"আমার চতুর্পাশে, সব কিছু যায় আসে,
আমি শুধু তুষারিত, গতিহীন ধারা..."
প্রায় দীর্ঘ এক বছর বাদে আবার কিছু একটা নিয়ে লিখতে বসলাম - মাঝে শরীর ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো - যে জায়গায় যেতে আমি সবচেয়ে অপছন্দ করি সে জায়াগাতেই, অর্থাৎ হাসপাতালের এমার্জেন্সি রুমে আমায় কাটাতে হলো অসহনীয় তিন রাত, চার দিন। ভাগ্যের অদৃষ্ট পরিহাস বোধ করি একেই বলে !
স্মৃতিরা হলো যেন অনেকটা জলে ধোয়া ছবির দল। অনেক দৃশ্য আবছা হয়ে গেছে - রং হারিয়ে সাদা-কালো, বা একেবারেই বিবর্ণ হয়ে গেছে - চেষ্টা করলেও আজ আসল রং মনে আসে না। ছোটবেলায় ডায়েরী লেখার অভ্যেসটা মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো আমার সেজদি। শিয়ালদায় স্টেশনে যাবার পথে ফুটপাথের দু'পাশ জুড়ে গজিয়ে থাকা স্টেশনারি দোকান গুলোতে ফুল-পাতার মতো ডাঁই করে থাকা ডায়েরীর স্তুপ থেকে তিনি একটি স্বস্তা ধরণের, ছোট্ট ব্রাউন ডায়েরী কিনে এনে আমাকে বলেছিলেন যে সেটা লিখে শেষ করতে পারলেই আরেকটা 'নতুন' কিনে দেবেন! সেই "আরেকটা নতুন"-এর লোভে পড়ে আমি প্রতি রাতে ঘুমাতে যাবার আগে পালা করে রাত জেগে সারাদিনের কেচ্ছা-কাহিনীর কিছু কিছু কথা, সাল-তারিখ-ক্ষণ দিয়ে তিন-চার পাতা ভ'রে লিখে চলতাম। পরবর্তী কালে দেখা গেলো সেইসব ডায়েরীর লেখা পড়েই দাদা-দিদিরা জেনে ফেলছে সেই কিশোর বয়সে আমার যাবতীয় 'ইনফ্যাচুয়েশেনার'-এর কথা !! অগত্যা নিত্য-নতুন লুকানোর জায়গা খুঁজে বার করতো হতো আমায় ! তবে গ্র্যাজুয়েশনের সময় থেকে লেখার অভ্যেস কমতে কমতে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলো। লেখার জন্যে সময় বার করা মুশকিল হয়ে উঠেছিলো ঠিকই, কিন্তু তার থেকেও খালি মনে হতো যে এইসব ছাইপাঁশ লিখে আর কি হবে!! সেই সব দুঃখ-হতাশার বাতুলতা কেউ কি না-হেসে কোনোদিনও শুনবে? এখন মাঝে মাঝে মনে বড়ো আফশোষ হয় যে কেন লিখে চললাম না? চললে, আজ স্মৃতিকে অ্যাতো করে তৈলমর্দন করতে হতো না - আর স্মৃতিরাও আমাকে এরকম ভাবে ল্যাজে-গোবরে খেলানোর সুযোগ পেতো না।
ছোটবেলার দিনগুলো ভরা থাকতো ভালো আর মন্দ, দুইয়েতেই। স্কুলের দিনগুলোতে যেমন সকালের দিকে বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চাইতো না, আবার তেমনিই রোববারের সকালে কিছুতেই সাতটার পর বিছানায় পড়ে থাকতে পারতাম না। সারা সপ্তাহ জুড়ে আমাকে নিয়ম করে পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়া আর ঘুমাতে যেতে হলেও, রবিবারের সারাটা দিন-রাত জুড়ে আমার দৌরাত্ম্যতে কেউ কোনো বাধা দিতো না। কোনোরকমে মুখ-হাত ধুয়ে, সকালের জলখাবারের পরেই আমাকে বাবার সাথে যেতে হতো বাজারের দিকে, মূলত: বাজারের থলি বইবার জন্যে। পাড়ার বন্ধুদেরকে দেখাবার জন্যে আমি বাজারের থলিগুলোকে দু'হাতে বেশ গম্ভীরভাবে বয়ে নিয়ে চলতাম যাতে আমাকে কিছুটা বড়ো আর বয়স্ক দেখায়। ঝটপট বেড়ে ওঠার সেই ভয়ানক কুবুদ্ধি যে কেন আমার মাথায় সেদিন ভর করে ছিলো, তা আমি আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না !
|
ছেলেবেলা সব দেশেতেই সমান আকর্ষণীয়... |
কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাঁদের সান্নিধ্যে এলে মনটা আলোয় ভরে যায় - এক মহৎ উপলব্ধি হয়। যে উপলব্ধি সারা জীবন মনের গভীরে এক আশ্চর্য আলো জ্বালিয়ে রাখে। কালের পাকচক্রে পড়ে সেই মানুষটি হয়তো একসময় আর জীবিত থাকেন না, কিন্তু তাঁর ছড়িয়ে দেওয়া আলোটা থেকেই যায়। সেই কনে-দেখা আলোর আভা স্মৃতিকে আচ্ছন্ন করে রাখে আমাদের বাকি জীবনটা জুড়ে। সেই রকমই একজন মানুষ ছিলেন লাইব্রেরীয়ান নিমাইদা। আমার স্কুল থেকে সামান্য দূরেই ছিলো এক সমৃদ্ধ পাঠাগার। আমার বাবা ছিলেন তার সক্রিয় সভ্য - তবে অফিস শেষে তিনি নিয়ম করে লাইব্রেরি যেতে পারতেন না। তাঁর জায়গায় বরং আমার ছোটদাই নিয়ম করে সপ্তাহান্তে গিয়ে, দুটি কার্ডে মোট চারটি গল্প-উপন্যাসের বই ইস্যু করে আনতো। ছোটদার হাত ধরেই প্রথম যেদিন নিমাইদার সাথে আলাপ হয়েছিলো তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। তবে তার অনেক আগে থেকেই আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে, স্কুল ফাঁকি দিয়ে বা স্কুল শেষ করে, প্রায় প্রতিদিনই নিয়ম করে 'ইন্দ্রজাল কমিকস', 'শুকতারা', 'আনন্দমেলা' ইত্যাদি পড়ার জন্যে সেখানে গিয়ে ঢুঁ মারতাম। বইপত্র ইস্যু করার টেবিলে সদা-গম্ভীর মুখ করে বসে থাকা সৌম্য চেহারার নিমাইদাকে আমরা সব সময়ই এড়িয়ে চলতাম, কারণ তাঁর মুখোমুখি হলেই তিনি জিজ্ঞাসা করতেন পরীক্ষা কেমন হয়েছে - শেষ পরীক্ষায় অঙ্কে আর ইংরেজিতে কতো নাম্বার পেয়েছি, সায়েন্স পড়াচ্ছেন কোন টীচার, আনন্দবাবু আমাদের কোনো ক্লাস নেন কি না, ইত্যাদি সব কঠিন, বিরক্তিকর প্রশ্ন। সে যাই হোক, ছোটদার হাত ধরে নিমাইদার সাথে সৌজন্যমূলক পরিচয় হতেই তিনি একগাল হেসে ছোটদার কানে তুলে দিলেন যে আমরা দলবেঁধে প্রায় প্রতিদিনই সেখানে স্কুল কেটে ঘন্টাদুয়েক হাজিরা দিয়ে যাই!! ছোটদার মুখে পাহাড়ি সান্যালের মতো "আই সী, আই সী" শুনে বুঝতে পারলাম যে আজ বাড়ি গিয়ে কপালে আমার বিস্তর ঝামেলা অপেক্ষা করে আছে !
এরপর থেকে লাইব্রেরী গেলেই নিমাইদা নিয়ম করে আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন বাবা কেমন আছেন, বাড়িতে আমি কি করে সময় কাটাই, কি বই পড়ছি এইসব। এক দিন দুরু দুরু বুকে তাঁর কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম যে শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র আর বিভূতিভূষণের বই কোথায় রাখা আছে। তিনি কিছুটা আপ্লুত স্বরেই বললেন, "এই বয়সে, বিভূতিভূষণ তাও ঠিক আছে, কিন্তু শরৎচন্দ্র পড়ার দুর্বৃদ্ধি কে মাথায় ঢোকালো ?" - আমি আমতা আমতা করে জানালাম যে বাবা বলেছেন, কোনো কিছু শুরু করতে হলে ভালো করেই শুরু করা উচিত - তাই আমি যেন রবীন্দ্র-বঙ্কিম-শরৎচন্দ্র দিয়েই... - শুনে তিনি উচ্চস্বরে হেসে উঠে বললেন, "ঠিকই বলেছেন উনি - এসো আমার সাথে..." --- তিনি চেয়ার থেকে উঠে আমায় সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন লাইব্রেরীর একটি বিশেষ আলমারীর দিকে - বললেন সেই আলমারীতেই আছে পুরানো দিনের বিখ্যাত সব বই - আমি আমার পছন্দমতো বেছে নিয়ে পড়তে পারি। কি করে ক্যাটালগ দেখে, বা বইয়ের কভারে লাগানো লেবেল পড়ে বই খুঁজতে হয় তাও তিনি সযত্নে বুঝিয়ে দিলেন।
নিজের হাতে বই খোঁজার বিরল অধিকার পেয়ে আমি উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলাম - অজস্র বইয়ে সাজিয়ে রাখা সারি সারি সব বুকশেল্ফ - বই আর বই, যেন বইয়ের সমুদ্র। পুরানো বইয়ের অদ্ভুত গন্ধে মাথা যেন ধাঁধিয়ে যেতে লাগলো। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম বিবর্ণ, অবহেলিত সেই বুকশেল্ফগুলিতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা আমাদের বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী সব দিকপাল সাহিত্যিকদের অসামান্য সব রত্নমালা। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে এঁদের অনেকের সাথেই অল্পবিস্তর আলাপ হয়েছে - কিন্তু সে আলাপ তো নগন্য মাত্র - তাতে কি মন ভ'রে? কিন্তু, আজ থেকে তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্যের সাথে আমার পরিচয়ের আর কোনো বাধাই রইলো না। এরপর থেকে মাঝে মাঝেই নিমাইদার সাথে আমার সাহিত্য নিয়ে ছোটোখাটো প্রশ-উত্তরের সেশন চলতে থাকলো। সেই সব সেশনের শেষে তিনি কিছুটা অভ্যেসবশতই নিয়ম করে বলতেন, "বই পড়ার অভ্যাসটা কখনো ছেড়ো না, আর কখনও ভুলেও বইকে অসম্মান করো না..."
ক্লাস টেন-তে ওঠার অনেক আগেই আমার শেষ হয়ে গেলো শরৎচন্দ্রের যাবতীয় নভেল। এরপর সেই লাইব্রেরী থেকে লাগাতার, অজস্র বই নিয়ে পড়ে চলেছিলাম, এমন কি মাস্টার্স কমপ্লিট হয়ে যাবার পরেও। বিভূতিভূষণের 'আরণ্যক', শীর্ষেন্দুর 'দিন যায়', সঞ্জীবের 'লোটাকম্বল', তারাশঙ্করের 'হাঁসুলিবাঁকের উপকথা', নারায়ণ সান্যালের 'নাগচম্পা', রমাপদ চৌধুরীর 'বন পলাশীর পদাবলী', বিমল করে 'আত্মজা' নিয়ে তুল্য মূলক বিচার চলতে থাকতো নিমাইদার সাথে। বাংলা ভাষার মহীরুহ থেকে নবীন প্রজন্মের সাহিত্যিকদের সাথে আমরা যাবতীয় যোগসাজশের সূত্রপাত, বা ভিত্তিস্থাপন ওই লাইব্রেরী আর নিমাইদার হাত ধরেই।
~ ~ ~ ~ ~
কর্মসূত্রে দেশ ছেড়ে চলে আসার আগে, ইচ্ছা থাকলেও নিমাইদার সাথে দেখা করে আসা হয়ে ওঠেনি। বুঝি সম্পর্কের টানে মায়ার বাঁধন অনেক কমে গিয়েছিলো। আজ যদি টাইম মেশিনে করে কোনও ভাবে সেই অকালপক্ক কৈশোর জীবনে ফিরে যেতে পারি, তো নিমাইদার কাছে প্রথমদিনই গিয়ে হাজির হবো। কোনও কথা বলবো না - স্রেফ বুকে জড়িয়ে তাঁকে ধরে বেশ কিছুক্ষন চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকবো - আর ছাড়বো না কিছুতেই...