Friday, May 11, 2012

বাংলা গানের স্বর্ণযুগের কিছু কথা ...

বাংলা গানের স্বর্ণ যুগ বলতে মোটামুটি ১৯৫০ দশকের মাঝামাঝি হতে ১৯৭০ দশকের শেষ পর্যন্ত সময়টাকে ধরা যেতে পারে |
এই সময়ে কি কন্ঠশিল্পী, কি গীতিকার, কি সুরকার - সব দিকেই সীমাহীন প্রতিভাসম্পন্ন একদল মানুষের আবির্ভাব হয়েছিলো, যারা একে অপরকে ইন্সপায়র করে চলেছিলেন - আর যার ফলস্বরূপ আমরা অসাধারণ কিছু গান পেয়ে গেছিলাম | এই সব গান হিট হবার জন্যে  কোনো রক বা ব্যান্ড পার্টি-র দরকার হোত না - বা কোনো প্রোমো-প্রোগ্রাম-এর প্রয়োজন পড়েনি কখনো |
সারা বছর ধরে নিয়মিত অনুশীলন-এর পর শিল্পীরা পূজার সময়ে SP বা EP বা LP রেকর্ড-এ ২টি, বা ৪টি বা ১২ টি গান রেকর্ড করতেন | LP রেকর্ড প্রায় হতোই না বলা চলে |
গ্রামোফোন ছিলো তখন হাতে গোনা কিছু মানুষের সাধ্যে - সুতরাং আমরা, মানে আম-জনতারা অধীর হয়ে থাকতাম রেডিও বা বেতার-এ প্রচারিত আকাশবাণী-র গানের অনুষ্ঠানের জন্যে - টিপিক্যালি যেটা শুরু হত বিবিধ ভারতী-তে সন্ধ্যা ৬:১৫ তে "অনুরোধের আসর" দিয়ে, চলত আধঘন্টা, মানে ৬:৪৫ পর্যন্ত | প্রতি ৫ মিনিটে একটি করে গান ও কিছু বিজ্ঞাপন - অর্থাৎ সব মিলিয়ে ৫টি কি বড়জোর ৬টি গান শোনা যেতো এ ছাড়া শনি-রবিবার দুপুরের দিকেও এক্সট্রা কয়েকটা গানের অনুষ্ঠান হতো বলেই মনে পড়ে |

এই ব্লগ-এ আমি সেই স্মরনীয় গানগুলোর পিছনে লুকিয়ে থাকা কিছু কিছু ঘটনা সামনে আনার কিছুটা চেষ্টা করেছি মাত্র জানিনা - আমার এ প্রয়াস আদৌ কারোর কোনো কাজে আসবে কিনা | আশা করি আমার মতো সঙ্গীতপিপাসু  মানুষদের হয়তো এই সব ঘটনা জানতে পেরে ভালো লাগবে - at least কয়েকটা...  এটাই আশা, এটাই ভরসা... সুতরাং শুরু করা যাক তাহলে |

১. আবার দু'জনে দেখা  - যমুনার ওই কিনারে  (শিল্পী: দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়)
পূজার  গান - সাল: ১৯৭০ 
রেকর্ড নং: 45 GE 25387 


দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়-এর প্রথম গান মেগাফোন কোম্পানি থেকে - কিন্তু সে গান খুব একটা ভালো চলেনি | এর পর সুরকার নচিকেতা ঘোষ HMV তে যোগ দেবার পর উনি দ্বিজেনবাবুকেও HMV তে টেনে নিয়ে আনলেন | তারপর যখন সলিল চৌধুরী ওনাকে দিয়ে 'শ্যামলবরণী ওগো কন্যা ' গাওয়ালেন, রাতারাতি দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত হয়ে গেলেন |
গীতিকার পুলক বন্দোপাধ্যায় ওনার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু ছিলেন |   তখনো দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় বিয়ে করে ওঠেননি, তাই পুলক বন্দোপাধ্যায় মাঝেমাঝেই ওনাকে খোঁচা দিতেন: 'কি বিয়ে করছো কবে? নেমতন্নো পাবো কবে?, ইত্যাদি' - এরপর একদিন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় একটি মেয়ের বিয়ের ফোটো দেখিয়ে বললেন যে এই মেয়েটির নাম হলো 'সবিতা' - একেই বিয়ে করবো বলে ঠিক করেছিতা ভালো, যথা সময়ে বিয়ের চিঠিও পেলেন পুলক বন্দোপাধ্যায় - কিন্তু বিয়ের সময়ে থাকতে পারলেন না | রেকর্ডিং-এর জন্যে বম্বে যেতে হলো, তারপর আবার ছুটতে হলো দিল্লীতে |
দিল্লীতে থাকাকালীন একদিন কুতবমিনার বেড়াতে গিয়ে দেখা পেয়ে গেলেন দ্বিজেনবাবুর ফোটোতে দেখা সেই মেয়েটিকে | কপালে সিঁদুর আছে ঠিকই, কিন্তু স্বামী হিসাবে সঙ্গে রয়েছেন অন্য একজন !! দ্বিজেনবাবু নন.... খারাপ লাগলো, খটকা লাগলো ঠিকই - কিন্তু লেখার একটা বিষয়বস্তু তাঁর মাথার মধ্যে চাড়া দিয়ে উঠলো - আর সেই সাথে সৃষ্টি হলো অবিস্মরনীয় সেই গান: 'আবার দু'জনে দেখা  - যমুনার ওই কিনারে, না না বৃন্দাবনে নয় - নয় ওই ব্রজপুরে - তার চেয়ে কিছু দুরে কুতুবের মিনারে... ' |

কলকাতায় ফিরে প্রখ্যাত সুরকার 'নচিকেতা ঘোষ' কে শোনাতেই উনি তক্ষুনি সুর করে ফেললেন গানের
| তারপর গানের বিষয়বস্তু জেনে বললেন: 'আরে, সেই সবিতার সাথে তো দ্বিজেনবাবুর বিয়ে হয়নি - হয়েছে অন্য এক সবিতার সাথে নাম দুজনার একই - তাই বিয়ের কার্ড-এ "সবিতা " নাম-ই লেখা হয়েছিলো ...'  এ যেন  'Comedy of Errors'  !!
এরপর পূজার গান হিসাবে দ্বিজেনবাবুকে এই গানটা গাওয়াতে চাইলে, যেই উনি গান রচনার মূল কারণটা  শুনলেন, কিছুতেই আর রাজি হলেন না গানটা তুলতে।  শেষ পর্যন্ত ওনার সদ্য বিবাহিতা গিন্নী সবিতা (দ্যি সেকেন্ড) কে দিয়ে, অনেক বলে কইয়ে, দ্বিজেনবাবুকে রাজি করানো হলো |



2. পরের দ্রব্য নিজের বলিয়া মনে করা...
শক্তি সামন্তের বম্বে-র স্টুডিও-র নাম ছিল 'নটরাজ স্টুডিও'
'অনুসন্ধান' ছায়াছবির কাজ চলার সময় শক্তিদা ওনার স্টুডিও-র প্রজেকশন থিয়েটারে নির্মীয়মান এই ছায়াছবির দুটো গান শোনাচ্ছিলেন - 'ফুলকলি গো ফুলকলি, বল না এটা কোন গলি...' আর 'ফেঁসে গেছে, ফেঁসে গেছে কালিরামের ঢোল...' | গান শুনে তো উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে প্রায় সবাই রাহুল দেব বর্মন-এর খুব প্রশংসা করছেন | এ ব্যাপার দেখে শক্তিদা একটু মুচকি হেসে বললেন: 'ও দুটো আবার রাহুলের সুর কোথায়?  দুটোই তো পূব বাংলার নিজস্ব ঘরানায় বানানো শচীন দেব বর্মনের সুর - আমিই তো পঞ্চমকে ওই সুর দুটো লাগাতে বলেছিলাম....' - একেই বলে বাবার সম্পত্তি পায় ছেলে... অর্থাৎ প্রথম গানটি:  'ফুলকলি গো ফুলকলি, বল না এটা কোন গলি...' হলো শচীনদার বিখ্যাত 'সুন্দরী গো সুন্দরী, দল বেঁধে আয় গান ধরি' থেকে নেওয়া (মানে ঝাড়া) আর দ্বিতীয়টা হলো 'শুনি তাকদুম তাকদুম বাজে / বাজে ভাঙ্গা ঢোল / ও মন যা ভুলে যা কি হারালি / ভোলরে ব্যথা ভোল...'  থেকে ঝাড়া, থুড়ি নেওয়া !

আরেকবার শচীনদার সামনেই তাঁর খুব কাছের এক মানুষ বলে উঠলেন যে সলিল চৌধুরী আজকাল বেশ কায়দা করে দুটো বিখ্যাত বিদেশী গানকে বাংলায় লাগিয়েছেন
| একটা হলো 'Happy Birthday to You...' গানের সুরে 'ক্লান্তি নামে গো, রাত্রি নামে গো...' আরেকটা আমেরিকান গায়ক প্যাট বুনের 'টেকনিক' গানের সুর নিয়ে 'দুরন্ত ঘুর্নির তাই লেগেছে পাক, এই দুনিয়া ঘোরে বন বন বন...' - ধরা ছোয়াঁর কোনো উপায় নেই
শুনে স্বল্পভাষী  শচীন দেব এক মারাত্মক কথা বলে আলোচনাটা থামিয়ে দিলেন - বললেন আসল কথা হলো 'কায়দা করে' লাগানো | সেটা রবি ঠাকুর করেছেন, ডি এল রায়, কাজী নজরুল, আমি (শচীন দেব বর্মন), আরও অনেকেই করেছেন |  গুরু দত্তের হিন্দী ছবি 'প্যায়াসা'-তে হেমন্তের গাওয়া 'জানে বহ কায়সে, লোগ থে  জিন কে / প্যার  কো প্যার মিলা...' গানটার সেকেন্ড লাইনটা যে আমাদের National Song -এর 'পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা, দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ...' সেটা ক'জন লোক খেয়াল করেছে শুনি? বলেই সেখান থেকে উঠে পড়লেন সঙ্গীত জগতের এই তুলনাহীন সঙ্গীতব্যক্তিত্ব |  
[[এখানে বলে রাখা ভালো যে সলিল-দা 'Happy Birthday to You' গানের ওরিজিনাল সুরের রিদম ৪/৪ হতে ৩/৪-এ চেন্জ করে, আর প্রতি লাইনে আলাদা আলাদা সুর দিয়ে এক অবিস্মরণীয় কম্পোজিশান সৃষ্টি করেছিলেন।  বলে না দিলে যা বোঝা প্রায় অসম্ভব ]]   


. আমার বলার কিছু ছিলো না (শিল্পী: হৈমন্তী শুক্লা
পূজার গান - সাল: ১৯৭২
রেকর্ড: EP  
  
সুকন্ঠী হৈমন্তী শুক্লা ছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী হরিহর শুক্লার সুযোগ্যা কন্যা। নতুন শিল্পীর ভাগ্য সব সময় সুপ্রসন্ন হয় না  - কিন্তু হৈমন্তী শুক্লা ছিলেন এ দিক দিয়ে খুব-ই ব্যতিক্রমী | 'দুষ্টু মিষ্টি', 'বালক শরচন্দ্র', আরও বেশ কিছু ছায়াছবিতে গান করে হৈমন্তী শুক্লা তখন বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন হিন্দুস্থান রেকর্ডিং কোম্পানি তে তাঁর কেরিয়ার শুরু হয়েছিল | সেখানকার মহিলা গায়িকাদের মধ্যে তখন হৈমন্তী শুক্লার স্থান ছিলো অনেক উঁচুতে | এই সময় বিমান ঘোষ রেডিও ছেড়ে HMV-তে যোগ দিলেন আর হৈমন্তী শুক্লাকেও বললেন HMV-তে যোগ দিতে। হিন্দুস্থান রেকর্ডিং কোম্পানির তুলনায় HMV ছিলো অনেক বড়ো। তাই এখানকার ভিড়ে হারিয়ে যাবার সম্ভাবনাও ছিলো অনেক বেশি, তবুও হৈমন্তী শুক্লা HMV-র অমোঘ আকর্ষণ এড়াতে পারলেন না |  কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা এর পর বিমানদা হৈমন্তী শুক্লাকে দিয়ে যা যা গান করালেন তার একটাও চললো না | বাধ্য হয়ে সেবারের পুজোর সময়ে তাই হৈমন্তী শুক্লার মতো আরও কিছু উঠতি শিল্পীদের, সবাইকে দিয়ে দু'খানা করে গান দিয়ে একটা LP রেকর্ড বার করার প্ল্যান করা হলো | তা জানতে পেরে হৈমন্তী শুক্লা খুবই ভেঙ্গে পড়লেন এবং তখনকার বিখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দোপাধ্যায় কে ধরলেন একটা গান লিখে দেবার জন্যে | বিমানদাকে হাজার অনুরোধ করেও কিছু করা গেলো না, কারণ HMV-র কাছে শিল্পীর আসল পরিচয় হলো তাঁর কত রেকর্ড বিক্রি হলো | অন্যদিকে LP-তে  সবার সাথে কমন রেকর্ড বার করা মানে গানের কেরিয়ার একরকম শেষ |
পুলক বন্দোপাধ্যায় তাই বিমানদাকে একটা শেষ সুযোগ দিতে বললেন এবং কথা দিলেন যে প্রখ্যাত গায়ক মান্না দে কে অনুরোধ করে হৈমন্তী শুক্লার গানের সুর দেওয়াবেন | মান্না দের কথা শুনে বিমানদা শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন | ওনারা দুজনে বেশ কিছুদিন আগে স্কটিশ চার্চ কলেজে একসাথে পড়েছিলেন |  

পরের দিন সকালেই হৈমন্তী শুক্লা মান্না দের বাড়িতে হাজিরা দিলেন | সেই বছরে ঠিক হয়েছিলো যে মান্না দে-ই 'আমার বলার কিছু ছিলো না, চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে...' গানটি নিজের সুরে, নিজের কন্ঠে রেকর্ড করাবেন | কিন্তু  পুলক বন্দোপাধ্যায়-এর নাছোড়বান্দা অনুরোধ-এ শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন গানটা হৈমন্তী শুক্লাকে ছেড়ে দিতে যদিও গানটি উনি আসলে নিজে গাইবার জন্যেই বানিয়েছিলেন | স্বার্থত্যাগের এমন দৃষ্টান্ত সঙ্গীত জগতে বোধ হয় খুব একটা দেখা যায় নি, আর যাবেও না হয়ত কখনো |
 
গানটি প্রকাশিত হবার পর রাতারাতি হৈমন্তী শুক্লা খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে গেলেন | যে শিল্পী HMV-র করুনার পাত্রী হয়ে সেবার সুযোগ পেলেন, তাঁর-ই গান হয়ে গেল কিনা সুপার-ডুপার হিট ! এক গানেই হয়ে গেল তাঁর গল্ফ্গ্রীনের ফ্ল্যাট আর গাড়ি |  


৪. ওই যে সবুজ বনবিথীকা (শিল্পী: মাধুরী চট্টোপাধ্যায় )
পূজার গান - সাল: ১৯৬৭ 
কথা ও সুর: সলিল চৌধুরী 
সলিল চৌধুরীর সুরে গান গাইবার সৌভাগ্য যে গুটিকয় শিল্পীদের হয়েছিল তার মধ্যে একজন হলেন মাধুরী চট্টোপাধ্যায় সম্পূর্ণ অন্য এক ধরনের গলা নিয়ে জন্মেছিলেন মাধুরী চট্টোপাধ্যায় - মুহুর্তের মধ্যে সপ্তকের খাদ থেকে চড়ায় উঠে যেতে কোনো সমস্যা হতোনা তাঁর
সলিল চৌধুরীর ছেলেবেলাটা কেটেছিলো তাঁর বাবার সাথে আসামের চা বাগানে, যেখানে অসমীয়া ফোক সঙ আর পাহাড়ি গানের সুরের মিশেল তাঁর মনের মধ্যে গভীর দাগ কেটে দিয়েছিলো এর সাথে যোগ হয়েছিলো তাঁর বাবার সংগ্রহে থাকা একগাদা ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল রেকর্ড, যিনি পেশায়  ছিলেন ডাক্তার এক বিদায়ী আইরিশ ডাক্তারের কাছ থেকে একটা  গ্রামোফোন যোগাড় হয়েছিল সেটাতে দিনের পর দিন মোজার্ট, বিঠোফেন, চৈকভস্কি, চপিন-দের কম্পোজিশন শোনা, আর তার সাথে বনের আওয়াজ, পাখিদের ডাক, পাহাড়ি বাঁশির সুর - এ সবই তাঁর মনের সুরের ভান্ডার কে ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল  
তাঁর প্রিয় সুরকার ছিলেন মোজার্ট ওয়েস্টার্ন অর্কেস্ট্রেশনের উপর বেস করে ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল রাগ বা ফোক সুরের মিশেল হলো সলিল চৌধুরীর গানের অন্যতম বৈশিষ্ঠ

১৯৬৭ সালে বিঠোফেনের 6th সিম্ফনির ফার্স্ট মুভমেন্ট (Pastoral)-এর উপর বেস করে সুর দিলেন তাঁর নিজেরই লেখা গান  'ওই যে সবুজ বনবিথীকা'
গানটির ঘোরাফেরা আড়াই অকটেভ জুড়ে, সঙ্গে আছে এক নোট  থেকে আরেক নোটের সূক্ষ 
সূক্ষ লাফ
মাধুরী চট্টোপাধ্যায় অসাধারণ দক্ষতার সাথে গানটি পরিবেশন করেছিলেন। 


৫. বাংলায় 'পপ' গান - শিল্পী: রাণু মুখোপাধ্যায়
পূজার গান - সাল: ১৯৭০
গীতিকার: পুলক বন্দোপাধ্যায়
সুর: বিদেশী

ভি বালসারা ছিলেন বোম্বাইয়ের একজন ডাকসাইটে  বাজিয়ে তাঁর মতো বিচিত্র রকমের বাদ্যযন্ত্রের এত পারদর্শী বাজনাদার আমাদের দেশে বোধহয় আর দুটি নেই রাজ কাপুরের 'আওয়ারা' হিন্দী ছবিতে তাঁর সঙ্গত করা 'আওয়ারা হু' গানটি সুপারহিট হবার পর উনি কলকাতায় এসে ঠিক করলেন বাংলায় পপ গানের সুর দেবেন HMV-র তখনকার অধিকর্তা মি: এ. সি. সেন.  এই প্রস্তাব সাগ্রহে লুফে নিলেন বালসারাজি রাণু মুখোপাধ্যায়ের (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের-এর কন্যা) নাম প্রস্তাব করলেন এখানে বলে রাখা ভালো যে তখন পার্ক স্ট্রিটের 'ট্রিনকাজ' রেঁস্তরার সিঙ্গার উষা উত্থুপ অলরেডি ইংরেজি গান গেয়ে বেশ কিছুটা নাম করে ফেলেছেন, কিন্তু তাঁকে দিয়ে বাংলায় 'pop song' গাওয়ানোর কথা ভাবা হয়নি
যাই হোক ১৯৬৯ সালে বার হলো রাণু মুখোপাধ্যায়-এর গাওয়া প্রথম "বাংলা পপ" গানের একটি 'SP রেকর্ড' দুটো গান-ই বেশ ভালো হিট  হয়ে উঠলোপরের বছর অর্থাৎ ১৯৭০ সালে  রাণু ঠিক করলেন যে তাঁর অতি প্রিয় 'জর্জি গার্ল' আর কনি ফ্রান্সিসের 'সামার ওয়াইন'-এর গান বাংলাতে গাইবেন গানের কথা লেখার ভার পড়লো পুলক বন্দোপাধ্যায়ের ওপর
পুলকবাবু বুঝলেন যে original গান দুটোর হুবহু ট্রান্সলেশন করলে রক্ষণশীল বাঙালি সমাজ খুব সম্ভবত পছন্দ করবেনা - তাই তিনি তাঁর মৌলিক চিন্তাধারা প্রয়োগ করে লিখে ফেললেন দুটি গান: (১) একা আমি যাই, সাথে কেউ কেন চলছে না আর  (২) যখনি বেড়া আমি পাইন বনে

দুটি গানে মিউজিক অ্যারেন্জমেন্ট এবং সঙ্গত করলেন ভি বালসারাজি
রা
ণু মুখোপাধ্যায় অসাধারণ গাইলেন - শুনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত ভূয়সী প্রসংসা করে ফেললেন কিন্তু রেকর্ড প্রকাশিত হবার সময় ভি বালসারাজি সুরকার হিসাবে তাঁর নাম দিতে চাইলেন না - কারণ গানগুলোর অরিজিনাল সুর তাঁর নয়  HMV সুরকার হিসাবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কেও রাজি করাতে পারলেন না অত:পর কি আর করা, যথাসময়ে বার হলো সুরকার-হীনা, শুধু গীতিকারের নাম সহ SP রেকর্ড - যা কিনা আজও এদেশে একটা সর্বকালীন রেকর্ড !

সমস্যা যেন মাটি ফুঁড়ে বার হলো কিছুদিন বাদে একদিন দুপুরে HMV-র ডালহৌসীর অফিসে তলব পড়লো পুলক বন্দোপাধ্যায়েরজানা গেলো কপিরাইট আক্ট ভাঙ্গার খপ্পরে পড়েছে সেই রেকর্ড যে গান  E.M.I. গ্রুপের নয়, সে গান ব্যবহারের অধিকার HMV-র নেই গানের কথা সম্পূর্ণ এদেশীয় এবং অরিজিনাল হলেও, সুরের দিক দিয়ে আসল ইংরেজি গানের সাথে এর কোনো তফাত নেই সুরটা যদি সামান্য বদলানো হত, তাহলে এসব ঝামেলায় পড়তে হতো না কপিরাইট আক্ট-এ কথা ব্যবহার করা যেমন অপরাধ, তেমনি সুর ব্যবহার করাও অপরাধ "কম্পোজিশন" মানে কথা ও সুর দুই-ই যেহেতু রেকর্ড-এ শুধু পুলক বন্দোপাধ্যায়ের নামের উল্লেখ আছে, সুতরাং কম্পোজার হিসাবে তাকেই ধরা হবে 
 

এইসব শুনে এসি ঘরে বসে পুলক বন্দোপাধ্যায় দরদর করে ঘামতে লাগলেন - মুখে কোনো কথা বলার শক্তিটুকু যেন রইলো না ব্যাপার-স্যাপার দেখে মি: এ. সি. সেন. হেসে ফেললেন - বললেন যে তিনি অলরেডি করেসপন্ডেনস করে সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন রয়ালটির ফিফটি পার্সেন্ট ওদেরকে দিয়ে দিলে, ওরা আর কোনো সমস্যা করবে না জানিয়েছে 
মুক্তির যে কি আনন্দ ত়া সেদিন পুলক বন্দোপাধ্যায় যেন নতুন করে অনুভব করেছিলেন



৬. ক'ফোঁটা  চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালবাসবে (শিল্পী: মান্না দে)
পূজার গান - সাল: ১৯৭১
গীতিকার: পুলক বন্দোপাধ্যায়
সুরকার: ডা: নচিকেতা ঘোষ 



বাংলা আধুনিক গানের জগতে সুরকার হিসাবে নচিকেতা ঘোষের অবদান ভোলার নয় গান সৃষ্টির এক আশ্চর্য্য প্যাশন ছিল তাঁর মধ্যে রোজ সকালের গরম চা-এর মতই একটা টাটকা তাজা গানে চুমুক না দিতে পারলে বোধহয় তাঁর গোটা  দিনটাই বৃথা যেতো তিনিই হলেন প্রথম মিউজিক ডিরেক্টর যিনি লতা মঙ্গেশকারকে দিয়ে বাংলা ছায়াছবিতে (অর্ধাঙ্গিনী) গান গাইয়েছিলেন তাঁর পিতা ডা: সনৎ কুমার ঘোষ ছিলেন কলকাতার প্রখ্যাত চিকিৎসক (গোল্ড মেডালিস্ট) এবং তখনকার মুখ্যমন্ত্রী ডা: বিধান চন্দ্র রায়ের আটেনডিং ডাক্তার
   
ষাটের দশকের প্রথম দিকে নচিকেতা ঘোষ কলকাতা ছেড়ে রওনা হন বম্বের ফিল্মি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার জন্যে বছর সাত-আটেকের পর তিনি কলকাতাতে ফিরে বাংলা গানের সুর দেওয়া শুরু করলেনতিনিই উত্তমকুমারের কন্ঠে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বদলে মান্না দের কন্ঠ ব্যবহার শুরু করেছিলেন
  
তখন সবে ওনার স্ত্রী
বিগতা হয়েছেন - শোকে মুঝ্যমান হয়ে আছেন  এর মধ্যে তেমন ভালো সুরও সৃষ্টি করতে পারছেন নাহারমোনিয়াম নিয়ে বসে আছেন তবলজির সাথে, কিন্তু কোনো গানের 'মুখড়া' মাথায় আসছে না ।  শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে তিনি পুলক বন্দোপাধ্যায় কে ফোন করে বললেন যে একটা গান লিখে দিতেপুলক বাবুর মাথায় ছিল ওনার স্ত্রী বিয়োগের কথাটা - টেলিফোনেই বলে দিলেন গানের প্রথম দুটো লাইন:
     ক'ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালবাসবে,
       পথের কাঁটায় পায়ে রক্ত না ঝরালে
কী করে এখানে তুমি আসবে?

শুনে টেলিফোনে প্রায় এক মিনিট কোনো সাড়াশব্দ নেই - তারপর নচিবাবু আবার লাইন দুটো বলতে বললেন - পুলকবাবু আবার তা বললেন
।  শোনার পর হঠা লাইন কেটে গেল ওদিক থেকে । 
কিছুক্ষণ বাদে আবার এলো টেলিফোন এবারে কিন্তু কন্ঠস্বরে অনেক বদল - বললেন: ভীষণ জরুরি, এক্ষুনি পুলকবাবুকে চাই, গাড়ির পেট্রোলের দাম পর্যন্ত তিনি দিয়ে দেবেন 

অগত্যা কী আর করা, পুলক বাবু ছুটলেন সালকিয়া থেকে পাইকপাড়ায় গিয়ে শুনলেন মুখড়ার সুর খানা ওনার সামনেই বসে লিখে দিতে হলো অন্তরার কথাগুলো   - বেলা দুটোয় শেষ হলো গান রচনা । এর অনেক পরে মান্না দে গানটি রেকর্ড করেছিলেন ১৯৭১ সালে পূজার গান হিসাবে 




৭. শোনো কোনো একদিন  আকাশ বাতাস জুড়ে রিমঝিম বরষায়
শিল্পী: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
সুরকার ও গীতিকার:  সলিল চৌধুরী 
পূজার গান - সাল: ১৯৬৯
রেকর্ড নং: 45GE-25354 

একটা গানের লাইফটাইম কত বছর হতে পারে? আজকালকার দিনের ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞাসা করলে মোস্ট প্রোবাবলি বলবে গানের আবার লাইফটাইম কি? গান মানে গান...  একজন গাইবে, যার ইচ্ছা হবে শুনবে - ভালো লাগানোর দায়িত্ব তো শ্রোতাদের! কেউ কেউ হয়তো বলবে ব্যান্ডের গান হলে এক বছর, জীবনমুখী হলে মেরেকেটে দেড় থেকে আড়াই বছর, আর সিনেমার গান হলে যতোদিন সেটা সিনেমাহলে চলবে ততোদিন...

কিন্তু অর্ধ-শতাব্দী জুড়ে কোনো গান বেঁচে থাকতে পারে কি?
অসম্ভব মনে হলেও উত্তরটা হলো 'হ্যা' - যদি সেই গানে কথা ও সুরের সঠিক মেলবন্ধন থাকে, গানের সুরের মধ্যে নাটকীয়তা থাকে, গানের কথার মধ্যে চিন্তার খোরাক আর বাঁধুনি থাকে - যার ফলে গান শেষ হয়ে গেলেও মাথার মধ্যে সেই গানের রেশ থেকেই যায় আর অবিশ্রান্ত ভাবে সুরটা গুনগুন করে বেজেই চলে |
 
এরকমই একটা গানের উদাহরণ হলো সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে হেমন্তের মুখোপাধ্যায়-এর গাওয়া ১৯৬৯ সালের পূজার সেই অবিস্মরণীয় গান: 'শোনো ! কোনো একদিন, আকাশ বাতাস জুড়ে রিমঝিম বরষায়...'
| ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে নি:সন্দেহে সর্বপ্রথম এবং খুব সম্ভবত সর্বশেষ গান যার ঘোরাফেরা  তিনটে অকটেভ-এর জুড়ে, তাও আবার তিনটে আলাদা আলাদা স্কেলে, এখনকার দিনের মিউজিশিয়ান-দের কল্পনাতেও যা হয়তো কোনোদিনও আসবে না!

শোনা যায় সলিলদা নাকি এই গানটি কম্পোজ করেছিলেন কিশোরকুমারকে দিয়ে গাওয়ানোর জন্যে
| কিন্তু স্টুডিওতে বসে এই গানের সুরের ওঠা-নামা শুনে কিশোরদা উঠে ছুটতে আরম্ভও করেন আর বলতে থাকেন "এই গান আমি কক্ষনো গাইবো না... এটা ভীষণ শক্ত... এই গান হেমন্তদা ছাড়া আর কেউ গাইতে পারবে না... আপনি হেমন্তদাকে বলুন..."
শেষ পর্যন্ত সলিলদা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দিয়েই গানটিও রেকর্ড করান | 
রেকর্ডের উল্টো দিকে ছিলো তাঁর আরেক কিম্বদন্তী সৃষ্টি: 'আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা...' |
   
গানটা যতোবার-ই শুনি ততোবার-ই মনে হয় যে সলিলদা ঠিকই বলেছিলেন, "ঈশ্বর যদি কোনো দিন গান গান, তাহলে সেটা ঠিক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠের মতোই শোনাবে..."


Resource: "কথায় কথায় রাত হয়ে যায়" (আনন্দ পাবলিশার্স, July 1999)


5 comments:

  1. Kato kichhu jaantam na.
    Khub valo laaglo..
    Aaro chai...

    ReplyDelete
  2. A very nice compilation. Keep up the good work. Erakom aaro chai.

    ReplyDelete
  3. Darun.. bolleo kom bola hay..
    khub valo laaglo pore...

    ReplyDelete
  4. অনেক ধন্যবাদ এই সুন্দর article-টির জন্য। আরও কিছু পাওয়ার আশায় রইলাম আপনার কাছ থেকে। আরেকবার ধন্যবাদ না দিয়ে পারলাম না।

    ReplyDelete
  5. অসাধারণ উপস্থাপন! হৃদয় স্পর্শ করলো! বাংলা গানের স্বর্ণযুগের এই সমস্ত প্রতিভাধর ব্যাক্তিত্ব, আমাদের প্রিয় মানুষের কথা শুনতে, জানতে এবং ভাবতে ভাবতে এক লহমায় কখন যেন ডাউন মেমোরি লেনে পৌঁছে গিয়েছিলাম! অজস্র🙏💕 ধন্যবাদ এবং আন্তরিক অভিনন্দন!

    ReplyDelete