Sunday, June 22, 2014

আকাশ ঢাকা দৈত্য গাছেদের দল (যত্তোসব)...

Ancient Giant Sequoia Trees - Nature's ever-growing wonders...
...
.....
অতি ধীর কচ্ছপের গতিতে চলতে চলতে আমরা শেষমেষ সিকোয়া ন্যশনাল পার্কের ঢোকার মুখের কাছাকাছি চলে আসলাম। সামনে গাড়িদের বিশাল লম্বা লাইন। লং উইকেন্ড বলে যেন সারা ক্যালিফোর্নিয়ার লোকজন এখানে চলে এসেছে - আধ মাইল স্পিডে গাড়ি এগুচ্ছে। মাথার উপরে ঝকঝকে, ঘন নীল আকাশ - দেখেই মনে হয় ফটোশপড - নাহলে এতো নীল হয় কি করে? আমাদের পাশে পাশেই চলেছে হালকা জঙ্গুলে জায়গা। আমাদের ঠিক সামনের একটা কনভার্টিবলে এক ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী (সম্ভবত:) খুব করুণ মুখ করে বসে আছেন। গাড়ির নেমপ্লেটে লেখা: 'KANCHWA' - দেখেই আমার 'কানচা রে কানচা রে, প্যার মেরা সাচ্চা, রুক যা না-যা দিল তোড়কে...' বলে গান গাওয়ার বেজায় ইচ্ছা হতে লাগলো। একটু পরে সামনের সেই দুঃখী মানুষদ্বয় বিরক্ত হয়ে গাড়ির ছাদটা লাগিয়ে দিলো! অবশেষে গেটের কাছে এসে আমরা পার্কে ঢোকার টিকিট কিনে নিলাম। এক্কেবারে দুর্গম জায়গা - কোনো মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, খাবার দোকানপত্র কিচ্ছু নেই, গার্বেজ-বিন প্রায় চোখেই পড়ে না - কিন্তু পার্কিং লট আর স্যানিটারী টয়লেট ঠিক বানিয়ে রেখেছে। রেস্টরুমখানা আবার কাঠের লগের সুদৃশ্য বাড়ির মতো দেখতে। ভুলে করে আমি আবার সেটার খান কয়েক ছবি তুলে নিলাম!! যাই হোক এবার সিকোয়া ন্যশনাল পার্কের মধ্যে দিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো আমাদের - ধীরে সুস্থে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাড়ি জমালাম। ধীরে সুস্থে কথাটা অবশ্যি ঠিক নয় - বেশ আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ - জিকজ্যাক মোচড় - 90 ডিগ্রী নয়, একেবারে 180 ডিগ্রীর মোচড়। এক মোচড় দিয়ে গাড়ি সোজা করতে না করতেই আরেকটা এসে হাজির হয়। রাস্তার পাশে রেলিং-ফেলিং বলে কিছু নেই। মাঝে মাঝেই পাশে খাড়া খাদ - সেইখানে আবার এক্সট্রা খাতির হিসেবে বিশাল থামের মতো ইয়া লম্বা লম্বা সিকোয়া গাছ। এর মধ্যে আরেক জ্বালা হলো, উপরে উঠছি বলে কান বন্ধ হয়ে শ্রবণশক্তি লোপ পেতে চলেছে। রাস্তার আশে পাশে 60 ডিগ্রীতে খাড়া খাড়া পর্বতের ঢাল উঠে গেছে। সেই ঢালগুলোতে আবার 30 ডিগ্রী কোণে অগুন্তি সিকোয়া আর পাইন গাছ। পথের মাঝে মাঝে এক একটা পর্বত সামনা-সামনি অ্যাতো কাছে চলে আসছে যে বুক ধ্বক করে ওঠে।

থাকি একটা মেগা-সিটিতে - অর্ধেক জীবন কাটিয়ে দিয়েছি উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর মনুমেন্ট দেখে। কলকাতায় সাউথ সিটির পঁয়ত্রিশতলা বিল্ডিং-এর টংয়ে উঠেছি। শিকাগোর সীয়ার্স টাওয়ারে চড়েছি - টরন্টোর সিএন টাওয়ারেও ওঠা হয়েছে। কিন্তু এরকম বিশাল কিছু আমি বাস্তবে কেন, স্বপ্নেতেও কখনো দেখিনি। দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে, উচ্চতা, গভীরতায়, অপ্রতিসমতায়, কোনভাবেই কোন কিছুর সাথেই আমি এই গাছগুলোর তুলনা করতে পারছিলাম না। এরা অ্যাতোটাই উঁচু, আর বিশাল যে সরাসরি উপরের দিকে না তাকালে আকাশ আর দেখা যায় না। চিন্তার অতীত কোন প্রাচীনকালে এই দৈত্য-সমাকৃতি গাছেদের সৃষ্টি হয়েছিলো - আরও অনিদির্ষ্ট কাল থাকার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এরা দাঁড়িয়ে আছেই তো আছে। দেখলেই কেমন জানি নিজেকে খুব ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, আর নশ্বর বলে মনে হয়। ছোটবেলায় গাছের মাথায় বাড়ি বানিয়ে থাকার খুব শখ হতো - আমাদের বাগানের বড়ো আমগাছটায় উঠে, তার দুই বিশাল কান্ডের জয়েন্টে গ্যাট্টুস হয়ে বসে থাকতাম। কিন্তু আজ এই সব বিশাল বিশাল গাছ দেখে হঠাৎ করে মন বলে উঠলো, 'বাপধন, সে শখের দরকার তোর আর নেই...'

Tuesday, June 10, 2014

আবার একটা বিশ্বকাপ এসে গেলো !!

1982 সালের বিশ্বকাপ - পড়ি তখন ক্লাস থ্রী, কি ফোরে। কোথায় বিশ্বকাপ হচ্ছে তা জানি না, জানার দরকারও ঠিক মনে আসেনি, কারণ কলকাতার মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের থেকে ফাটাফাটি খেলা, জগতে আর কোথাও
হতে পারে, এই বিশ্বাস তখনও জন্ম নেয় নি। ছোটদার মুখে একদিন শুনলাম 'জিকো' বলে নাকি ব্রাজিলের এক দূর্ধর্ষ প্লেয়ার আছে, যাকে অনেকে 'সাদা পেলে' বলে ডাকে। এই কথাটা শুনে নড়েচড়ে বসলাম। কারণ ব্রাজিলের নাম একটু আধটু শুনলেও, 'পেলে' আমাদের প্রায় ঘরের, আদরের ছেলে - বিশেষ করে তার গায়ের রং 'কালো' বলে, তাকে যেন আরও বেশী করে ভালো লাগে। আমাদের তখন টিভি কেনার মতো সামর্থ্য আসেনি। শুধু টিভি কেন, মাঠে গিয়ে সত্যিকারের চামড়ার ফুটবলে খেলার মতো পয়সাও পাড়ার ক্লাবটার ছিলো না। বাড়ি থেকে মাঝে মধ্যে দু-একটা সস্তা, প্লাস্টিকের ছোটো ছোটো বল কিনে দিতো - তাই নিয়েই খুব খেলতাম - মাঝে-সাঝে বাতাবি লেবুও দিব্যি ফুটবলের কাজ করে দিতো !! বাড়িতে সব দাদাই কম-বেশী ফুটবল খেলতে ভালোবাসতো। ছোটদা বললো, 'চল, আমার এক বন্ধুর বাড়িতে টিভি আছে - সেখানে তোকে নিয়ে যাবো - ব্রাজিল আর রাশিয়ার (সোভিয়েত ইউনিয়ন) খেলা দেখতে পাবি...' - শুনেই এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। 'সাদা পেলে'-কে দেখার সুযোগ কি কেউ ছাড়ে !! মনে মনে ঠিক করে নিলাম যে আমি রাশিয়া, অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নকেই সাপোর্ট করবো। কারণ বাড়িতে তখন 'মিশা' আর 'সোভিয়েত দেশ' নামে দুটো রাশিয়ান ম্যাগাজিন আসে, খোদ মস্কো থেকে পোস্টাল সার্ভিসে। সেই সব বইয়ের (বাংলায় অনুবাদ করাগল্পগুলো পড়তে মন্দ লাগেনা - তার থেকেও বড়ো কথা ওই সব বইয়ের পাতার কোয়ালিটি খুব ভালো। বই-খাতার 'মলাট' দিতে আর বিশেষ করে কালীপূজার সময় 'ছুঁচো বাজি'-র খোল তৈরী করতে সেগুলো খুব কাজে আসে!! তাছাড়া জ্ঞান হওয়া থেকেই শুনে আসছি, অ্যামেরিকা মানেই 'নোংরা, অসভ্য, লোচ্চা - শয়তানের দেশ, ক্যাপিটালিস্ট কান্ট্রি' - অন্যদিকে 'রাশিয়া' মানেই 'মার্ক্সবাদ', অর্থাৎ স্বর্গ। এমন কি রাশিয়ানদের 'হাগু-পাদু'ও নাকি বেশ সুস্বাদু!!

তো, সেই রাতে ছোটদার সাথে সাইকেলে করে গেলাম তার সেই বড়লোকি বন্ধুর বাড়ি - গিয়ে দেখি চারিদিক সব কেমন যেন চুপচাপ, শুনশান। আস্তে করে ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখি, আরে ব্বাপ - এ তো জন-সমুদ্র !! ঘরভর্তি একগাদা লোক - কচি-কাচা থেকে ইয়ং থেকে বুড়ো, যে যেখানে পেরেছে বসে গেছে। খেলা তখন অলরেডি শুরু হয়ে গেছে - সবাই হাঁ-করে সাদা-কালো ছোট্ট একটা টিভির পটলের মতো স্ক্রিনটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আমরা যে ঘরে ঢুকেছি তা কেউ ভ্রূক্ষেপই করলো না। কোনোমতে মেঝেতে গুঁজে-সুজে থেবড়ে বসে পড়ে আমিও খেলা দেখতে লাগলাম - কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মুখও literally হাঁ-হয়ে গেলো !! এ কি দেখছি - এ তো ভাই ফুটবল খেলা নয় - এটা একটা আর্ট !! ব্রাজিলের প্রত্যেকটা প্লেয়ার যেন পায়েতে আঠা লাগিয়ে নেমেছে - বল যেন তাদের পা-থেকে বিপক্ষের প্লেয়ারদের কাছে যেতেই চায় না !! অন্যদিকে একই অবস্থা রাশিয়ান গোলকিপারটারও, সেও হাতে যেন আঠা মেখে নেমেছে (পরে তার নাম জেনেছিলাম 'দাসায়েভ') - সে ব্যাটা কিছুতেই গোলে বল ঢুকতে দেবে না !! মাছির মতো উড়ে উড়ে, ড্রাইভ মেরে মেরে ব্রাজিলের যাবতীয় শট আটকে দিচ্ছে। রাশিয়াও মাঝে মাঝেই বেশ ভালো আক্রমণ করছে - একটা পেনাল্টি পেতে গিয়েও পেলো না - এসময় হঠাৎই, দুম করে ব্রাজিলিয়ান গোলকিপার এক হাস্যকর গোল খেয়ে বসলো। ফার্স্ট হাফ শেষে খেলার স্কোর লাইন দাঁড়ালো: রাশিয়া 1, ব্রাজিল 0 - মনটা খারাপ খারাপ লাগছে - কেন তা জানিনা। আমার পছন্দের টিম জিতছে, কিন্তু তবুও ব্রাজিলের জন্যে একটা অদ্ভুত চিনচিনে, মন খারাপ ভাব শুরু হয়ে গেছে - এটাকেই কি বলে ভালোবাসা?

10 মিনিট বাদেই শুরু হলো সেকেন্ড হাফ - বাপরে বাপ, আক্রমন কাকে বলে তা এবারে স্বচক্ষে দেখলাম। জিকো, সক্রেটিস আর ফ্যালকাও-দের একের পর এক আক্রমণে রাশিয়া একেবারে নাজেহাল হয়ে, কোনঠাসা হয়ে পড়লো। শেষ পর্যন্ত পর পর দুটো অসাধারণ গোল দিয়ে ব্রাজিল ম্যাচটা ঠিক বার করে নিলো। ব্রাজিলের দ্বিতীয় গোলটার সময় আমিও যে কেমন উর্দ্ধবাহু হয়ে, তারস্বরে 'গো-ও-ও-ল' বলে চিল্লাতে শুরু করেছি, সেটা দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। 

এর পরে বহুবার নানান বিশ্বকাপে, নানান দেশের খেলা দেখেছি - মারাদোনা, রোসি, গুলিট, জিদান, লিনেকার, বেকহ্যাম, রোনাল্দিনহো, কাকা, ইত্যাদি থেকে হালফিলের ইনিয়েস্তা, রুনি, মেসি, রোনাল্ডো, নেইমার... বহু গোলকিপারও দেখেছি। কিন্তু ব্রাজিল-রাশিয়া ম্যাচের সেই আক্রমনাত্মক টিম গেম, আর রুশ গোলকিপার, 'দাসায়েভের' সেই সব অবিশাস্য গোল-বাঁচানো, এখনো ভুলতে পারিনি। দেখি, এবারের বিশ্বকাপ আমার সেই আক্ষেপ ঘোচাতে পারে কি না...

YouTube Video:  Brazil v USSR (June 14th, 1982 ) <= Click to watch

Thursday, June 5, 2014

একশো টাকার প্রজেক্ট

আর কিছু না চাই, যেন আকাশখানা পাই,
        আর একটা পালিয়ে যাওয়ার মাঠ...

আমাদের ছোটোবেলায় চারিদিকে ছিলো ধূ-ধূ প্রান্তর, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ আর মাঠ। একগাদা খেলার মাঠ তো ছিলোই, এছাড়াও বাড়ির কিছুটা দূরেই ছিল আদিগন্ত ধানক্ষেত, আর আগুনরাঙা ফুলে ভরা কৃষ্ণচূড়া, শিমূল গাছেদের সারি। এক একসময় মনে হতো বিরাট মাঠ-সমুদ্রের মধ্যে কয়েকটা ছোটো ছোটো বাড়ি-ঘর মাথা তুলে কোনোমতে বেঁচে আছে!! গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়া সূর্য্যের আলো গায়ে মাখতে মাখতে বিকেলগুলোতে মাঝে মাঝেই আমি বন্ধুদের সাথে হেঁটে হেঁটে, সবাই মিলে অনেক দূরে চলে যেতাম। একবার একটা সুন্দর মাঠ খুঁজে বার করেছিলাম, অনেকটা সেই রূপকথার গল্পে থাকা 'তেপান্তরের মাঠ'-টার মতোই। মাঠের মাঝে সটান চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে, উপরে থাকা অসীম ঘন নীল সেই আকাশের দিকে চেয়ে মন কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠতো। ভাবতাম কোথাও কোনো ভিন নক্ষত্রের গ্রহমন্ডলীতে হয়তো আছে প্রাণ, হয়তো আছে আমাদের মতনই বুদ্ধি-জ্ঞান সম্পন্ন কোনো জীব, যাদের কেউ কেউ হয়তো আমার মতনই এমনি করে কল্পনা করছে যে এই মহাবিশ্বে ওরা নিঃসঙ্গ কিনা। 

বয়সের সাথে সাথে মানুষের চিন্তা-ভাবনা, চাহিদা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা-নেশা, সব কিছুই বদলে যায়। সেই সুদূর ছোটোবেলায় কেবলই ভাবতাম আর একটু বড়ো হলেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। পালিয়ে যাওয়া ঠিক নয় - নিছক রোমাঞ্চের আশায় বাড়ি ছেড়ে, মাঠ-ঘাট পেরিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো। বাড়িতে শাসন থাকলেও, সেটা এমন কিছু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে ছিলো না।  কিন্তু অতিরিক্ত অ্যাডভেঞ্চার গল্প ও কমিকস বই পড়ার দৌলতে সব সময়ই মনে হতো বাড়ি ছাড়তে না-পারলে এ-জীবনে কিছুই করা হবে না। বাইরের জগৎ মানেই অনেক, অনেক মজা আর স্বাধীনতা - নিয়মের তেমন কোনো বেড়াজাল নেই। কিংবা হয়তো আরও অন্য কিছু ভাবতাম, আজ সেইসব আর মনে পড়েনা, শুধু মনে পড়ে মাঠ ছাড়িয়ে বেড়িয়ে পড়ার সেই অলীক হাতছানিকে। ছোট্ট মাথায় অনেক চিন্তা করে ঠিক করলাম যে মোটামুটি 'একশো' টাকা হলেই বেরিয়ে পড়া যায়।  একশো টাকা ছিলো তখনকার দিনে একটা বিশাল ব্যাপার - কারণ সে'সময় জিনিপত্রের দাম ছিলো অনেক কম। বিশ পয়সাতেই মিলতো পাঁউরুটি - সিঙারার দাম ছিল দশ পয়সা। মাত্র দুই টাকাতেই বাক্সভর্তি সন্দেশ কেনা যেতো। বাবার সাথে বাজার করতে করতে বেঁচে থাকার জন্যে নূন্যতম জিনিষপত্রগুলোর দাম সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা গড়ে উঠেছিলো। কোথায় থাকবো, বা কি কাজ করে টাকা রোজগার করবো, সেই সব নিয়েও অনেক প্ল্যান করা হয়েছিলো, তবে তার বেশিরভাগটাই এখন আর মনে পড়েনা !! এইরকম করেই সে পরিকল্পনার নানান ফাইন টিউনিং-এর মধ্যে দিয়ে আমার দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো। এমন সময়ে ঘটলো সেই উত্তেজনার ঘটনাটি - যা আমি করবো করবো করেও করে উঠতে পারিনি, সেটাই করে দেখালো আমার এক পিসতুতো দাদা। ক্লাস নাইনে ওঠার পরীক্ষায় পরপর দু'বার ফেল করে, নিজেদের আলমারী থেকে বেশ কিছু টাকা-পয়সা হাতিয়ে, সে বাড়ি ছেড়ে বেমালুম হাওয়া হয়ে গেলো। বাড়ির বড়োদের কপালে চিন্তার ভাঁজের সাথে সাথে আমার মনে আশার আলো বেশ জোরালো হয়ে উঠলো - অ্যাতোদিনে একটা সত্যিকারের রোল মডেল পাওয়া গেছে !! দিন তিন-চার কেটে গেলো - কিন্তু তার পরে ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস হয়ে উঠলো - পুলিশে ফরম্যালী জানানো উচিত হবে কিনা এই নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়ে গেলো। ওদিকে তার মা কেঁদে কেঁদে একেবারে প্রায় পাগল-প্রায় হয়ে উঠলেন। 

তখনকার দিনে মোবাইল ফোন জন্ম নেয়নি - ল্যান্ড ফোনও কারোর বাড়িতে ছিলো না। চিঠি, আর খুব দরকার পড়লে টেলিগ্রাম, এই দুটোই ছিলো যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু মানুষের নিজেদের মধ্যে ভালোবাসার নেটওয়ার্ক ছিলো অনেক জোরদার আর রিলায়েবল। লোকজন একে-অপরের বিপদে স্বেচ্ছায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতো। সেরকমই কে-একজন এক বিকেলে এসে জানালো  যে সেই পিসতুতো দাদাকে নাকি আলিপুরের দিকে কোথায় যেন দেখা গেছে। আবার শুরু হলো নতুন করে খানা-তল্লাশ, জিজ্ঞাসাবাদ। এইবারে সেই দাদার আরেক ক্লোজড ফ্রেন্ডের কাছ থেকে মিললো সম্ভাব্য এক ঠিকানা। পরের দিন সকালেই আমার বাবা সহ বেশ আরো কয়েকজন পাড়ি দিলো সেই অ্যাড্রেস নিয়ে। এর পরের ঘটনাগুলো অনেকটা গতানুগতিক ও হতাশের। বন্ধুর বন্ধু, তস্য বন্ধুর বাড়ি থেকে উবড়ে আনা হলো আমার সেই পিসতুতো দাদাকে। 'চল বাবা - চল বাবা, বাড়ি চল এবার' ইত্যাদি নানান ভালো ভালো কথা বলে তাকে ফিরিয়ে আনা হলো বাড়িতে।  আর ফিরে আসার পরপরেই শুরু হলো তার বাবার বেদম প্রহার - সোজা ভাষায় যাকে বলে 'রাম প্যাঁদানি' - সঙ্গে থাকা অন্যান্যেরা সময়মতো হস্তক্ষেপ না-করলে হয়তো থানা-পুলিশই করতে হতো সে'দিন!! মার খাবার পর তার সেই হতদরিদ্র, ভাঙাচোরা চেহারার খবর শুনে আমার নিজের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হলো - বাড়ি-ছাড়ার প্ল্যানের কিছু রদ-বদল করতে হলো। অত:পর সেই পরিকল্পনাকে ব্যাক-লটে ফেলে রেখে, দূরের সেই মাঠটার ওপারে একটা দো'তলা খাবারের দোকান চালু করার নতুন প্রোজেক্ট শুরু হলো, সঙ্গে জুটে গেলো আমার মতোই স্বপ্নবিলাসী আরেক বন্ধু - মূলধন সেই একশো টাকাই !  কিন্তু সে পরিকল্পনাও খুব বেশী দিন টিকলো না - কারণ খাবারের সম্ভাব্য মেনু নিয়ে আমার ও সেই হবু পার্টনারের মধ্যে ঘোরতর মতবিরোধ দেখা দিলো। এইভাবে নানাবিধ একশো-টাকার পরিকল্পনার স্রোতে ভেসে চললাম আমি - কিন্তু নিষিদ্ধ সেই ফল আর আমার নাগালে এলো না। ধীরে ধীরে কেমন করেই না-জানি মনের নানান পরতের পর পরতের তলায় চাপা পড়ে গেলো 'বাড়ি ছেড়ে হারিয়ে যাবার' সেই অদম্য বাসনা। কঠোর বাস্তবের নাগপাশ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো আমায়। ডাঁয়ে-বাঁয়ে অজস্র লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে সময় যেন কোথা দিয়েই হুশশ করে কেটে গেলো। স্মৃতির সেই পরত পরত লেয়ারগুলো আজ সরিয়ে দেখি পালিয়ে যাবার সেই মাঠখানা এখনও খুঁজে চলেছি আমি...