"নয়ন ছেড়ে গেলে চলে, এলে সকল-মাঝে -
তোমায় আমি হারাই যদি তুমি হারাও না যে..."
মাঝে মাঝে উল্টো-পাল্টা সব গানের দল ঝাঁক বেঁধে এসে মনকে অকারণেই উথাল-পাতাল করে তোলে। বেশ কিছুদিন ধরে কানের মধ্যে ঘুন পোকার মতো ঘুন-ঘুন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে পুরানো গানের একটাই লাইন: "তোমায় আমি হারাই যদি তুমি হারাও না যে..." - খুব ছোটবেলায় রেডিওতে যখন দেবব্রত বিশ্বাসের অবিস্মরণীয় কন্ঠে এই গানটা শুনতাম, কি এক অজানা দু:খের ভারে গলা যেন অবরুদ্ধ হয়ে আসতো - কিন্তু সে গানের কি যে ছাই মানে, তা বুঝে ওঠার মতো বয়স তখনও হয়ে ওঠেনি। আরও অনেক, অনেক দিনের পর, দু:খ-কষ্টের শত টানা-পোড়েনের হাত ধরে আস্তে আস্তে এই গানের নিবিড় অর্থ বুঝে নিতে পেরেছিলাম। আসলে সঠিক সময় না-এলে মনে হয় সব গানের মর্ম বুঝে ওঠা যায় না।
The woods are lovely, dark, and deep...... |
সলিল চৌধুরীর 'পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি...' গানটা শুনলেই আমার আবার সবসময় হারিয়ে যাবার ভয় হতো - কেন যে কে-জানে !! মনের মধ্যে ভেসে উঠতো বিশাল লম্বা একটা রাস্তার মাঝামাঝি গিয়ে আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছি - সীমাহীন রাস্তার দু'ধারে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা লম্বা ঘন-সবুজ গাছের সারি। মৃদু বাতাসের ভারে তারা আস্তে আস্তে দুলছে, আর আমাকে ইশারা-ইঙ্গিতে ফিসফিস করে কি যেন সব বলে চলেছে। সেই থেকে নতুন কোন পথে যাবার কথা ভাবলেই আমার শুধু পথ হারাবারই ভয় হতো।
গ্রীষ্মের অসহ্য গরমের হাত থেকে বাঁচতে আমরা সন্ধ্যা হতেই আমাদের তিনতলার বাড়ির ছাদটাতে, মাদুর হ্যারিকেন আর বই-খাতা সঙ্গে নিয়ে হাজির হতাম। পড়াশুনার শেষে মাদুরে চিৎ হয়ে শুয়ে তারাভর্তি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, শত-সহস্র, নিযুত-কোটি তারাদের মাঝে থাকা ছায়াপথের গোলকধাঁধায় হারিয়ে গিয়ে সহসাই চমকে উঠতাম - এ কোথায় চলে যাচ্ছি আমি!!
গ্রীষ্মের অসহ্য গরমের হাত থেকে বাঁচতে আমরা সন্ধ্যা হতেই আমাদের তিনতলার বাড়ির ছাদটাতে, মাদুর হ্যারিকেন আর বই-খাতা সঙ্গে নিয়ে হাজির হতাম। পড়াশুনার শেষে মাদুরে চিৎ হয়ে শুয়ে তারাভর্তি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, শত-সহস্র, নিযুত-কোটি তারাদের মাঝে থাকা ছায়াপথের গোলকধাঁধায় হারিয়ে গিয়ে সহসাই চমকে উঠতাম - এ কোথায় চলে যাচ্ছি আমি!!
নিঝুম নিশুতি রাতে একবার তীব্র জল-তেষ্টায় ঘুম ভেঙ্গে যায় - ধীর পায়ে বিছানা থেকে নেমে বাড়ির বারান্দায় এসে দেখি, জ্যোৎস্নার রুপালী আলো গায়ে মেখে আমাদের বাড়ির উঠানটা, ঠিক যেন ভরা বর্ষার পুকুরের মতো টলটল করে উঠেছে। ঝিঁঝি পোকাদের সমবেত হাঁক-ডাকও যে অজানা ভুবনের সঙ্গীত হয়ে উঠে মানুষকে ঝিম ধরা এক নেশায় ডুবিয়ে দিতে পারে, তা সেদিন প্রথম জানতে পেরেছিলাম। জল-তেষ্টা ভুলে সেদিন বহুক্ষণ একা একা বারান্দায় বসে, সেই অদ্ভুত অর্কেস্ট্রার মৌতাতে মজে গেছিলাম। এতো তীব্র মায়াময় ভুবনে আবার কখনো ফিরে উঠতে পারবো কি না, সে বিশ্বাসে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে।
ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে আমরা দু'জনে দুজনার মতো করে কল্পনার রাজ্যে ভেসে যাই। আমি দেখি ভেজা কদম, শুকনো খড়, পানের বরজ, নদীতে জোয়ার-ভাঁটা, আশ্বিনের ঝড়, আকাশ কালো করে ঝুম বৃষ্টি নামা, মেঘ-কুয়াশার লুকোচুরি, ভোরের দোয়েল পাখি, সোনালি ফসলের মাঠ, ছায়াময় স্নিগ্ধ ঘাসের পাটি... হঠাৎ করেই ও আমাকে চমকে দিয়ে বলে ওঠে "ওই দ্যাখো বাবা লাইটনিং ম্যাককুইন, ওই যে যাচ্ছে মুড-স্প্রিং ট্রাক !!" - ও আছে ওর কল্পনা রাজ্যে, CARS-এর মায়াবী জগতে - আর আমি ঘুরে চলেছি আমার স্বপ্ন-রাজ্যে - হারিয়ে যাবার শত চেষ্টা করেও ঠিক হারিয়ে যেতে পারছি না। খালি খালি ভয় জাগছে মনে... নিজের অজান্তেই কখন যে গুন গুন করে গেয়ে উঠি, "তোমায় আমি হারাই যদি তুমি হারাও না যে..."