Tuesday, October 23, 2012

ছেলেবেলার দিনগুলো...

ছেলেবেলা দিগুলো...

                                                          
ভাবি বসে আবার যদি পেতাম হারানো সব দিন,
   ছোট হাসির, ছোট খুশির, ফেলে দেওয়া দিন -
  আজ বুকে করে তারে তুলে নিতাম...




ছেলেবেলার দিনগুলো একটু নয়, এখনকার থেকে বেশ অনেকটাই অন্যরকম ছিল। সে সময় না ছিলো কোনো আই-ফোন/আই-প্যাড, না ছিলো কোনো ভিডিও গেমস বা স্যাটেলাইট চ্যানেলের-র দৌরাত্ম। কিন্তু তাতে মনে হয় না কোনো কিছু মিস করেছি। আমাদেরকে ঘিরে থাকতো এক রাশ নি:স্বার্থপর মানুষের দল - যাঁরা কোনো কিছুর প্রত্যাশা না করেই আমাদের ছেলেবেলার প্রতিটি দিনকে ভরিয়ে তুলতেন হাসি-ঠাট্টা-গান-আনন্দ দিয়ে। আর ছিলো অসাধারন সুন্দর রাশি রাশি রল্পের বই, রূপকথা, পক্ষীরাজ, ভুত-প্রেত, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী, ঠাকুরমার ঝুলি, আরব্য রজনী, দিগন্ত জোড়া মাঠ-গাছ-পালা। শীতের আকাশ ভরে যেতো ঘুড়ির ঝাঁকে। বিকেল হলেই ছেলেরা বল হাতে নেমে পড়তো মাঠে, ফিরতো সেই সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলে। তখন না ছিলো কোনো IPL, না ছিলো 'মিরাক্কেল' তাই স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই যে এখনকার দিনের ছেলেমেয়েদের  তুলনায় আমরা হাজার কেন, কোটি গুন বেশি আনন্দে মানুষ হয়েছিলাম। স্মৃতির গোলকধাঁধার অন্ধকারে হারিয়ে যাবার আগে সেই পুরানো দিনগুলির কিছু কিছু ঘটনা এখানে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। হয়তো ভবিষ্যত প্রজন্মের কেউ কেউ এটা পড়ে সেই সব হারিয়ে যাওয়া  দিনগুলোর রোমাঞ্চ অনুভব করার চেষ্টা করবে।

আমাদের বাড়িটা ছিলো লম্বা 'L'-প্যাটার্নের, বেশ বড় দখিন মুখ খোলা এক বাড়ি। বাড়ির মধ্যে বিশাল একটা উঠান ছিলো, যার মাঝখানে পদ্মফুল আঁকা মোজাইক করা গোল মতো ছোট্ট একটা অংশ ছিলো। ওই জায়গাটা অমন কেন করা হয়েছিলো তার আসল কারণ জানা নেই। কিন্তু যতদুর মনে পরে ওটা ছিলো আমার পিসেমশাইয়ের বুদ্ধি। তিনি ছিলেন পরম বৈষ্ণব ভক্ত। ঐ জায়গাটাতে 'সত্য নারায়ণ' পূজার সিন্নি দেবার জন্যে একটু আলাদা করে তৈরী করেছিলেন। যাই হোক, আমরা ওটাকে সেন্টার করে নানান খেলা খেলতাম - কানা-মাছি, ছু-কিতকিত, এক্কা-দোক্কা, কুমীর-ডাঙ্গা, রুমাল-চোর। কালীপূজার সময় ওখানেই তুবড়ি, চরকি বা রকেট বাজি রেখে আগুন দেওয়া হতো। বিভিন্ন পূজা অনুষ্ঠানে ওই জায়গাটা কে আল্পনা দিয়ে সাজানো হতো। বিয়ের সময় নতুন বউ এসে ওখানে দাঁড়াতো আর বাড়ির মেয়েরা তাকে বরণ করা শুরু করতো।


জোস্না রাতে চাঁদের রূপালী আলোয় সারা উঠানটা ঝকমকে হয়ে থাকতো। লোডশেডিং-এর কালো হাত সেই আলোকে ঢাকতে পারতো না। উঠানের ধারে হয়ে থাকা লম্বা লম্বা ফুল গাছের ডালপালার ছায়ারা সেই আলোতে নানান রকমের শেপ-এর সৃষ্টি করতো। কখনো মনে হতো একটা বিশাল শিয়াল, বা দৈত্য বা ঝাঁকরা মাথা কোনো বিশাল লোক দাঁড়িয়ে আছে। অন্য দিকে একটা বিশাল কৃষ্ণচূড়া আর নিমগাছ ছিলো। ওই নিমগাছের কল্যাণে যে কতো কেটে যাওয়া ঘুড়ি ধরা পড়তো তার ঠিকানা নেই। প্রতি বছর বসন্ত কালের সেই ভয়ানক রোগের সময় দূর দুরান্ত থেকে কতো চেনা-অজানা লোকে এসে নিম গাছের ডাল-পাতা নিয়ে যেতো। এছাড়া নিমপাতা ভেজে খাওয়া বা বেটে গায়ে মাখা, নিম ডালের তৈরী দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজা - এ সব তো ছিলোই। মনে আছে প্রতিবছর পয়লা বৈশাখের ভোরবেলাতে বাবা উঠানের মাঝখানে বেশ কিছু খড় জমা করে আগুন জ্বালিয়ে তার উপর শুকনো ঘাস-পাতা আর জল ঢেলে ধোঁয়ার সৃষ্টি করতেন। এটা ছিল পুরানো একটা বাঙালি  রিচুয়াল। অবশ্য জানিনা এ যুগের বাঙালিরা এর খবর জানে কি না। যাই হোক, ওই দিন আমাদের ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি  উঠে সেই আগুন-ধোঁয়া জায়গাটা তিনবার প্রদক্ষিণ করে আড়াআড়ি ভাবে লাফ দিয়ে পার হতে হতো। আর মনে মনে বিগত বছরের জমে থাকা যাবতীয় অপকর্মের জন্যে ভগবানের কাছে ক্ষমা চেয়ে এবং নতুন বছরটা যাতে ভালোভাবে কাটে তার জন্যে প্রার্থনা করতে হতো। ঘুম থেকে অত ভোরবেলা উঠতে একটু খারাপ লাগতো ঠিকই, কিন্তু যখন দেখতাম বাড়ির বাকি সবাই অলরেডি উঠে গেছে তখন আর কিছুতেই শুয়ে থাকতে পারতাম না। বাড়ির বিড়াল টাকেও সঙ্গে নিয়ে প্রদক্ষিণের চেষ্টা করতাম। কিন্তু বিড়ালরা ধোঁয়া সহ্য করতে পারে না, তাই অগত্যা আমাকে একা একাই ঘুরতে হতো। মা-পিসিমারা এইদিন কাঁচা হলুদ আর নিম পাতা শিলনোড়াতে বেটে পেস্টের মতো করে রাখতেন। সেটা দিয়ে গুরুজনেদের পায়ে স্পর্শ করে প্রণাম করতে হতো। এরপর সর্ষের তেল দিয়ে সেই বাটা সারা গায়ে-মুখে-পিঠে ভালো করে মেখে, কিছুক্ষন অপেক্ষা করে তারপর স্নান করতে হতো। ত্বকের যাবতীয় রোগ সরিয়ে দিতো এই বাটা - অসাধারণ ছিলো তার ভেষজ গুণ। 


আমাদের বাড়িতে সেই সময় দুটো  সাদা গরু, একটা সাদা বিড়াল আর একটা কুকুর ছিলো। এই দিন গরুগুলোকেও স্নান করানো হতো। সে এক বিশাল ব্যপার। কুকুরটাকে ধরে পুকুরে ফেলে দেওয়া হতো - সে মহা আনন্দে সাঁতার কেটে পাড়ে চলে আসতো। কিন্তু বিড়ালটা জলের সাথে এ জাতীয় আহ্লাদ একদম পছন্দ করতো না। সে ধোঁয়াপর্ব শেষ হবার আগেই ভেগে পড়তো। বেলার দিকে বাড়িতে ফিরে আসলে ছোটদি তাকে ধরে জোর করে আলতা দিয়ে সাজিয়ে দিতো। সাদা ধপধপে বিড়ালের কান, কপাল আর থাবা চারখানা লাল আলতা দিয়ে লেপে দেবার পর তাকে অদ্ভুত দেখাতো - যেন একটা বনসাই বাঘ! এমন কি অন্য বিড়ালরাও তাকে এসময় এড়িয়ে এড়িয়ে চলতো। একটু বেলা হয়ে গেলেই শুরু হতো বাড়ির পুকুর থেকে জাল দিয়ে মাছ ধরা। বাবা জাল হাতে করে পুকুরের জলে নেমে পড়তেন, আর আমি বা বাড়ির কাজের ছেলেটা বালতি হাতে করে পাড়ের ধার দিয়ে ঘুরে ঘুরে জালে ওঠা মাছগুলোকে বালতির মধ্যে জমা করতাম। বাজার করতে যাওয়া লোকজনেরা মাঝে মাঝেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করতো কি মাছ উঠেছে বা কটা মাছ উঠলো - এই সব! মাছের লোভে লোভে বিড়ালটাও এই সময় আমাদের থেকে একটু দুরত্ব রেখে রেখে ঘুরতো - যদি কোনো ভাবে একটা টাটকা মাছ পাওয়া যায়, আর কি! এই দিনের রান্নার আয়োজন একটু বড়সড় করেই করা হতো। দুপুর বেলায় সবাই মিলে যখন একসাথে খেতে বসতাম তখন মনে হত যেন ছোটখাটো একটা বিয়ে বাড়ি! সে মাছের স্বাদ তেমন হয়তো ছিলো না, রান্নাবান্নাও হয়তো হতো খুবই সাধারণ মানের, কিন্তু সেই একসাথে খেতে বসার মজা, আনন্দ আর আমেজ এখনকার দিনের নামী-দামী, ফাইভ ষ্টার রেস্তুরাঁর সেরা মেনুকেও হার মানায়। 


সেই নিম গাছকে একদিন কেটে ফেলা হলো। আমি তখন এত ছোটো যে আমার ঠিক মনেও নেই যে কি কারণে কাটা হয়েছিলো। তবে যতদুর মনে হয় নিমগাছের শিকড়গুলো ক্রমশ বেড়ে গিয়ে উঠানের পাঁচিলের ভিঁত নড়িয়ে দিচ্ছিলো, আর পাড়ার লোকেদেরও কমপ্লেন ছিলো যে ওই নিমগাছে নাকি ব্রম্ভদৈত্য আছে! আমি কিন্তু কোনদিন অশুভ কিছু দেখিনি বা ফিল করিনি। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় যে সেই বিশাল নিমগাছকে অকালে কেটে ফেলে যে অন্যায় করা হয়েছিলো, তার ফল আমাদেরকেই নানান ভাবে পেতে হয়েছে, বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া সময়কে তো আর ফেরানো যায় না। মানুষ কত কিছু পারে - আবার কত সামান্য জিনিষও পারেনা। বৃথাই আমরা গর্ব করি আমাদেরকে  নিয়ে - নকল টেকনোলজির  মোহে পরে হাজার হাজার টাকা নষ্ট করে গ্যাজেট কিনে ঘর সাজাই দিনের পর দিন! 

ছোটবেলা থেকেই বিড়ালের প্রতি আমার একটা বিশেষ টান গড়ে উঠেছিলো  - কেন তা জানিনা। যদিও ভালো করেই জানতাম যে ডিপথেরিয়ার মতো মারাত্মক অসুখ বিড়ালের থেকেই হয়। আমাদের পরিবার ছিল বেশ বড়সড়, একান্নবর্তী। কিন্তু পরিবারের সকলেই কমবেশি বিড়াল পছন্দ করতো। একটাও বিড়াল নেই এরকম সময় আমার ছোটোবেলার জীবনে খুব কমই এসেছিলো। অদ্ভুত শোনালেও আমাদের বাড়ির সব কটা বিড়ালের নাম-ই ছিলো এক: 'মেনি' ! এমনও হয়েছে যে বিড়ালটা ছিলো এক হুলো বিড়াল, কিন্তু তাকেও ওই একই 'মেনি' নামে ডাকা হতো।

এই বিড়াল নিয়ে বেশ কিছু মজার ঘটনা মনে পড়ছে - যদিও মনে হয়না যে এই সব কটা ঘটনাতেই একই বিড়াল জড়িত ছিলো।

বিড়াল-১  
আগেই বলেছি আমদের একটা বেশ বড় পুকুর ছিলো। পুকুরের নামার মুখে বসার জন্যে সিমেন্টের বাঁধানো চারখানা সিট আর বেশ অনেক কটা ধাপ-ধাপ কাটা সিঁড়ি ছিলো। গ্রীষ্মকালে আমরা এই সীটগুলোতে এসে বসতাম। সারা দিনের দাবাদহের পরে বিকেলবেলার দিকে পুকুর থেকে আসা ঠান্ডা হওয়াতে মন প্রাণ জুড়িয়ে যেত। বাবা এই পুকুরে মাছের সীজনে নানান রকমের চারামাছ ফেলতেন - ট্যাংরা, কই, মৃগেল, রুই, বাটা, সিলভার কাপ, আরও কত কি। বাঁক কাঁধে করে জেলেরা এসে ভালো ভালো কথা বলে মাছ গছিয়ে দিয়ে যেতো, যার বেশির ভাগ-ই হতো খুব নিম্ন মানের। সাইজে খুব একটা বাড়তো না, আর স্বাদ-ও ছিল বেশিরভাগ সময়ে বাজারের কেনা মাছের থেকে অনেক খারাপ। হয়তো আমাদের পুকুরের মাটি বা জলেরও তেমন কোনো গুণ ছিল না। সে যাই হোক, এইসব চারা মাছেরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতো। আমাদের পুকুরে ধাপ কাটা কাটা সিঁড়ির একদম শেষ সিঁড়িতে জলে ডুবিয়ে রাখা থাকতো এঁটো-কাঁটা হাঁড়ি কড়াই। সেই সব  হাঁড়ি কড়াইতে লেগে থাকা খাবারের লোভে মাছেরা দল বেঁধে সিঁড়ির কাছে এসে হানা দিতো। এমনও হয়েছে যে এক দিকে মানুষজন হাত পা ধুচ্ছে আর অন্য দিকে মাছের দল নিশ্চিন্তে খাবার খেয়ে যাচ্ছে। হয়তো বাচ্ছা মাছ বলেই মানুষের প্রতি অতটা ভয় তখনো তাদের জেগে ওঠেনি। 
সবাই জানে মাছের প্রতি আছে বিড়ালের চিরন্তন লোভ। আমাদের বিড়ালটাও মাছেদের এই বাড়াবাড়ি সাহস লক্ষ্য করেছিলো। এক বিকালবেলা সীটে বসে গল্প বই পড়ার জন্যে এসে দেখলাম যে বিড়ালটা সিঁড়ির একদম শেষ ধাপে মূর্তির মতো বসে একমনে জলের দিকে চেয়ে আছে। বুঝলাম যে সে ওখানে আসা মাছেদেরকে লক্ষ্য করছে। আমি কয়েক বার ডেকেও তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলাম না। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলো - আমি আমার হাতের গল্পের বইতে তখন মনোনিবেশ করে আছি। হঠা চমকে উঠলাম বড়সড় একটা ঝাপ্টাঝাপ্টির আওয়াজে। দেখি আমাদের বুদ্ধিমান বিড়াল জল থেকে দ্রুত উঠে আসছে - ভিজে একেবারে পাটিসাপটা!
বুঝলাম মাছ ধরার প্ল্যান করে উনি জলে ঝাঁপ মেরেছেন, কিন্তু মাছেরা যে ওনার থেকেও বেশি বুদ্ধিমান আর সুইফ্ট, সেটা ওনার ছোট্ট মাথায় আসেনি! অগত্যা যা হবার তাই হয়েছে। মাছের দল ধীরেসুস্থে পালিয়ে গেছেন আর উনি অসময়ে জলে ঝাঁপ মেরে বৃথাই নাকানী চুবানি খেয়ে, গোবর গনেশ হয়েছেন। কোনো মাছই ধরা পড়ে নি। সেই প্রথম আমার জীবনে দেখা কোনো বিড়ালের স্বেচ্ছায় জলে অবতরণ! এর পরে অবশ্য আর কোনদিনও তাকে এই একই ভুল করতে দেখিনি। 


বিড়াল-২ 
ছোটবেলার জীবনে দুঃখকষ্ট অনেক ছিলো, কিন্তু আনন্দের অভাব কখনোই অনুভব করিনি। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণেই বেশিরভাগ দিন-ই আমাদের নিরামিষ পদ রান্না হতো। মাঝে মাঝে আমরা ছিপ দিয়ে পুকুর থেকে মাছ ধরার চেষ্টা করতাম। বেশিরভাগ সময়েই ছিপে কই কি বাচ্ছা রুই মাছ ধরা পড়তো। পুকুরের সিঁড়ির ধারে একটা জবা গাছ বেড়ে উঠেছিলো, যার ডালপালা বেশ অনেকটাই বড় হয়ে ছাতার কাজ করতো। একদিন আমি এই জবা গাছের নিচে ছিপ ফেলে বসে আছি। আমার কাছাকাছি আমাদের সাদা বিড়ালটাও চুপচাপ বসে আছে। হঠাত দেখি ছিপের ফাতনাটা ডুবে ডুবে যাচ্ছে। বুঝলাম মাছ এসে টোপ গিলেছে। উত্তেজনার বসে ছিপ ধরে মারলাম খুব জোরে এক টান। এতো জোরে টান মেরেছি যে মাছ সমেত ছিপের দড়ি প্রায় ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গিয়ে জড়ালো মাথার উপরে থাকা জবা গাছের ডালপালায়। আমার সাথে সাথে আমার পাশে বসা বিড়ালটাও মাছের এই শুন্য পথে উড়ান লক্ষ্য করেছিলো। আমরা দুজনেই তাড়াতাড়ি গাছের দিকে এগিয়ে গেলাম। মাছটা খুব একটা ছোট ছিলো না। ডালে ঝোলা মাছের ঝাপটানি দেখে বিড়ালটা লোভে অস্থির হয়ে উঠলো। আমি তাড়াতাড়ি করে জবা গাছের ডাল থেকে মাছ আর ছিপের দড়ি ছাড়িয়ে নিয়ে বাড়িতে চলে  এলাম মা'কে দেখাতে যে এই মাছটা কে ছেড়ে দেবো  কি না। বঁড়শীর বাঁকানো অংশটা  থেকে মাছের ঠোঁঠ ছাড়াতে বেশ বেগ পেতে হলো - কারণ মাছটা টোপটা  বেশ ভালো করেই গিলেছিলো। মা বললো  যে আর মাছ ধরতে হবে না - ওটাতেই সে রাতের রান্না হয়ে যাবে। সুতরাং আমি ছিপ গুছিয়ে রেখে দিলাম। তার বেশ কিছু পরে কি একটা কাজে আমি আবার পুকুরের দিকে গেলাম। অবাক হয়ে দেখলাম আমাদের বিড়ালটা তখনও সেই একই ভাবে জবা গাছের ডালের দিকে ঘাড় উঁচু করে এক দৃষ্টিতে চেয়ে বসে আছে!! আমি যে অনেক আগেই মাছটাকে নিয়ে চলে গেছি সেটা সে বুঝতেও পারেনি বা বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। সে তখনও ভেবে চলেছে যে মাছটা জবা গাছের কোনো ডাল পাতার আড়ালে লুকিয়ে ঝুলছে, আর কোনো এক সময়ে ঝুপ করে নিচে পড়ে যাবে! তখন তিনি সেটাকে ধরে খাবেন!!
অবশ্য প্রশ্ন উঠতেই পারে যে কে বেশি লোভী ছিলো সেই দিন - মানুষ না বিড়াল? তবে লোভ বা নৃশংসতা, এই দুয়ের কোনোটাতেই মানুষের কাছাকাছি কোনো জীব আছে, বা ছিলো কি এই পৃথিবীতে?


বিড়াল-৩  
আমাদের বাগানটা ছিল বেশ বড় - আম, পেয়ারা, কাঁঠাল, কুল, নারকেল, সুপারি, লিচু, জামরুল, গোলাপজাম, কলা গাছ , করমচা, চালতা, ফলসা, সবেদা, বাতাবি লেবু আরো হরেক রকম ফলের গাছে ভরা ছিল জায়গাটা। ফুলের গাছও  ছিল বেশ অনেক রকমের - হাস্নুহানা, কদম, বাসক, গোলাপ, দোপাটি, কাঞ্চন, অপরাজিতা, মাধবীলতা, বুগেন্ভলিয়া, জবা, রঙ্গন, শ্বেত পদ্ম, গন্ধরাজ...  এ ছাড়া ইউটিলিটি সব্জি, যেমন লাউ-কুমরো, লঙ্কা, পেঁপে, ডুমুর, পালং/পূঁই/কলমী শাক, ওল-কচু, বেগুন, ঢেঁড়স, থানকুনি পাতা, ইত্যাদি তো ছিলই। এত বড় বাগান ওই অঞ্চলে আর কোথাও ছিলনা। সেই জন্যে অনেক সময় সাপ-খোপ, পেঁচা, বাদুড়েরও উপদ্রব হতো। মাঝে মাঝে 'শোড়েল' বলে শিয়ালের মতো এক জন্তু রাতের বেলা হানা দিতো। তার গায়ে থাকতো এক বিশ্রী রকমের গন্ধ, যা বহুদূর থেকে নাকে আসতো। তা থেকেই বুঝতে পারতাম যে বাগানে শোড়েল এসেছে! তখন টর্চ, লাঠি-সোঠা নিয়ে বাগানে গিয়ে তাড়া করা হতো। বাদুড়রা অন্য কোথাও থেকে বাক্স বাদাম নিয়ে এসে রাতের বেলা গাছের ডালে ঝুলে ঝুলে খেতো। কিন্তু  বাক্স বাদামের খোলা খুলে খাওয়া সহজ কথা নয় - তাই বেশিরভাগ সময় ওরা কিছুটা চিবিয়ে বাদামটা ফেলে চলে যেতো। পরের দিন সকালে গিয়ে আমরা সেই সব বাদাম খুঁজে খুঁজে বাড়িতে নিয়ে এসে ভালো করে ধুয়ে হাতুড়ি দিয়ে ভেঙ্গে খেতাম। খেতে আহামরি হয়তো তেমন ছিলো না, কিন্তু সেই বয়সে এই ভাবে  বাদাম খোঁজার মধ্যে বেশ রোমাঞ্চ লুকিয়ে থাকতো। যাই হোক সেই বাগানে মাঝে মাঝেই বাইরে থেকে একটা কুকুর এসে তার প্রাত্যহিক কৃতকর্ম করে যেতো। বাগানের চারদিকে উঁচু পাঁচিল দেওয়া ছিল, কিন্তু ঢোকার মুখের যে গ্রীলের গেট টা  ছিলো সেটার মধ্যে দিয়ে কুকুর অনায়াসেই গলে যেতো পারতো। ঢিল ছুঁড়ে বা তাড়া  করেও সেই কুকুরকে ভয় দেখানো যায় নি। তাছাড়া কুকুরটা ছিলো অত্যাধিক চালাক। সে যেন জানতো যে কোথায় কখন কে আছে।
এই সময় আমাদের বাড়িতে যে পুঁচকে বিড়ালটা  ছিলো সে বয়সে তখন বড় জোর তিন কি চার মাস হবে। প্রচন্ড চটপটে আর ফুল অফ এনার্জি ! সেও বুঝে গেছিলো যে আমরা কুকুরটাকে ভয় দেখাতে চাই। বাগানের ঘাসগুলো ছিলো বিড়ালের থেকে উঁচু হাইটের - তাই ঘাসের মধ্যে বসে থাকলে তাকে চট করে খুঁজে পাওয়া যেতো না। একদিন আমি বাড়ির দোতলা থেকে লক্ষ করলাম যে কুকুরটা বাগানে ঢুকে তার পছন্দ মতো জায়গা খোঁজা শুরু করেছে। সবে ভাবছি যে নিচে নেমে তাড়া করবো, এমন সময় দেখলাম আমাদের সেই পুঁচকে বিড়ালটা ঘাসের মধ্যে দিয়ে খুব আস্তে আস্তে কুকুরটার পিছনে যাচ্ছে। এত নিঃশব্দে যাচ্ছে যে কুকুরটা খেয়ালও করেনি। কুকুরটা যেই তার কৃতকর্ম শুরু করেছে, ঠিক সেই সময় বিড়ালটা তার পিছনে এসে হঠাত 'ম্যাওওও' বলে এক লাফে নখ দাঁত বার করে কুকুরের পিঠে চড়ে বসলো - ঠিক যেমন ঘোড়ার পিঠে সহিস উঠে বসে! কুকুরটা এই অতর্কিত আক্রমনের জন্যে একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না। সে ব্যাটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে, প্রাতকৃত্য বাকি রেখেই কেঁউ কেঁউ করতে করতে দিলো লম্বা এক দৌড়। একবার ফিরেও দেখলো না যে তার প্রতিপক্ষ একটা ছোট্ট পুঁচকে বিড়াল... সেই যে পালালো আর কোনদিনও তাকে বাগানে দেখিনি। আমরা সবাই মিলে যা কুকুরটা কে শেখাতে পারিনি, ঐ ছোট্ট  বিড়াল তা একদিনেই করে ফেলেছিলো। অনেক সময় শাসন করেও যা শেখানো যায় না, ভয় দেখিয়ে তা কিন্তু সহজেই আদায় করা যায়!

এই একই বিড়াল আরেকটু বড় হয়ে অচেনা এবং ভিতু মানুষদের ভয় দেখাতো - বিশেষ করে একা একা যাওয়া আসার সময়। সে কোথাও কিছু নেই, আচ্চমকা ছুটে এসে পায়ের হাঁটুর কাছের মাংস ধরে একটু ঝুলেই পালিয়ে যেতো। অনেক সময় তার নখের আঁচড়ে রক্ত পর্যন্ত বার হয়ে যেতো। কিন্তু বকে বা মেরে তার এই দুঃসাহসিক খেলা বন্ধ করা যায় নি। আমাদের বাড়ির বাইরের গ্রীলের গেট থেকে দরজা পর্যন্ত আসতে যেটুকু গলি মতো ছিলো, সেই জায়গাটাতে ছিল তার অবাধ রাজত্ব। চেনা মানুষদের যাওয়া আসার সময় সে কোনো ভ্রুক্ষেপ করতো না। কিন্তু অচেনা আর ভিতু মানুষদের কাছ থেকে সে মাশুল নিয়েই  ছাড়তো। আমার দুই ভাগ্নী আমাদের বাড়ির কাছাকাছিই এক ভাড়া বাড়িতে থাকতো। তারা প্রায় প্রতি বিকেল বেলাতেই আমাদের বাড়িতে খেলতে আসতো, কারণ আমাদের একটা বড়  উঠান ছিলো আর তাদের সমবয়সী অনেকই সেখানে খেলতে আসতো এদের মধ্যে ছোটোজনটি ছিলো কম্পারেটিভলি বেশি ভীতু। সেটা বিড়ালটাও না জানি কেমন করে বুঝে গেছিলো। তাই তারা যখন দু'জনে আমাদের বাড়িতে ঢুকতো, সে ওই ছোট জনকেই টার্গেট করতো। কোথায় যে সে ওদের জন্যে লুকিয়ে ওয়েট করে থাকতো, তা তারা কিছুতেই ধরতে পারতো না!  আর বড়জনও তাই ছোটো বোনকে গার্ড হিসাবে পাশে পাশে রেখে হাঁটতো! বিকেলবেলাতে আমরা অপেক্ষা করতাম ওদের জন্যে - যেই শুনতাম 'ও মামা, বিড়ালে কামড়ে দিলো  গো ...'  বলে এক বিকট আর্ত্মনাদ... তখনি বুঝে যেতাম যে তারা এসে গেছে। ফেরার সময়ও হত এই একই ঘটনার পুন:প্রচার। তাই অনেকদিন-ই ফেরার সময় ওদেরকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে হতো। সুতরাং 'হাইড-এন্ড-সীক' কেবল যে মানুষরাই খেলে এটা ঠিক কথা নয়। 
এতো রসিক বিড়াল আমাদের বাড়িতে আর দুটো আসেনি।


বিড়াল-৪   
আমাদের বাড়িতে উঠানের গায়ে গায়েই একটা ভাঁড়ার ঘর ছিলো। সেটাতে মূলত বাগানের ডাব-নারকেল, সুপারি, সবেদা,বাতাবি লেবু আর ধানের বস্তা রাখা হতো। পিসেমশাইয়ের বেশ কতক বিঘা ধানী জমি ছিলো - সেটাতে তিনি লোক দিয়ে ধান চাষ করাতেন। খুব সম্ভবত আমন আর আউশ ধান চাষ হতো। প্রতি বছরই যে ভালো ফলন হত তা নয়, কিন্তু হতো। তবে ভালো ফলনের ধান  পিসেমশাই নিজেদের জন্যে না রেখে বিক্রি করে দিতেন, যা নিয়ে অনেক অসন্তোষ দেখা দিতো - সে কথা আপাতত বলছি না। এছাড়া হাবিজাবি কাঠ, দা-কুড়ুল, কেরোসিন তেল, ইত্যাদিও থাকতো সেই ভাঁড়ার ঘরে। তবে ঘরটার অবস্থা তেমন ভালো ছিলো  না। শুধু  চার দেয়ালগুলো কোনরকমে ইঁট দিয়ে গাঁথা ছিলো, আর মাথায় ছিলো টালির ছাদ, যার অনেকগুলোই  আবার ভাঙ্গা। ছাদের কাঠের অবস্থাও তেমন মজবুত ছিলো না, যার ফলে ভারী চেহারার কেউ ওই ছাদে সহজে উঠতে চাইতো না। ধানের জন্যেই বোধ হয় ইঁদুরের খুব উপদ্রব ছিলো। ইঁদুর মারা বিষ ব্যবহার করেও কোনো লাভ হতো না - কারণ ইঁদুর গুলো চালাক ছিলো। তারা সহজে বিষমাখা খাবার খেতো না, বা খেলেও তারপর জল খেয়ে নিতো - যার ফলে বিষ ঠিকঠাক কাজ করতো না। আমাদের প্রতিবেশী কৃতি-দির মা তখন আমাদের বাড়িতে গল্প করার জন্যে প্রায়-ই আসতেন। তাঁরা এককালে জমিদার ছিলেন - বেশ বড়লোক - আর তাঁদের বাড়িতে প্রচুর পোষা বিড়াল, পাখি, কুকর ছিলো।  তিনিই বুদ্ধি দিলেন বাড়িতে একটা বিড়াল পুষতে। আমার তো শুনে মহা আনন্দ। সেই প্রথম বোধ হয়  আমাদের বাড়িতে বিড়ালের আবির্ভাব হয়েছিলো। যাই হোক একদিন আমি আর পিসিমা ঘটা করে ওদের বাড়ি থেকে ছোট্ট একটা ফুটফুটে, সাদা বিড়ালছানা নিয়ে এলাম। কান আর লেজ ছাড়া তার শরীরের সব অংশই ধপধপে সাদা - দূর থেকে দেখলে তাকে অনেকসময় খরগোশের বাচ্ছা বলেও মনে হতো। মহা উত্সাহে তার সাথে খেলতাম। এক মুহূর্ত তাকে না দেখলে মনে হত কতোদিন দেখিনি! কিন্তু সে ভালবাসা বেশিদিন টিকলো না - মানুষের প্রেমিকার মতোই সে প্রথম কয়েক মাস আমার সাথে সাথে খুব ঘুরলো। অন্য কেউ ডাকলে আসুক বা না-আসুক, আমি ডাকলেই যেখানেই থাকুক না কেন ঠিক দৌড়ে চলে আসতো। কয়েক মাস বাদে যখন সে একটু সাবালক হলো,  আমাকে পাত্তা দেওয়া বন্ধ করে দিলো। তখন তার আলাদা একটা জগত হয়ে উঠেছিলো। কোলে নেওয়া আর তেমন পছন্দ করতো না - সকাল হলেই বাড়ির বাইরে গিয়ে পাঁচিলে উঠে বসে থাকতো। কেবল খাবার সময় হলে আর সন্ধ্যা হয়ে গেলে বাড়িতে চলে আসতো। প্রচন্ড ডিসিপ্লিনড আর শিকারী ছিলো এই বিড়াল। আমরা তখন মাটিতে পিঁড়ি পেতে বসে খেতাম। কিন্তু খাবারের থালা খোলা পড়ে থাকলেও সে কখনই লোভ করে তাতে মুখ দিতো না - চুপচাপ পাশে বসে অপেক্ষা করতো যতক্ষণ না আমরা নিজে থেকে তাকে খাবার দিচ্ছি - কোনো রকম তাড়াহুড়ো সে করতো না। প্রতিরাতে খাবারের পাট চুকলেই দেখতাম সে গুটি গুটি ভাঁড়ার ঘরের ছাদের টালির উপর গিয়ে গ্যাট হয়ে বসে ইঁদুর ধরার চেষ্টা করছে। রাতের বেলা যখন সারা বাড়ির আলো নিভে যেতো,  তখন ভাঁড়ার ঘরের ছাদের দিকে তাকালেই মনে হতো একখানা সাদা পেঁজা তুলোর বস্তা পড়ে আছে সেখানে। ইঁদুরের উপদ্রব খুব দ্রতই কমে গেলো। ইঁদুর  খেয়ে খেয়ে বিড়ালটা গায়েগতরে বেশ ভারিক্কি হয়ে উঠলো আর তার চলাফেরার মধ্যে কেমন একটা লীডার গোছের ভাব চলে এলো। অন্য বিড়ালরা তো বটেই, এমন কি কুকুর বা কাক গুলোও তাকে এড়িয়ে চলতো। একদিন রাতের বেলা আমরা যথারীতি একসাথে সবাই খেতে বসেছি, বিড়ালটাও ধারে কাছেই ছিলো - হঠাত দেখি কি রকম একটা বিশ্রী টাইপের গন্ধ আসছে কোথা থেকে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি একটা গোদা ইঁদুর মুখে করে তিনি আমাদের পাশে এসে বসে আছেন! ভাবখানা, এতোদিন তোমাদের খাবার আমি খেয়েছি, এবার আমার খাবার-ও তোমরা খেয়ে দেখো! মা তা দেখা মাত্র "দূর হ' হতচ্ছাড়া " বলে চেঁচিয়ে উঠতেই সে এক দৌড়ে ইঁদুর সমেত গিয়ে উঠলো ভাঁড়ার ঘরের ছাদের মাথায় - আর আমাদের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো, যেন নীরবে বলতে চাইলো যে ভালো কাজ করলেও সবাই তা ভালো ভাবে নেয় না...


'ঈশ্বর' আছেন কি? 
আমাদের বাড়িতে পূজা-আচ্চা ভালোই হতো। বাড়ির তিনতলার ছাদে আলাদা একটা ছোট ঠাকুরঘর ছিলো - সেখানে স্বরস্বতী ঠাকুর, শিব ঠাকুর, রাধা-কৃষ্ণ ও আরও নানান বিগ্রহের মূর্তি রাখা ছিলো। একটা কাঠের ছোটো ঠাকুরদালানও ছিলো। মূলত: দিদিরা, আর কখনো বা মা পালা করে করে ঠাকুর ঘরের কাজ করতেন। সকালে ঘর খোলা ও পরিষ্কার করা, দুপুরে ফুল-জল খাবার দেওয়া আর সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ জ্বালানো, শাঁক বাজানো এবং পূজার খাবার তুলে রেখে ঘরে তালা দেওয়া। এছাড়া বাড়ির একতলায় উঠানের পাশে একটা পাকা তুলসীমঞ্চ ছিলো যার সামনের দিকে কিছু ঠাকুরের ছবির প্লেট বসানো ছিলো। আর বাড়ির মধ্যেই একটা বেলগাছ ছিলো, যার গোড়াটা আবার ইঁট-কাদা দিয়ে বাঁধানো ছিলো, সেটাও ছিল শিব ঠাকুরের প্রতিভূ। এই দুটো জায়গাও একই সময়ে পরিষ্কার করা হত। সন্ধ্যাবেলা ঠাকুর ঘর থেকে প্রদীপ, ধূপ জ্বালিয়ে নিয়ে এসে বাড়ির প্রতিটি ঘরের সামনে দেখানো হতো। তারপর বেলগাছের কাছে আর তুলসীমঞ্চে সেই আলো দেখিয়ে তিনবার শাঁক বাজানো হতো। বাড়ির সবাই, বিশেষ করে বড়োরা এই সময় ভক্তিভরে প্রণাম করতেন। অল্প মনে হলেও এই পুরো প্রসেস টা শেষ করতে বেশ সময় আর এফর্ট লাগতো। কারণ একতলা থেকে তিনতলা ছিল মোট ৫২টা  সিঁড়ি। সেটা বার দুয়েক ওঠা-নামা করতে হত তিনবেলা। এছাড়া বাসি ফুল ফেলে দিয়ে বাগানের গাছ থেকে নতুন ফুল তোলা, ঠাকুরের ভোগের বাসন-পত্র দুর্বা ঘাস দিয়ে মেজে পরিষ্কার করা - এ সবই ছিলো সময়্সাধ্য কাজ। বেশিরভাগ সময় আমার সেজদি খুশিমনে এই কাজ গুলো করতেন - একদিন দুদিন নয়, দিনের পর দিন। হয়তো সেই কারণেই ভাগবান তাঁকে অনেক আগেই নিজের কাছে ডেকে নিয়েছেন। আজ সেই ঠাকুর ঘরের অবস্থা দেখলে খুব কষ্ট হয়। এ দু'চোখ খোঁজে সেজদি কে। সেই যে প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়ের গানটা ছিলো না - "বড়ো সাধ জাগে, একবার তোমায় দেখি..." - সেই গানটার কথা বা সুর আগে তেমন ভালো লাগতো না, কিন্তু আজকাল খুব নস্টালজিক লাগে। সত্যি, আমরা কাছের মানুষদের তখনই মনে করি যখন তাঁরা খু-উ-ব দুরে চলে যান।

যাই হোক সেই ছোটো বয়স থেকেই ঠাকুর-দেবতার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা আপনা আপনিই গড়ে উঠেছিলো - কিন্তু সেটা সবসময় এক মাত্রায় থাকতো না। স্বরস্বতী, দূর্গা বা কালী পূজার সময়ে মনে যেন বেশি করে ভক্তিভাব আসতো - কিন্তু অন্য সময় ঠাকুর ঘরের কাজ করতে বললে একটু গররাজিই হতাম। তবে এই ভক্তিভাবটা সবচেয়ে জেগে উঠতো ইস্কুলের পরীক্ষার সময়, বিশেষ করে এনুয়াল পরীক্ষার সময়! আমাদের তিনতলার ছাদটার চারিদিক চারফুট উঁচু সিমেন্টের রেলিং দিয়ে ঘেরা ছিলো, এর মাঝে মাঝে আবার একটু অল্টারনেট স্পেসিং দিয়ে খোপ-খোপ কাটা ছিলো। আমার ছোটোবেলার বেশিরভাগ সকালই কেটেছিলো এই ছাদে বসে পড়াশুনা করে। সকালবেলায় উঠে যখন মাদুর পেতে ছাদে বোসতাম, তখন অদ্ভুত ভালো লাগতো। চারিদিক আলোয় ভরা, শান্ত, নির্জন, পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ - কনসেনট্রেশানের জন্যে আলাদা করে চেষ্টা করতে হতো না। শীত বা গ্রীষ্মের সূর্য্যের আলোর পরিক্রমণ পথ অনুযায়ী আমার পড়তে বসার জায়গাটাও সরে সরে যেতো। একমাত্র বর্ষাকালেই আমি দোতলার কোনো ঘরে বসে পড়তাম। এই ছাদে পড়তে বসার কল্যাণে আমাকে যেমন বাড়ির কাজকর্ম কম করতে হতো, তেমনি বাড়ির একতলার চেঁচামিচিও অনেক কম কানে আসতো। 
সে সময় আমাদের স্কুলে দুবার করে পরীক্ষা হতো। গ্রীষ্মের ছুটির পর হাফ-ইয়ার্লি, আর পূজার ছুটির পর ফাইনাল বা এনুয়াল। এখন অবশ্য পড়াশুনার সিস্টেমটাই বদল হয়ে গেছে। শুনেছি শীতকালের দিকে নাকি আর ফাইনাল পরীক্ষা হয় না - আবার বেশিরভাগ জায়গায় নাকি মার্কসের বদলে 'গ্রেড' দেওয়া হয়! শুনে বড়ো অদ্ভুত লাগে। অবশ্য এটা ঠিক যে পূজার ছুটির পর ফাইনাল পরীক্ষার একটা নেগেটিভ দিক ছিলো, কারণ পূজার ছুটিতে শুধু দুর্গাপূজা নয়, লক্ষীপূজা, জগদধার্ত্রী, কালীপূজা আর ভাইফোঁটা থাকতো।এছাড়া ঐসময়ে পাড়াতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই থাকতো। এর মধ্যে সবচেয়ে পপুলার ছিলো খেলার মাঠের মধ্যে দুটি খুঁটি পুঁতে সাদা পর্দা টাঙিয়ে তাতে বায়স্কোপের ছায়াছবি দেখা। আমাদের সেই অঞ্চলে তখন দুটো বড়ো ক্লাব ছিলো  - 'আমন্ত্রনি' আর মিলন সংঘ। এরাই পালা করে এই ব্যবস্থা করতো। পর্দার যে কোনো দিকে বসেই সে ছায়াছবি দেখা যেতো। কোন দিকে বা কার পাশে বসে দেখবো সেটা স্থির করতে করতেই অনেকটা সময় কেটে যেতো। 'ক্ষুদিরাম', 'সুভাষচন্দ্র', 'অতিথি', 'পথের পাঁচালি' - এ ধরনের বিখ্যাত ও শিক্ষামূলক ছায়াছবি দেখানো হতো। মাঝে মাঝে লোডশেডিং হয়ে গেলে বা প্রজেক্টারে 'রীল' জড়িয়ে গেলে আমাদের কি আক্ষেপ হতো!

আমাদের বাড়িতে আবার কালীপূজার রাতে জ্বালানোর জন্যে 'তুবড়ি' আর 'ছুঁচো' বাজি তৈরী করা হতো। এই বাজি তৈরী করাটা ছিলো দক্ষজগ্গ্যের মতো এক বিশাল ব্যাপার। কম করে দু'সপ্তাহের প্রিপারেশন নিতে হতো। সোরা, গন্ধক, লোহাচুর বা আলুমিনিয়াম-চুর আর কাঠকয়লা যোগাড় করে, শিলনোড়াতে বেটে, রোদ্দুরে শুকিয়ে, তুবড়ির ও ছুঁচোর খোলের মধ্যে ঠেসে ঠেসে ভরতে হতো। প্রতিটি বাজির ফর্মুলা ছিল এক এক রকম। যদ্দুর মনে পড়ে 'ছুঁচো' বাজির জন্যে আমরা ফলো  করতাম ৭-৪-৩। অর্থাৎ ৭-ভাগ সোরা, ৪-ভাগ গন্ধক আর ৩-ভাগ কাঠ কয়লার মিশ্রণ। পূজার সময় পার্বণীতে পাওয়া টাকা-পয়সা শেয়ার করে সোরা, গন্ধক আর লোহাচুর কিনে আনা হতো শান্ত-দার দোকান থেকে। কিন্তু কাঠকয়লার জন্যে শুকনো আর হাল্কা কোনো গাছের ডালের প্রয়োজন হতো - বিশেষ করে কূলগাছের শুকনো ডাল এ জন্যে ছিলো আদর্শ। বাবা অনেক আগে থেকেই শুকনো কূলকাঠ খুঁজে খুঁজে যোগাড় করে রাখতেন। সেই কাঠ আধা পুড়িয়ে, তার কয়লা হামান-দিস্তায় বেটে বেটে একটা কাপড়ের মধ্যে ফেলে ঘষে ঘষে ছাঁকতে হতো - সোরা বা গন্ধকও তাই। বাটা যতো মিহি হবে বাজি ততো ভালো হবে। তারপর সব মশলা একসাথে ভালো করে মিশিয়ে আবার বাটতে হতো - তখন শিল-নোড়া ব্যবহার করতাম। লোহাচুর বা আলুমিনিয়াম-চুর শুধু তুবড়ির জন্যে লাগতো। লোহাচুরে তুবড়ির আলো কিছুটা লাল টাইপের হতো আর আলুমিনিয়াম-চুরে সেটা হতো রুপোলি সাদা। আলুমিনিয়াম-চুরের দাম ছিল ভালোই, তাই আমরা সাধারণত লোহাচুর-ই কিনতাম। তুবড়ির খোল রেডিমেড কেনা গেলেও 'ছুঁচো' বাজির জন্যে স্পেশাল কাগজের খোল লাগতো। স্পেশাল, কারণ কাগজ যদি খুব মোটা হয় তাহলে বাজি খুব একটা দৌড়াবে না, আবার বেশি পাতলা হলে তাড়াতাড়ি ফেটে যাবে! এই খোল তৈরীর জন্যে আমরা 'সোভিয়েত দেশ' বলে এক মাগ্যাজিনের পাতা ব্যবহার করতাম। এই মাগ্যাজিন প্রকাশিত হতো মস্কো থেকে, আসতো পোস্টাল ডাকে। আমরা এই মাগ্যাজিনের গ্রাহক যে কেন হয়েছিলাম তা জানা নেই, তবে মনে হয় তার একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ কারণ ছিলো এই 'ছুঁচো' বাজি আমি, ছোটদা আর ছোটদি ছিলাম এই বাজি তৈরী দলের নিয়মিত সদস্য। ছোটদা ছিলো আমাদের লিডার। মাঝে মাঝে মা বা পিসিমা এসেও গজগজ করতে করতে বাজির মশলা ছাঁকার সময় হেল্প করতেন। বাবা দূর থেকে সেইসব দেখে দেখে হাসতেন আর খুব মজা পেতেন। মেজদা হেল্প করতেন ছুঁচোবাজির মশলা খোলে ঠাসার সময়।তুবড়ির মশলা ঠাসা কম্পারেটিভলি সোজা ছিলো, বরং ছুঁচো বাজির মশলা ঠাসতে গিয়ে আঙ্গুলে ফোস্কা পরে যেতো। কারণ একটা বড়ো পেরেক দিয়ে ক্রমাগত ঠুসতেই  হতো আর এক একটা করে ছুঁচো বাজি কমপ্লিট করতে সময়ও লাগত কম করে পাঁচ থেকে সাত মিনিট। আমি অবশ্য এই দুটোর কোনটাই করতাম না। আমার কাজটা ছিল অনেকটা যোগাড়ের মতো। কোনো গুরুত্ত্বপূর্ণ কাজে নয় বরং আজেবাজে কাজগুলিই আমাকে দেওয়া হতো। মাঝে মাঝে বৃষ্টির কারণে কয়েকদিন কাজ বন্ধ থাকলে, যেদিন তারপর রোদ্দুর উঠতো সেদিন রাত পর্যন্ত বাজি তৈরীর কাজ চলতো। কালীপূজার  বেশ কয়েক রাত আগে থেকেই চলো বাজি টেস্টিং-এর পালা। সারা ঘরবাড়ির জানালা দরজা বন্ধ করে, সমস্ত জামা কাপড় সরিয়ে আমরা ছুঁচো বাজিতে আগুন দিতাম। মেজদির বন্ধু উত্তমদা, তিনি আবার ব্যাং-বাজি আর উড়ন-তুবড়িও করতেন। তাঁর কাছ থেকেও অনেক ভালো ফর্মুলা যোগাড়  হয়েছিলো।  সে ছিলো এক অদ্ভুত আনন্দ আর উন্মাদনার সময়। সেই বাজি তৈরীর কথা আবার পরে বলা যাবে - এখন বলি ঠাকুরের প্রতি আমার ভক্তিভাবের কথা। 


আমি পড়াশুনায় বেশ ভালোই ছিলাম। তবুও বাড়ি থেকে বলে দেওয়া হতো যে অঙ্ক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সব প্রশ্নের উত্তরগুলো লিখে আনতে - যাতে বাকিরা বুঝতে পারে যে আমি কটা প্রশ্নের ঠিক এন্সার করেছি। ভুল বেশি করলে কপালে দুর্ভোগ লেখা থাকতো। এনুয়াল পরীক্ষা সাধারণত শেষ হতো ডিসেম্বরের প্রথম উইকের শেষ দিকে। তারপর থাকতো টানা তিন সপ্তাহ ছুটি। তখন শুরু হতো আমাদের ঘুড়ি ওড়ানো আর ক্রিকেট খেলার সিজন। এই সময়ে আর পড়তে বসতে হতো  না। গপ্ল্পের বইয়ের আলমারি থেকে দেবসাহিত্য কুটিরের মোটা মোটা পূজাবার্ষিকী গুলো নিয়ে পড়লে কেউ আর বকতো না। আমি মাঝেমাঝে সকালে বা সন্ধ্যাবেলায় সব প্রশ্নপত্রগুলো নিয়ে বসতাম - রিভাইস করার জন্যে। তারপর আমার বেস্ট গেস অনুযায়ী প্রতিটাতে নম্বর দিয়ে একসাথে যোগ করে দেখতাম যে টোটাল কত নম্বার পেতে পারি। বেশিরভাগ সময়েই আমার আন্দাজ খুব একটা খারাপ মিলতো না। নতুন বছরের প্রথম উইকে আমাদের স্কুলে রেজাল্ট বার হতো। দুরুদুরু বুকে আমরা রওনা হতাম ইস্কুলের দিকে। এই রেজাল্ট বার হবার কিছুদিন আগে থেকে আমার মনে ঠাকুরের প্রতি ভক্তিভাব খুব বেড়ে উঠতো। ছাদের ঠাকুরঘরে গিয়ে বসে থাকতাম মাঝে মাঝেই - আর মনে মনে বলতাম যে ঠাকুর আমার পরীক্ষার রেজাল্ট যদি সত্যি সত্যিই ভালো হয়ে থাকে, তো তার প্রমাণস্বরূপ আমাকে একটা ভালো ঘুড়ি পাইয়ে দাও। 

একবার মনে আছে যে রেজাল্ট বার হবার দিন প্রায় এসে গেছে কিন্তু আমি তখনও কোনো নতুন ঘুড়ি পাইনি - খুব টেনশন শুরু হয়ে গেছে। দোকান থেকে নতুন ঘুড়ি কেনাই  যায় - কিন্তু সেটা ঠিক ঘুড়ি-পাওয়া নয়। দিনের বেলা প্রায় সারাক্ষণই ছাদে ছাদে সময় কাটাই। প্রত্যেক দিনই প্রচুর ঘুড়ি কেটে যায় - কিন্তু সেগুলো সবই বাড়ির এদিক ওদিক দিয়ে চলে যায়। বাগানে যাওবা কিছু ঘুড়ি পড়ে, তা সবই অন্যেরা আমার যাবার আগে লুটে নেয়! পাঁচিল টপকে সবাই চলে আসে বড়ো বড়ো লগা বা আঁকশি নিয়ে - কেউ কোনো বারণ শোনে না। এই ভাবে রেজাল্ট বার হবার আগের দুপুরে বসে আছি ছাদে - কোনো কিছু তেমন ঠিক ভালো লাগছে না। আস্তে আস্তে মনে হচ্ছে যে এবছর পরীক্ষাটা হয়তো ঠিক ভালো হয়নি। দূপুর গড়িয়ে যাচ্ছে... হঠাৎই শুনি একটা চেঁচামিচির আওয়াজ। দেখলাম একটা বড়ো ঘুড়ি পশ্চিমদিক থেকে কেটে ভাসতে ভাসতে আসছে! সেটার পিছু ধাওয়া করেছে একদঙ্গল ছেলে। দেখে প্রচণ্ড উত্তেজনায় আমার হাত-পা কাঁপতে লাগলো। ঘুড়িটা এমন কিছু উপরে নয় যে আমাদের বাড়ি ক্রশ করে চলে যাবে আবার খুব নিচেও নয় যে আগের বাড়িগুলোতে আটকে যাবে। নিচে রাস্তায় জড়ো হওয়া ছেলেদের দলের আক্ষেপ শোনা যাচ্ছে - ওই ক'টা মুহূর্ত যেন মনে হলো অনন্তকাল... দেখতে দেখতে ঘুড়িটা দুলতে দুলতে ঠিক আমাদের ছাদের মাঝে এসে গোত্তা খেয়ে পড়লো! আমাকে ধরার জন্যে কোনো চেষ্টাই করতে হলো না। আনন্দে তখন আমার নাচতে ইচ্ছা করলো। ঘুড়ি তো পেয়েছিই, সে তো আর কেউ নিয়ে নিতে পারবে না - কিন্তু তার থেকেও বড়ো কথা হলো যে এটা একটা শুভ ঘটনার ইঙ্গিত - নিশ্চয় আমার পরীক্ষা ভালো হয়েছে আর ঈশ্বর বলে নিশ্চয় কেউ আছেন। সেই রাতে অনেক শান্তি আর আনন্দ নিয়ে ঘুমালাম। পরের দিন সকালে বেশ আগ্রহ নিয়ে, টেনশনহীন ভাবে ইস্কুলের দিকে রওনা দিলাম! সেবার যথারীতি আমার এক্সপেক্টেশান মিলে গিয়েছিলো - কাঙ্খিত রেজাল্টই হয়েছিলো। বাড়ি ফিরে আসার পর সবার খুশি খুশি চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলেছিলাম 'ঈশ্বর, তুমি সত্যিই আছো'।  



                                                                           To Be Continued...