবছি এবছর পূজায় আমার নতুন বইয়ের সাথে সাথে একটা ফ্যান্টাস্টিক, নতুন ব্র্যান্ডের অ্যান্টাসিডও বাজারে লন্চ করে দেবো !! নামও ঠিক করে রেখেছি: “Fantacid” - জম্পেশ হবে - কি বলেন?

Friday, October 18, 2013

তোতলামি আর টলা-দা

তার আসল নাম যে কি ছিলো তা এখন ভুলে গেছি - বয়সে কিছুটা বড়ো ছিলো - সবাই ডাকতো 'টলা' বলে। তাই শুনে শুনে আমরাও বলতাম 'টলা-দা '। খুব সম্ভবত হাইটে বেশ কিছুটা লম্বা হবার দরুণই তার এরকম নাম হয়ে গেছিলো। তো সেই টলা-দার সাথে আমার প্রথম পরিচয় খেলার মাঠে। স্কুলে ইন্টার-ক্লাস ফুটবল লীগ চলছে। সে বছর সবাইই খুব সিরিয়াস - এমন কি স্যারেরাও পর্যন্ত মাঝেসাঝে মাঠে এসে খেলা দেখছেন। নিজের ক্লাসের ফুটবল টিমে চান্স না পেলেও মোটিভেশন বাড়ানোর জন্যে টিমের সাথে সাথে আমরা সবসময়ই মাছির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। এরকমই এক দিন আমাদের উপরের দুই ক্লাসের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক খেলা চলেছে। আমরা যথারীতি মাঠের ধারে বসে গলা ফাঠিয়ে  চলেছি যে টিম জিতলে আমাদের নিজের ক্লাসের সুবিধা হয়, তার হয়ে।


খেলা শেষ হতে তখন আর মিনিট পনেরো বাকি - এখনও পর্যন্ত কেউ কোনও গোল দিতে পারেনি। খেলা ড্র হয়ে গেলে আমাদের ক্লাসেরই লাভ হবে, তাই আমরা মোটামুটি খোশ মেজাজেই আছি। কিন্তু বিধি বাম - খেলা শেষ হবার কিছু আগে হঠাৎ করেই ফরোয়ার্ডে খেলা একজনের পায়ের মাসলে লেগে গেলো খিঁচ - একটা সাবস্টিটিউশানের দরকার। দেখতে পেলাম লম্বা মতন একটা ছেলে খুব কষে, কায়দা করে করে ওয়ার্ম-আপ শুরু করে দিয়েছে - বুঝলাম সেইই মাঠে নামবে এবার। নাম জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম তার নাম নাকি  'টলা' - তবে পুরো নাম কেউই বলতে পারলো না। ভাবলাম ভালোই তো - বেশ লম্বা আছে, কর্ণার থেকে যদি হেড করে একটা গোল করে ফেলতে পারে তো পোয়া-বারো ! কিন্তু ও মা! কোথায় কি! টলা-দা দেখি লম্বা লম্বা পায়ে খালি টেরে-বেঁকে দৌড়েই বেড়াচ্ছে - বল পজেশান-এর কোনো সেন্স-ই নেই। এমন কি সোজা সোজা বল রিসিভ করতে গিয়েও অপোন্যান্টের পায়ে তুলে দিচ্ছে। এমনিতেই বৃষ্টিতে ভেজা মাঠ পিচ্ছিল হয়ে আছে, তার ওপরে টলা-দা ছুটতে গিয়েও আছাড় খেয়ে খেয়ে মাঠে হাসির রোল তুলে দিলো। এদিকে না-জানি কেন আমাদের টেনশান হতে শুরু  করে দিয়েছে - শেষ মিনিট দশেকই যেন অনন্তকাল বলে মনে হতে লাগলো। বিপক্ষ টিম হঠাৎই যেন তেড়েফুঁড়ে খেলা শুরু করেছে - আমরা রেফারির বাপ-বাপান্ত শুরু করে দিয়েছি - কেন সে খেলা শেষের হুইসিল বাজাচ্ছে না !

 

অন্তিম মুহুর্তের দিকে খেলা চলে এসেছে - পেনাল্টি বক্সের সামনে এবার একটা লুজ বল এসেছে।  টলা-দা গোলের দিকে পিছন করে বলটা ভালোই ব্লক করেছে - আমরা তারস্বরে চেঁচাচ্ছি 'মার, মার - মেরে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দে...' এমন সময় বিপক্ষ টিমের স্টপার, বিজেন মুখ দিয়ে 'এইই... টলা... এদিকে, হুসস, হুসস...' করে শিস দিয়ে ইশারা করতেই দেখি টলা-দা কোনদিকে না-দেখেই টুক করে বেমালুম বলটা বাঁ-দিকে পাস দিয়ে দিলো। আমরা তো 'থ' হয়ে গেছি। আর যায় কোথায়, বিজেন ব্যাটাচ্ছেলে দাঁড়িয়ে ছিলো ফাঁকায় সেকেন্ড পোস্টের দিকে - কিন্তু গোলকীপার তখন ফার্স্ট পোস্টের দিকে রয়েছে। বল পাওয়া মাত্রই বিজেন চোখের পলকে সজোরে মারলো, যাকে বলে এক গোলা শট। গোলকীপারকে নড়াচড়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ না-দিয়েই বল চলে গেলো গোলপোস্টের মধ্যে দিয়ে একেবারে সোজা মাঠের বাইরে। ভাগ্যিস গোলপোস্টে কোনো জাল লাগানো ছিলো না - থাকলে নির্ঘাৎ ছিঁড়ে যেতো ! 


ঘটনার ঘনঘটায় আমাদের সকলের মুখ বাস্তবিকই 'হাঁ' হয়ে গেছে - শোকে-দুঃখে পাথর, কথা বলার অবস্থাটুকুও যেন কারোর নেই। বল কুড়িয়ে এনে সেন্টার হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই রেফারির শয়তানি হুইসিল বেজে উঠলো। যাহ: খেলা শেষ ! এবং স্কোরলাইন ০-১ !! ঠিক যে ভয়টা করেছিলাম, সেইটাই হলো। মাঠের অন্যদিকে তখন টলা-কে ঘিরেই একটা জটলা শুরু হয়ে গেছে। তার নিজের টিমের প্লেয়াররাই তাকে নিয়ে তখন তুলোধোনা শুরু করে দিয়েছে। আমরা সবাই দৌড়ে গেলাম - শুনতে পেলাম টলা-দার খ্যাঁকারী কন্ঠস্বর: 'আররে! আমায় শুধু শুধু মা-মারলে হবে? আ-আ-আম্মি, কি-কি-ক্করে বুজজজবো যে, শা-শালা  বি-বিজেনটাই শিস দিয়েছে...'। দুঃখের মধ্যেও হাসি চলে এলো - বুঝলাম টলা-দা আদপেই হলো গিয়ে একটি খাঁটি রত্ন - তোতলামিও রয়েছে তার  মধ্যে !!


এই টলা-দাই বেশ কয়েকবার পরীক্ষায় গাড্ডা মারার পর অবশেষে আমাদের সাথেই ক্লাস শুরু করলো - দেখলাম কোনও দিকে কোন গুণ না-থাকা স্বত্তেও একজন মানুষকে অন্যেরা কতোটা পছন্দ করতে পারে। এটাকেই কি তা'হলে  বলে 'base less ভালো-লাগা'? শক্ত হোক, সোজা হোক, যে কোন কাজেই টলা-দা এক কথায় রাজি, যদিও ততোদিনে আমরা সবাই জেনে গেছি যে নেহাৎ উপায় না থাকলে ওকে কোন কাজ দেওয়া উচিত নয়,  তা সে যতো সোজা কাজই হোক না কেন! কিন্তু আবার টলা-দা ছাড়া কোন কিছুই তেমন জমে ওঠে না! বিশেষ করে উত্তেজিত হয়ে গেলে তার তোতলামির মাত্রা  যেতো বহু গুণে বেড়ে, আর সেটা  যে কোন ঘটনার seriousness বা টেনশান, মুহুর্তের মধ্যে লঘু করে দিতো - ঠিক যেমন ব্লটিং পেপার জল শুষে নেয়। অগত্যা আমাদের সকল অভিযানেই টলা-দা রইলো জড়িয়ে  - অনেকটা পাঁচমেশালী তরকারির 'বেগুনের' মতো হয়ে !

 

আলাপ পরিচয় ক্রমশ বেড়ে উঠলে জানতে পারলাম যে টলা-দা হলো পরিবারের এক মাত্র ছেলে, যাকে বলে বংশের প্রদীপ - বড়ো এক দিদি আছেন, তাঁর বিয়ে হয়ে গেছে৷ গ্রামের বাড়িতে সম্পত্তির পরিমাণ বেশ ভালোই৷ বাস্তু-ভিটে, বড়ো দুই পুকুর, ধানী-জমি, বাগান-বাড়ি, প্রায় খান-শয়েক সুপারি আর নারকেল গাছ - সব যোগ করলে আয় মন্দ নয়৷ গোঁত্তা খেতে খেতে বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় স্কুলের গন্ডী  কোনভাবে পার করার পর টলা-দার বাবা তাকে আদেশ দিলেন পারিবারিক সম্পত্তির দেখাশুনার। এর সাথে টলা-দাকে ব্যবসায় নামতে হবে, চিংড়ি মাছের ভেড়ির ব্যবসা৷ টলা-দা তখন নব্য যুবক, আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গায়ে। মাঝে মাঝেই হেঁড়ে গলায় কিশোরকুমারের "আর তো নেই বেশি দিন, মিলবো এবার দু'জনে..." গেয়ে উঠছে। খুব ইচ্ছে কলকাতায় থেকে একটা চাকরি, আর কোন একটা মেয়ের সাথে সাচ্চা প্রেম করার !  কিন্তু দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাবা বা জ্যেঠুর সামনে মুখ খোলার দু:সাহস নেই৷ তাই অনিচ্ছাসত্বেও সে মাছের ব্যবসাতেই মনোনিবেশ করলো৷ গোল বাঁধলো কিয়ৎকাল পরে যখন তার জ্যেঠু হুকুম দিলেন বিয়ের পিঁড়িতে বসার৷ টলা-দা পুরোপুরি বেঁকে বসলো - সে কিছুতেই বিয়ে করবেনা অ্যাতো কম বয়সে৷ এমন নয় যে সে অন্য কাউকে কথা দিয়ে রেখেছে, তবু সে মেয়ে-দেখে কিছুতেই "অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ" করতে পারবে না৷ অন্যদিকে তার বাবা-জ্যেঠুরাও অনড় - মেয়ের বাড়ি গিয়ে তাঁরা ততদিনে মেয়ে দেখে-শুনে  প্রাথমিক কথাবার্তা সেরে রেখে এসেছেন - অর্থাৎ জল অনেকদূরই গেছে গড়িয়ে, এখন সহসা বেঁকে বসলে ঘোর প্রেস্টিজ ইস্যু৷ অগত্যা মাঠে নামলেন টলা-দার মা ও জ্যেঠিমা। তাঁরা অনেক কষ্ট করে টলা-দাকে কোনওভাবে রাজি করালেন, বললেন: "অন্তত: একটিবার যা,  গিয়ে মেয়েটাকে দেখে আয়... তারপর না'হয়..." - গোঁজ হয়ে টলা-দা শেষমেষ রাজি হলো যেতে। 

বিজয়া দশমীর পরের সপ্তাহে, এক রবিবারের দুপুরে মেয়ে দেখতে যাওয়া স্থির হলো৷ ঠিক হলো আমরাও, মানে তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধুরা মিলে এক সাথে যাবো মেয়ের বাড়ি অবধি কাছাকাছি গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে আমরা কোনো একটা দোকানে অপেক্ষা করবো তারপর টলা-দার  মেয়ে দেখা শেষ হলে আবার সবাই মিলে হৈচৈ করতে করতে যেমন এসেছিলাম তেমন ফিরে আসবো। এতে টলা-দার মনখারাপ ভাবটা কিছুটা কমবে। তো সেইমতো দুটো গাড়ি ঠিক করা হলো - একটাতে টলা-দা আর তার জামাইবাবু আমাদের সাথে উঠে বসলেন - আর অন্য গাড়িতে চললেন টলা-দার পরিবারের বয়ঃজ্যেষ্ঠরা ৷ গাড়িতে উঠেই শুরু হলো টলাদার গজগজানি, আর তার সাথে যোগ হলো তোতলামো: "আমার প-প-প্রবলেম টা তোরা কেউই বু-বু-বুঝছিস না৷ আমি এখন কি-কি-কিচচচুতেই ব্যে ক-করবো না..." এই একই কথা বলে চললো ফাটা রেকর্ডের মতো৷ মাঝরাস্তায় গাড়ি থামলো চা-সিগারেটের জন্য। আমি আর তার জামাইবাবু তাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গিয়ে বোঝালাম, "শোন, জ্যেঠুদের সাথে বাওয়ালী করে কোনও লাভ নেই - বেয়াড়া পাবলিক - কায়দা করে সব সামলাতে হবে৷ তুই স্মার্টলি যাবি - ঘ্যাম নিয়ে মেয়ে দেখবি - যা যা খাবার দেবে সবকিছু  খেয়েদেয়ে স্মার্টলি চলে আসবি, আর ফিরে এসে বলবি যে মেয়ে তোর পছন্দ হয় নি৷ ব্যাস, হয়ে গেলো - খেল খতম, পয়সা হজম..." - বুদ্ধিটা তার মনে ধরলো - অত:পর আবার যাত্রা শুরু হলো।  

মেয়ের বাড়ির কাছাকাছি এক মোড়ে এসে আমরা সবাই প্ল্যান মাফিক গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম
টলা-দারা যথারীতি আবার রওনা দিয়ে দিলো। আমার মনটা একটু খচখচ করতে লাগলো, তোতলাবে না তো ? আবার না-জানি কোন হাসির খোরাক হয়ে দাঁড়ায়! ঘন্টাদেড়েক বাদে টলা-দারা ফিরে এলো - শুনলাম মেয়ের বাড়িতে বেশ ভালোই খাতির-যত্ন হয়েছে। আর টলা-দাও না-তুতলিয়ে বেশ সপ্রতিভ ভাবেই সবার সাথে কথা বলেছে - তারপর যথাসম্ভব বিনয়ী হয়ে তারা বিদায় নিয়ে এসেছে৷ শুনে আমরা সবাই মিলে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম !


সন্ধ্যা নেমে এসেছে - রবিবারের নির্জন রাস্তা দিয়ে আমাদের গাড়ি হু-হু করে ছুটে চলেছে বাড়ির পথেপেছনের সিটে আমরা আর টলা-দার জামাইবাবু। সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসে আনমনা টলা-দা৷ জামাইবাবু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলেন, "তা'হলে, বাড়ি গিয়ে ওই কথাই হচ্ছে তো?" - টলা-দার দৃষ্টি সামনের কাঁচে নিবদ্ধ, খানিকক্ষন চুপচাপ, তারপর ঘাড় না ঘুরিয়েই বলে উঠলো, "অপ-প-পছন্দের  ক-ক-কো-নও  কারণ  তো  দে-দেখলাম না..." - আমরা আবার 'থ' মেরে গেলাম - আগেই বলেছি, উত্তেজিত হলেই টলা-দা তোতলায় !!