Sunday, May 1, 2016

ছেলেবেলা অনেক দূরে ফেলে রেখে এসেছি

ফেসবুক, ট্যুইটার আর হোয়াটস-অ্যাপের চক্করে আজকাল বড়ো থেকে মাঝারি কি ছোটো, কারুরই তেমন দম ফেলার ফুরসত নেই। সময় পেলেই সবাই নাকের ডগায় স্মার্টফোন এনে দু'হাতের আঙুলগুলো দিয়ে অনবরত: পুটুর-পুটুর করে কি যেন সব লিখে চলে। "চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি"-র যুগ আজকাল চলে গেছে। এখন সব কিছু তো ফেসবুক আর হোয়াটস-অ্যাপেই আগে চলে আসে !

কিন্তু রাত-গভীরে নি:শব্দ আকাশে দৃষ্টির লাগাম ছেড়ে দিয়ে, চাঁদ তারা ছাপিয়ে, দূর থেকে আরো দূরে, সীমাহীন মহাশুন্যের অন্তহীনতা অনুভব করার মজাই আলাদা। মানুষ যে কতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, নগণ্য, তা উপলব্ধি করার জন্যে পয়সা খরচ করে সমুদ্র বা পাহাড়ের কাছে যাবার দরকার নেই - নির্জন রাতের তারাভর্তি আকাশই যথেষ্ঠ।    
ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহীত 
ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ি তখন - গ্রীষ্মের প্রচন্ড খরতাপে এক সপ্তাহ আগে থেকেই আমাদের স্কুলে ছুটি পড়ে গেছে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে চলেছে লোডশেডিং। রাতে খাওদায়ার পাট চুকে গেলে ভাই-বোনেরা  সবাই মিলে ঠিক করলাম বাড়ির ছাদে মশারি টাঙিয়ে ঘুমাবো। সেই মতো অনেক কেরামতি, কসরত করে মশারির চারটে খুঁট কোনোমতে টাঙানো হলো। একটা চাদর আর কয়েকটা বালিশ এনে, ট্যারা-বাঁকা সেই মশারির মধ্যে শুয়ে আমরা ফিসফিস করে গল্প করে চলতেই থাকলাম। তারপর একসময় সব শুনশান - কেবল আমি আর তারাভর্তি বিশাল আকাশ। আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো সেটা যেন অল্প অল্প করে নেমে আসছে আমার দিকে। হালকা হাওয়ায় মশারিটা মাঝে মাঝে তিরতির করে কাঁপছে - বাগানের জুঁই-হাস্নুহানা, গন্ধরাজের মিশেল সুবাতাসে একসময় মনভার হয়ে আসলো। রাত ভেঙে দানাদানা হয়ে  মশারির ভিতরে যেন ছড়িয়ে পড়লো। এইভাবে কখন যে  ঘুম এসে আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলো তা টেরও পেলাম না। হঠাৎই অনেক রাতে ধড়মড় করে উঠে বসলাম - আকাশে আর কোনও তারা নেই। নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেছে গোটা আকাশটা - তার সাথে শুরু হয়েছে দমকা ঝড়ো বাতাস। মশারির দড়ি প্রায় ছিঁড়লো বলে - কালবৈশাখী আসছে সবকিছু তছনচ করে। আশেপাশে চেয়ে দেখি বাকি সবাই কে কখন ভেগে গেছে - পড়ে আছি শুধু আমি, একাই !!  কোনোমতে চাদর আর মাথার বালিশটা বগলে চেপে আমি দিলাম সিঁড়ির দিকে টানা এক দৌড় - মশারি রইলো পড়ে সেই ছাদেই।


* * * * * *
সেই সব দিন চলে গেছে চিরকালের জন্যে - ফেসবুক, ট্যুইটার কি হোয়াটস-অ্যাপের হাজার কেরামতিতেও সেই সব অনুভুতি আর কখনও ফিরে আসবেনা। রাত আর ভোরের মাঝে থাকা মায়াবী আবছায়ার মতো সেই সব ভালোলাগাটুকু কোন এক অজানা রহস্যে সেঁধিয়ে গেছে স্মৃতিসাগরে কোথাও।  মাঝে মাঝে পুরানো দিনের বিস্মৃত-প্রায় কিছু গল্প পড়ি, আর নিজের মনে নিজেই চমকে উঠি সেই সব হারানো স্মৃতির আচমকা জাগরণে।  


Monday, April 4, 2016

বিশ্বাসে মিলায়, তর্কে বহুদূর

ঈশ্বর আছেন কি না তা সত্যিই এক বড় রহস্যময় প্রশ্ন। জীবনে বহুবার এমন কিছু অসহায় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি যে মনে হয়েছে যে ঈশ্বরের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া সেখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভবপর ছিলো না। আবার অন্যদিকে বহু জটিল পরিস্থিতিতে ঈশ্বরকে একমনে ডেকেও কোনো লাভ হয়নি। হয়তো বা আমার সেই ডাকের মধ্যে তেমন আকুলতা ছিলোনা, বা নিষ্ঠার অভাব ঘটেছিলো। 

ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি আমাদের বাড়িতে নিয়ম করেই দু'বেলা পূজা-আর্চা হতো। নিম্ন-মধ্যবিত্তের সংসারে পুজারী ব্রাহ্মণ ডেকে, মন্ত্র-উচ্চারণ সহ পুজা করার সামর্থ্য আমাদের ছিলো না। অগত্যা ফুল-দূর্বা-ভোগ সহযোগে, কাঁসর-শঙ্খধ্বনি ও ঠাকুর প্রনামের মধ্যে দিয়ে, অনাড়ম্বর ভাবেই মূলত: আমাদের বাড়ির পুজাগুলি সম্পন্ন হতো। সেই কারণেই কি না জানিনা, ছোটবেলায় তেমন কোনো বড়োস দুর্ঘটনা, বা অমঙ্গলের কালো ছায়া আমাদের পরিবারে দেখা দেয়নি। মা-পিসিমা বহুবারই বাড়ির ছাদের ঠাকুরঘরে 'অন্য কোনো এক কিছুর' উপস্থিতি লক্ষ্য করেছিলেন। আমার কপালে তেমন কিছু দেখার সৌভাগ্য না-ঘটলেও গভীর রাতে নূপুরের মিষ্টি-ধ্বনি সহযোগে অদ্ভুত সুন্দর, অপার্থিব কোনো এক কিছুর সুঘ্রাণ বহুবারই আমি ঘুমের মধ্যে উপলব্ধি করেছিলাম।   

জীবনের মাঝপথে এসে বুঝেছি ঈশ্বরের অস্ত্বিত্ব যুক্তি দিয়ে বোঝা সম্ভব নয় - এটা এক শুধুই অনুভুতি মাত্র। যার মধ্যে ধর্ম নেই, মন্ত্র নেই, বাহ্যিক আড়ম্বর নেই  - আছে শুধু ঐ অনুভুতি। জাগতিক বাস্তব সমস্ত কিছুর বাইরে, অন্য কোনো এক কিছুর অস্তিত্ব। পোশাক, চামড়ার রং, উঁচু জাত-এর গাম্ভীর্য্য থেকে শুরু করে আমরা অনেক কিছু পরে আছি - আস্তরণের পর আস্তরণ দিয়ে আমরা ঢেকে আছি। এক এক রকমের অহংকারের পলেস্তরা ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে থাকা আসল 'আমি'কেই গ্রাস করে  ফেলেছে। সেই আস্তরণ, অহংবোধ থেকে মুক্ত না-হতে পারলে এ জীবনে ঈশ্বরের দর্শন সম্ভবপর নয়।