Wednesday, March 26, 2014

মন যতোদূর চাইছে যেতে ঠিক ততোদূর আমার দেশ...


এই ভোরবেলা অবধিও মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে চলেছিলো - সেই বৃষ্টিতে গাছপালা, লতাপাতা, পাখির গা', আর ঘরের চাল ধুয়ে-মুছে সব চকচক করে উঠেছে। বিকেলের বৃষ্টি যেমন মন-খারাপের বার্তা নিয়ে আসে, তেমনি সকালের বৃষ্টি বুকভরা এক নাম-না-জানা আনন্দ বয়ে আনে। বৃষ্টির জলে স্নান করে জবা, কুমড়ো ফুল আর ধানের সবুজ পাতাগুলো, সোনালী রোদে চিকচিকে হাসি খেলছে। মৃদুমন্দ বাতাসে ঋষি-মুনিদের মত ধানের শিসগুলো এদিক-ওদিক মাথা দুলিয়ে চলেছে। ভারতের এই অংশটি পূর্ব সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। আধুনিকতার ছোঁয়া মানুষের পায়ে পায়ে চলে আসলেও জীবন চলার পথে তার ছাপ এখনো সুস্পষ্ট নয়। তাই সোঁদা মাটির ঘ্রাণ এখনও এখানে পাওয়া যায় - সুনীল আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শান্তির নি:শ্বাস নেওয়া যায় - ইলশে-গুঁড়ি বৃষ্টিতে প্রকৃতির ভালবাসাকে বুকে আপন করে টেনে নেওয়া যায়। কুটনৈতিক টানাপোড়ন, রাজনীতির বিভীষিকা কিংবা ধর্মীয় বিভেদ এখনো এখানকার মানুষে-মানুষে বিভেদ জোগাতে পারেনি। জীবন চলে এখানে শান্ত, নির্বিকার ভঙ্গীতে - এক নিজস্ব ছন্দে...



ফরচুন কুকি

লাঞ্চে গিয়েছিলাম খেতে Milpitas-এর এক পপুলার চাইনীজ রেঁস্তরাতে, 'Chili Palace'-এ। শুক্রবারের দুপুরে মারাত্মক ভীড় - টিম লাঞ্চ বলে একসাথে বড়ো টেবিল পাওয়াও বেশ মুস্কিল। প্রায় আধঘন্টা দাঁড়ানোর পর মিললো আমাদের খাবার জায়গা - দুটো টেবিল জোড়া লাগিয়ে একসাথে বসার ব্যবস্থা হলো। চুটিয়ে খাওয়া-দাওয়ার পর এলো সেই মজার মুহূর্তটি - অর্থাৎ 'ফরচুন কুকি' ভাঙার পালা। টিম লাঞ্চে নব্য চালু করা ত্যাঁদড়ামো-রীতি অনুযায়ী আমাদের প্রত্যেককে তাদের ফরচুন কুকি ভেঙ্গে, সেটার মধ্যে থাকা কাগজে কি মেসেজ লেখা আছে তা জোরে জোরে পড়তে হবে। সব থেকে হাস্যকর এবং অভিনব মেসেজ যে পাবে, তার খাবারের দামের শেয়ার, অন্যেরা শেয়ার করে নেবে !! ভোটাভুটিতে সবথেকে মজার মেসেজটিকে নির্বাচন করা হবে - এবং এক্ষেত্রে আমাদের ম্যানেজার, 'শ্রীনিবাসন'-এর ভুমিকা পালন করার গুরুদায়িত্বটি নেবেন। আমার ভাগ্যে যথারীতি সে রকম ভালো কিছু কখনো হয় না - এবারেও হলো না। কিন্তু আমার ফরচুন কুকি-র মেসেজটা পড়ে আমার নিজেরই বেশ মজা লাগলো - 'Must talk to a forgotten friend to get invaluable advise that may change course of your life...' -এরকম intrigued ধরণের একখানা মেসেজ। এমনিতে অবশ্য আমার বন্ধুদের সংখ্যা খুব বেশী নয় - তার উপরে মুখচোরা বলে অনেকেই আমাকে আন-সোশ্যাল এবং কম-জ্ঞানী বলে সম্মান দিয়ে থাকে। তাই সেরকম ভাবে ধরতে গেলে আমার প্রায় টু-থার্ড বন্ধুরাই দিব্যি চলে আসবে 'ফরগটন' লিস্টে !! কিন্তু ফরচুন কুকি বলে কথা - তাছাড়া জীবনের এই মধ্য পর্যায়ে এসে মাগনা অ্যাডভাইসে জীবনের কোর্স বদলানো মুখের কথা নয়। লোকে কতো পয়সা খরচ করে, লাইফ চেঞ্জের উদ্দেশ্যে shrink-এর কাছে যায় - আর আমি তো প্রায় ফ্রী-তেই বদলানোর সুযোগ পেয়ে যাচ্ছি !! তাই অফিসে ফিরেই ডেস্কে বসে একদম পুরানো দিনের ইমেলগুলোতে চোখ বোলাতে লাগলাম। কোন মহাজ্ঞানী যেন বলে গিয়েছিলেন, “যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন...” - তো, কে বলতে পারে, আজই হয়তো আমার সেই 'হারানো রতন' পাবার দিন !! বিস্তর চিন্তা-ভাবনার পর অবশেষে সিলেক্ট করলাম প্রবাস জীবনের শুরুতেই সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়া এক বিচ্ছু ক্লাসমেটের নাম! একসময় সবার পিছনে লেগে লেগে সে আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিলো - কিন্তু গানের গলাটি ছিলো তার বেশ ভালো। ওই একটা কারণেই তার যাবতীয় বাঁদরামো কিছুটা মুখ বুজে সহ্য করে এসেছিলাম। গলায়-গলায় বন্ধুত্ব না-হলেও, মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য একটা রিলেশান কেমন করে না-জানি গড়ে উঠেছিলো। শেষ কথাবার্তা হয়েছিলো প্রায় বছর-বারো আগে - অর্থাৎ এক যুগ পেরিয়ে গেছে আমাদের নিশ্চুপতার পালা !!

ফেসবুক-এ সার্চ করে তার পাত্তা যোগাড় করতে খুব বেশী সময় লাগলো না - ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট-এর জবাব পেতে লাগলো আরো ঘন্টা দুয়েক !! তার মিনিট দশেকের মধ্যে আমার সেল ফোনে পিড়িং পিড়িং টোনে ভেসে এলো তার গা-জ্বলানো কন্ঠস্বর: “কি রে হতচ্ছাড়া, বেঁচে আছিস এখনো?” - এরপর চললো অনর্গল, অবান্তর, লাগামহীন কথাবার্তা - অনেকটা আনাড়ি চাইনিজদের পিং-পং খেলার ঢংয়েই !! স্কুল-জীবন হয়ে কলেজ জীবন, বান্ধবী থেকে বৌ, ইন্ডিয়ান রাজনীতি ঘুরে ক্রিকেট, শ্রীনিবাসন থেকে সাউথ সিটি, ছেলে-পিলে, বাবা-মা, সুগার-কোলেস্টেরল - আরো যত্তসব হাবিজাবি কথার পর হঠাৎই খেয়াল হলো: আরে!! সে ব্যাটা কোথায় থাকে আর কি কাজ করে, সেই দরকারী কথাটাই তো জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি !! তাই প্রশ্ন করলাম, “এখন কোথায় আছিস আর কি কাজ করছিস ?” - তার দেওয়া উত্তরে প্রায় ২২০ ভোল্টেজের কারেন্ট শক খেয়ে চমকে উঠলাম - জানলাম গত দেড়বছর ধরে সে আর আমি একই কোম্পানিতে কাজ করে চলেছি - ITতেই !!! সে এখন আছে অ্যামেরিকার-ই East Coast-এর দিকে - কিন্তু যে অ্যান্ড্রয়েড-প্রজেক্টে সে কাজ করছে তার সব কিছুই কন্ট্রোল হয় এখান থেকে - অর্থাৎআমার ফ্লোরের অন্যদিকে থাকা এক প্রজেক্ট টিমের দ্বারা !! সুতরাং রেসিডেন্সিয়াল ডিস্ট্যানসটুকু বাদ দিলে সে আর আমি এক ফ্লোরেই কাজ করে যাচ্ছি। সে আছে ফোর্থ ফ্লোরের নর্থ-এর দিকে, আর আমি সাউথের দিকে - লে হালুয়া !!! TGIF (Thank God It Was Friday)....


Friday, March 21, 2014

পরবেশ আলী...

নারিকেল-সুপারি-কাঁঠাল-জামরুল গাছে ঘেরা এক ঘন বাগান ছিলো আমাদের একসময়। আমার ছোটবেলার প্রচুর সময় কেটে গেছিলো সেই বাগানে, বেশিরভাগ সময়ই একা-একা খেলতে। বাগানের গাছের ডাব-সুপারি-ডাঁটা-কাঁঠাল-ইত্যাদি পাড়া, পাতা-কাটা, জঞ্জাল সাফ করা থেকে যাবতীয় কাজ করে দিতো 'পরবেশ আলী' নামে এক বিশ্বাসী মুসলমান। আসতো সে লক্ষীকান্তপুরের এক অজ পাড়া-গাঁ থেকে - আমরা ডাকতাম তাকে 'পরবেশদা' বলে। মা ঠাট্টা করে বলতেন, ও হলো গিয়ে 'শুনে-মোল্লা' - অর্থাৎ দেশভাগের পরে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার সময়ে ওকে জোর করে, প্রাণের হুমকি দিয়ে মুসলমান হতে বাধ্য করা হয়েছিলো। বাড়ির যে-কোন অনুষ্ঠান বা পরিশ্রমের কাজে পরবেশদা এক কথায় রাজি হয়ে যেতো। কোনো মজুরি তাকে সাধারনত: দেওয়া হতো না, বিনিময়ে সে কিছুটা কমদামে গাছের ডাব-নারকেল-সুপারি আমাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে, বাজারে বেশী দামে বিক্রি করতো - এটাই যা ছিলো তার লাভ। শীতকালের দিকে বাগানের কোন উঁচু  গাছে ঘুড়ি আটকে পড়লে, আমি ভোর-সকালে ঘুম থেকে উঠে পরবেশদার আসার জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম - কখন সে এসে, গাছে চড়ে সেই ঘুড়িটা আমায় নামিয়ে দেবে !! লম্বা যে-কোন নারকেল গাছের একেবারে মাথায় উঠে যেতে তার লাগতো দু' থেকে তিন মিনিট - কিন্তু সেই দু-তিন মিনিট সময়ই যেন মনে হতো কয়েক ঘন্টা !! নিচে দাঁড়িয়ে থেকে, মাথা সোজা উপরের দিকে তুলে আমি কড়া নজর রেখে চলতাম যে ঘুড়িটার কোন ক্ষতি যেন সে না-করে ফেলে - কিন্তু তার নিজের কষ্টের কথা কখনো মাথাতেই আসে নি। একবার সে পাড়ার অন্য এক লোকের বাগানের নারকেল গাছ থেকে নামতে গিয়ে, গাছের প্রায় মাঝমাঝি থেকে পা-স্লিপ করে, সোজা নীচে পড়ে গিয়ে বেশ ভালোমতো জখম হয়ে যায় !! আমাদের বাড়ি থেকেই তার সুশ্রুষার সব খরচ দেওয়া হয়। অস্বাভাবিক প্রাণশক্তির কল্যাণে সে মাস খানেকের মধ্যেই আবার সুস্থ হয়ে ওঠে। 

আজ আমাদের সেই বাগান ও গাছপালা তাদের জীবনের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে - পরবেশ আলীরও অনেক বয়স হযে গেছে। আগের মতো অতো দ্রুত সে গাছে চড়তে পারে না। অনিয়মিত হলেও, সে তবু আসে আমাদের বাড়িতে - বাগানের খুচ-খাচ কাজ করে দিয়ে যায়, আগের মতোই যত্ন করে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের বাগান, গাছপালা, আর বাবা-মাকে, আমাদের চেয়েও সে  চিরটাকালই অনেক, অনেক বেশি ভালবেসেছিলো...

Saturday, March 8, 2014

আমজনতা


'আমজনতা' শব্দটার অর্থ প্রায় সবারই জানা - কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কথাটার উৎপত্তি হলো কি করে। অনেকেই বলবে উর্দুতে 'আম' মানে হলো গিয়ে 'সাধারণ' - কিন্তু উর্দুতেই বা 'আম' কথাটা এলো কি করে? আমগাছের 'আম' থেকে? যদি তাই হয়, তা'হলে আম কি একসময় এতোটাই সস্তা আর সুলভ ছিলো যে জনসাধারণ সবাই-ই আম খেতে পেতো? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় - অন্তত: ইদানিং যে হারে স্বাদু আমের প্রতুলতা কমছে। সে যাই হোক এতোকাল ধরে আমি নিজেকে ঐ 'আমজনতা' হিসাবেই গণ্য করে এসেছি - কারণ আমাদের জ্ঞাতি-গুষ্ঠির মধ্যে চেনা-জানা কারোরই কোনও রকমের পলিটিক্যাল পাওয়ার তো দূরের কথা, পলিটিকসের সাথে চেনা-জানা কারোর আলাপ পর্যন্ত নেই। এমনকি পুলিশ, ল-ইয়ার, পঞ্চায়েত-নেতা, পার্টিবাজ, বোমাবাজ, নিদেনপক্ষে গুন্ডা বা চাঁদাবাজ কারোর সাথে কোন জানা-শোনা নেই। সুতরাং আমি 'আমজনতা' হবো না তো, কি 'ইয়ে' হবো ?

কবিগুরু বলে গিয়েছিলেন “আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না” - খুবই খাঁটি কথা। বছরখানেক আগে শীতের ছুটিতে দেশে গিয়েছি। এখান থেকে নিয়ে যাওয়া আমার মোবাইল সেটটিকে এক বই-কাগজ-বিক্রীওয়ালা ভালোবেসে 'নিজের মনে' করে নিয়ে চলে গেছে। অত:পর দেশী এক চায়না-মোবাইল সেট কিনে কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু চাইনিজরা বোধহয় তেমন জল-টল খায় না। এক দুপুরে জামাকাপড় কাচার সময় বালতির জলের মধ্যে মাত্র একবার চোবানি খেয়েই প্যান্টের পকেটে বন্দী থাকা সেই চাইনিজ সেটটি যুগপৎ বোবা আর অন্ধ হয়ে গেলো। কি আর করা ! মোড়ের কাছের মোবাইল ফোনের বুথটাতে গেলাম। আগে এই ছোট্ট দোকানটা শুধুমাত্র STD/ISD-র ব্যবসা করেই লালে-লাল হয়ে উঠেছিলো। বামফ্রন্ট জমানার মতোই সে সুখের দিন আর নেই - মুঠো-ফোন আসার পর ইদানিং সে-ব্যবসায় বেশ কিছুটা ভাঁটা পড়ে গেছে। এখন বেচারাকে ফোন কার্ড বিক্রির সাথে সাথে জেরক্স-এর কাজ করে দিন গুজরান করতে হচ্ছে। আমি আমার সেই মৃত সেটটা দোকানদারকে দেখালাম। দোকানদার অভিজ্ঞ এক ডাক্তারের মতোই উল্টে-পাল্টে, বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেটটাকে দেখে গম্ভীর মুখে রায় দিলো, 'আপনার মোবাইলটা ফ্ল্যাশ করাতে হবে' - আমি গোবেচারার মতো পাশের টুলটায় বসে পড়লাম। যস্মিন দেশে যদাচার.... বসে আছি তো আছিই। ডাক্তারসাহেব মোবাইলটাকে তার কম্পুটারের সাথে লাগিয়ে দিয়ে আমাকে ছাইপাঁশ কি সব দেখিয়ে চললো। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেনে গেলাম যে এ দোকানে মোবাইল সার্ভিসিং-এর পাশাপাশি মোবাইলে গান ভরেও দেওয়া হয়, 'ফেলো কড়ি মাখো তেল' পন্থায়। কিছুক্ষণ পরপর নিরীহগোছের মানুষেরা মোবাইল ফোন নিয়ে আসছে - আর ফোনের মেমরি কার্ড ভর্তি করে গান নিয়ে যাচ্ছে। 'কপিরাইট' বলে কোনো কিছু এরা বাপের জন্মে শুনেছে বলে মনে হয় না। বুঝলাম ট্রেনে কিংবা বাসের ভীড়ের মধ্যে তারা তাদের আদরের চায়না-সেটগুলোতে অত্যন্ত মমতা নিয়ে এইসব গানগুলো বিকট স্বরে চালিয়ে, আশেপাশের সবাইকে গান-পাগল করে তুলে, নিজেরা উদাস হয়ে যাবে। আমি ধৈর্য্য ধরে বসেই আছি আমার মোবাইলটার চিকিৎসা হওয়ার অপেক্ষায়। এ সময় আমার পিছন থেকে এক বয়স্ক লোক এসে তার ফোনের মেমরি কার্ডটা দোকানদারকে দিয়ে বললেন, 'কিছু ভালো গান ভরে দ্যান তো...' - তার গলা শুনে আর মুখ দেখে আমার কিছুটা চেনাচেনা লাগলো। যতদূর মনে পরে সে একসময় হাত দেখা, ঘটকালির সাথে সাথে পার্ট-টাইম পূজারী গোছের কিছু কাজ করে বেড়াতো। দোকানদার জিজ্ঞেস করলো, 'এখনকার গান দেবো, না কি পুরানো দিনের'? তো সে জবাব দিলো, 'দাও কিছু মান্না-হেমন্ত, কিছু দ্বিজেন্দ্রগীতি, নজরুল-বাউল, লোকগীতি, সব মিলিয়ে মিশিয়ে' - শুনে মনে হলো গান নয়, যেন মশলা-মুড়ি বা পাপড়ি-চাটের অর্ডার দেওয়া হচ্ছে !! কিন্তু তবুও মনে মনে তার তারিফ না-করে পারলাম না। এ ঘোর অরাজকতার যুগে হিন্দী লারেলাপ্পা, রক বা so called জীবনমুখী গান ছেড়ে নজরুল-দ্বিজেন্দ্রলালের গান, বা বাউল গান শোনার মতো লোক স্বচক্ষে দেখতে পাওয়া মুখের কথা নয়। ফোনে গান গোঁজা শেষ হলে দোকানদার লোকটার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকালো, যদি আরও কিছু ব্যবসা বাড়ানো যায় আর কি - বললো: 'এটাতে অনেকটা জায়গা খালি আছে - আর কিছু দেবো কি ?' - এবার সেই লোকটা আমার দিকে একটু আড়চোখে তাকিয়ে, কিছুটা চাপা স্বরে ফিসফিসিয়ে বললো, 'দ্যান, কিছু বাংলা-এক্স ভিডিও-গান ঢুকিয়ে দ্যান...' - দমকা কাশির মতোই আমার হঠাৎ ভীষণ হাসি এসে গেলো। অনেক কষ্টে নিঃশ্বাস চেপে, মুখটাকে শক্ত করে আমি বসে রইলাম। কিছুই যেন শুনতে পাইনি এমন ভঙ্গিতে উল্টো দিকে তাকিয়ে রইলাম - লোকটার দিকে তাকালে হয়তো সে লজ্জা পাবে। এবারও দ্রুত গান-গোঁজা শেষ করে দোকানদার বললো, 'এখনও কিছু জায়গা খালি আছে, আর কি দেবো তাড়াতাড়ি বলুন...' - লোকটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলো, 'ভাটিয়ালি কিছু আছে কি ?' - দোকানদার এবার না-সূচক মাথা নাড়লো - অর্থাৎ ভাটিয়ালি গান তার গান-গুদামে নেই। লোকটার আচরণে আমি এবার একই সঙ্গে আশ্চর্য এবং দুঃখিত হলাম। হঠাৎ করে আমার মনে হলো এরাই হচ্ছে আমাদের দেশের আসল 'আমজনতা' - যাদের কাছে 'খচ্চর-গাধা-ঘোড়া-ময়ূর-বুনিপ', সবারই এক দাম। এরা 'সোনার কেল্লা' দেখেও আনন্দ পায়, আবার 'মিশর রহস্য' দেখেও হাততালি দেয় !! তবে দোকানদারটাই বা কেমন ধরণের মানুষ !! খারাপ জিনিস রাখে, এটা নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ করার অধিকার আমার নেই - তাহলে 'ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে' - তা-বলে তুই হতচ্ছাড়া দু'চারটে ভালো জিনিষও রাখবি না !! “এ তুমি কেমন তুমি - অ্যা:?” - ইচ্ছা করছিলো ব্যাটার পশ্চাৎদেশে কষে একটা লাথি মারি। কিন্তু 'টেকনিক্যাল ডিফিকাল্টির' জন্যে সেটা করা গেলো না - কারণ দোকানদারের স্বাস্থ্য আমার চেয়ে অনেক ভালো !! 

রিয়ালাইজেশান: 'আমজনতা'-র ক্ষমতা খুবই কম - তাই ইচ্ছা থাকলেও বেশিরভাগ সময়ই কোনও উপায় থাকে না।

Saturday, March 1, 2014

ঘটনার ঘনঘটা...

আমার অফিসে কর্মরত ইন্ডিয়ানদের মধ্যে মূলত: দু'ধরণের গ্রুপ আছে - একদল, যারা বেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ - খালি স্টক, শেয়ার, সেকেন্ড মর্টগেজ, রথ আই-আরে, অ্যামেরিকান বেসবল/সকার, ট্যাক্স, ফান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ইত্যাদি নিয়ে কপচাতে থাকে আর সংখ্যালঘু আরেকদল বেশ আলটপকা জিনিষ নিয়ে কথা বলে, at least লাঞ্চ টাইমে খেতে বসে। আমি সাধারনত: ওই সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রুপটিকে সযত্নে এড়িয়ে চলে অন্য গ্রুপটির সাথে বসে লাঞ্চ সেরে নিই, যদিও ভালো করেই জানি যে তাদের কাছ থেকে জীবনযাপনের উপযোগী কোনো কার্যকরী টিপস বা সাজেশন আশা করা একেবারেই অবান্তর। এই যেমন আগের দিন কে-একজন যেন প্রশ্ন করলো যে ব্রেনের কোন অংশটা ঠিক করে, যে আজ বাড়ি ফিরে কি খাবো, বা এই উইকেন্ডে কোন সিনেমা দেখবো, ইত্যাদি। এটা একেবারেই বাচ্চাদের প্রশ্ন - এই প্রশ্নের উত্তর আমি একসময় খুব ভালো করেই জানতাম। কিশোর বয়সে এই ধরণের মামুলি নিউরোসায়েন্স প্রশ্নের উত্তর লেখার সময় আমি ব্রেনের ছবি এঁকে সঠিক Lobe-টা হাইলাইট করে দিতাম - কিন্তু কোন এক দূর্বোধ্য কারণে আজ সেই উত্তরটা একদমই  মনে করতে পারলাম না। কিছুপরে আরেকজন কে বলে উঠলো যে premonition-এর কোনো রিয়েল এক্সপেরিয়েন্স কারোর কখনো হয়েছে কি না। এই প্রশ্নটা শুনতেই মাথায় চড়াক করে, যাকে বলে একেবারে স্পার্ক খেলে গেলো। এরকম ঘটনা আমার জীবনে গোটা কয়েকবার ঘটেছে - যাকে বলে হান্ড্রেড পার্সেন্ট premonition না হলেও, অন্তত: ৮৫% তো বলা যেতে পারে!! হঠাই মনে হলো অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে - তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে, ডেস্কে ফিরে এসে কিছুটা উদ্দেশ্যবিহীন ভাবেই premonition নিয়ে গুগল-সার্চ করে চললাম। Premonition কথাটার মানে জানলেও সেটা কেন জানিনা আমার সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে কখনো এক করে ভেবে দেখিনি। তবে আমার সে অভিজ্ঞতার কথা এখানে বললে কিছুটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে - নিজের জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত কথাবার্তা সবসময় চেঁচামিচি বা পাগলের প্রলাপ হয়ে দাঁড়ায়, বাকি সবাইয়ের কাছে। তাই একটা সিমিলার ঘটনার আড়ালে সেটা বলার চেষ্টা করা হলো এখানে। এই ঘটনা বর্ণনায় দরকার একজন নায়িকা, তার নায়ক, আর আরেকজন থার্ড-পারসন-সিঙ্গুলার নাম্বার। ইচ্ছা করেই এই তিনজনের কোনো নামকরণ করা হলো না - তার দরকারও নেই। এই তিনজনকে স্রেফ 'নায়ক', 'নায়িকা' আর 'লোক' হিসাবেই রেফার করা হলো। 
The part of the brain that controls discernment is the frontal lobe or the prefrontal cortex
......... আজ তার জন্মদিন - ঘুম থেকে উঠেই খুশিতে নায়িকা ডগমগ হয়ে উঠলো, কারণ একটু পরেই তারা শপিং করতে বার হবে - একটা দামি কোন জুয়েলারী কেনার উদ্দেশ্যে, সেটাই হবে তার অফিশিয়াল বার্থ-ডে প্রেজেন্ট। হাতের কাজগুলো সব ঝটপট সেরে নিয়ে, স্নান-টান সেরে, সেজেগুজে তারা দুজনে বেরিয়ে পড়লো কাছের শপিং কমপ্লেক্সটার দিকে। কেনাকাটি শেষ হলে, কোনো ভালো একটা রেঁস্তোরায় লাঞ্চ সেরে নিয়ে তারা একটা কোন নতুন মুভি দেখতে যাবে - আপাতত: এইই হলো তাদের প্ল্যান। উইকেন্ডের বাজারে দোকানগুলোতে মোটামুটি ভালোই ভীড় হয়েছে - বিশেষ করে ফ্যাশন রিলেটেড দোকানগুলোতে। শপিং কমপ্লেক্সে ঢুকে নায়িকাকে তার নিজের পছন্দমতো দোকানগুলোতে ইচ্ছামতো ঘুরতে দিয়ে নায়ক সামান্য কিছু ডিসট্যানস রেখে চলতে থাকলো। ইদানিং তার এজাতীয় দোকানগুলোর প্রতি অজানা এক বিরক্তি জমতে শুরু করে দিয়েছে, কিন্তু আজকের এই বিশেষ দিনে সে-সব কিছু মাথায় না-আনাই ভালো। অবশেষে এক পপুলার দোকানে বেশ কিছুক্ষণ ধরে অনেকগুলো আইটেম নাড়াচাড়া করার পর কয়েকটা অর্নামেন্ট নায়িকার হিটলিস্টে ঢুকে পড়লো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এগুলোর কয়েকটার দাম একেবারেই কম - কারণ সেগুলো দেখতে ভালো হলেও, কোন আসল স্টোন বা নামী-দামী মেটালের নয়। আবার বাকিগুলোর দাম তাদের বাজেটের থেকে বেশ কিছুটা বেশি !! সুতরাং কি করা যায় তা ভাবতে ভাবতেই হঠা করে তার সেই সিক্সথ সেন্সের অস্বস্তির ভাবটা আবার প্রকট হয়ে উঠলো। ঘাড় ঘোরাতেই নায়িকা সেই লোকটিকে” দেখতে পেলো - খুবই সাধারণ, অনুজ্বল পোশাকপরা প্রায় মাঝবয়সী এক লোক, চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পিঠে বোধহয় একটা ব্যাকপ্যাক - দু'পকেটে দু'হাত ঢুকিয়ে, তার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ভাবলেশহীন মুখে এদিকেই চেয়ে আছে - তাকিয়ে আছে ঠিক তার দিকে নয়, বরং তার পছ্ন্দ করা সেই জিনিষগুলোর দিকে। আচমকাই নায়িকার এ দোকানটা আর তেমন ভালো লাগলো না, অন্য দোকানের দিকে পা বাড়ালো সে। বেশ কিছুক্ষণ এ-দোকান, সে-দোকান ঘুরে ঘুরে চললো সে। এখন তার দৃষ্টি শুধু জুয়েলারীর দিকেই সীমাবদ্ধ নয় - আড়ালে আড়ালে সে লক্ষ্য রেখে চলেছে যে লোকটা কি তাকে সত্যিই ফলো করছে - না কি সবই তার মনের ভ্রান্ত কোনো ধারণা। কিন্তু তার আশঙ্কা একেবারেই অমূলক নয় - বাস্তবিকই সে লোকটাকে ঠিক খুঁজে পেয়ে যাচ্ছে - হয় পাশের দিকে, নয় কিছুটা পিছনে, অ্যাঙ্গেল করে 'সেই হতচ্ছাড়া' মোটামুটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে - যদিও কখনই সে তার চোখে চোখ রাখছেনা। এবার নায়িকা ঠিক করলো আচমকাই সে কমপ্লেক্স থেকে বার হয়ে গিয়ে অন্য কোন দোকানে ঢুকে পড়বে। সেই মতো কাছের এক্সিটটা আসতেই সে এসকালেটারে উঠে পড়লো - এবারে পিছনে তাকিয়ে ধারে কাছে কোথাও সে লোকটাকে দেখতে পেলো না। স্বস্তির একটা নি:শ্বাস ফেলে শপিং কমপ্লেক্সটা থেকে বার হয়ে রাস্তায় পড়তেই আচমকা সে লক্ষ্য করলো যে রাস্তার অন্য ফুটপাথ দিয়ে, প্রায় তাদের সমান্তরাল ভাবেই সেই লোকটি হেঁটে চলেছে - তবে তার দৃষ্টি সোজা সামনের দিকে। হঠা করেই মনের মধ্যে যেন একরাশ বিরক্তি দলা বাঁধতে শুরু করলো, আর তার সাথে জমতে থাকলো এক অজানা রাগ। বেশ কিছুটা হেঁটে, ঝট করে ডাইনে বেঁকে নায়িকা একটা দামী জুয়েলারী দোকানের দরজা খুলে তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়লো। এই দোকানটি বাস্তবিকই উচ্চবিত্তদের জন্যে - জিনিষপত্তের কোয়ালিটির সাথে সেগুলোর দামও বেশ চোখে পড়ার মতোই !! কিন্তু নায়িকার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা জেদ ঢুকে গেছে। এই কেনাকাটির ঝামেলা সেরে তাকে দ্রুত এই চত্ত্বরটা থেকে বার হতে হবে। একটা ডার্ক গ্রীন কালারের এমারেল্ডের সেট তার খুব পছন্দ হয়ে গেলো। যদিও এই সেটটার দাম তাদের অরিজিনাল বাজেটের প্রায় দেড় গুনেরও বেশি, কিন্তু তার মাথায় এখন ঝোঁক চেপে গেছে - এটাকেই-ই সে আজ কিনবে। এবার তার মনে হতে লাগলো যে একদিক দিয়ে হয়তো ভালোই হয়েছে, কারণ সেই লোকটি না থাকলে তারা হয়তো এই দোকানে ভুলেও আসতো না - আর এই সেটটা এককথায় অসাধারণ লাগছে তার কাছে - দাম হয়তো একটু বেশি, কিন্তু সত্যিই কি দারুণ বেশি? এমন জিনিষ সে আর কোথাও আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারলো না। ঝট করে যেমন তার মনে একরাশ বিরক্তি এসে গিয়েছিলো, ঠিক তেমনি করেই আবার খুশির চোরাগোপ্তা প্যাঁচে মনটা ক্রমশ: ভালো হয়ে উঠতে লাগলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার নায়কটি অবশ্য এসব কিছুই জানতে পারলো না, পারার কথাও অবশ্যি তার ছিলোনা - তার মনের মধ্যে কেবল একটাই প্রশ্ন ঘুরে চলেছে, 'আর ক'টা দোকান আমরা ঘুরে ঘুরে চলবো'!! দাম দরাদরির প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে পড়েছে তারা - হঠাৎই এসময় শো-কেসের স্বচ্ছ গ্লাসের রিফ্লেকশানে নায়িকা পরিস্কার দেখতে পেলো যে তাদের ঠিক অন্যপাশেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সেই লোকটি - আর তার দৃষ্টি এবারেও তার পছন্দ করা সেই সেটটার দিকেই। আর চুপ করে সে থাকতে পারলোনা - মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছে এবার। সে সরাসরি লোকটার দিকে ঘুরে, প্রচন্ড জোরে চেঁচিয়ে উঠলো: কি পেয়েছেন কি আপনি? এভাবে আমাকে ফলো করে চলেছেন কেন? পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নায়কটি অবাক হয়ে গেলো, কিন্তু সে যথাযথ নায়কোচিত ভাবেই হাতের জামা গুটিয়ে, মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে এগিয়ে গেল লোকটার দিকে - যদিও সে লোকটির কোনো দোষ খুঁজে পেলো না। নিতান্ত গোবেচারার মতোই লোকটি ভ্যাবলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার নায়িকার সামনে। তো-তো করে সে কিছু বলে ওঠার চেষ্টা করলো - কিন্তু তার সে'কথায় কোন ভ্রুক্ষেপ না দিয়ে, প্রচন্ড রাগে জ্বলতে জ্বলতে নায়িকা তার নায়ককে জোর করে টেনে নিয়ে দোকান থেকে বার হয়ে পড়লো। চুলোয় যাক কেনাকাটা, আজকের দিনটাই খুব বাজে !! আর কোথাও না-গিয়ে সোজা বাড়ির দিকে ফিরে চললো তারা। বাড়িতে ফিরে এসে ফোনের মেসেজবক্সের দিকে চোখ পড়তেই নায়িকা দেখলো বিপ-বিপ করে লাল আলো জ্বলে চলেছে সেখানে - একটি নয়, তিন তিনটি মেসেজ জমা হয়ে আছে ওটাতে। প্লে-বাটন চাপতেই ফোনের যান্ত্রিক কন্ঠ বলে চললো, নায়িকার বাড়ির খবর ভালো নয় - তার বাবাকে হসপিটালাইজড করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি - হৃদপিন্ড আর ঠিকঠাক কাজ করছে না - অপারেশানের প্রয়োজন এক্ষুনিই - কিন্তু খরচের অন্তত: ৮০% টাকা একসাথে জমা না-দিলে ভালো কোনখানে অ্যাডমিশন করানো যাবেনা - তাই চাই টাকা, বেশ কিছু টাকা, অবিলম্বেই।    

হঠাৎই নায়িকা বিহ্বল হয়ে পড়লো - আজকের এই জন্মদিন, হাসি-আনন্দ, জুয়েলারী কেনা, তাকে ফলো-করে চলা সেই লোকটি - এ সবকিছুই এখন খুব অর্থহীন হয়ে উঠলো। শুকনো গলায় নায়ক এ সময় বলে উঠলো, একদিক দিয়ে জুয়েলারী না-কিনে ভালোই হয়েছে। ওই টাকাটাই বরং ওয়ার-ট্রান্সফার করে দেওয়া যাক এখন - কিনলেই বরং আবার ফেরত দেবার ঝামেলায় পড়তে হতো। এ কথায় সম্বিৎ ফিরতেই নায়িকার মনে সহসা সন্দেহ দেখা দিলো, তাহলে কি সেই লোকটি.... সেই লোকটিই কি আগে থেকে এসবের কিছু জানতো... এ জন্যেই সে কি তাকে ফলো করে চলছিলো? এই সব ভাবনার মাঝেই হঠা 'ডিং-ডং' সুরে দরজার কলিংবেলটা বেজে উঠলো। দরজা খুলতেই তারা আরও অবাক - সেই লোকটাই বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঘরে ঢুকতে দেওয়া আদৌ ঠিক হবে কিনা, তা স্থির করার মাঝেই লোকটি বলে উঠলো: ম্যাডামের রাগ কি এখন কমেছে একটু ? - এরপরও তাকে ঘরের ভিতরে আসতে না-বললে খুব খারাপ দেখায়। অত:পর কুন্ঠিত পদক্ষেপে ঘরে ঢুকে, জড়োড়ো ভাবে সোফার এক কোনে বসে পড়ে লোকটি - জানায় যে নায়িকাকে সে আসলেই ফলো করে চলছিলো, যাতে কোনো জুয়েলারী না-কেনা হয়ে ওঠে। কিন্তু 'কেন', এ প্রশ্নের কোনো সঠিক জবাব সে দিতে পারে না - কেবল বলে, যে কিছু মুষ্ঠিমেয় প্রিয়জনদের আগাম কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনার খবর সে পেয়ে যায় কোনও ভাবে, আগে থেকেই। নায়িকা চমকে গিয়ে বলে সে তো জীবনে লোকটিকে আগে কোথাও দেখেনি - ঘনিষ্ঠতা তো দূরের কথা, তাহলে? লোকটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে: ঠিকই, আমরা কেউ কাউকে চিনি না - কিন্তু আপনার মুখের সাথে আমার প্রেমিকার মুখের প্রচুর মিল ছিলো। এবার আরও কৌতুহল বেড়ে ওঠে তাদের - 'ছিলো' মানে? তো, সেই প্রেমিকার নাম কি, আর কোথায়ই বা আছে সে এখন। কিন্তু সে-সব প্রশ্নের উত্তরে লোকটি চুপচাপ, মুখ নীচু করে বসে থাকে। অত:পর যেন অনেক কষ্ট হচ্ছে, এরকম যন্ত্রনাকাতর ভাবে মুখ তুলে সে ধীর কন্ঠে বলে ওঠে যে তার সেই প্রেমিকা 'আরো ভালো' কাউকে খুঁজে নিয়ে চলে গেছে - কোথায় গেছে জানা নেই, কিন্তু তার নিজের premonition আজও ঠিকই কাজ করে চলেছে - এমন কি মুখের মিল থাকা সম্পূর্ন আলাদা কোনো মানুষের সম্পর্কেও... ~~~~ ঘটনার ঘনঘটায় তারা তিনজনেই হতবাক হয়ে গেলো। কেবল ঘরের দেওয়ালে ঝোলা ঘড়ির পেন্ডুলামটা টিকটিক শব্দে বেসুরো আওয়াজ করে দুলে যেতে লাগলো।       

   
মাস খানেক পরের ঘটনা: 
নায়িকার বাবা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেছেন - সময়মতো এবং সঠিক অস্ত্রপচারের দৌলতে ঈশ্বর তাঁকে আপাতত আরও কিছুকাল বাঁচার অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন। নায়িকা ঈশ্বরের সাথে সাথে সেই অজানা লোকটিকেও মনে মনে অজস্র ধন্যবাদ দিয়ে চলে, আজও। দূর্ভাগ্যবশত: লোকটার নাম জানা হয়ে ওঠেনি সে'দিন - প্রয়োজনই বোধ করেনি তারা কেউই - তাই সে এখন কোথায় আছে, তা একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারেন।