Sunday, January 19, 2014

হলুদ গাঁদার ফুল দে এনে দে...

পূজা বাঙালীর জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ - বাঙালী thrives on পূজা। বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগে থাকলেও আমাদের ছোটবেলাকার সময়ে 'পূজা' বলতে মোটামুটি তিনটে পূজাকেই ধরা হতো। প্রথম obviously দেবী দূর্গা - অর্থাৎ দূর্গাপূজা - যা কিনা বাঙালী ঐতিহ্য আর জাঁকজমকের প্রতীক। তাঁরই হাত ধরে ধরে চলে আসতেন শক্তিময়ী কালীঠাকুর, যে পূজা ছিলো মূলত: আতসবাজি আর আলোর রোশনাইয়ের যুগল সম্মেলন।  এরই মাস তিন-চার পরে আসতো সরস্বতী পূজা - যা ছিলো এককথায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের, এবং বিদ্যার্থীদের একান্ত আপনার পূজা। লক্ষ্মী, জগদ্ধাত্রী বা বিশ্বকর্মা পূজোগুলোকে ঠিক সেই অর্থে পূজা বলে মনে হতো না। অবশ্য এসবই সেকালের কথা। আজকাল অবশ্য যে কোন পূজা এলেই সর্বপ্রথম  ডোনেশন, শব্দ-হুঙ্কার, মদ-মারামারি আর দূর্ধর্ষ জ্যামের কথাই মনে চলে আসে - ভক্তি আর তেমন ঠিক আসেনা।
আমাদের বাড়ির ছাদ 
দূর্গাপূজায় মনে ভক্তির থেকে বরং শ্রদ্ধা আর সম্ভ্রমের ভাবই বেশি করে জাগতো - সেটার পিছনে অবশ্য শ্রদ্ধেয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ মহাশয়ের রোমাঞ্চকর, মন্দ্র-মুগ্ধ কন্ঠে মহালয়ের ভোরের স্ত্রোত্র-পাঠের একটা জোরালো ভুমিকা থাকতো। কালীপুজায় লক্ষ্য থাকতো কখন তৈরী-করা ছুঁচো-তুবড়ি গুলোকে, বা বাজার থেকে কিনে আনা আতসবাজি গুলোকে একের পর এক ফাটাবো, বা কিভাবে বাড়িটাকে টুনি বাল্বের আলো দিয়ে সাজাবো, এইসব। কিন্তু সরস্বতী পূজায় মনের নির্বিচল ভক্তি আর প্রার্থণা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতো। কি করে, বা কারা যেন যেন মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো যে সরস্বতী ঠাকুরকে ভক্তি না-জানালে পরীক্ষায় কখনোই ভালো কিছু করতে পারবো না - তা সে যে পরীক্ষাই হোক না কেন! সেই ভয় থেকেই মনে হয় চলে আসতো ভক্তি - আর তারই হাত ধরে ধরে কখন চলে এসেছিলো ভালোবাসা। সন্ধ্যার দিকে  বাবা অফিস থেকে ফিরলেই তাঁর হাত ধরে ট্রেনে চেপে উঠে পড়তাম কলকাতার দিকে। কখনো ঢাকুরিয়া, কখনো বালিগঞ্জ, কি শিয়ালদহের নানান রাস্তা ধরে ঘুরে ঘুরে, সারি-সারি ঠাকুরের মধ্যে থেকে আমাদের পকেটের পূজার বাজেট স্ট্রেচ করতে করতে, ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে সেরা ঠাকুরটি বেছে নিতাম। তারপর তাঁকে ঘাড়ে করে নিয়ে, ট্রেনের ভীড়ের হাত থেকে সযত্নে আগলে রেখে, নানান পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে বাড়ি পৌঁছাতাম। প্রায় মধ্যরাতে বাড়ি ফিরে মা-পিসিমার শাঁক বাজানোর শব্দে হঠাৎই খেয়ালে আসতো যে কি ভীষণ ক্ষিদে পেয়ে গেছে!! 

বাবা এর কয়েকদিন আগে থেকে, বাজার থেকে কিনে যোগাড় করে রাখতেন চাঁদমালা, শোলার কারুকাজ করা ঠাকুরকে সাজানোর নানান ধরনের জিনিষ, যাবতীয় পুজাসামগ্রী, আর কিনে আনতেন রং-বেরঙের পাতলা পাতলা ঘুড়ির কাগজ - লাল-নীল-হলুদ-বেগুনী-সবুজ-সাদা-কমলা। রাত জেগে জেগে সেগুলো কাঁচি দিয়ে ট্র্যাঙ্গেল আকারে কেটে, থাক-থাক করে গুছিয়ে রাখা হতো। ঠাকুরের হাতে থাকা বীণার গায়ে কয়েকটা সাদা মোটা সুতো আলপিন দিয়ে সযত্নে বেঁধে দেওয়া হতো, সেটার  'তার' হিসাবে। পূজার দিন ভোরসকালে উঠে, ঘাড়ে করে কাঠের মই নিয়ে, বাড়ির ছাদে গিয়ে হাজির হতাম সেইসব রঙিন কাগজগুলোকে সঙ্গে করে - সাথে থাকতো একবাটি আঠা আর টুনদড়ির গোলা। বাড়ির ছাদের ঠাকুরঘরের মাথা থেকে ছাদের রেলিঙের নানান দিক পর্যন্ত টুনদড়ি টাঙিয়ে টাঙিয়ে সেই সব তিনকোণা কাগজগুলোকে, রঙের কম্বিনেশন বজায় একের পর এক আঠা দিয়ে লাগিয়ে চলতাম। শীতশেষের সকালের মৃদুমন্দ হাওয়ায় সেই রঙিন কাগজের দলেরা যেন হেসে হেসে কাঁপতে থাকতো। বাড়ির অন্যান্য সদস্যরাও এসময় ঠাকুর ঘর সাজানোর নানান কাজে লেগে যেতো - সে ছিল এক অদ্ভুত আনন্দ, উত্তেজনা আর ভালোলাগা সময়। এরই মাঝে নীচের তলা থেকে মায়ের হাঁক শোনা যেতো, "ওরে! ঠাকুর মশায় এসে গেছেন!" - তড়িঘড়ি করে স্নান করার জন্যে নিচে নেমে আসতাম।  ঠাকুরমশায় এই দিন থাকতেন মহাব্যস্ত - কিছুতেই একমুহূর্ত বেশি অপেক্ষা করতে চাইতেন না। শাঁক-কাঁসরঘন্টা বাজানোর মধ্য দিয়ে দাদা ঘাড়ে করে দেবীপ্রতিমাকে নিয়ে চলতেন নিচের তলা থেকে ছাদের ঠাকুরঘরের দিকে। ছোটদি বাড়ির টবে ফুটে থাকা গাঁদাফুল তুলে, মালা তৈরী করে ঠাকুরের গলায় দিয়ে দিতেন। বাজার থেকেও কিনে আনা হতো হালকা-হলুদ, গাড়-হলুদ, কমলা রঙের একগুচ্ছ গাঁদাফুলের মালা। সেই সমস্ত মালা পরে, চাঁদমালা হাতে নিয়ে সুসজ্জিত হয়ে, আমাদের ছোট্ট ঠাকুরঘর আলোয় ভরিয়ে দিয়ে বিরাজমান হতেন দেবী সরস্বতী। আমরা পুকুর থেকে চট করে একটা ডুব দিয়ে, বা কলঘরে ঢুকে  কোনোমতে এক বালতি জল মাথায় দিয়ে, গা-হাত মুছে, নতুন জামাকাপড় পরে ঠাকুরঘরের দিকে ছুটতাম, হাতে থাকতো বেশ কয়েকটা পড়ার বই - যার মধ্যে কেশবচন্দ্রের অঙ্কের বই, মাইতি-চৌধুরীর কেমিস্ট্রির বই, আর রেনে-মার্টিনের ইংরাজি গ্রামারের বই অবশ্যই থাকতো প্রাইম সদস্য হিসাবে। সেই বইগুলোকে দেবীর পায়ের কাছে সারি দিয়ে সাজিয়ে, হাত জড়ো করে বসে যেতাম ঠাকুর মশায়ের পাশে বা পিছনে - যে যেরকম পারে। মেঘমন্দ্র কন্ঠে ঠাকুরমশায় দেবী-স্ত্রোত্র পাঠ করে চলতেন। ধুপ-ধুনোর অপরূপ গন্ধে ভরা সেই  ঠাকুরঘরে বসে, একগাদা গাঁদাফুলের মালায় সুসজ্জিত সেই দেবী প্রতিমার প্রশান্তি-ভরা, অসম্ভব সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে বিভোর হয়ে যেতাম - অবাক মনে বিস্ময় জাগতো গতরাতের থেকেও আজ যেন তাঁকে আরো, আরও বেশী করে সুন্দর এবং প্রাণময়ী লাগছে !

অঞ্জলীর দেওয়ার পর  প্রণাম-প্রাথর্ণা শেষ করে আমরা ছাদ সাজানোর কাজকর্ম, যা-কিছু বাকি থাকতো, সব ঝটপট কমপ্লিট করে নীচে নেমে আসতাম। দিদিরা এর মধ্যে ঠাকুরঘরের কাজ গুছিয়ে প্রসাদ বিতরণ শুরু করে দিতেন। তার পর শুরু হতো বাড়ির দাওয়ায়, রোদ্দুরে মাদুর পেতে বসে, একসাথে খই-মুড়ি-কড়াইশুঁটি-নারকেল-শাঁকালু-মোয়া-নলেনগুড় সহযোগে নিরামিষ ব্রেকফাস্ট-কাম-লাঞ্চ - আর তার সাথে নির্ভেজাল আড্ডা, গল্পের বই পড়া - সময়ের কোনো হিসেবই থাকতো না। দূর-দূরান্তের পূজামন্ডপগুলো  থেকে ভেসে আসতো মাইকে বেজে চলা একের পর এক বাংলা গান - যার একটা আজ খুব করে মনে পড়ছে: রূপকুমারী মেয়ে মান করেছে - বাঁধবে না চুল, সে বাঁধবে না রে - হলুদ গাঁদার ফুল দে এনে দে...  

Wednesday, January 1, 2014

“পশ্চিম দিগন্তে তখন রঙের আগুন...”

Sunset while driving on I-5...
চলেছি I-5 হাইওয়ে দিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসের দিকে। মাত্র দুটো করে লেন - মোটামুটি বাঁশের মতো মসৃণ, স্ট্রেট রাস্তা মাইলের পর মাইল - চলেছি তো চলেছিই - পথ আর যেন ফুরায় না। এই I-5-এর দূর্নাম আছে ঘুমপাড়ানি হাইওয়ে বলে!! সামনের গাড়ীর পিছনে জ্বলে থাকা লাল আলোর দিকে একটানা চেয়ে থাকতে থাকতে ঝিম ধরে গিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, যার অবশ্যম্ভাবী ফল ক্লান্ত চোখে অজান্তেই ঘুম নেমে আসা। তাই ক্রমাগত বকবক করে কথা বলে বলে, এদিক-সেদিক তাকিয়ে, বা অযথাই লেন বদল করে করে চলতে হয়। এমনভাবেই চলেছি আমরা, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার উপক্রম করছে - হঠাৎই পাশের জানলার দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেলো - পশ্চিম দিগন্তে শুরু হয়েছে যেন রঙের আগুন-খেলা। 'ক্রিমসন' রঙ দিয়ে মহাকাল দিগন্তের অসীম ক্যানভাসে যা-তা শুরু করে দিয়েছেন। আর তারই ফলস্বরূপ পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরের সূর্য্য ঠিক যেন গলে গলে মিলিয়ে যাচ্ছে সেই দূরের দিগন্তরেখায়। অপূর্ব সে দৃশ্য... আবারও একবার মনে মনে বলে উঠলাম এক-পৃথিবী সৌন্দর্য দেখার জন্য, এক পৃথিবীর পথ চলার জন্য, এক জীবন বড়োই অল্প সময়।
Sunset while driving on I-5...
Sunset while driving on I-5...
স্কুলে আমাদের জীবনবিজ্ঞান বা বায়োলজীর টিচার ছিলেন মূলত দু'জন। দু'জনেই দারুণ পড়াতেন। ব্ল্যাকবোর্ডে চকের কয়েকটা মাত্র আঁচড়ে প্রায়-নিখুঁত ছবি এঁকে এঁকে আমাদের জীবনবিজ্ঞানের জটিলতা বোঝাতেন, আর আমরা হাঁ করে তা দেখতাম আর খাতায় সব নোট করে নিতাম। যতদুর মনে পড়ে ক্লাস এইটে ওঠার পর আমাদের এই সাবজেক্টের টিচার বদলে গিয়ে 'দিব্যেন্দুবাবু' ক্লাস নেওয়া শুরু করলেন। অনাড়ম্বর জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী সেই স্যারের জ্ঞানের বহর দেখে তাঁকেই রোল মডেল করে নিয়ে পরবর্তী জীবনে বায়োলজীর টিচার হবোই হবো বলে একপ্রকার দৃড়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলাম। একদিন ক্লাসের পড়ানোর ফাঁকে স্যার গল্পচ্ছলে বলে চলেছিলেন তাঁর জীবনের কিছু কথা - খুব ইচ্ছা ছিলো তাঁর এয়ার-পাইলট হবার। এক্সজামে পাস করে ইন্টারভিউতেও ভালো করেছিলেন। কিন্তু বাড়িতে তাঁর ঠাকুমার কনসিস্টেন্ট আপত্তি আর কান্নাকাটিতে তা আর হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত জীবনের দিশা বদলে এই 'স্কুল-টিচারী'-র কাজ তাঁকে শুরু করতে হয়। খানিকটা চাপা ক্ষোভ, বা হয়তো কিছুটা হতাশার আঁচ তাঁর সেদিনের কথার মধ্যে ফুটে উঠেছিলো। হঠাৎই স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা বলতো, সূর্যাস্তের ঠিক আগে পশ্চিম আকাশে যে রংটা হয়, তার নাম কি?” - আমরা তখন মুষ্টিমেয় কতকগুলো রঙের কথা জানি - মোটামুটি 'ভিবজিওর (বা বেনিআসহকলা)' অবধি আমাদের দৌড় ! সেই মতো আমরা কেউ কেউ 'রেড' বা 'গোল্ডেন' বলে উঠলাম। স্যার মুখে চু: চু: শব্দ করে হেসে উঠে বললেন, “যা:হ! তোদের কপালেও এয়ার-পাইলটের চাকরি লেখা নেই !!” - একটু থেমে তিনি বললেন, “ওই সময়ের রঙটাকে বলে 'ক্রিমসন'...” - তারপর ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে সেই ক্রিমসন word-টার spelling-টা লিখে দিলেন। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “স্যার, আপনি এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে পেরেছিলেন?” - ক্লাসের ঘন্টা পড়ে যাওয়ায় তিনি উঠে পড়েছিলেন, যেতে যেতে বললেন, না পারলে আর চাকরিটা পেলাম কি করে ! কিন্তু ঐযে বলে না, কপালে না থাকলে কি আর হয় কিছু !!

আজ এই পড়ন্ত বিকেলের, সেই ক্রিমসন রঙের আলোয় স্কুলের 'দিব্যেন্দুবাবু'-র কথা আরও একবার মনে পড়ে গেলো। আমার কপালেও বায়োলজীর টিচার হওয়ার কথা লেখা ছিলোনা নিশ্চয়ই!!