Sunday, October 26, 2014

'মন্টোভানী' অর্কেস্ট্রার হাত ধরে...

ছোটবেলায়, অর্থাৎ ৮০-র দশকের শুরুতে আমার একবার টাইফয়েড অসুখ হয়েছিলো। অসুখটা সিরিয়াস ধরণের হলেও শহরতলীতে এটা তেমন কোন চিন্তার বিষয় ছিলো না। মা অভয় দিলেন 'টাইফয়েড', 'বসন্ত', এসব ধরনের অসুখ সবার জীবনে একবার না-একবার হবেই - হাজার সাবধানতার মধ্যে থাকলেও হবে। তাই অযথা ভয়ের কোনো কারণ নেই, সময়মত ওষুধ আর পথ্যির দরকার। সেইমতো আমাকে পাড়ার এক অ্যালোপ্যাথী ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো - তিনি  সব দেখে-শুনে বেশ কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ক্যাপসুল দিয়ে দিলেন। আমার ইস্কুলে যাওয়া, মাঠে খেলতে যাওয়া সব বন্ধ হয়ে গেলো। রাতদিন আমি শুধু বিছানায় শুয়ে বসে, নানান গল্পের বই পড়ে পড়ে সময় কাটাতে লাগলাম। অদ্ভুত ব্যাপার হলো অন্য সময়ে একটু গল্পের বই পড়ার জন্যে মন ছোঁক-ছোঁক করলেও, অসুখের সময় কিন্তু সেই একই বইগুলো পড়তে তেমন ভালো লাগে না। বরং কিছুক্ষণ বাদেই চোখ জ্বালা-জ্বালা করে ওঠে, হাতে ব্যাথা শুরু হয় - বেসিক্যালি শক্ত অসুখ হলে কিছুই আর তেমন ভালো লাগে না। সপ্তাহখানেক পরে অসুখ গেলো সেরে, আমি আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করে দিলাম। এর ঠিক দু'দিনের মাথাতেই আমি স্কুল থেকে আবারও ভালো জ্বর গায়ে ফিরলাম। শুরু হলো আবার বকুনি, একগাদা অযাচিত উপদেশের বন্যা, শুয়ে-বসে বাবার অন্ন ধংসের জন্যে প্রচ্ছন্ন তিরস্কার - আবার ডাক্তারখানার উদ্দেশ্যে যাত্রা। এইবারে কিন্তু ডাক্তারবাবু মুখ গোমড়া করে বললেন যে আরও কড়া ডোজের ক্যাপসুল তিনি দিয়ে দিয়েছেন বটে, তবে সে'টাতে কাজ না'হলে কিন্তু সত্যিকারেরই চিন্তার বিষয় আছে। শুনে আমার শুকনো মুখ আরও শুকিয়ে গেলো। সেই অশুভ সংবাদ নিয়ে বাড়ি ফিরতেই শুরু হয়ে গেলো একেবারে জেড-ক্যাটেগরির কঠোর নিরাপত্তা বলয়। ঘরের দরজা বন্ধ করে, মশারির মধ্যে আমাকে সর্বক্ষণ থাকার নির্দেশ দেওয়া হলো। একমাত্র বড়ো আর ছোটো-বাইরের জন্যেই আমি পারমিশান নিয়ে ঘরের বাইরে যেতাম। বন্দী জীবনের যে কি মাহাত্ম্য তা আমি এর আগে কখনোই এমন করে রিয়ালাইজ করিনি।
বাড়ির  বিশাল উঠান - একসময় ছিলো অসাধারণ সুন্দর -
আজ  অনাদর ও অবহেলায় সেও গেছে 
বুড়িয়ে... 
ক্যাপসুলের কড়া ডোজে ধীরে ধীরে আমার শরীরের জ্বরের ওঠানামা কমে যেতে লাগলো - কিন্তু সেই সাথে শরীর আরও দুর্বল হয়ে পড়লো। ডাক্তার বলে দিয়েছে প্রচুর রেস্ট নিতে। একতলার মাঝের এক ঘরে আমি পড়ে থাকি। মা আর কাজের লোক ছাড়া সেই ঘরে অন্য কারুর ঢোকা বারণ। মাথার কাছে বিরাট জানালা - সেই জানালা দিয়ে আমাদের বাড়ির বিশাল উঠানটার প্রায় পুরোটাই দেখা যায়। সারাদিন শুয়ে থাকি বলে রাতের ঘুম অনেকটাই কমে গেছে। একরাতে হঠাৎই ঘুম গেলো ভেঙে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি ঝকঝকে রুপালি আলোর জ্যোৎস্নায় আমাদের সারা উঠানটা ভরে উঠেছে। রাত তখন নিশ্চয়ই বারোটার বেশি হবে, কারণ বাড়ির সব আলো নিভে গেছে। রান্নাঘরের দিক থেকে কোনো আওয়াজও কানে আসছে না। ঝিমঝিম করছে দুপুর রাত - আমার চোখে তখন ঘুম-ঘুম ভাব লেগে আছে। সেই আবছা চেতনার মধ্যে অবাক হয়ে দেখলাম, উঠানের ঠিক মাঝখানে আমার মেজদা রেডিও চালিয়ে, একটা মাদুর পেতে বাবু হয়ে বসে আপনমনে বাঁশি বাজিয়ে চলেছেন - তাঁর পাশে বসে রয়েছে আমাদের বাড়ির মোটা সাদা বিড়ালটা। মেজদার বাঁশির ধবনি, আর রেডিওতে বেজে চলা এক অদ্ভুত অর্কেস্ট্রার অপূর্ব সুরের যুগলবন্দীতে কেমন যেন দুলছে আশেপাশের সারা জগটা। সেই সুরের মূর্ছনায় আমার দুর্বল মাথাও কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। আমি অসুস্থ শরীরেই ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসলাম। মনে হতে লাগলো রেডিও থেকে কি-একটা যেন তরঙ্গের মতো আভা কেঁপে কেঁপে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, কিম্বা হয়তো সে'সবই আমার অসুস্থ মস্তিষ্কের অলীক কল্পনা মাত্র! অজানা এক ভয়ে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম, আর একমনে সেই বাজনা শুনে চললাম। এরপর কখন যে অজান্তেই বিছানায় হেলে পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছি, তা টেরও পাই নি। পরের দিন সকালে মেজদাকে ডেকে গতরাত্রের  সেই বাজনাটার কথা জিজ্ঞাসা করে তেমন কোনো সদুত্তর পেলাম না। প্রতি রাত্রেই মেজদা খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে গেলে রেডিওতে আকাশবাণীর 'খ' চ্যানেল চালিয়ে গান শোনেন। রাত বারোটার পর সেখানে বেজে চলে নাম-না-জানা নানান দেশের বিখ্যাত বিখ্যাত শিল্পীদের অর্কেস্ট্রা, ইনস্ট্রুমেন্টাল, পপ, কান্ট্রি, ইত্যাদি বিচিত্র ধরনের সঙ্গীত। তাদের প্রতিটির নামধাম মনে রাখা মুখের কথা নয়। যাই হোক, তিন সপ্তাহ কঠোর নিয়ম-কানুনের মধ্যে থাকার পর আমার সেই কঠিন অসুখ পুরোপুরি সেরে গেলো, কিন্তু মাথার মধ্যে গেঁথে রইলো সেই অজানা অর্কেস্ট্রার অদ্ভুত মায়াবী সুর। সেই সুরের উৎস খোঁজার জন্যে আমার মধ্যে এক অদ্ভুত ছটপটানি  শুরু হয়ে গেলো। কিন্তু আমার ক্ষমতা বা জ্ঞান, দুইই খুব সীমিত - আর কি করেই বা আমি অন্য কাউকে সেই সুরের সাথে পরিচয় করে তার সম্বন্ধে আরও ডিটেলস জানবো!! অত:পর শুরু করে দিলাম মেজদার সাথে রাত জাগা। নিশীথ রাতে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের শ্রোতার সংখ্যা আরও একটা বাড়লো - মেজদাও আরেকটা সঙ্গী পেয়ে বেশ খুশিই হলেন। রাত বারোটার পর থেকে শুরু হতো আমাদের পালা করে রেডিও শোনা - সঙ্গে নিয়ে বোসতাম এক মিনি টেপ-রেকর্ডার, একটা ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেট পুরে, যাতে সেই অর্কেস্ট্রা আবার শুনতে পেলেই সেটাকে ঝটপট ক্যাসেটে বন্দী করে ফেলা যায়।    

এইরকম ভাবে মাস আট-নয় কেটে গেলো - শীত শেষ হয়ে নতুন বছর এসে গেলো। তারা-ভরা অন্ধকার একরাতে বাড়ির দাওয়ায় আমরা যথারীতি বসে আছি তিনজনে। বাগানের গাছপালা থেকে ঝিঁঝিঁ পোকাদের অস্পষ্ট ডাক শোনা যাচ্ছে - গাছে গাছে কিছু নিশি-পাওয়া পাখিদের ছটপটানি। এমনই নিঝুম এক  রাতে রেডিওতে আবার শোনা গেলো সেই অর্কেস্ট্রা। এবার হাতের কাছেই রেডি করাই ছিলো টেপ-রেকর্ডারটা - নিমেষের মধ্যেই সেটা দিলাম চালু করে। অর্কেস্ট্রার প্রথম দিকের কিছুটা অংশ ছাড়া, প্রায় পুরোটাই ক্যাসেট-বন্দী করা গেলো। অদ্ভুত এক প্রাপ্তির আবেশ নিয়ে ঘুমাতে গেলাম সেই রাতে। সেই সে রাতের মতো 'আনন্দের ঘুম' আমি জীবনে আর কখনো ঘুমাইনি - এমনকি প্রথম চাকরি পাবার দিনেও নয় !!   

কিন্তু সমস্যার পুরোটা সমাধান হলোনা - অর্কেস্ট্রার নামটা কি, কেইই  বা তার রচয়িতা, তা কিছুই জানা হয়নি, কারণ সেটা ক্যাসেট চালু করার অনেক আগেই রেডিওতে বলে দিয়েছে। অত:পর এক দুপুরে সেই ক্যাসেট পকেটে করে গেলাম গোলপার্কের বিখ্যাত গানের দোকান 'দি মেলোডি'-তে। কাউন্টারে বসে থাকা এক বয়স্ক ভদ্রলোককে বেশ কিছুক্ষণ ধরে অনুরোধ করার পর তিনি রাজি হলেন আমার সেই ক্যাসেটের বাজনাটা শুনতে। কয়েক মিনিট শুনেই তিনি বলে দিলেন যে সেটা হলো বিখ্যাত ওয়েস্টার্ন মুভি "ডক্টর জিভাগো"-র "Somewhere My Love"-এর সুর। সে'কথা জেনেই তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু অর্কেস্ট্রাটা যে কে পরিচালনা করেছেন সেটা তিনি বলতে পারলেন না। কারণ ওয়েস্টার্ন গানের জগতে পপুলার কোনো মিউজিক নানান শিল্পীরা নিজেদের মতো করে গেয়ে রেকর্ড করে থাকেন, সেই ভাবে অনেকেই অর্কেস্ট্রা হিসাবেও গান রেকর্ড করে থাকেন। কিন্তু যা জেনেছি তাতেই আমি অনেক খুশি, কারণ একটা পয়েন্টার ততক্ষণে আমি পেয়ে গেছি - বাকিটা এবার আমি ঠিক ম্যানেজ করে নিতে পারবো। 

সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে একের পর এক মাস কেটে যেতে লাগলো, অর্কেস্ট্রার কথা আমার মাথাতেই আছে, কিন্তু ক্যাসেট কিনে কিনে সেই সুরের খোঁজ করে বেড়ানো সম্ভব হলো না, কারণ পাশ্চাত্য সংগীতের ক্যাসেটের বেশ ভালোই দাম, তাছাড়া  কলকাতার হাতে-গোনা কয়েকটি নামী দোকান ছাড়া বেশির ভাগ দোকানেই সে'সব পাওয়া যায় না। তখনকার দিনে গ্রীষ্মের সন্ধ্যাগুলোতে লোডশেডিং হওয়াটা একটা বাঁধা-ধরা ব্যাপার ছিলো। আমরা সবাই তাই ল্যাম্প-হ্যারিকেন, দেশলাই সব হাতের কাছে গুছিয়ে রেখে পড়তে বসতাম। এরকমই এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় আমি দোতলার দখিন দিকের বারান্দায় বই-খাতা-পত্র নিয়ে পড়তে বসেছি। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে, সারাটা দিন অসহ্য গরমে কেটে যাবার পর ধীরে ধীরে আবহাওয়াটা একটু একটু করে শীতল হতে শুরু করেছে। বারান্দার রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে দেখছি আকাশ জুড়ে চাঁদের আলোর ঢল নেমেছে আমাদের বাড়ির উঠানে। সামান্য বাতাসে নারকেল গাছের পাতাগুলো খুব মৃদু ভাবে নড়াচড়া করছে, চারিদিক প্রায় নিস্তব্ধ, নিঝুম। বাগানের দিকে কিছু জোনাকির দল উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে - উঠানের এক দিকে কুকুরটা শুয়ে মুখ দিয়ে কামড়ে কামড়ে মশা মারার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে। নীচের রান্নাঘরে উনুন জ্বেলে মা একা একা রান্না করে চলেছেন। উঠানের সিঁড়িতে বসে মেজদি অলসভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। চাঁদের আলোয় তার মুখটা কি অসম্ভব দু:খী দু:খী লাগছে। কানে এলো রেডিওতে বেজে চলা পুরুষ কন্ঠের একটা গান। গায়কের কন্ঠ, বা গায়কী আহামরি তেমন কিছু নয়, কিন্তু গানের সুরটা ছিলো অসাধারণ - যা শুনেই আমার গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে উঠলো - আরে! এতো আমার সেই haunted অর্কেস্ট্রাটারই সুর!!! এই বাংলা গানে ছন্দের রকমফের থাকলেও, মূল সুর কিন্তু এক। দোতলা থেকে একদৌড়ে নেমে এসে মেজদির পাশে বসে পড়লাম - দু'জনে চুপচাপ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে চললাম সেই অপূর্ব সুরের মাতন নাচ: 'কে ডাকে আমায়, আজি এ নিরালায় - সে কি চেনা মোর, মন কি তারে চায় ?'। কিছুক্ষণ পরেই গানটা শেষ হয়ে গেলো - কিন্তু মন-কেমন করা সেই সুরের রেশ রয়েই গেলো, অনেকটা যেমন বাজি পুড়ে যাবার পরও তার গন্ধ আশেপাশের বাতাসে থেকে যায়। মেজদি বললো সেই বাংলা গানটার শিল্পী ছিলেন, 'দিলীপ সরকার' - এই প্রথম আমি সেই শিল্পীর গাওয়া কোনো গান শুনলাম। মনে মনে ভীষণ উত্তেজনা অনুভব করলেও আমি তা কাউকেই ঠিক বোঝাতে পারলাম না। উল্টে লক্ষ্য করলাম এক বিচিত্র মন খারাপ করা ভাব জমা হয়ে যাচ্ছে আমার মধ্যে। মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকলো এই গানটার সুর - এই বাংলা গান, আর সেই রাতের নাম না-জানা অর্কেস্ট্রা, দুটোরই সুর এক ও অভিন্ন !! 

এর অনেক বছর পরের কথা - তখন আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি - মাঝে মধ্যেই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে একা একা সেন্ট্রাল ক্যালকাটার ওয়েলিংটন স্কোয়ারের পুরানো রেকর্ডের দোকানগুলোতে ঢুঁ-মারি। কিনি যতো না, তার থেকে বেশি করি নাড়াচাড়া। দেখতে দেখতে ওখানকার দোকানদাররা সবাই আমাকে চিনে গেলো। আমি গেলে তারা আর কোনো উৎসাহ দেখাতো না। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে দোকানদারের সাথে সাথে আমিও ক্রেতাদের নানান প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছি - যার জন্যে আমি রেকর্ডপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলেও অনেক দোকানদারই খুব বেশি মাইন্ড করতো না। এই ভাবে রেকর্ড ঘাঁটতে ঘাঁটতে একদিন আমি পুরানো দিনের এক অর্কেস্ট্রার রেকর্ডের সন্ধান পেয়ে গেলাম, যাতে রয়েছে সেই "Somewhere My Love" গানটা, আর দেখলাম সেটা পরিচালনা করেছেন 'Mantovani (মন্টোভানী)' বলে একজন অ্যাঙ্গলো-ইটালিয়ান সংগীতকার। রেকর্ডের উল্টো পিঠের মিউজিকটির নাম ছিলো: "Games That Lovers Play" - দোকানদার জানালো যে সেই মন্টোভানী নাকি লন্ডনের খুব বিখ্যাত এক মিউজিক ডিরেক্টর। কিছুক্ষণ দরাদরি করে পাক্কা দশ টাকায় কিনে ফেললাম সেই পুরানো, রং চটে যাওয়া, স্ক্র্যাচে ভরা SP-রেকর্ডটা।  
সেই সময় এই দশ টাকাই  ছিলো অনেক টাকা, কিন্তু আমি তখন এক অদ্ভুত উত্তেজনায় কাঁপছিলাম। কতক্ষণে যে বাড়ি ফিরে রেকর্ড চালিয়ে সেই বাজনাটা শুনবো, তার জন্যে তর যেন আর সইছিলো না। রাস্তাঘাটের সামান্য জ্যামও অসহ্য মনে হতে লাগলো - আধঘন্টার ট্রেন-জার্নি যেন মনে হলো অনন্তকাল! অবশেষে বাড়িতে ফিরে এসে, কোনো রকমে জামা-প্যান্ট বদল করে, রেকর্ড-প্লেয়ারটা বার করে সেটাতে চালিয়ে দিলাম কিনে আনা সেই রেকর্ডটা। মন্টোভানী অর্কেস্ট্রার অসম্ভব মায়াবী সুরের মূর্ছণায় আমি চোখ বুজে ফেললাম - ফিরে গেলাম বছর ছয়েক আগেকার সেই মায়াবী নিশুতি রাতে। সুরের দোলায় ভাসতে ভাসতে মনে হলো যেন আমি কোনো এক অতিলৌকিক জগতে চলে যাচ্ছি। সেই সন্ধ্যায় একলা ঘরে চুপচাপ বসে বারবার আমি সেই একই রেকর্ডের বাজনা শুনে চললাম। বাংলা গানটা খুঁজে না-পেলেও, অরিজিনাল অর্কেস্ট্রার রেকর্ডটা at least কিনতে পেরেছি বলে নিজেকে অসম্ভব ভাগ্যবান বলে মনে হতে লাগলো। 
        
এর পরে আরো বহুকাল কেটে গেলো - টেকনোলজির ধাক্কায় পরে রেকর্ড, ক্যাসেট সব বিলুপ্ত হয়ে CD/MP3-র রূপ ধারণ করলো। চিরসুন্দর বাংলা আধুনিক গানকে পিছনে ফেলে ব্যান্ডের গান আর জীবনমুখী গান, পিঁপড়ের মতো চারিদিক থেকে গানের বাজার ছেয়ে ফেললো। মুড়ি-মুড়কির মতো গুচ্ছ গুচ্ছ গান বার হতে লাগলো - এ বলে আমায় দ্যাখ তো, ও বলে আমায় দ্যাখ। 'দিলীপ সরকারের' সেই সে গানের খোঁজ আমি চালিয়ে যেতেই লাগলাম - কিন্তু কোথাও আশার তেমন কিছু খুঁজে পেলাম না। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের পুরানো রেকর্ডের দোকানগুলোর অবস্থাও দ্রুতহারে পড়তে শুরু করলো। অনেকই দোকানে রেকর্ডের বদলে স্রেফ সিডি/MP3 বিক্রি আরম্ভ করে দিলো - কেউ কেউ দোকানের পাটই দিলো তুলে! চাকরিসুত্রে আমি এর মধ্যে দেশ ছেড়ে পরবাসী হয়ে পড়েছি - সাথে করে নিয়ে এসেছি সেইসব মলিন হয়ে যাওয়া ক্যাসেটগুলো। রেডিওর সামনে বসিয়ে রেকর্ড করা সেই সব গানগুলোকেই আমি যত্ন করে MP3-তে কনভার্ট করে, নয়েজ ফিল্টার্ড করে, সময়ে অসময়ে শুনতে থাকি। মন্টোভানী অর্কেস্ট্রার বহু অ্যালবামই আমি কিনে কিনে ঘরের আলমারি ভরিয়ে ফেলেছি। কিন্তু আমার না-পাওয়া haunted গানের লিস্টে 'দিলীপ সরকার'-এর গাওয়া সেই বাংলা গান ঠিকই রয়ে গেছে। গত কালীপূজার রাতে ছেলের সাথে ফুলঝুরি জ্বালাতে গিয়ে কি যেন হঠাৎ করে মনে হলো আমার। ভাবলাম, দেখি তো আরও একবার Google-সার্চ করে - হয়তো আমার মতোই বোরিং কোনো মানুষ সেই গানকে এতোদিনে কোথাও আপলোড করে রাখলেও রাখতে পারে। টেকনোলজির হাজার গন্ডা মন্দ দিকের সাথে সাথে কিছু ভালো দিকও তো রয়েছে। এইভাবে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎই খেয়ালে এলো YouTube-এ এক সুহৃদয় ভদ্রলোক আমার সেই হারানো গানটি বেশ কিছুদিন হলো আপলোড করে দিয়েছেন !!! এতোদিনের হারানো সেই গানকে এতো সহজে খুঁজে পেয়ে, আনন্দে আমার দু'চোখ অজান্তেই জলে ভরে উঠলো। তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়েও যেন আমার মন থামতে চাইলো না। মনে হলো কাছে-দূরের, চেনা-জানা সবাইকে জানাই যে একটা গানের সুর অ্যাতো সুন্দরও কি কখনো হতে পারে? যে মানুষ একে অপরের ধংসলীলায় মেতে ওঠার জন্যে অবিশ্রান্ত ভাবে কতো কি-ই না করে চলেছে, সেই একই মানুষের মধ্যে এরকম অসম্ভব সুন্দর সুর-সৃষ্টির আশ্চর্য্য ক্ষমতা ঈশ্বর যে দিলেকি করে, সেটাই এক চরম বিস্ময়...... 
~ ~ ~
এখানে একসাথে শেয়ার করলাম সেই অসাধারণ ওয়েস্টার্ন মিউজিকটি, ও সেই অপূর্ব রোম্যান্টিক বাংলা গানটি। 
>>> ইউটিউব লিঙ্ক 


Tuesday, October 7, 2014

"ও কাঠঠোকরা বউ মান কোরো না, শোনো কথা..."


"আবেশে মুখ রেখে পিয়াল ডালে
ওই সাতরঙা পাখি বলে মনের কথা, 
                   গরবী মানিনী তার সাথী রে,
বলে নীড়  সাজানোর কতো কথা
ও কাঠঠোকরা বউ মান কোরো না, 
                                         শোনো কথা...."

Black rumped golden flame-back 'Woodpecker'
(Scientific Name: Dinopium Bengalensi)
আমার ছোটবেলায় শোনা, নির্মলা মিশ্রের গাওয়া একটা খুব মিষ্টি আর মজার গান - দিদিদের মুখে যে কতোবার শুনেছি, তার ঠিক নেই। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে, ১৯৬৯ সালে পুজার গান হিসাবে HMV থেকে প্রকাশিত হয়েছিলো এই গানের রেকর্ডটি। গানটির গীতিকার ছিলেন শ্রদ্ধেয় পুলক বন্দোপাধ্যায়, আর এতে সুর দিয়েছিলেন সে'সময়কার প্রখ্যাত সুরকার, রতু মুখোপাধ্যায়। বাংলা গানের জগতে পাখিদেরকে নিয়ে গান খুব একটা শোনা যায় না, তার উপরে কাঠঠোকরার মতো সাধারণ পাখিকে নিয়ে গান তো নয়ই।

আমার বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব মোটামুটি সাড়ে নয় মাইলের মতো। রাস্তায় খুব একটা ভীড় না থাকলে মোটামুটি মিনিট কুড়ি থেকে পঁচিশের মতো লাগে আমার অফিসে যেতে, বা অফিস থেকে ফিরতে। যাবার সময় আমি সাধারনত গাড়ির রেডিওর FM ট্র্যাফিক চ্যানেলটা (KCBS FM106.9) চালিয়ে দিই, যাতে প্রতিদিন কোথায় কি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে,বা কোন রাস্তায় কিরকম জ্যাম হয়ে চলেছে, সেসব তথ্য জানতে পারি। বে-এরিয়ার এই লোকাল চ্যানেলে সকালের দিকে প্রতি দশ মিনিট অন্তর করে করে ট্র্যাফিক আপডেট দিয়ে চলে, আর তার ফাঁকে ফাঁকে নানান ধরনের ছোট ছোট খবর এবং বিজ্ঞাপন শোনায়। তবে সেগুলো আমাদের দেশের মতো তিতি-বিরক্তিকর, গান-ওয়ালা, আলতু-ফালতু নাটকীয় বিজ্ঞাপন নয় - বেশিরভাগই ট্যেকনোলজি ওরিয়েন্টেড, আর যথেষ্ঠ শিক্ষণীয়। এই যেমন গতকাল সকালে Woodpecker, অর্থাৎ "কাঠ-ঠোকরা" পাখিকে নিয়ে দু'মিনিটের, ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপন-কাম-প্রতিবেদন হলো, যেটা শুনে আমি এতো অবাক হয়ে গেলাম যে ঠিক করলাম বাড়ি ফিরেই সেটা নিয়ে একটা কিছু লিখবো !!
~ ~ ~ ~ ~

সম্প্রতি চাইনিজ সায়েন্টিস্টরা কাঠঠোকরা-র একটা 3D কম্প্যুটার মডেল তৈরী করেছে, যাতে বোঝা যায় যে কি করে কাঠঠোকরা পাখিরা খাবার খোঁজার সময়ে কাঠের উপরে তাদের ছোট্ট ঠোঁট দিয়ে করে চলা অবিশ্রান্ত ঠোকরানোর ধাক্কার ধকল সামলে নেয়। গবেষণায় জানা গেছে যে তারা খুব কম করে হলেও, ১৬ মাইল স্পীডে কাঠের উপরে ঠুকরিয়ে চলে - ওই একই স্পীডে আমরা যদি কোনো শক্ত গাছে আমাদের মাথা ঠোকরাই তো কয়েকবার ঠোকরানোর পরেই আমাদের মাথাটা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যাবে!!  Obviously এই সব গবেষণার মূল উদেশ্য হলো, কি করে আমরা মোটরগাড়ির shock absorber-কে আরও ইমপ্রুভড করতে পারি, যাতে চলন্ত দুটো গাড়ির মধ্যে মুখোমুখি, ভয়ানক collision হলেও, মৃত্যুর হাত থেকে গাড়ির ড্রাইভাররা অন্তত: প্রানে বেঁচে যায়, এবং গাড়িরও কম physical ড্যামেজ হয়।

তো, দেখা গেছে কাঠঠোকরার ছোট্ট মাথাটা হলো এক ধরনের অত্যাধুনিক "শক অ্যাবজর্ভার" - যেটা কিনা প্রতিটি ধাক্কায় উৎপাদিত এনার্জির 99%-এরও বেশি শুষে, বা অ্যাবজর্ভ করে নেয় !! আর তারপর সেই এনার্জিকে "Strain Energy"-তে রুপান্তরিত করে, নিজেদের দেহের মধ্যেই চালান করে দেয় !! যার ফলে কাঠঠোকরার ব্রেনে সেই এনার্জির প্রভাব খুব সামান্যই এসে 
পৌঁছায় - in fact এক পার্সেন্টের এক-তৃতীয়াংশেরও কম এনার্জি তাদের ব্রেনে গিয়ে পৌঁছায়। আর সেই এনার্জি তাদের ব্রেন থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের দেহের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে দেহের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যে জন্যে তারা ঠোকরানোর সময়ে কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর ছোট্ট করে একটা break নিয়ে নেয়।

শুধু এইই নয়, আরো জানা গেছে যে কাঠঠোকরার মাথার খুলি, আর ঠোঁঠের structure, সময়ের সাথে সাথে ক্রমাগতই  evolved হয়ে চলেছে, যাতে আরো, আরও কম ধাক্কার ধকল তাদের শরীরকে সইতে হয়। আমরা (মানুষেরা) তাদের এই উন্নত পদ্ধতিকে ফলো করে আরো better অ্যান্টি-শক
যন্ত্র (anti-shock devices) বানাতে পারি - যেগুলো আমাদের মোটরগাড়িদের মুখোমুখি, ভয়ানক ধাক্কা এড়াতে, কিম্বা আরও নির্ভরযোগ্য স্পেস ক্র্যাফট তৈরিতে অনেক কাজে আসবে।

এই ছোট্ট পাখির দেহে যতো কলাকৌশল আছে, মানুষ তা এতোদিনেও নিজেদের জগতে আয়ত্ত করতে পারেনি !! ভাবলেই ভীষণ অবাক হয়ে যেতে হয় !! 
 ঈশ্বর কি তাহলে সত্যিই কোথাও আছেন ?


Monday, October 6, 2014

“রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে, একি তব হরি খেলা”





টিন-এজেড বয়সের মাঝামাঝি পর্যন্তও “বড়ো কত্তা” অর্থাৎ শচীনদেব বর্মণের গানকে ভাবতাম আদ্যিকালের, বুড়োটে লোকেদের গান - কি নাঁকি নাঁকি গলায় খালি “ইঁয়া, ইঁয়া, ইঁয়া...” করে যান। কিন্তু ও মা! সেই বুড়োর গানে যে এতো প্রেমরস লুকিয়ে ছিলো তা আগে কে জানতো !! সেকেন্ডারী এক্সজামের প্রিপারেশন নেবো কি, মন যেন বিদ্রোহ করে বলে উঠলো “ওরে! ভালোবাসা না থাকলে তোদের কোনওদিন কিস্যুটি হবে না, এটা নিশ্চিত করে জেনে রাখ। ভালোবাসা ছাড়া কোনও গতি নেই-রে! কোন-ও উপায় নেই!! কিসের এতো তোদের হিসেবের জীবন, কিসেরই বা এতো লক্ষ্য - খালি এগিয়ে চলা, আর এগিয়ে চলা !! শুধু ভালোবেসে যা রে, আচ্ছা-সে ভালোবেসে যা...” 


শীতের বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে - ঠিক সন্ধ্যের মুখে চিরাচরিত লোডশেডিংয়ের আঁধার। সুগন্ধি চেসমী গ্লিসারিন দিয়ে স্নান করা শরীরে ভালো করে সাদা শালটা জড়িয়ে, ঠোঁটে “সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রীম, বোরোলীন” লাগিয়ে, কষে জানুয়ারীর শীত উপভোগ করে চলেছি। বাইরে টুপটাপ ঝরে চলেছে শীত। হাতে রয়েছে আধ-খাওয়া চায়ের কাপ, কোলে বিরাজমান সঞ্জীব চ্যাটুজ্জ্যের 'লোটাকম্বল'-এর প্রথম পর্ব, অসহায় ভাবে ভাঁজ হয়ে পড়ে। মন প্রেমরসে একেবারে যাকে বলে টই-টম্বুর। কোন দূরের একটা বাড়ির রেডিও থেকে লোডশেডিং ভেদ করে, তুলোর মতো দুলতে দুলতে ভেসে এলো শচীন-কত্তার নাঁকি কন্ঠের মায়াবী সুর: “মুক্তা যেমন শুক্তির বুকে তেমনি আমাতে তুমি, আমার পরাণে প্রেমের বিন্দু তুমি শুধু তুমি...” - ব্যাস ! হয়ে গেলো - লোডশেডিং আর আমাকে একা থাকতে দিলো না। কল্পনার প্রেমিকার মুখ বুকে পোস্টার করে, ভালবাসার সাগরে ভেসে গিয়ে, আবেগে দু'চোখ বুজে আমিও কূঁই কূঁই করে তাঁর সাথে গলা মিলিয়ে উঠলাম: “তুমিই, শু-ধু তুমি...” - এমন সময়ে হঠাৎই জ্বলে উঠলো ঘরের টিউবলাইট, আর তার সাথে সাথে দেখলাম আমার পিতৃদেব গম্ভীর চালে ঘরে প্রবেশ করছেন, কঠিন মতো একটা মুখ নিয়ে। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো - প্রেমরস মুহুর্তেই হাওয়া চৈত্রের খাঁ-খাঁ দুপুরে। হাত থেকে বই গেলো পড়ে অসাড়ে। কি করি, কি করি, ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত স্কুলের ইংলিশ-গ্রাম্যার টিচার, শ্যামলবাবুর ময়রা-মুখ আর তাঁর স্নেহময়ী কানমলার রেওয়াজি স্বাদ মনে এনে, সঙ্গে সঙ্গে সুরের হেরফের ঘটিয়ে করুণ মুখে গুনগুনিয়ে উঠলাম: “তোমায় আমায় মিলে, এমনি বহে ধারা... তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা...” - পিতৃদেব কিছুক্ষণমাত্র সময় নিলেন ব্যাপারটা কি ঘটে চলেছে তা অনুধাবনে। তার পর “উঁহুমমম” শব্দের একটা বিকট গলা-খাঁকারি দিয়ে ঘরের খোলা জানালাটা বন্ধ করতে এগিয়ে গেলেন। মুহুর্তেই নিজেকে যেন মনে হলো একটা 'মুষিক' মাত্র !! - “যাক বাব্বা ! আলো এসে গেছে, বাঁচা গেছে - যাই এবার পড়তে বসি গিয়ে...” বলে আমি হন্তদন্ত করে উঠে পড়লাম...



Friday, October 3, 2014

"দিন যাক এই ভরসায়, কথা দাও আবার আসবে 
এমনি করেই ভালোবাসবে..."



এক একটা পুজো যায়, আর জীবনের আয়ু থেকে এক কটা বছর সাদা মেঘের মেলায় ভাসতে ভাসতে অনন্তে মিশে যায়। আমাদের মাথার চুলে পাক ধরে, দাঁতের গোড়া নড়ে ওঠে, কপালে আরেকটা নতুন রেখা যোগ হয়। চোখের চশমার কাঁচ বদল হয়, কারো বা পরচুলা ঝোলে মশারির পাশে পেরেকে। মহালয়ার শেষ রাতে শুরু হয়ে যায় 'স্মৃতি তুমি বেদনা' - তারপর বিসর্জনের  গঙ্গায় দেবী প্রতিমার সঙ্গে ভাসান হয়ে যায় জীবনের আরেকটা দায়সারা বছর, অসফল তিনশো পঁয়ষট্টিটা দিন। 

পুজো এলো এবং চলে গেলো, যেমন চিরকাল আসে যায়। ঝড়ের মতো আসে, তার চেয়েও দ্রুত বেগে চলে যায়। নবমী নিশি বড়ো দ্রুত অতিক্রান্ত হয়। অনেকদিন আগে এক আধুনিক কবি লিখেছিলেন ---
বোধনের ঢুলি বাজাবেই শেষেবিসর্জনের বাজনা
থাক থাক সে তো আজ না, 
              সে তো আজ নয়, আজ না...
দেবী বিসর্জন...
কিন্তু থাক থাক করে কিছুই কি ধরে রাখা যায়? ঢাকের শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যায়। শুন্য মন্ডপে সঙ্গীহীন ক্ষীণ প্রদীপশিখা স্মরণ করিয়ে দেয় গতদিনের উৎসব রজনীর কথা। বাতাসে আরেকটু হিমেল ভাব, শরতের শেষ শেফালী ঝরে পড়ে অনাদরে ধুলোভরা রাস্তায়। পুরানো গৃহস্থ বাড়ির ছাদের শিখরে জ্বলে ওঠে কোন সনাতন পৃথিবীর অমল আকাশ প্রদীপ...

স্মৃতি, তুমি বেদনা
এক বিদেশী কবরখানায় কোন এক সমাধিলকে লেখা দেখেছিলাম: "I know this will happen, but it is too quick to think" -- প্রত্যেকবার পুজোর পরে ওই সমাধিফলকের কথা আমার মনে পড়ে যায় - জানতাম আরেকটা পুজো ফুরিয়ে যাবে, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সেটা ভাবিনি। তবুও দিন আসে, দিন যায় - বিষন্ন মনটাকে সোজা করে নিই আগামী বছরের পুজার প্রত্যাশায়। আবার শুরু হয় অপেক্ষার পালা, নতুন এক উদ্যমে। পুজোর পর যথারীতি যেমন ছিলাম দ্রুত তেমন অবস্থায় প্রত্যাবর্তন। কোনো প্রভেদ হয়না, শুধু দিন আরেকটু ছোট, রাত আরেকটু ঠান্ডা - কলকাতার জীবনের তার একটু নিচুতে বাঁধা ....