Thursday, June 22, 2017

অচিনপুরের গল্প

[ছবি: ইন্টারনেট]
একা একাই হাঁটছিলাম - ধীরে সুস্থে, এদিক ওদিক দেখে -  অচেনা কিন্তু পুরো অচেনা যেন ঠিক নয় -  রাস্তার ধারে ধারে ঘন জঙ্গল, জ্যোৎস্না আছে বটে, কিন্তু সেই আলোতে খুব বেশি কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাঁদিকে একটু এগিয়ে লাহিড়ীদের বিশাল গোল-বাড়ি, দেওয়াল থেকে পলেস্তরা খসে পড়ে পড়ে ইঁটগুলো যেন বিশ্রীভাবে হাসছে - আরেকটু এগিয়ে গেলেই স্কুলের সেই বড়ো মাঠ -  এক ধারের একটা ল্যাম্প পোস্টে টিমটিম করে আলো জ্বলছে।  মাঠের শেষ প্রান্তে কারা কি বসে আছে? একসময় ওখানে বসেই সন্ধ্যার অর্ধেকটা সময় কেটে যেতো - খেলা, পড়াশুনা, কবিতা, প্রেমিকা, পলিটিক্স, সিনেমা থেকে যাবতীয় সরস ও ভাব-আলোচনার ঢেউ বয়ে যেতো। 

নিস্তব্ধতারও এক অচেনা শব্দ আছে - ঝিঁঝির একটানা অসহ্য ডাকে কান যেন ঝিমিয়ে যাচ্ছে - একটু এগোলেই নাট্যভবন, ওখানে নাটকের রিহার্সাল হতো একসময় - সময় মেপে, প্রচুর হাঁক-ডাক করে - এখনও হয়তো হয়, কি হয় না, কে জানে !  বৃষ্টি-ভেজা মাটি থেকে সোঁদা গন্ধ আসছে, কিছুটা যেন অপার্থিব লাগছে, অস্বস্তিকর হলেও ভালো লাগছে। ডাঁয়ে পথটা ঘুরে যেতেই সান্যালদের বাগান, ওখানে কেয়ারী করে ফুলের গাছ ছিলো একসময়।  পরী লাল গোলাপ খুব ভালোবাসতো - পরী কি এখনও আসে আর ? মাঝে-সাঝে, শীতের ছুটিতে ?  মাথার উপরে দুদিকে হেলে থাকা গাছ থেকে টুসটুসে কামরাঙা নিচে পড়ে ফেটে রয়েছে -  দু-চারটে বুনো ফলও, বোধহয় বিষাক্ত --- আরো একটু যেতেই গিরীনদার চায়ের দোকান -  ছিলো, কিন্তু এখন আর নেই।  শনি আর রবিবার করে ওখানে সিঙাড়া-ফুলুরি-বেগুনি-পিয়াঁজি ভাজা হতো -- চারটে একসাথে কিনলে ছোটো এক ঠোঙা মুড়ি ফ্রী-তে মিলতো।  ওখানে দাঁড়িয়েই সময় যেন হূ-হূ করে কেটে যেতো - মিলি স্কার্ট পরে তার বন্ধুদের সাথে দল বেঁধে কিচিরমিচির করতে করতে একসাথে অঙ্ক-স্যারের বাড়িতে পড়তে যেতো - প্রতি মঙ্গল আর শনিবার করে - ফিরতে ফিরতে হয়ে যেতো সেই রাত দশ'টা, কি তারও পর. . .

হঠাৎ করেই শিরশিরে বাতাস বইতে শুরু করে দিয়েছে - ঠান্ডার পরশে থেকে থেকে শিউরে উঠছি - ছায়াগুলোও কিরকম যেন শীতল শীতল লাগছে। গাছের ডালেরা মাঝে মাঝে ঝাপ্টা মেরে যাচ্ছে - গালে পাতার চকিত স্পর্শ - কেমন যেন ভয়-ভয় ভাব চারিদিকে। আরও একটু সামনে এগোলেই রেল-জংশন...  রথীনদার গলা-কাটা লাশের খবর ভোর-সকালে পেতেই ঘুমচোখে পড়িমরি করে একসাথে ছুটে গিয়েছিলাম। পিয়ালীদির সেদিন কালরাত্রি চলছিলো - কেউ জানাতে যেতে রাজি হয়নি - চারদিনের মাথায় আমি গেছিলাম, পিনটুকে সঙ্গে নিয়ে।  এক নিঃশ্বাসে কথাটা বলেই দৌড়ে পালিয়ে এসেছিলাম দু'জনেই. . .  পিয়ালীদির সামনে থাকতে কেমন যেন ঘেন্না করছিলো। সেদিনের সেই স্মৃতিগুলো যেন এখনো চাপ হয়ে ঘুরে-ফিরে মরছে ওখানে। 


* * * * *

ঘন জঙ্গলে ভ'রে থাকা পথ দিয়ে আমি একা একাই হেঁটে চলি  - বন-জ্যোৎস্নায়, নিস্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে, সোঁদা মাটি আর ফেটে থাকা বুনো ফলেদের বিষণ্ণ গন্ধের মধ্যে দিয়ে --- নুইয়ে পড়া গাছের চন্দ্রাতপ শামিয়ানা কেমন যেন ঘোর টেনে আনে চোখে - একদম অন্যরকম, অচেনা। ওখানেই একসময় শব্দ ছিলো, জীবন ছিলো, আর ছিলে তুমি -
   একটু এগোলেই -
         একটু ফিরলেই...




No comments:

Post a Comment