Saturday, April 19, 2014

ফুল ফুটুক না-ফুটুক আজ বসন্ত...

কিশোর বয়সের কোন এক বন্ধুর কাছে প্রথম শুনেছিলাম যে 'প্রেম করলে প্রচুর হাঁটতে হয়' - যুক্তি হিসাবে সে বলেছিলো যে প্রেমিকাকে কারণে-অকারণে সারপ্রাইজ দিতে হলে চাই পকেটভর্তি টাকা, যা দিয়ে কথায় কথায় বাদাম-ঝালমুড়ি, আলুকাবলি-ফুচকা, রোল-ক্যাডবেরীর সাথে সাথে গচ্চা দিয়ে গোচ্ছা গোচ্ছা (রক্তবর্ণ) গোলাপ ফুল কিনে দিতে হবে - সে তার জন্মদিন আসুক, বা না-আসুক !! তা, অ্যাতো পয়সা আসবে কোথা থেকে? বাড়ি থেকে পাওয়া পকেটমানি দিয়ে তো বাবা অ্যা-ত্তো সব কুলোবে না। অগত্যা যেখানে পারবে সেখান থেকে পয়সা বাঁচাবে - সুযোগ পেলেই বাসে-ট্রামে না-চড়ে স্রেফ হাঁটবে - তাতে শরীরের ব্যায়ামও হবে, প্লাস প্রেমিকাকে মন-ভোলানো কথা বলার রিহার্সালটুকুরও সময় হয়ে যাবে।

তা, সে'সময়ে আমি প্রচুর হেঁটেছি - not necessarily for উপরে বর্ণিত কারণে - বরং রেকর্ডের কারণে। Wait !! হাঁটার রেকর্ড করার জন্যে নয় ! বরং সেকেন্ডহ্যান্ড, পুরানো গানের রেকর্ড খুঁজে খুঁজে স্বস্তায় কেনার জন্যে - mostly 'HMV', 'মেগাফোন' আর 'ইনরেকো' থেকে বার হওয়া আগেকার দিনের বাংলা আধুনিক গানের রেকর্ডের জন্যে। সেন্ট্রাল কলকাতার ধর্মতলার মোড় থেকে ওয়েলিংটন স্কোয়ার, অর্থাৎ 'রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার' হয়ে 'কলেজ স্ট্রীট' পর্যন্ত রাস্তাটা হলো একটা বিশাল 'L'-এর মতো। আমি বহুবার পয়সা বাঁচাতে, বাসে না-উঠে স্রেফ পায়ে হেঁটে ধর্মতলার মোড় থেকে কলেজ স্ট্রীট চলে আসতাম - তারপর সারা বইপাড়া চক্কর মেরে মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে সোজা শিয়ালদাহ স্টেশনে এসে বিনা-টিকিটে সাউথের ট্রেন ধরতাম। তা সেই ওয়েলিংটন স্কোয়ার রাস্তার দু'পাশে সে-সময় প্রচুর পুরানো রেকর্ডের দোকান ছিলো। তাদের কাছে প্রায় যে-কোন ধরনের বাংলা, হিন্দী, এমনকি ওয়েস্টার্ন অর্কেস্ট্রা, রক, পপ, ইনস্ট্রুমেন্টালের বিশাল কালেকশন থাকতো। কলেজ স্ট্রীটের বইয়ের দোকানগুলোর মতোই এদের নিজেদের মধ্যে নেটওয়ার্ক ছিলো দেখার মতো। কোনো রেকর্ড নিজের কাছে না-থাকলে সেটা আর কার কার কাছে থাকতে পারে, তা এরা চোখ বুজে, এক মূহুর্তে বলে দিতে পারতো। "Georgy Girl" সিনেমার বহুখ্যাত Georgy Girl গানটা যে Seekers নামে এক অস্ট্রেলিয়ান, ফোক বেসড মিউজিক্যাল গ্রুপ সৃষ্টি করেছিলো, তা প্রথম জেনেছিলাম ফুটো হয়ে যাওয়া, হাতকাটা গেঞ্জি পরে বসে থাকা এক বয়স্ক দোকানদারের কাছ থেকে। ছোপ কাটা, সস্তা চায়ের কাপে চুক-চুক করে চুমুক দিতে দিতে তিনি বলে চলেছিলেন ওই রেকর্ডের আর কোন কোন গানগুলো তাঁর ভালো লাগে। সে ছিলো এক সম্পূর্ণ অন্য জগৎ - আজকালকার অনলাইন পাইরেসি আর গুগল সার্চের জগতে যা কল্পনা করাও অবান্তর।

সেই একই ওয়েলিংটন স্কোয়ার রাস্তা ধরে লাস্ট বার কলকাতায় গিয়ে অনেকটা হেঁটেছিলাম - কোনো রেকর্ড কেনার বাসনা ছিলো না - সঙ্গে হেঁটে যাবার মতো কোনো প্রেমিকাও পাশে ছিলো না - স্রেফ হাঁটার জন্যেই হেঁটেছিলাম - বেশ কয়েক ঘন্টা ধরেই। কিন্তু কিছুক্ষণ হাঁটার পরেই, সত্যজিৎ রায়ের 'সোনার কেল্লা' ছায়াছবির সেই জয়সলমীরের ভাঙা-চোরা কেল্লার পথে দাঁড়ায়ে পড়া ছোট্ট মুকুলের মতোই দু'চোখ জলে ভর্তি হয়ে, গলা অবরুদ্ধ হয়ে, চাপা কান্না নেমে এসেছিলো। দোকানগুলো বেশিরভাগই আজ আর নেই - যেগুলো কোনওভাবে টিকে আছে তাদের চেহারা আরও খারাপের দিকে। অধিকাংশ দোকানেরই তাক ভর্তি থাক-থাক সস্তা MP3 আর কিছু ক্যাসেটের ঢল। রেকর্ড যা-কিছু আছে তা কোনমতে, সংকোচে মুখ নিচু করে দোকানের এক কোনে পড়ে রয়েছে - কেউ ভুলেও আর তাদের খোঁজ করেনা - অনেকটা বৃদ্ধাশ্রমে পড়ে থাকা অসহায়, ভগ্নপ্রায় পূর্বপুরুষদের মতো। আবারও মনে চলে এলো হারিয়ে যাওয়া আরেক বন্ধুর কথা: "Being 'Alone' is different from being 'Lonely'. One is by choice - other one is plain sad fate..."

শ্রদ্ধেয় সুভাষদা (কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়) মিছেই বলে গেছেন 'ফুল ফুটুক না-ফুটুক আজ বসন্ত...'


Sunday, April 13, 2014

তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে - শুভ নববর্ষ ১৪২১

ভাই, যতোই বলুন না কেন, 'শুভ নববর্ষ' বলার থেকে 'হ্যাপি নিউ ইয়ার' বললে নিজেকে বেশ অনেকটাই মডার্ন আর স্মার্ট দেখায় - তাই না? সত্যি করে বলুন - বিলিতী ইংরেজী ভাষায় কথা বলার মধ্যে বেশ একটা 'ইয়ে, ইয়ে' ব্যাপার আছে। খামোকা সেন্টিমেন্টাল না হয়ে ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে হবে। সেই 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' সিনেমার উৎপল দত্তের কথা মনে করে দেখুন - তাই বলছি, একগাদা ফালতু, বস্তাপচা, সেকেলে সেন্টু খেয়ে কোন লাভ আছে? আপনিই বলুন।

আমার কিন্তু চোখ বুজলে এখনও বেশ মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখের দিনে, বেশ ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে পড়তাম। বাবার কড়া আদেশ ছিলো, অন্তত ওইদিন বেশিক্ষণ ঘুমানো চলবে না। বাড়ির উঠানে জড়ো করা থাকতো কিছু ভেজা খড়-বিচুলি আর শুকনো ঘাস-পাতা। সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হতো - গল গল করে সাদা-কালো বিচিত্র গন্ধ-বর্ণ মাখা সেই ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়ে যেতো উপরে, আরও উপরে। আমরা ঘুম ঘুম চোখে সবাই, সেই ধোঁয়া-ভরা জায়গাটা একে একে যজ্ঞস্থান মনে করে গোল করে তিনবার প্রদক্ষিণ করতাম। তারপর ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে এক লাফ মেরে সেই ধোঁয়া-কুণ্ডলীকে অতিক্রম করতাম। পাশে দাঁড়িয়ে থেকে বাবা গম্ভীর গলায়, প্রায় মন্ত্র উচ্চারণের স্বরে বলে উঠতেন: “বিগত বছরের যাবতীয় শোক-দুঃখ, ভুল-ত্রুটি, ব্যথা-যন্ত্রণা, পাপ-কুকর্ম, সব ধুয়ে মুছে যাক - নতুন বছর আমাদের সকলের জন্য নিয়ে আসুক অফুরন্ত হাসি-আনন্দ-সৌভাগ্য, উৎসাহ উদ্দীপনা, চির-সবুজ সতেজতা” - রেডিওতে শোনা যেতো সেই চির-চেনা রবীন্দ্রসঙ্গীত: 'এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...'। বেলা গড়ালে নিমপাতা আর কাঁচা হলুদ বাটা, সর্ষে তেল দিয়ে সারা গায়ে-মুখে ডলে ডলে, ভালো করে মেখে পুকুরে সাঁতার কেটে খুব করে স্নান করতাম। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে নাম-না-জানা কতো লোক একের পর এক এসে হাজির হতো, শুভ নববর্ষ জানাতে। কেউ কেউ আবার গল্প-গুজবের ফাঁকে দিব্যি থেকে যেতো, দুপুরের খাবার খেয়ে তবে যেতো। মা মহা সমারোহে তৈরী করতেন দুপুরের খাবারের জন্যে নানান রকমের পদ। খেতে বসতে বসতে প্রায় বেলা দেড়টা বেজে যেতো। একসাথে সবাই মিলে বসে তুমূল চেঁচামিচি আর হৈ-হল্লার মধ্য দিয়ে আমরা শুরু করতাম ভুরিভোজন - শুক্তো দিয়ে হতো শুরু, আর শেষ হতো চাটনি-দৈ-মিষ্টি দিয়ে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসলে বাবার হাত ধরে গুটিগুটি বেড়িয়ে পড়তাম ধারে-কাছের নানান দোকানে হালখাতার নিমন্ত্রণ রাখতে। 'গনেশের মুদিখানা', 'ললিত বস্ত্রালয়', 'কান্ত মিত্রের সোনার দোকান',আরও অনেকগুলো দোকান - সবক'টার নাম এখন আর মনেও আসে না। লাল-নীল গার্ডার দিয়ে গোল করে বাঁধা একখানা কালেন্ডার, আর এক বাক্স মিস্টি সব দোকান থেকেই পাওয়া যেতো - কিন্তু বরফ দেওয়া ঠান্ডা লস্যি বা বোতল ভর্তি কোকাকোলা দিতো শুধু সোনার দোকানগুলোতেই। তাই ওই সব দোকানগুলোতেই যেতাম আগে আগে। প্রচুর ভীড় ঠেলে ঠেলে, সেই মিস্টির বাক্স আর ক্যালেন্ডারগুলোকে সাবধানে দোমড়ানো-মোচড়ানোর হাত থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে বাড়ি ফেরা, কোন যুদ্ধ জয়ের থেকে কম কিছু ছিলো না। সাদা রংয়ের মিষ্টির বাক্সগুলো ভর্তি থাকতো বোঁদে/সীতাভোগ, মিহিদানা, পান্তুয়া আর ল্যাংচা দিয়ে। সারা বছরে হাতে-গোনা যে কয়েকবার বাড়িতে লুচি, আলুর-দম রান্না হতো, পয়লা বৈশাখের রাত ছিলো তাদের মধ্যে একটি। গরম গরম লুচি-আলুর দম শেষ করবার পরে, সেই মিষ্টিগুলো খেতে যে কি অস্বাভাবিক ভালো লাগতো, তা হয়তো ঠিক লিখে বোঝানো যাবে না। খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকলে কোন ঘরের দেওয়ালে কোন ক্যালেন্ডার টাঙাবো, তা ঠিক করতে করতেই রাত কাবার হয়ে যেতো।

আর এখন?
পয়লা বৈশাখের দিনে, সকাল সাড়ে-সাতটায় MP3-রুপী চৌরাশিয়ার বাঁশি হাই-ফাই মিউজিক সিস্টেমে সুরের মূর্ছণা ছড়ালে পাশের ঘর থেকে হুমকি শোনা যায়: “ম্যা-ন, হোয়াট আর ইয়ু ডু-ইং !! মা গো, আর কতোকাল এ-যন্ত্রণা সইতে হবে !! এই ভোরবেলা টুকুতেই যা-এট্টু ঘুমোই আমি !!!” - অগত্যা চৌরাশিয়াকে বাঁশি-হারা করে, চোরের মতোই প্রায় নি:শব্দে চা-তৈরী করে ল্যাপটপে ব্রাউসিংয়ের মধ্য দিয়ে হারানো পয়লা বৈশাখের স্মৃতি হাঁতড়ে বেড়াই। বেলা গড়ালে নিদান আসে: “বলি শুনছো? সল্টলেকের 'কট-এন্ড-বোল্ড', কিম্বা 'সিক্সথ বালিগঞ্জ প্লেস'-এ বুকিংটা আগে থেকেই করে দাও। মেনুতে 'ডাব-চিংড়ি'-টা আছে কিনা ভালো করে শিওর হয়ে নিও, তাহলে দারুন জমে যাবে - বু-ঝে-ছো? ছোটপিসি আর রাঙাকাকুদের ওখানেই মিট করতে বলে দেবো - সোজা চলে আসবে নববর্ষ করতে। আবার হাঁদার মতো যেন বাংলাতে জিজ্ঞাসা কোরে বোসোনা - বোলো, 'প্রনস কুক্ড ইন টেন্ডার কোকোনাট ক্রিম'...” - আমি খান-কতক ঢোঁক গিলে, খাবি খেয়ে শুনে যাই খালি, আর মনে মনে ভাবি - হায়রে বাঙালী ! দেখ, আসলি হাঁড়ির হাল কাকে বলে ! - যাই হোক, 'শুভ নববর্ষ ১৪২১' ....